পবিত্র কোরআনে আল্লাহ ইয়েমেনের এক নারীর গল্প বলেছেন। বিলকিস হজরত সোলায়মান (আ.)-এর যুগে বিস্তীর্ণ অঞ্চলের সম্রাজ্ঞী ছিলেন। সোলায়মান (আ.) ওই নারীর (বিলকিসের) সাম্রাজ্যের কথা জানতেন না। তিনি তাঁর গোয়েন্দা পাখি হুদহুদের মাধ্যমে জানতে পারেন, কারো আনুগত্য স্বীকার না করেই বিলকিস বিস্তীর্ণ একটি অঞ্চল শাসন করছেন। তিনি তাঁকে আত্মসমর্পণের আহ্বান করলেন। কোরআনের সুরা নমলের ২৪টি আয়াতে আল্লাহ ঘটনাটি তুলে ধরেছেন। কোরআনের ভাষ্যে ঘটনাটি বর্ণনা করা যাক।
কোরআনে আছে, সে (হুদহুদ) দেরি না করে এসে পড়ল এবং বলল, ‘আমি এমন সব তথ্য লাভ করেছি, যা আপনার জানা নেই আর সাবা থেকে সঠিক খবর নিয়ে এসেছি। আমি এক নারীকে দেখলাম সে জাতির ওপর রাজত্ব করছে। তাকে সবই দেওয়া হয়েছে ও তার আছে এক বিরাট সিংহাসন। আমি তাকে ও তার সম্প্রদায়কে দেখলাম, তারা আল্লাহর পরিবর্তে সূর্যকে সিজদা করছে। শয়তান ওদের কাছে ওদের কাজকর্ম শোভন করেছে ও ওদের সৎ পথ থেকে দূরে রেখেছে যেন ওরা সৎ পথ না পায় এবং যিনি আকাশ ও পৃথিবীর গোপন বিষয়কে প্রকাশ করেন, যিনি জানেন যা তোমরা গোপন কর ও যা তোমরা প্রকাশ কর, সেই আল্লাহকে যেন ওরা সিজদা না করে।
আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, তিনিই মহা আরশের অধিপতি।’ (সোলায়মান) বলল, ‘আমি দেখব, তুমি সত্য বলছ না মিথ্যা বলছ? তুমি আমার এ চিঠি নিয়ে যাও। এ তাদের কাছে দিয়ে এসো। তারপর তাদের কাছ থেকে সরে পড়ো ও দেখো তারা কী উত্তর দেয়।’ (সাবা রানি বিলকিস) বলল, ‘পারিষদবর্গ! আমাকে এক সম্মানিত পত্র দেওয়া হয়েছে। এ সোলায়মানের কাছ থেকে। আর তা এই: করুণাময়, পরম দয়াময় আল্লাহর নামে।
অহংকার করে আমাকে অমান্য করো না, আনুগত্য স্বীকার করে আমার কাছে উপস্থিত হও।’ (বিলকিস) বলল, ‘পারিষদবর্গ! আমার এ সমস্যায় তোমাদের পরামর্শ দাও, আমি যা করি তা তো তোমাদের উপস্থিতিতেই করি।’ ওরা বলল, ‘আমরা তো শক্তিশালী ও কঠোর যোদ্ধা; তবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আপনার, কী নির্দেশ দেবেন, তা আপনিই দেখুন।’ (বিলকিস) বলল, ‘রাজা-বাদশাহরা যখন কোনো জনপদে প্রবেশ করে, তখন তাকে বিপর্যস্ত করে দেয় ও সেখানকার মর্যাদাবান ব্যক্তিদের অপদস্থ করে; এরাও তা-ই করবে। আমি তাঁর কাছে উপঢৌকন পাঠাচ্ছি। দেখি, দূতেরা কী উত্তর আনে।’
দূত সোলায়মানের কাছে এলে সোলায়মান বলল, ‘তোমরা কি আমাকে ধনসম্পদ দিয়ে সাহায্য করতে চাও? আল্লাহ তোমাদের যা দিয়েছেন তার চেয়ে উত্তম জিনিস দিয়েছেন আমাকে, অথচ তোমরা তোমাদের উপঢৌকন নিয়ে উৎফুল্ল বোধ করছ।... তোমরা ওদের কাছে ফিরে যাও, আমি অবশ্যই ওদের বিরুদ্ধে এমন এক সৈন্যবাহিনী নিয়ে উপস্থিত হব, যা রুখবার শক্তি ওদের নেই। আমি ওদেরকে সেখান থেকে অপমান করে বের করে দেব ও ওদেরকে দলিত করব।’
সোলায়মান আরও বলল, ‘হে আমার পারিষদবর্গ। তারা আমার কাছে আত্মসমর্পণ করতে আসার পূর্বে তোমাদের মধ্যে কে তার সিংহাসন আমাকে এনে দেবে?’ এক শক্তিশালী জিন বলল, ‘আপনি আপনার স্থান থেকে ওঠার আগেই আমি তা এনে দেব। এ ব্যাপারে আমি এমন শক্তি রাখি। আর আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন।’ কিতাবের জ্ঞান যার ছিল সে বলল, ‘আপনি চোখের পলক ফেলার আগেই আমি তা এনে দেব। সোলায়মান যখন তা সামনে রাখা দেখল, তখন বলল, এ আমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ, যাতে তিনি আমাকে পরীক্ষা করতে পারেন, আমি কৃতজ্ঞ না অকৃতজ্ঞ। যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সে তা নিজের জন্য করে, আর যে অকৃতজ্ঞ সে জেনে রাখুক যে আমার প্রতিপালকের অভাব নেই, তিনি মহানুভব।’ সোলায়মান বলল, ‘তার সিংহাসনের আকৃতি বদলে দাও; দেখি সে ঠিক ধরতে পারে, নাকি ভুল করে।’ বিলকিস যখন পৌঁছাল, তখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, ‘তোমার সিংহাসন কি এ রকম?’ সে বলল, ‘এ তো এ রকমই। আমরা আগেই সবকিছু জেনেছি ও আত্মসমর্পণও করেছি।’ আল্লাহর পরিবর্তে সে যার পূজা করত, তা-ই তাকে সত্য থেকে সরিয়ে রেখেছিল, সে (বিলকিস) ছিল অবিশ্বাসী সম্প্রদায়ের একজন। তাকে বলা হলো, ‘এই প্রাসাদে প্রবেশ করো।’ যখন সে ওটার দিকে তাকাল, তখন তার মনে হলো এ এক স্বচ্ছ জলাশয় এবং সে তার কাপড় হাঁটু পর্যন্ত টেনে তুলল। সোলায়মান বলল, ‘এ তো স্বচ্ছ স্ফটিকের প্রাসাদ।’ (বিলকিস) বলল, ‘হে আমার প্রতিপালক। আমি তো নিজের ওপর জুলুম করেছিলাম। আমি সোলায়মানের সঙ্গে বিশ্বজগতের প্রতিপালকের কাছে আত্মসমর্পণ করছি।’ (সুরা নমল, আয়াত: ২২-৪৪)
নিজের সিংহাসন সোলায়মান (আ.)-এর দরবারে দেখে বিলকিস অবাক হবেন এবং ক্ষমতা দেখে তাঁকে নবী হিসেবে মেনে নিয়ে আনুগত্য করবেন। তাই তাঁকে পরীক্ষা করার জন্য সোলায়মান (আ.) কিছু নির্দেশনা দিলেন। বললেন, তাঁর সিংহাসনের ধরন পাল্টে দাও। এরপর দেখি, সে সত্য পথের দিশা পায়, নাকি যারা পথের দিশা পায় না তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়।
রানি বিলকিস আত্মসমর্পণের জন্যই এলেন। তাঁকে সিংহাসনটি দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করা হলো, ‘এটা কি আপনার সিংহাসন?’ তিনি বললেন, ‘তাই তো মনে হয়। আমরা আত্মসমর্পণ করতেই এসেছি।’ রানি বিলকিসকে প্রাসাদে আমন্ত্রণ জানিয়ে সোলায়মান (আ.) বললেন, ‘প্রাসাদে প্রবেশ করুন।’
প্রাসাদের মেঝে দেখে তিনি ভাবলেন সেটি স্বচ্ছ পানির হ্রদ। বিভ্রান্ত হয়ে পানি থেকে বাঁচানোর জন্য তিনি পায়ের গোছা থেকে কাপড় উঁচু করেন।
সোলায়মান (আ.) বললেন, ‘এটা স্বচ্ছ কাচের প্রাসাদ।’
রানি বিলকিস এসব পরীক্ষার মধ্য দিয়ে গিয়ে সোলায়মান (আ.)-এর অলৌকিক ক্ষমতা উপলব্ধি করলেন। তিনি আত্মসমর্পণ করলেন। বললেন, ‘হে আমার প্রতিপালক, আমি অবশ্যই নিজের প্রতি জুলুম করেছি। আমি সোলায়মানের সঙ্গে বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করছি।’