সভার মূল উদ্দেশ্য হলো খোলামেলা আলোচনা, নিজের মত চাপিয়ে দেওয়া নয়
সভার মূল উদ্দেশ্য হলো খোলামেলা আলোচনা, নিজের মত চাপিয়ে দেওয়া নয়

পরামর্শ সভায় বরকত আনার কৌশল

আমরা সাধারণত কোনো পরামর্শ সভাকে এমন এক স্থান হিসেবে দেখি, যেখানে কেবল তথ্য ও যুক্তির আদান-প্রদান ঘটে। কিন্তু এ সভাকে যদি আমরা ‘আত্মার মিলনের স্থান’ হিসেবে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করি, তবে কেমন হয়?

আমাদের পরামর্শ সভাগুলো কীভাবে নিজের ও প্রতিষ্ঠানের জন্য ‘বরকত’ (ঐশী কল্যাণ) বয়ে আনার মাধ্যম হতে পারে এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির সোপান হতে পারে, সে বিষয়ে আজ আলোচনা করব।

আত্মা যেন ব্যূহবদ্ধ সেনা দলের মতো

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আত্মাগুলো যেন সংগৃহীত সৈন্যর মতো। তাদের মধ্যে যারা একে অপরকে চিনতে পারে, তারা মিলেমিশে থাকে। আর যারা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পারে না, তারা বিচ্ছিন্ন থাকে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৬৩৮)

এ হাদিস বুঝতে হলে আমাদের জানতে হবে যে আমাদের আত্মার পথচলা পৃথিবীতে জন্মের মুহূর্ত থেকে শুরু হয়নি; বরং সব আত্মা সৃষ্টি হয়েছিল এক প্রাক্‌-অস্তিত্বের জগতে। সেই আদিম জগতে কিছু আত্মা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল, কিছু হয়নি। এ সংযোগই পৃথিবীতে প্রকাশ পায়।

আকল যদি আধ্যাত্মিকভাবে সুস্থ থাকে, তবে একজন ব্যক্তি কেবল দুনিয়াবি লাভ-ক্ষতি না ভেবে পরকালীন কল্যাণ ও দীর্ঘমেয়াদি ইতিবাচক প্রভাব বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন।

এ কারণেই হয়তো কোনো পরামর্শ সভায় এমন কারও সঙ্গে আপনি সহজে মিশে যেতে পারেন, যাকে আগে কখনো দেখেননি; আবার বিপরীতটাও ঘটে।

তবে মনে রাখতে হবে, এটি কোনো এড়ানোর সুযোগ নয়; বরং আমাদের আধ্যাত্মিকতার পরীক্ষা। যদি আমরা ‘ইহসানের’ (সর্বোত্তম আচরণ) সঙ্গে কাজ করতে শিখি, তবে তা পুরো দলের জন্যই কল্যাণকর হবে।

পরামর্শ সভায় আত্মার বিভিন্ন স্তর

ইসলামি মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে মানুষের অন্তরের কয়েকটি স্তর রয়েছে। একজন মানুষ যখন কোনো পরামর্শ সভায় যোগ দেন, তখন তিনি তাঁর এই বিভিন্ন স্তরগুলো নিয়েই উপস্থিত হন:

কলব (অন্তর): কলব সুস্থ থাকলে তা সভার আধ্যাত্মিক দিকটি উপলব্ধি করতে পারে। কিন্তু কলব যদি হিংসা বা অহংকারে আক্রান্ত হয়, তবে তা অফিসে নেতিবাচক রাজনীতি বা আচরণের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়।

আকল (বুদ্ধি): আকল যদি আধ্যাত্মিকভাবে সুস্থ থাকে, তবে একজন ব্যক্তি কেবল দুনিয়াবি লাভ-ক্ষতি না ভেবে পরকালীন কল্যাণ ও দীর্ঘমেয়াদি ইতিবাচক প্রভাব বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন।

নফস (প্রবৃত্তি): সভার সবচেয়ে ‘সক্রিয়’ অংশ হলো নফস। এটি লাগামহীন থাকলে মানুষকে একগুঁয়ে ও অহংকারী করে তোলে।

রুহ (আত্মা): এটি নফসের বিপরীত। আত্মার এ বিশুদ্ধ অংশটি আমাদের উচ্চতর উদ্দেশ্য ও ঐশী বাস্তবতার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে চায়।

দেহ: শরীর হলো আত্মার বাহন। পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও পুষ্টির মাধ্যমে আমরা যদি দেহের যত্ন নিই, তবে পরামর্শ সভায় আমরা অনেক সতেজভাবে উপস্থিত হতে পারি।

বরকত-সংস্কৃতির জন্য প্রয়োজনীয় কৌশল

অতিরিক্ত ব্যস্ততার পরিবর্তে ‘বরকত-সংস্কৃতি’ বা ঐশী কল্যাণময় পরিবেশ তৈরির করার দিকে মনোযোগ দেওয়া ভালো। এ সংস্কৃতি মূলত আল্লাহকেন্দ্রিক ও সুনির্দিষ্ট প্রভাব চালিত। আমাদের পরামর্শ সভায় বরকত যুক্ত করতে নিচের পদক্ষেপগুলো নেওয়া যেতে পারে:

সভার আগে করণীয়

  • উদ্দেশ্য ঠিক করা: সভা শুরুর আগে নিজের নিয়তকে আল্লাহর সন্তুষ্টির সঙ্গে যুক্ত করুন।

  • নামাজকে অগ্রাধিকার: নিশ্চিত করুন যেন সভার সময় নামাজের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়। সভার অজুহাতে নামাজ বিলম্বিত করা উচিত নয়।

  • পূর্ণ প্রস্তুতি: ভালোভাবে প্রস্তুতি নেওয়া অন্য সদস্যদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের একটি অংশ। আলোচ্যসূচি (এজেন্ডা) আগে থেকেই পাঠিয়ে দিন।

শয়তান যেন দলের সদস্যদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করতে না পারে, সেদিকে সতর্ক থাকুন। বিতর্ক বাড়লে ‘আউজুবিল্লাহ’ পড়ে নিজেকে শান্ত রাখুন।

সভা চলাকালে করণীয়

  • আধ্যাত্মিক পবিত্রতা: ওজু করে সভায় বসা ভালো। এতে শয়তানের প্রভাব কমবে। কাজ শুরু করার আগে সচেতনভাবে ‘বিসমিল্লাহ’ বলুন।

  • পরামর্শনীতি: সভার মূল উদ্দেশ্য হলো খোলামেলা আলোচনা, নিজের মত চাপিয়ে দেওয়া নয়। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আর কাজে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করুন...। (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৫৯)।

  • রাগ নিয়ন্ত্রণ: শয়তান যেন দলের সদস্যদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করতে না পারে, সেদিকে সতর্ক থাকুন। বিতর্ক বাড়লে ‘আউজুবিল্লাহ’ পড়ে নিজেকে শান্ত রাখুন।

  • মজলিশ শেষে: সভা শেষে নির্দিষ্ট দোয়াটি পাঠ করুন। এতে সভার যাবতীয় অনিচ্ছাকৃত ভুলত্রুটি ক্ষমা হয়ে যায়।

সভার পরে করণীয়

  • ইস্তেখারা ও কৃতজ্ঞতা: গৃহীত সিদ্ধান্তের কল্যাণের জন্য আল্লাহর কাছে সাহায্য চান। যাঁরা ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছেন, তাঁদের ধন্যবাদ জানান।

  • ক্ষমা চাওয়া: যদি সভায় কাউকে আঘাত দিয়ে থাকেন, তবে দেরি না করে ক্ষমা চেয়ে নিন।

  • সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন: পরামর্শের ভিত্তিতে নেওয়া সিদ্ধান্তের দায়িত্ব নিন। রাসুল (সা.) উহুদ যুদ্ধের আগে নিজের ব্যক্তিগত ইচ্ছার চেয়ে ‘শুরা’র সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দিয়ে তা কার্যকর করেছিলেন।

  • দলের জন্য দোয়া: ব্যক্তিগতভাবে সহকর্মীদের জন্য দোয়া করতে সময় নিন। এ আধ্যাত্মিক বন্ধনই কাজের পরিবেশকে সুন্দর করে তোলে।

এ পদক্ষেপগুলো সভার সময়কে কেবল কাজে লাগানোর উপায় নয়; বরং নিজেদের জন্য এবং প্রতিষ্ঠানের জন্য বরকত তৈরি করার এক চমৎকার সুযোগ।