জান্নাতের ৮টি দরজার নাম কী

জান্নাত আল্লাহ তায়ালার অনন্ত করুণার প্রতিদান, যা তিনি তাঁর প্রিয় বান্দাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন। কোরআনে বলা হয়েছে, “যারা বিশ্বাস করে এবং সৎকর্ম করে, আমি অবশ্যই তাদের প্রবেশ করাব জান্নাতে, যার নিচ দিয়ে নদী প্রবাহিত।” (সুরা নিসা, আয়াত: ৫৭)

সহিহ হাদিসে আছে, জান্নাতে রয়েছে আটটি দরজা (বাব), প্রতিটি নির্দিষ্ট আমলের জন্য নির্ধারিত। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩২৪৮; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১০২৭)

জান্নাতের ৮টি দরজার নাম ও বিবরণ

১. বাবুস সালাহ: নামাজের দরজা। এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করবেন তাঁরা, যারা নিয়মিত সালাত আদায় করতেন এবং নামাজের প্রতি যত্নবান ছিলেন।

হাদিসে নবীজি (স.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি নিয়মিতভাবে নামাজ আদায় করে, কেয়ামতের দিন তাকে এই দরজা দিয়ে ডাকা হবে।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৮৯৭)

২. বাবুল জিহাদ: জিহাদের দরজা। এই দরজা তাদের জন্য যারা আল্লাহর পথে সর্বস্ব উৎসর্গ করেছেন।

নবীজি (স.) বলেন, “জিহাদকারীদের জন্য জান্নাতে একটি বিশেষ দরজা রয়েছে—বাবুল জিহাদ।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৮৯০)

৩. বাবুস সাদাকা: দান-সদকার দরজা। যারা নিঃস্বার্থভাবে দান করতেন—গোপনে ও প্রকাশ্যে—তাদের জন্য এই দরজা।

আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেন, “যে ব্যক্তি নিয়মিতভাবে দান করতো, তাকে এই দরজা দিয়ে ডাকা হবে।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৮৯৬)

৪. বাবুর রাইয়ান: রোজাদারদের দরজা। এটি রমজানের রোযাদারদের জন্য বিশেষভাবে নির্ধারিত।

নবীজি (স.) বলেন, “জান্নাতে রাইয়ান নামে একটি দরজা আছে, যার মধ্য দিয়ে কেবল রোযাদাররাই প্রবেশ করবে। তারা প্রবেশ করলে সেই দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৮৯৬; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১১৫২)

৫. বাবুল হাজ্জ: হজকারীদের দরজা। যারা হজ সম্পন্ন করেছেন আন্তরিকভাবে, আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে, তাদের জন্য এই দরজা।

ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, “হজ ও উমরাহ সম্পন্নকারীদের জন্য জান্নাতে একটি বিশেষ দরজা রয়েছে।” (সুনান আন-নাসাঈ, হাদিস: ২৬৩৫)

৬. বাবুল কাজিমিনাল গাইজ: যারা রাগ সংবরণ করে তাদের দরজা।

আল্লাহ বলেন, “যারা রাগ সংবরণ করে এবং মানুষকে ক্ষমা করে—আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন।” (সুরা আল-ইমরান, আয়াত: ১৩৪)

মুফাসসিরগণ বলেন, এই আয়াতের প্রতিদান হলো জান্নাতে বিশেষ প্রবেশপথ।

৭. বাবুল আইমান: ডান দিকের দরজা। এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করবেন তাঁরা, যাদের হিসাব খুব সহজে নেওয়া হবে এবং যাদের আমলনামা ডান হাতে দেওয়া হবে।

নবীজি (স.) বলেন, “যারা ডান দিক থেকে ডাকা হবে, তারা এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৫৪১)

৮. বাবুজ জিকির: আল্লাহর স্মরণকারীদের দরজা। যারা নিয়মিত জিকির, তাসবিহ, তাহমিদ, তাকবির পাঠ করতেন, আল্লাহ তাঁদের এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করাবেন।

(ইমাম নববী, শরহ সহিহ মুসলিম, ৭/১৩৬, দারুল মাআরিফ, কায়রো, ১৯৮০)

জান্নাতের দরজা কাকে আহ্বান করবে, সে-সম্পর্কে আবু হুরাইরা (রা.) একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন, রাসুল (স.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি নামাজ, রোজা, দান-সদকা ও জিহাদে সমানভাবে অংশগ্রহণ করবে, তাকে জান্নাতের সব দরজা থেকে ডাকা হবে: ‘হে অমুক, এসো এই দরজা দিয়ে।’”

তখন আবু বকর (রা.) জিজ্ঞেস করেন, “হে আল্লাহর রাসুল, কেউ কি আছে যাকে সব দরজা থেকে ডাকা হবে?”

নবীজি (স.) বলেন, “হ্যাঁ, আর আমি আশা করি তুমি তাদেরই একজন।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৮৯৭; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১০২৭)

জান্নাতের ৮ দরজা ও ৮ স্তরের পার্থক্য

মনে রাখতে হবে, এগুলো জান্নাতে প্রবেশের পথ বা গেট। প্রতিটি নির্দিষ্ট শ্রেণির আমলকারীদের জন্য নির্ধারিত।

এগুলো জান্নাতের “গেট”, অর্থাৎ প্রবেশপথ।

নবীজি (সা.) বলেছেন, “জান্নাতে আটটি দরজা আছে, এবং প্রতিটি দরজা নির্দিষ্ট আমলের জন্য।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩২৪৮; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১০২৭)

এগুলো জান্নাতে প্রবেশের পথ, জান্নাতের ভেতরে কোনো আলাদা স্থান নয়।

আর জান্নাতের ৮ নাম বা স্তর মানে হল, যা জান্নাতের বিভিন্ন স্তর বা শ্রেণি। প্রত্যেক স্তরের মর্যাদা ও সৌন্দর্য ভিন্ন। যত উত্তম আমল, তত উঁচু স্তর।

হাদিসে বর্ণিত আছে, “জান্নাতে রয়েছে শত স্তর; প্রতিটি স্তরের মধ্যকার দূরত্ব আকাশ ও জমিনের মতো।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২৭৯০)

জান্নাতের ৮ নাম বা স্তর হলো:

১. জান্নাতুল ফিরদাউস: সর্বোচ্চ ও শ্রেষ্ঠ জান্নাত (সূরা মু’মিনুন, আয়াত ১১)

২. জান্নাতুল আদন: স্থায়ী নিবাস (সুরা তাওবা, আয়াত ৭২)

৩. জান্নাতুল নাঈম: সুখ ও প্রশান্তির বাগান (সুরা মায়িদাহ, আয়াত ৬৫)

৪. জান্নাতুল মাওয়া: আশ্রয়ের জান্নাত (সূরা আন-নাজম, আয়াত ১৫)

৫. দারুস সালাম: শান্তির আবাস (সুরা ইউনুস, আয়াত ২৫)

৬. দারুল খুলুদ: চিরস্থায়ী বাসস্থান (সুরা ফুরকান, আয়াত ১৫)

৭. দারুল মুকামা: নিরাপদ ও সম্মানিত নিবাস (সুরা ফাতির, আয়াত ৩৫)

৮. আল-মাকামুল মাহমুদ: প্রশংসিত স্থান, যা নবীদের মধ্যে বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ (সুরা ইসরা, আয়াত ৭৯)

“জান্নাতের ৮ দরজা” মানে জান্নাতে প্রবেশের ভিন্ন ভিন্ন পথ, আর “জান্নাতের ৮ নাম বা স্তর” মানে জান্নাতের ভিন্ন ভিন্ন মর্যাদা ও স্তর। দুটি সম্পূর্ণ আলাদা ধারণা, কিন্তু উভয়ই জান্নাতের মাহাত্ম্য প্রকাশ করে।

অর্থাৎ, কেউ এক দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারে, কিন্তু কোন স্তরে যাবে, তা নির্ভর করে তার ইমান, নিয়ত ও আমলের মানের ওপর।

জান্নাতের দরজার প্রতীকী শিক্ষা

১. বৈচিত্র্যপূর্ণ আমল: আল্লাহর পথে চলার বিভিন্ন উপায় রয়েছে।

২. সমন্বিত জীবন: শুধু এক ইবাদত নয়, বরং সব দিক থেকেই ভারসাম্যপূর্ণ জীবন যাপন করাই লক্ষ্য।

৩. রহমতের বহুমাত্রিকতা: আল্লাহর রহমত এত বিস্তৃত যে, একেকটি গুণের জন্য আলাদা দরজা উন্মুক্ত করেছেন।

৪. প্রেরণার উৎস: জান্নাতের প্রতিটি দরজা আমাদের জীবনের প্রতিটি ভালো কাজের প্রতি আহ্বান জানায়।

জান্নাতের ৮টি দরজা আল্লাহর করুণার প্রতীক এবং মানব জীবনের উদ্দেশ্যকে স্পষ্ট করে যে মানুষ শুধু নামাজ, রোজা, দান বা হজ নয়, বরং সামগ্রিকভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে চলবে।

প্রতিটি দরজা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, কোনো আমলই ছোট নয়, আর আল্লাহর দরজা সর্বদা উন্মুক্ত সেইসব বান্দাদের জন্য, যারা তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনে নিবেদিত।