সুরা হজ:

হজের বিধান ও ইসলামের মৌলিক শিক্ষা

সুরা হজ, পবিত্র কোরআনের ২২তম সুরা, মদিনায় অবতীর্ণ। এটিতে ১০টি রুকু এবং ৭৮টি আয়াত রয়েছে। এই সুরায় হজের বিধান, কোরবানির নির্দেশনা, কিয়ামতের ভয়াবহতা, মানুষের সৃষ্টি, আল্লাহর একত্ববাদ এবং সৎকর্মের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। সুরাটি হজের বিধানের উল্লেখের কারণে ‘সুরা হজ’ নামে পরিচিত। এ ছাড়া এটি বিশ্বাসীদের জন্য নামাজ, জাকাত, ধৈর্য এবং আল্লাহর ওপর ভরসার শিক্ষা প্রদান করে।

 সুরার প্রধান বিষয়

 সুরা হজের শুরুতে কিয়ামতের ভয়াবহতা এবং আল্লাহর প্রতি ভয় রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মানুষের সৃষ্টির সাতটি ধাপের বর্ণনা দিয়ে আল্লাহর সৃষ্টিশক্তি তুলে ধরা হয়েছে: ‘হে মানবজাতি, পুনরুত্থান সম্বন্ধে তোমাদের সন্দেহ! আমি তো তোমাদের সৃষ্টি করেছি মাটি থেকে, তারপর শুক্র থেকে, তারপর রক্তপিণ্ড থেকে, তারপর আংশিক আকারপ্রাপ্ত ও আংশিক আকারহীন চর্বিতপ্রতিম মাংসপিণ্ড থেকে...তারপর আমি তোমাদের শিশুরূপে বের করি, পরে তোমরা পূর্ণ যৌবনে উপনীত হও।’ (সুরা হজ, আয়াত: ৫)

 এই সুরায় আল্লাহর একত্ববাদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে এবং শিরককারীদের সমালোচনা করা হয়েছে। মহানবী (সা.)-কে সান্ত্বনা দিয়ে বলা হয়েছে, পূর্ববর্তী নবীদের (নুহ, ইবরাহিম, লুত, সালেহ, মুসা প্রমুখ) সম্প্রদায়ও তাদের নবীদের মিথ্যাবাদী বলেছিল এবং আল্লাহ তাদের শাস্তি দিয়েছিলেন।

হজের বিধান

 হজ ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ এবং আর্থিক ও শারীরিকভাবে সামর্থ্যবান নারী-পুরুষের জন্য ফরজ। সুরা হজের ২৭ নম্বর আয়াতে হজের ঘোষণার কথা উল্লেখ করা হয়েছে: ‘মানুষের মধ্যে হজের ঘোষণা দাও, তারা তোমার কাছে আসবে হেঁটে এবং দ্রুতগামী উটে চড়ে, দূরদূরান্তের পথ থেকে।’ (সুরা হজ, আয়াত: ২৭)

হজরত ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর নির্দেশে বায়তুল্লাহ নির্মাণ করেন এবং কুবাইস পাহাড়ে দাঁড়িয়ে হজের ঘোষণা দেন, যা আল্লাহ আসমান-জমিনে পৌঁছে দেন। হজের সময় নির্ধারিত হয়েছে শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজ মাসে, বিশেষত জিলহজের ৮ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত। হজের স্থানগুলো হলো মক্কার কাবা শরিফ, সাফা-মারওয়া, মিনা, আরাফাত ও মুজদালিফা।

হজ মানুষকে পাপমুক্ত করে এবং জান্নাতের পথ সুগম করে। মহানবী (সা.) বলেছেন: ‘যে ব্যক্তি হজ করল এবং হজ অবস্থায় কথা ও কাজে পাপ থেকে বিরত রইল, সে হজ শেষে সেই দিনের মতো নিষ্পাপ হয়ে ঘরে ফিরবে, যেদিন তার মা তাকে প্রসব করেছিলেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১,৫২১)

কোরবানির গুরুত্ব

 কোরবানি হলো জিলহজ মাসের ১০ থেকে ১২ তারিখের মধ্যে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নির্দিষ্ট পশু জবাই করা। এটি সামর্থ্যবান নারী-পুরুষের জন্য ওয়াজিব। কোরবানি প্রত্যেক নবীর শরিয়তে বিদ্যমান ছিল, যদিও পদ্ধতি ভিন্ন ছিল। মহানবী (সা.) মদিনায় ১০ বছর জীবিত থাকাকালীন প্রতিবছর কোরবানি করেছেন। কোরআনে বলা হয়েছে: ‘সব সম্প্রদায়ের জন্য আমি কোরবানির বিধান দিয়েছি...যেসব চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছেন, সেগুলোর ওপর যেন তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।’ (সুরা হজ, আয়াত: ৩৪)

 কোরবানির মূল উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর নৈকট্য অর্জন। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহর কাছে ওদের মাংস বা রক্ত পৌঁছায় না, বরং পৌঁছায় তোমাদের ধর্মনিষ্ঠা।’ (সুরা হজ, আয়াত: ৩৭)

 কোরবানির পশু জবাইয়ের সময় আল্লাহর নাম নিতে হবে, এবং গোশত নিজে খাওয়া, দরিদ্রদের দান করা এবং অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

বিশ্বাসীদের বৈশিষ্ট্য

 সুরায় সত্যিকার বিশ্বাসীদের চারটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে, ‘যাদের হৃদয় আল্লাহর নাম করা হলে ভয়ে কাঁপে, যারা তাদের বিপদ-আপদে ধৈর্য ধরে ও নামাজ কায়েম করে এবং আমি তাদেরকে যে জীবনের উপকরণ দিয়েছি, তার থেকে ব্যয় করে।’ (সুরা হজ, আয়াত: ৩৫)

 এই গুণাবলি বিশ্বাসীদের জীবনে আল্লাহর প্রতি ভক্তি ও সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ প্রকাশ করে।

সামাজিক ও ধর্মীয় নির্দেশনা

 সুরা হজে নামাজ কায়েম, জাকাত প্রদান এবং আল্লাহর ওপর ভরসা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহকে মহানুভব অভিভাবক ও সাহায্যকারী হিসেবে অবলম্বন করতে বলা হয়েছে। সুরার শেষে মুসলিম উম্মাহর পরিচয় তুলে ধরে বলা হয়েছে: ‘তিনি পূর্বে তোমাদের নামকরণ করেছিলেন “মুসলিম”...সুতরাং তোমরা নামাজ কায়েম করো, জাকাত দাও ও আল্লাহকে অবলম্বন করো। তিনিই তোমাদের অভিভাবক, এক মহানুভব অভিভাবক ও সাহায্যকারী।’ (সুরা হজ, আয়াত: ৭৮)

 এ ছাড়া আল্লাহর শক্তির তুলনায় শিরককারীদের দুর্বলতা একটি উপমার মাধ্যমে বর্ণনা করা হয়েছে: ‘তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাকো তারা তো কখনো একটি মাছিও সৃষ্টি করতে পারবে না...আল্লাহ তো ক্ষমতাবান পরাক্রমশালী।’ (সুরা হজ, আয়াত: ৭৩-৭৪)

সূত্র: মুহাম্মদ আসাদ, দ্য মেসেজ অব দ্য কোরআন, সুরা হজ