ইসলাম-পূর্ব আরব সমাজে কাবা ঘরকে কেন্দ্র করে কিছু বিশেষ দায়িত্ব ছিল, যা কোরাইশ গোত্রের বিভিন্ন শাখার মধ্যে বণ্টিত ছিল। এসব দায়িত্ব সামাজিক মর্যাদা, নেতৃত্ব ও আস্থার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতো।
এর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানজনক দায়িত্ব ছিল হাজিদের পানি পান করানোর দায়িত্ব, যা আরবি পরিভাষায় “সিকায়া” নামে পরিচিত।
“সিকায়া” বলতে বোঝায়, হজের মৌসুমে দূর-দূরান্ত থেকে আগত হাজিদের জন্য নিরাপদ ও পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা করা। মরুপ্রধান আরব ভূখণ্ডে পানির সংকট থাকায় এই দায়িত্ব ছিল জীবনরক্ষার সমতুল্য।
ইতিহাসবিদ ইবনে হিশাম উল্লেখ করেছেন, কোরাইশদের মধ্যে যিনি সিকায়ার দায়িত্বে থাকতেন, তিনি সমাজে বিশেষ সম্মান ও প্রভাব অর্জন করতেন। (ইবনে হিশাম, সিরাতুন্নবি, ১/১৫২, দারুল জিল, বৈরুত, ১৯৯০)
ঐতিহাসিক সূত্রসমূহে সর্বসম্মতভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, কোরাইশদের মধ্যে হাজিদের পানি পান করানোর দায়িত্ব ছিল বনু হাশিম গোত্রের ওপর। এই দায়িত্বের মূল প্রবর্তক ছিলেন আবদুল মোত্তালিব ইবনে হাশিম, রাসুল (স.)-এর দাদা।
ইবনে কাসির উল্লেখ করেন যে, আবদুল মোত্তালিব স্বপ্নে নির্দেশ পেয়ে জমজম কূপ পুনরাবিষ্কার করেন এবং হাজিদের জন্য সেই পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ২/২৯৫, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যা, বৈরুত, ১৯৯৮)
জমজম কূপ পুনরাবিষ্কারের পর আবদুল মোত্তালিব হাজিদের জন্য নিয়মিত পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। তাবারি লিখেছেন, হজের মৌসুমে তিনি জমজমের পানির সঙ্গে কখনও খেজুর বা মিষ্টি মিশিয়ে হাজিদের পান করাতেন, যাতে তারা ক্লান্তি ও তৃষ্ণা থেকে স্বস্তি পায়। (তারিখুল উমাম ওয়াল মুলুক, ২/২৫৭, দারুল তুরাস, কায়রো, ১৯৬৭)
আবদুল মোত্তালিবের ইন্তেকালের পর এই দায়িত্ব তাঁর সন্তানদের মধ্যে বণ্টিত হয়। পরবর্তীকালে এই দায়িত্ব প্রধানত পালন করেন তাঁর পুত্র আব্বাস ইবনে আবদুল মোত্তালিব (রা.)।
মক্কা বিজয়ের পর রাসুল (স.) কাবা-কেন্দ্রিক বহু দায়িত্ব পুনর্বিন্যাস করলেও সিকায়ার দায়িত্ব আব্বাসের কাছেই বহাল রাখেন—এ তথ্য ইবনে কাসির স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৪/৩০০, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যা, বৈরুত, ১৯৯৮)
কোরআন হাজিদের পানি পান করানোর দায়িত্বকে একটি সুপরিচিত সামাজিক বাস্তবতা হিসেবে উল্লেখ করেছে, “তোমরা কি হাজিদের পানি পান করানো এবং মসজিদুল হারামের তত্ত্বাবধানকে আল্লাহ ও পরকালে ইমান এবং আল্লাহর পথে জিহাদের সমতুল্য মনে করো?” (সুরা তাওবা, আয়াত: ১৯)
এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, সিকায়া তৎকালীন সমাজে একটি স্বীকৃত ও সম্মানজনক দায়িত্ব ছিল, যদিও কোরআন ইমান ও আল্লাহর পথে জিহাদের মর্যাদাকে তার ঊর্ধ্বে স্থাপন করেছে।
সিকায়ার দায়িত্ব থেকে স্পষ্ট হয় যে, ইসলাম-পূর্ব আরব সমাজেও মানবসেবা ও অতিথিপরায়ণতা একটি গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধ ছিল।
বিশেষ করে বনু হাশিম গোত্র এই দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা অর্জন করেছিল—যা পরবর্তী সময়ে রাসুল (স.)-এর দাওয়াত গ্রহণের সামাজিক ভূমি প্রস্তুত করে দেয়। (ইবনে হিশাম, সিরাতুন্নবি, ১/১৫৬, দারুল জিল, বৈরুত, ১৯৯০)
সব মিলিয়ে বলা যায়, কোরাইশদের মধ্যে হাজিদের পানি পান করানোর দায়িত্ব ছিল বনু হাশিম গোত্রের হাতে। এই দায়িত্বের সূচনা করেন আবদুল মোত্তালিব এবং পরে তা পালন করেন আব্বাস ইবনে আবদুল মোত্তালিব (রা.)।
সিকায়া শুধু একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব নয়; এটি মানবসেবা, নেতৃত্ব ও নৈতিক মর্যাদার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, যা ইসলামের মানবিক শিক্ষার সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত।