
‘কেন সর্বশেষ রিসালত মক্কায়?’ সিরাত সাহিত্যে জীবনীকারগণ প্রশ্নটি তুলেছেন। ড. রাগিব সারজানি বলছেন, এ প্রশ্নটি দিয়ে শুরু করি ‘কেন রাসুল (সা.) পারস্য কিংবা রোম বা অন্যান্য নবীদের মতো ফিলিস্তিনে; অথবা মুসা (আ.)-এর মতো মিশরে প্রেরিত হননি? কেনই-বা মক্কায় ওহি অবতরণের শুরু?
অথচ নবী জীবনের ঘটনাবলি মদিনা, তায়েফ ও আরব উপদ্বীপের অন্যান্য প্রান্ত ছুঁয়ে প্রবাহিত? আমরা জানতে চাই যে সর্বশক্তিমান কেন এই সফল প্রকল্পের (ইসলাম) ভিত্তি স্থাপনের জন্য এই উপত্যকাটি বেছে নিয়েছিলেন? এই জায়গার বৈশিষ্ট্যগুলি কী কী? তার ভৌগলিক অবস্থান ও প্রকৃতি কী?
একদিকে রোমান আরেকদিকে পারস্য সভ্যতা থেকে ঐ ভূখণ্ডটুকু সাংস্কৃতিকভাবে ছিল আলাদা ও ভিন্ন। তাই এ সুযোগ থাকল না যে কেউ বলবে মুহাম্মদ (সা.) পারস্য কিংবা রোমান সভ্যতার দর্শনে প্রভাবিত হয়ে কিছু রদ-বদলের মাধ্যমে ইসলামের কাঠামো দাঁড় করিয়েছেন।
অন্যদিকে আরব উপদ্বীপে একটি সাংস্কৃতিক উত্থান এবং সফলতা অর্জনের পরিবেশ ও পরিস্থিতি পূর্ণমাত্রায় বিরাজমান ছিল। বাস্তবেও স্বল্পতম সময়ে ইসলাম এই কেন্দ্র থেকে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে।
যে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রাখে, হয়তো তার উপলব্ধির মধ্যে একটি ত্রুটি ও খুঁত রয়ে গেছে, সে সেই ব্যক্তি থেকে ঘনিষ্ঠ, যে অন্য কোনও ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস রাখে কিংবা আদৌ কোনো ঈশ্বরের অস্তিত্বেই বিশ্বাস করে না।
ফিলিস্তিনে ইসাসহ (আ.) অসংখ্য নবীর কেন্দ্র ভূমি ছিল; কিন্তু এই বার্তা ফিলিস্তিনে না গিয়ে মক্কায় হওয়ায় কেউ দাবি করতে পারছে না যে রাসুল (সা.) তাওরাত ও ইঞ্জিল মিশ্রিত করে কিংবা কিছুটা বিকৃত করে বা পরিবর্তন করে ইসলাম তৈরি করেছেন।
তা ছাড়া মিশরে মুসা (আ.), ভারতে বৌদ্ধ আর ইরানে জরোস্টার ধর্মচর্চার উপস্থিতির কারণে জাজিরাতুল আরবে (আরব উপদ্বীপ) একটি মৌলিক শূন্যতা ছিল; বরং আল্লাহর পরিচয় ও তাঁর প্রতি ইমান এখানে কিছুটা রয়ে গিয়েছিল।
যে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রাখে, হয়তো তার উপলব্ধির মধ্যে একটি ত্রুটি ও খুঁত রয়ে গেছে, সে সেই ব্যক্তি থেকে ঘনিষ্ঠ, যে অন্য কোনও ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস রাখে কিংবা আদৌ কোনো ঈশ্বরের অস্তিত্বেই বিশ্বাস করে না। নবীজির জন্য মক্কাকে বাছাইকরণের মধ্য দিয়ে আল্লাহ ধর্মীয় দাওয়াতে ঘনিষ্ঠতার তারতম্যে নিকটজনকে অগ্রগণ্য করার ধারাবাহিকতা অনুসরণের শিক্ষা দিয়েছেন।’ (ইসলাম স্টোরি ডটকম প্রকাশিত লিমাযা মাক্কা অবলম্বনে)
জাজিরাতুল আরব ও বৃহত্তর শাম বা সিরিয়ার কোনো কোনো স্থানে অচেতন জড় পদার্থের সামনে মানুষের মস্তক অবনত না করা বিবেকবুদ্ধির অধিকারী একটি ক্ষুদ্র অংশ টিকে ছিল। বিশেষত মক্কায় রাসুল (সা.)-এর নবুয়তপ্রাপ্তির অল্পকাল পূর্বেই চক্ষুবিশিষ্ট বুদ্ধিমান ব্যক্তিদের একটি ক্ষীণ রেখা লক্ষ করা যায়। তাদের অন্তরে প্রতিমা পূজা দূষণীয় হওয়ার ধারণা উদ্রেক হয়েছিল।
ইবনে ইসহাক লিখেছেন, ‘একদিন কোন একটি প্রতিমার বার্ষিক মেলায় ওয়ারাকা ইবনে নওফেল, আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ, ওসমান ইবনে হুয়াইরিস এবং জায়েদ ইবনে আমর ইবনে নুফাইল অংশগ্রহণ করেন। এ মেলাতেই প্রতিমাপূজার আনুষঙ্গিক বিভিন্ন ক্রিয়াকাণ্ড দেখে তাদের অন্তরে এরূপ কল্পনার উদয় হল যে আমরা একটি পাথরের সামনে মাথা নত করে যা কিছু করি বা বলি, তা কি দেখার বা শোনার ক্ষমতা এই প্রস্তর মূর্তিটার রয়েছে? উপরন্তু কারও কোনো ক্ষতি বা উপকার করার ক্ষমতাও তো তার নেই।’
উক্ত চারজনের সকলেই কোরাইশের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। ওয়ারাকা ছিলেন খাদিজা (রা.)-এর চাচাত ভাই। জায়েদ ছিলেন ওমর (রা.)-এর চাচা। আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ হামজার ভাগিনা আর ওসমান হলেন আবদুল ওজ্জার পৌত্র।
একবার রাসুল (সা.) তার কবিতায় মোহিত হয়ে একশটির মতো কবিতার আবৃতি শুনেছিলেন এবং মন্তব্য করেছিলেন ‘উমাইয়া প্রায় মুসলিম হয়ে গিয়েছিল।’
ইবরাহিম (আ.)-এর প্রচারিত ধর্মের সন্ধানে জায়েদ সিরিয়ায় গিয়ে সেখানকার ইহুদি ও খ্রিষ্টান পাদ্রীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। কিন্তু কারো কথায় তৃপ্ত না হয়ে নিজেই ‘আমি ইবরাহিমের ধর্মমত গ্রহণ করলাম’ ঘোষণা দেন। আসমা বিনতে আবু বকর (রা.) বলেন, আমি জায়েদকে কাবাগৃহে হেলান দিয়ে কোরাইশদের সম্বোধন করে বলতে শুনেছি, ‘তোমাদের মধ্যে আমি ব্যতীত কেউ ইবরাহিমের ধর্মমতে প্রতিষ্ঠিত নেই।’
তিনি কন্যা শিশুর জীবন্ত প্রোথিত করার কুসংস্কারের বিরোধিতা করতেন এবং সেই সব কন্যাদের চেয়ে নিয়ে নিজে লালনপালন করতেন। তিনি রাসুলের সাহচর্য পেয়েছিলেন। বাকি তিনজন প্রতিমাপূজা ত্যাগ করে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। ওয়ারাকা মক্কায় বসবাস করতেন এবং রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল।
আরবে আরো কিছু দিব্য দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তির জন্ম হয়েছিল, যাঁরা প্রতিমাপূজা থেকে তওবা করেছিলেন। তম্মধ্যে আরবের নামকরা বক্তা কায়িস ইবনে সা’য়িদাতুল আয়িদি অন্যতম। সাহিত্য ও বক্তৃতামালার গ্রন্থসমূহে উল্লেখ আছে যে তিনি আরবের ওকাজ বাজারে যে বিখ্যাত বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তা রাসুল (সা.) শুনেছিলেন।
আরেকজন কায়িস ইবনে নাশাবা যিনি জাহিলি যুগে তওহিদবাদী হয়ে গিয়েছিলেন। রাসুলের নবুয়তপ্রাপ্তির পর ইসলাম গ্রহণ করেন। আরবের খ্যাতনামা কবি এবং তায়েফের গোত্রপ্রধান উমাইয়া ইবনে আবু সলত প্রতিমাপূজার কঠোর বিরোধিতা করতেন। তিনি আসমানি কিতাব পড়েছিলেন এবং ইবরাহিম (আ.)-এর ধর্মমত গ্রহণ করেছিলেন।
একবার রাসুল (সা.) তার কবিতায় মোহিত হয়ে একশটির মতো কবিতার আবৃতি শুনেছিলেন এবং মন্তব্য করেছিলেন ‘উমাইয়া প্রায় মুসলিম হয়ে গিয়েছিল।’ (আল্লামা শিবলি নোমানির সিরাতুন্নবি অবলম্বনে)
পূর্ববর্তী কিতাবে নবীজির নাম, বংশ, শারীরিক গঠন, চারিত্রিক মাধুর্য বিধৃত ছিল। তাঁর জন্মস্থান আর হিজরতের ভূমি উল্লেখ ছিল। আহলে কিতাবের (ইহুদি ও খ্রিষ্টান) কাছে নবীজির পরিচয় নিজেদের সন্তানের চেয়েও বেশি সুস্পষ্ট ছিল।
তারা মদিনায় বসতি গেড়েছিল এ আশায় যে তিনি তাদের মধ্য থেকে আসবেন। তারা যুদ্ধ জয়ে নবীজিকে অসিলা করে আল্লাহর নিকট সাহায্য চাইতো! মদিনার আকাশে ‘আহমদ’ নামে এক তারকা উদয়ের ঘোষণা দিয়ে নবীজির জন্ম সুসংবাদ দিয়েছিল ইহুদিরা। জাজিরাতুল আরবের দিকে-দিকে এক নবীর আগমনের যেন অপেক্ষা!
মক্কার এক যুবক আবু বকর (রা.) তাঁর খোঁজে সিরিয়া সফর করেছে, অথচ আল্লাহ তাআলার মনোনয়নে সেই ঠিকানা মক্কার উপত্যকা! একজন নবীর ঘোষণার ঐশ্বরিক মনোনীত স্থান মক্কা ইতোমধ্যে চূড়ান্তভাবে প্রস্তুত। সাফা পাহাড়ের পাদদেশে সে ঘোষণা হলো। প্রভাবশালীদের চোখ ছানাবড়া! ঘরে-বাইরে পুরোহিতদের তীব্র প্রতিবাদ।
এ কোরআন কেন অবতীর্ণ করা হল না দু’টি জনপদের কোনো প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তির ওপর?কোরআন, সুরা যুখরুফ, আয়াত: ৩১
আবু লাহাব চেঁচিয়ে উঠল। মক্কা ও তায়েফের সম্মানিতদের চেহারা মলিন। তাদের আলাপ বেশ উপভোগ্য, তারা বলেন, ‘এ কোরআন কেন অবতীর্ণ করা হল না দু’টি জনপদের কোনো প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তির ওপর?’ (সুরা যুখরুফ, আয়াত: ৩১)
দু’টি জনপদ বলতে মক্কা ও তায়েফ। আর প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তি বলতে মক্কার অলিদ ইবনে মুগিরা আর তায়েফের উরওয়া ইবনে মাসউদ সাকাফি। তাদের পূর্ব থেকেই প্রভাব-প্রতিপত্তি ও বিত্ত-বৈভব ছিল।
তাদের যুক্তি কোরআন যদি অবতীর্ণ হত, তবে দুটি শহরের মধ্য থেকে এ রকম কোনো ব্যক্তির উপর অবতীর্ণ হত, মুহাম্মদের ওপর নয়, যার ঘর পার্থিব ধন-সম্পদ থেকে শূন্য এবং যে তার জাতির নেতৃত্ব ও সর্দারির পদেও প্রতিষ্ঠিত নয়।
অথচ কাকে নবী বানানো যাবে, এ সিদ্ধান্ত একমাত্র আল্লাহর হাতে। তিনি জানেন মক্কায় না তায়েফে, ফিলিস্তিনে না মদিনায়; কোনো জননেতা, নাকি অনাথ সন্তানকে মনোনীত করবেন। তিনিই ভালো জানেন, এ মহান পদের যোগ্যতম ব্যক্তি কে।
‘আর যখন তাদের কাছে কোনো নিদর্শন আসে তখন তারা বলে, আল্লাহর রাসুলগণকে যা দেওয়া হয়েছিল আমাদেরকেও তার অনুরূপ না দেওয়া পর্যন্ত আমরা কখনো ইমান আনব না। আল্লাহ তার রিসালত কোথায় অর্পণ করবেন তা তিনিই ভাল জানেন। (সুরা বাকারা, আয়াত: ১২৪)
রাগিব সারজানি বলছেন, আমরা জানি যে এ স্থানটি (মক্কা) বাছাইয়ের পিছনে পুরো রহস্য জ্ঞান কেবল আল্লাহু মহান ছাড়া আর কেউ জানেন না।
ড. মুহাম্মদ তাজাম্মুল হক : অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়