সিরাতে রাসুলের (সা.) অনালোচিত বিষয়: ৪

রাসুলুল্লাহ (সা.) কয়টি বাণিজ্য সফর করেছেন

রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর জীবদ্দশায় বিভিন্ন সময় বেশ কিছু দেশে বাণিজ্য সফরে গিয়েছেন। কিশোর বয়স থেকেই এমন বাণিজ্য সফরের অভিজ্ঞতা তাঁর আছে।

 কিশোর বয়সে প্রথম সফর

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বয়স তখন মাত্র ১২ বছর। কুরাইশদের একটি ব্যবসায়ী কাফেলার সঙ্গে শাম সফরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন আবু তালিব। সফরের কষ্ট এবং বিভিন্ন সমস্যার কথা চিন্তা করে বালক মুহাম্মাদকে এ সফরে সঙ্গে নিতে চাচ্ছিলেন না তিনি। (সীরাত বিশ্বকোষ, মাকতাবাতুল আযহার, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা: ২৩৩)

যাত্রা শুরুর মুহূর্তে প্রিয় চাচাকে জড়িয়ে ধরে রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘হে চাচা, কার কাছে ছেড়ে যাচ্ছেন আমাকে? আমার বাবাও নেই, মা-ও নেই।’ (মাহবুবে খোদা, মাহমুদ, পৃষ্ঠা: ৫২)

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর করুণ আবদার এড়াতে পারলেন না আবু তালিব। বাণিজ্য কাফেলায় শরিক করলেন ভাতিজাকে। যাত্রা হলো শুরু। শাম পানে চলল বাণিজ্য কাফেলা। (ঘটনাটি তিরমিজি শরিফের ৩,৬২০ নম্বর হাদিস বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ হাদিসের বিলাল (রা.)-এর কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। বিজ্ঞ মুহাদ্দিসিনের মতে, সে অংশটুকু সহিহ্ নয়।) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সামনে খুলে গেল অবাক করা এক নয়া পৃথিবীর দরজা। (আল্লাহর পরে শ্রেষ্ঠ যিনি, ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা: ৮৪-৮৫)

এটা ছিল রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনের প্রথম বাণিজ্য সফর। প্রথম বিদেশ ভ্রমণ। আবু তালিব সিরিয়ার বাণিজ্যের কাজ সমাপ্ত করে রাসুলুল্লাহকে (সা.) নিয়ে তাড়াতাড়ি মক্কায় ফিরে এলেন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, আবুল ফিদা হাফিজ ইবনে কাসীর আদ-দামেশকী (র.), ইসলামিক ফাউণ্ডেশন, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা: ৫১৭)

কোনো কোনো বর্ণনায় আছে, নিরুপায় হয়ে চাচা আবু তালিব রাসুলুল্লাহকে (সা.) অন্য একজন লোকের সঙ্গে দ্রুত মক্কায় ফেরত পাঠালেন। (যাদুল মাআদ, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা: ৭৫)

অলৌকিক নিদর্শন

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বয়স যখন ১৩ বা ১৪ বছর, তখন আরেকটি বাণিজ্য সফরে যাওয়ার বর্ণনা উল্লেখ করেছেন ইমাম ইবনে কাসির এবং ইমাম ইবনে জাওজি (রহ.)।

জুবাইর বিন আবদুল মুত্তালিবের সঙ্গে ইয়ামান অভিমুখে যাত্রা করা একটি ব্যবসায়ী সফরে অংশ নেন রাসুলুল্লাহ (সা.)। কাফেলার অনেক সদস্য সেই সফরে কিছু অলৌকিক নিদর্শন দেখেছেন বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, আবুল ফিদা হাফিজ ইবনে কাসীর আদ-দামেশকী (রহ.), ইসলামিক ফাউণ্ডেশন, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা: ২৫৮)

 

তরুণ বয়সের বাণিজ্য সফর

হিলফুল ফুজুল ও ফিজার যুদ্ধের মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) তার চাচা জুবাইরের সঙ্গে ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য ইয়েমেন সফর করেন।

এ বাণিজ্য সফরে যাত্রাকালে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বয়স ছিল আনুমানিক ১৮ বছর। সফরটি সম্ভবত কুরাইশদের রীতি অনুযায়ী শীতকালেই হয়েছিল। (মুসলিম উম্মাহর ইসিহাস বিশ্বকোষ, মাওলানা মুহাম্মাদ ইসমাইল রাইহান, অনুবাদ: রাইহান খাইরুল্লাহ, মাকতাবাতুল আযহার, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা: ১৯৮)

প্রসিদ্ধ বাণিজ্য সফর

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর একটি বাণিজ্য সফর ইতিহাসের পাতায় সবচেয়ে বেশি প্রসিদ্ধ। তাঁর বয়স যখন ২৫ বছর, তখন তিনি খাদিজার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে মাইসারাকে সঙ্গে নিয়ে বাণিজ্যিক সফরে যান। (তাবাকাতে ইবনে সাদ, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা: ১২৯)

এ বাণিজ্য সফরে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে যত পণ্য ছিল, সবই বুসরার বাজারে বিপুল লাভে বিক্রি হয়। সাধারণ ব্যবসায়ীদের যা লাভ হয়, সে তুলনায় তিনি দ্বিগুণ লাভ করলেন।

এত বিপুল পরিমাণ লাভ দেখে মাইসারা বলেছিলেন, ‘হে মুহাম্মাদ! আমরা তো দীর্ঘদিন ধরে খাদিজার পণ্যের ব্যবসা করছি, কিন্তু এত লাভ আমাদের কখনো হয়নি।’

তাঁর এ সফলতা নিঃসন্দেহে আল্লাহ প্রদত্ত বরকতের ফসল এবং তাঁর উত্তম আচরণ, সততা, বিচক্ষণতা, পরিশ্রম ও লেনদেনের পরিশুদ্ধতা অনুধাবনের ফলাফল ছিল। (দালায়িলুন নুবুওয়াহ, আবু নুআইম, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা: ১৭৩-১৭৪; সীরাত বিশ্বকোষ, মাকতাবাতুল আযহার, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা: ১৯৬)

সেই বাণিজ্য সফরে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রেও রাসুলুল্লাহ (সা.) একজন বিচক্ষণ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যবসায়ী হওয়ার প্রমাণ দিয়েছেন। তিনি এমন সব প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী ক্রয় করে আনলেন, মক্কায় যার চাহিদা ছিল। সেসব বিক্রি করেও বিপুল পরিমাণ মুনাফা অর্জিত হয়। (প্রাগুক্ত: খণ্ড ১, পৃষ্ঠা: ১৯৬)

জুরাশের বাণিজ্য সফর

রাসুলুল্লাহ (সা.) খাদিজা (রা.)–র ব্যবসায়িক পণ্য নিয়ে দুইবার জুরাশে বাণিজ্য সফর করেছেন। (মুসতাদরাক, আল হাকেম, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা: ১৮২)

জুরাশ ইয়ামানের প্রাচীন একটি শহর। পঞ্চম ও ষষ্ঠ হিজরি শতাব্দী পর্যন্ত এটি ছিল জনবসতিপূর্ণ নগর। ইসলামের প্রাথমিক যুগে কামান ও দাব্বাহ তৈরির জন্য অঞ্চলটি বিখ্যাত ছিল। রাসুল (সা.)-এর নির্দেশে খালিদ বিন সাঈদ বিন আস (রা.) জুরাশ থেকে একটি দাব্বাহ এনেছিলেন, তায়িফ অবরোধের সময় যা ব্যবহার করা হয়। (সীরাত বিশ্বকোষ, মাকতাবাতুল আযহার, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা: ২৯৮-২৯৯)

অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য সফর

রাসুলুল্লাহ (সা.) মক্কার উপকণ্ঠে তিহামার হুবাশা বাজারেও বাণিজ্য সফর করেছেন।

হাকিম বিন হিজাম (রা.) বর্ণনা করেছেন, ‘রাসুলুল্লাহকে (সা.) আমি হুবাশার বাজারে দেখেছি এবং তাঁর কাছ থেকে তিহামার একটি কাপড় কিনেছি। ওই সময় তার সঙ্গে কুরাইশের আরও একজন ব্যক্তি ছিলেন।’ (দালায়িলুন নুবুওয়াহ, আবু নুআইম, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা: ৬৮; মুজামু মাসতাজাম, খণ্ড ২. পৃষ্ঠা: ৪১৮; তারীখে তাবারি, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা: ৩৫-৩৬)

 

আপনি তো আমাদের এলাকার নাম আমাদের চেয়েও বেশ ভালো জানেন

নবম হিজরিতে বাহরাইন থেকে আগত আবদুল কাইস প্রতিনিধিদলের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে গিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) ওই এলাকার নানা স্থানের নাম বলছিলেন।

প্রতিনিধিদলে আশাজ আবদুল কাইস (রা.) ছিলেন। তিনি ছিলেন সম্প্রদায়ের সরদার। বিস্ময় প্রকাশ করে তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আপনার ওপর আমার মাতা-পিতা কোরবান হোক। আপনি তো আমাদের এলাকার নাম আমাদের চেয়েও বেশ ভালো জানেন।’

রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘তোমাদের এলাকা আমার ভালো করে দেখা আছে।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ১৫,৫৫৯, ১৭,৮৩১)

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বাণিজ্য সফর নিয়ে অধ্যাপক আফজালুর রহমান মুহাম্মাদ আ ট্রেডার বইয়ে লিখেছেন, ‘খাদিজার ব্যবসায়িক প্রতিনিধি হিসেবে রাসুলুল্লাহ (সা.) বেশ কয়েকবার আরব উপদ্বীপের পূর্বে সিরিয়া, জোরাশ এবং বাহরাইনের বাণিজ্য সফরে নেতৃত্ব দিয়েছেন। নবুওয়াতের আগে ও পরের সময় মিলিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রায় ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ব্যবসা-বাণিজ্যে সক্রিয় ছিলেন, এই সময়ে তিনি ইয়েমেন, সিরিয়া, বসরা, ইরাক, জর্দান এবং আরব উপদ্বীপের বাণিজ্য শহরগুলোতে অত্যন্ত পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছিলেন। খাদিজার কারবার করার আগেও তিনি প্রায়ই বাণিজ্য সফরে যেতেন। যেমন—তিনি সিরিয়া ও ইয়েমেনের বসরা শহরে গিয়েছিলেন। এ ছাড়া বাহরাইন ও আবিসিনিয়াতেও বেশ কয়েকটি বাণিজ্য সফর করেছেন রাসুলুল্লাহ (সা.)।’

অধ্যাপক আফজালুর রহমান আরও লিখেছেন, ‘৩০ বছর বয়সে তিনি আরবের অন্য ব্যবসায়ীদের মতো ব্যাপকভাবে বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েন। বিয়ের পর তিনটি বাণিজ্য সফরের বর্ণনার কথা ইতিহাস থেকে জানা যায়—প্রথমটি ইয়ামানে, দ্বিতীয়টি নজদে এবং তৃতীয়টি নাজরানের বাণিজ্য সফর হিসেবে পরিচিত। আরও জানা যায়—ব্যবসায়িক এসব সফর ছাড়াও হজের মৌসুম, বিভিন্ন উৎসব এবং জুল-মাজাজ ও উকাজমেলার সময়ও ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন রাসুলুল্লাহ (সা.)।’

মিরাজ রহমান: লেখক