বিদায় হজের ভাষণে প্রিয় নবীজি (সা.) বলেন, ‘তোমরা যারা উপস্থিত রয়েছ, তারা অনুপস্থিতদের কাছে আমার বার্তা পৌঁছে দেবে।’ (বুখারি: ৬৫৯৮; আ. স. ৭০৭৮) আরেক হাদিসে বলা আছে, ‘আমার পক্ষ থেকে একটি বাণী হলেও অন্যের কাছে পৌঁছে দাও।’ (বুখারি: ৩৪৬১)
তাবলিগ জামাতের আজকের এই বিশ্বব্যাপী প্রচার ও প্রসারের পেছনে রাসুল (সা.)-এর সেই আহ্বানের প্রতিফলন দেখা যায়। আর দাওয়াতে তাবলিগ জামাতের পুনর্জাগরণ যিনি করেছিলেন, তিনি হলেন বিংশ শতাব্দীর প্রখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ ও সাধক হজরত মাওলানা ইলিয়াস আখতার কান্ধলভী (রহ.) (১৮৮৫-১৯৪৪)।
তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী দিল্লির দক্ষিণে অবস্থিত এক পশ্চাৎপদ নীরব অঞ্চল ছিল ‘মেওয়াত’। চারিত্রিকভাবে বিপর্যস্ত, ধর্মকর্মহীন, অশিক্ষিত ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন নামমাত্র মুসলমান ‘মেও’ জনগোষ্ঠীকে ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস, ধর্মের পূর্ণাঙ্গ অনুশীলন ও কালেমার দাওয়াতি মর্ম শিক্ষাদান এবং বিভ্রান্তির কবল থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে হজরত মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) তাবলিগ জামাতের কার্যক্রম শুরু করেছিলেন।
১৩৪৫ হিজরিতে দ্বিতীয় হজ থেকে ফিরে এসে তিনি তাবলিগি গাশ্ত শুরু করেন এবং জনসাধারণের মধ্যে কালেমা ও নামাজের দাওয়াত দিতে থাকেন। হিজরি ১৩৫২ সালে তৃতীয় হজ পালনের পর মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) বুঝতে পারেন, গরিব মেওয়াতি কৃষকদের পক্ষে দ্বীন-ধর্ম শেখার সময় পাওয়া কষ্টকর। ঘরসংসার ছেড়ে মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে ধর্মকর্ম শেখাও অসম্ভব। ওয়াজ-নসিহতের মাধ্যমে সামগ্রিক জীবন পাল্টে দেওয়া বা জাহিলি বিশ্বাসকে পরিবর্তন করাও সহজ নয়। তাই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল বা ছোট ছোট জামাত আকারে ইলমি ও দ্বীনি প্রতিষ্ঠানগুলোয় গিয়ে সময় কাটানোর জন্য তিনি সবাইকে উদ্বুদ্ধ করলেন এবং ধর্মীয় পরিবেশে তালিম দিতে শুরু করলেন।
তাবলিগ জামাতের প্রথম ইজতেমা হয় ১৯৪১ সালে দিল্লির নিজামুদ্দিন মসজিদের ছোট এলাকা মেওয়াতের নূহ মাদ্রাসায়। এতে প্রায় ২৫ হাজার তাবলিগি দ্বীনদার মুসলমান অংশ নেন। এভাবে মেওয়াতের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার কিছু মানুষের কাছে দ্বীনের কথা প্রচারের মাধ্যমে তাবলিগ জামাতের প্রসার ঘটে।
বাংলাদেশে বিশ্ব ইজতেমা প্রথম শুরু হয় ১৯৪৬ সালে ঢাকার রমনায় কাকরাইল মসজিদে। এরপর ১৯৪৮ সালে ইজতেমা হয় চট্টগ্রামের তৎকালীন হাজি ক্যাম্পে। এরপর ১৯৫৮ সালে ইজতেমা হয় বর্তমান নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে। তখন এটা কেবল ইজতেমা নামেই পরিচিত ছিল।
ইজতেমায় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় ১৯৬৬ সালে টঙ্গীর পাগার গ্রামের খেলার মাঠে ইজতেমার আয়োজন করা হয়। ওই বছরই প্রথম শুধু বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ অংশগ্রহণ করায় বিশ্ব ইজতেমা হিসেবে পরিচিতি
লাভ করে।
১৯৬৭ সাল থেকে এযাবৎ স্থায়ীভাবে বিশ্ব ইজতেমা নামে প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন মানুষের অংশগ্রহণের মাধ্যমে ঢাকার অদূরে গাজীপুরের টঙ্গীতে তুরাগ নদের উত্তর-পূর্ব তীরে রাজধানী উন্নয়ন করপোরেশনের প্রায় ১৭৫ একর বিশাল ভূমির ওপর শামিয়ানা টাঙিয়ে নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে ঐতিহ্যবাহী এই বিশ্ব ইজতেমা। ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ সরকার উল্লিখিত জায়গায় বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হওয়ার লিখিত অনুমতি প্রদান করে।
লোকসমাগম বেশি হওয়ায় ইজতেমা দুই পর্বে অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন পত্রিকার পরিসংখ্যানের হিসাবে দুই পর্ব মিলিয়ে ৬০ থেকে ৭০ লাখ মানুষ এতে অংশ নেন। এবং ১০০টির বেশি দেশের প্রায় অর্ধলাখ বিদেশি মেহমান এতে অংশ নেন।
প্রতিবছরই ইজতেমা শেষে হাজারো জামাত দেশের অভ্যন্তরে ও বিশ্বব্যাপী দাওয়াতি কাজের আঞ্জাম দেওয়ার জন্য বের হয় নিজের জানমালের কোরবানির দ্বারা। আল্লাহ দাওয়াত ও তাবলিগের এই মেহনতকে কিয়ামত পর্যন্ত জারি রাখুন। আমিন।
● মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম
smusmangonee@gmail.com