ইসলামে হিকমতের মর্ম ও গুরুত্ব

কোরআনের পাতায় ‘হিকমত’ শব্দটি ঘুরেফিরে এসেছে প্রায় ২০ বার। শুধু তা–ই নয়, এর ধাতুমূল থেকে জন্মানো আরও অনেক শব্দ চোখে পড়ে। যেমন ‘হাকিম’ শব্দটি। এর দেখা মেলে ৯৭ বার।

বিখ্যাত আভিধানিক গ্রন্থ লিসানুল আরব থেকে জানা যায়, আগে ‘হিকমত’ শব্দটির অন্য মানে ছিল। এর ব্যবহার ছিল মূলত ঘোড়ার লাগাম বোঝাতে। লাগামকে বলা হতো হিকমত। কেন? কারণ লাগামই তো ঘোড়াকে শাসনে রাখে। তাকে অবাধ্য হতে দেয় না, বেপরোয়া হতে দেয় না।

পরে মানুষের গভীর জ্ঞান আর জীবনবোধ বোঝাতে এই শব্দ ব্যবহৃত হতে শুরু করল। হিকমত মানুষকে নৈতিকতার লাগামে বেঁধে রাখে। সে নিজের কাছে দায়বদ্ধ থাকে। এখান থেকেই আরব মানসের একটি বড় পরিচয় মেলে। নৈতিকতার শিকড়হীন নিছক বুদ্ধির ফুলঝুরিকে আরব-মন যেন মেনে নিতে পারত না।

তিনি যাকে ইচ্ছা হিকমত দান করেন এবং যাকে হিকমত দান করা হয়, সে তো প্রভূত কল্যাণ লাভ করে। জ্ঞানবান মানুষেরা ছাড়া এ কথা কেউ বোঝেন না।’
সূরা বাকারা, আয়াত: ২৬৯

জুরজানি তাঁর বিখ্যাত তারিফাত বইয়ে বলছেন, হিকমত এমন এক জ্ঞান, যা দিয়ে জগতের প্রতিটি জিনিসের আসল রূপ খোঁজা হয়। তবে তা মানুষের সাধ্যের মধ্যে থেকেই। তাহলে দেখা যাচ্ছে, এটা তত্ত্বের জ্ঞান, যন্ত্রের নয়। এ গেল শাস্ত্রের কথা।

কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে যে হিকমত লুকিয়ে থাকে, তার চেহারাটা কেমন? জুরজানী বলছেন, মানুষের ভেতরে থাকা এ এক আশ্চর্য বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তি। তা যেমন জন্মগত প্রতিভার মতো প্রখর নয়, আবার নির্বুদ্ধিতার মতো ভোঁতাও নয়। দুইয়ের মাঝামাঝি এক অবস্থা।

ইসলামের আলো এসে পড়ার পর ‘হিকমত’ শব্দটি পেল এক নতুন মাত্রা। ধর্মীয় আবহে এর অর্থও নানা দিকে বাঁক নিল। ইবনে আব্বাস (রা.) মনে করতেন, কোরআনে হিকমত মানে হল হালাল-হারামকে চিনে নেওয়ার জ্ঞান।

এ নিয়ে অবশ্য নানা মুনির নানা মত। কেউ বলেছেন, জ্ঞান আর কর্ম যখন হাত ধরাধরি করে চলে, সেটিই হিকমত। কেউ–বা ভেবেছেন, প্রত্যেক মূলনীতিমূলক সত্য কথাই হিকমত। শুনতে এটাই সহজ মনে হয়। কিন্তু এই সংজ্ঞায় মন ভরে না। কারণ ‘মূলনীতি’ কথাটা আপেক্ষিক। ‘সত্য’-এর ধারণাও যে সবার কাছে এক নয়।

অনেকের ধারণা, কোরআনে হিকমত বলতে কেবলই সুন্নতে নববী বা হাদিস শরিফকে বোঝানো হয়েছে। এই দাবির কারণ ঠিক স্পষ্ট নয়। সম্ভবত মুতাজিলাদের যুক্তির বিরোধিতা করতেই এই মতের জন্ম। মুতাজিলাদের মধ্যেও কেউ কেউ আবার মনে করতেন, কোরআনের হিকমত আসলে ‘আকল’ বা যুক্তিবোধ ছাড়া আর কিছুই নয়।

এই বিতর্কের একটি সুন্দর সমাধান পাওয়া যায় বিখ্যাত ধর্মতাত্ত্বিক ইবনু কায়্যিমিল জাওযিয়াহের ব্যাখ্যায়। তিনি দেখালেন, কোরআনে হিকমত শব্দটি দুই ভাবে এসেছে। কখনো ‘কিতাব’ শব্দের হাত ধরে। যেমন সুরা বাকারার ১২৯ আর ১৫১ নম্বর আয়াতে। এসব জায়গায় হিকমতের অর্থ সুন্নাতে নববি বা হাদিস শরিফ। অর্থাৎ কোরআন ও সুন্নাহ।

হিকমত হলো মুমিনের হারানো সম্পদ। যেখানেই তা পাবে, সে-ই তার প্রকৃত অধিকারী।
তিরমিজি, হাদিস: ২,৬৮৭

আবার এমন কিছু জায়গা আছে, যেখানে হিকমত শব্দটি এসেছে একেবারে একাকী। সেখানে পরিপ্রেক্ষিত অনুযায়ী এর অর্থ বদলে গেছে। কখনো তা নবুয়তের কথা বলেছে। কখনো–বা গভীর জ্ঞান, বোধ আর উপদেশের ইশারা দিয়েছে।

এই গভীর জ্ঞান বোঝাতেই বলা হয়েছে, ‘তিনি যাকে ইচ্ছা হিকমত দান করেন এবং যাকে হিকমত দান করা হয়, সে তো প্রভূত কল্যাণ লাভ করে। জ্ঞানবান মানুষেরা ছাড়া এ কথা কেউ বোঝেন না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৬৯)

 সুরা নাহলের ১২৫ নম্বর আয়াতে দাওয়াতের যে মূলনীতি দেওয়া হয়েছে, সেখানেও হিকমতের ডাক। ‘তোমার প্রভুর পথে ডাকো হিকমতের সঙ্গে।’ এখানে হিকমত কী? এর এক অর্থ হলো, ঠিক সময়ে, ঠিক জায়গায়, ঠিক কাজটা করা। অর্থাৎ দাওয়াতের সময় স্থান-কাল-পাত্র মাথায় রাখা।

সৌদির ইসলামি পণ্ডিত শরিফ হাতেম আল-আওনি তাই লিখেছেন, ‘শুধু ভালো কাজের আদেশ আর মন্দ কাজে নিষেধ থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখলেই যে পরকালে শাস্তি পেতে হবে, এমনটা নয়। কখনো কখনো ভালো কাজের আদেশ আর মন্দ কাজে নিষেধ করাটাও আমাদের শাস্তির কারণ হতে পারে। যদি সেই ডাকে সময়, অবস্থা আর লাভ-ক্ষতির বিচার না থাকে। যাঁদের বুকে দ্বীনের আগুন, সেই ভাইয়েরা শুনে রাখুন—কিছু কিছু দাওয়াত ফিতনার জন্ম দেয়, যা মানুষকে ধর্ম থেকে আরও দূরে ঠেলে দেয়।’ (প্রবন্ধ: বাদুন নাহি আনিল মুনকারি ফিতনাহ)

সুন্নতে নববিতেও হিকমতের ব্যাপ্তি আমাদের মুগ্ধ করে। নবী (সা.) বলেছেন, ‘হিকমত হলো মুমিনের হারানো সম্পদ। যেখানেই তা পাবে, সে-ই তার প্রকৃত অধিকারী।’ (তিরমিজি, হাদিস: ২,৬৮৭)

এই একটি কথাতেই মুমিনের সঙ্গে হিকমতের নাড়ির যোগ ফুটে ওঠে। এ যেন এক নিরন্তর খুঁজে ফেরা, আর খুঁজে পেলেই তাকে পরম মমতায় আপন করে নেওয়া।

হিকমত শব্দের সঙ্গে দর্শনেরও এক গভীর যোগ রয়েছে। দর্শনের প্রতিশব্দ হিসেবেও শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। মুসলিম দার্শনিক ও ধর্মতাত্ত্বিক ইবনে রুশদ তাই তো তাঁর বইয়ের নাম রেখেছিলেন ফাসলুল মাকাল ফীমা বাইনাল হিকমাতি ওয়াশ শারিয়াতি মিন ইত্তিসাল (হিকমত আর শরিয়তের যোগসাজশের শেষ কথা)।

গ্রিক চিন্তার জগতেও প্রজ্ঞা অর্থেই হিকমত শব্দটি ব্যবহৃত হতো। তাঁরা বলতেন, একজন খাঁটি মানুষের মধ্যে চারটি গুণ থাকা চাই— প্রজ্ঞা বা হিকমত, সাহস, পবিত্রতা আর ন্যায়বোধ।

গ্রিক চিন্তার জগতেও প্রজ্ঞা অর্থেই হিকমত শব্দটি ব্যবহৃত হতো। তাঁরা বলতেন, একজন খাঁটি মানুষের মধ্যে চারটি গুণ থাকা চাই— প্রজ্ঞা বা হিকমত, সাহস, পবিত্রতা আর ন্যায়বোধ।

মুসলিম দার্শনিক ইবনে সিনা আর-রিসালাতুল খামিসাহ ফি আকসামিল উলুমিল আকলিয়্যাহ (বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানগুলোর প্রকারভেদ বিষয়ে পঞ্চম প্রবন্ধ) লেখায় বলেছেন, ‘হিকমত হলো চিন্তার শিল্প। এর জোরেই মানুষ গোটা বিশ্বজ্ঞানকে নিজের ভেতরে ধারণ করে। পৃথিবীতে তার যা করণীয়, তা সে করে। এভাবেই সে সম্মানিত হয়, পূর্ণতা পায়। জড় জগতের বাইরে সে নিজেই হয়ে ওঠে এক জ্ঞানময় জগৎ। আর এভাবেই সে পরকালের পরম সৌভাগ্যের জন্য তৈরি হয়।’

ইসলাম আসার আগে আরবে একধরনের হিকমতের চল ছিল। অল্প কথায় গভীর ভাব ফুটিয়ে তোলাকেই তখন হিকমত বলা হতো। সেই যুগের নৈতিক ধারার কবিরা ছিলেন এর ধারক। নবীজি (সা.)-এর বাণীর ক্ষেত্রেও অল্প কথায় অনেক কিছু বলার এই গুণের উল্লেখ আছে, যাকে বলা হয় ‘জাওয়ামিউল কালিম’।

মুসলিম দার্শনিকেরা বলেন, শরীয়তের হিকমত আর দর্শনের হিকমতে কোনো বিরোধ নেই। উচ্চারিত (মানতুক) হিকমত হলো শরিয়ত আর তরিকতের জ্ঞান। আর যা অনুচ্চারিত (মাসকুত), সেই হিকমত হলো দর্শন বা ফালসাফার জ্ঞান।

সাধারণ মানুষ তার নাগাল পায় না। যা হারানো রত্নের মতো এক বিশাল মরুভূমিতে খুঁজে ফিরতে হয়। আর যেখানেই তার দেখা মিলুক, তুলে নিতে হয় পরম যত্নে। এই হিকমত সাধনাতেই হয়তো কেটে যায় একজন মুমিনের গোটা জীবন।