মহানবী (সা.)-এর জীবন ধৈর্য ও দৃঢ়তার অনন্য দৃষ্টান্ত। আল্লাহ তাআলা তাঁকে তাঁর সৃষ্টির মধ্যে সর্বোচ্চ মর্যাদা দিয়েছেন, তবু তিনি জীবনে বহুবার কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখী হয়েছেন।
আমরা তাঁর জীবনের চারটি উল্লেখযোগ্য পরীক্ষা নিয়ে আলোচনা করব, যা তাঁকে মানসিকভাবে আরও শক্তিশালী করেছে এবং তাঁর নবুওয়াতের মহান দায়িত্ব পালনে প্রস্তুত করেছে।
নবীজি জন্মগ্রহণ করেছিলেন একজন অনাথ হিসেবে। তাঁর পিতা আবদুল্লাহ তাঁর জন্মের আগেই মৃত্যুবরণ করেন। এরপর মা আমিনা মারা যান শৈশবেই। এটা ছিল তাঁর জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষা।
তবে এই পরীক্ষা তাঁর জন্য একটি আশীর্বাদ হিসেবে কাজ করেছে। অনাথ হওয়া তাঁকে মানসিকভাবে শক্তিশালী করেছে, যা নবুওয়াতের মহান দায়িত্ব পালনে তাঁর জন্য জরুরি ছিল (ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন নববিয়্যাহ, অনুবাদ: মুহাম্মদ আবদুল হাই, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা: ২০০৪, ১/৭২-৭৪)।
সবচেয়ে বড় পুরস্কার সবচেয়ে বড় পরীক্ষার সঙ্গে আসে। যখন আল্লাহ কোনো কওমকে ভালোবাসেন, তিনি তাঁদের পরীক্ষা করেন।সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ২,৩৯৬
এই পরীক্ষা তাঁর মধ্যে সহানুভূতি ও মানবিক গুণাবলিও জাগ্রত করেছে। তিনি নিজে দুঃখ-কষ্টের মধ্য দিয়ে গিয়েছিলেন বলেই অন্যের দুঃখ বুঝতে পারতেন। এটি ছিল তাঁর নেতৃত্বেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক, যা তাঁকে মানুষের হৃদয় জয় করতে সহায়তা করেছে।
নবীজি (সা.)-এর জীবনে প্রিয়জনের মৃত্যু ছিল আরেকটি বড় পরীক্ষা। কৈশোরের আশ্রয় চাচা আবু তালিব এবং পরবর্তী সময়ের নির্ভরতা স্ত্রী খাদিজা (রা.) একই বছরে মারা যান, যা তখন ‘দুঃখের বছর’ (আমুল হুজন) নামে পরিচিত হয়।
আবু তালিব নবীজিকে মক্কার কুরাইশদের নিপীড়ন থেকে সুরক্ষা দিয়েছিলেন এবং খাদিজা ছিলেন তাঁর আর্থিক সমর্থনের একটি শক্তিশালী স্তম্ভ। এ ছাড়া সন্তানদের মধ্যে ফাতিমা (রা.) ছাড়া সবাই তাঁর জীবদ্দশায় মারা যান (ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, অনুবাদ: মুহাম্মদ আবদুর রশিদ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা: ২০১২, ৩/১৫৫-১৫৭)।
এই কঠিন সময়েও নবী (সা.) ধৈর্য ও আল্লাহর ওপর ভরসার একটি অসাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। শেষ সন্তান ইব্রাহিমের মৃত্যুতে তিনি বলেছিলেন: ‘চোখ অশ্রু ফেলে, হৃদয় দুঃখ অনুভব করে। আমরা এমন কিছু বলব না যা আমাদের প্রভুকে অসন্তুষ্ট করবে। হে ইব্রাহিম, তোমার বিদায় আমাদের খুব কষ্ট দিয়েছে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৩১৫)।
আমি আশা করি, আল্লাহ তাদের বংশ থেকে এমন লোক সৃষ্টি করবেন, যারা একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তার সঙ্গে কাউকে শরিক করবে না।সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩,২৩১)
আবু তালিব ও খাদিজা (রা.)-এর মৃত্যুর পর তিনি তায়েফে গিয়েছিলেন ইসলামের দাওয়াত দিতে; কিন্তু সেখানকার লোকেরা
তাঁকে পাথর ছুড়ে আহত করে।এমনকি জিব্রাইল (আ.) তাঁকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে তিনি যদি চান, তায়েফের লোকদের ধ্বংস করে দেবেন; কিন্তু নবীজি (সা.) বলেছিলেন, ‘বরং আমি আশা করি, আল্লাহ তাদের বংশ থেকে এমন লোক সৃষ্টি করবেন, যারা একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তার সঙ্গে কাউকে শরিক করবে না’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩,২৩১)।
মদিনায় হিজরতের পরও নবী (সা.)-এর পরীক্ষা শেষ হয়নি। উহুদের যুদ্ধে তিনি মাথায় আঘাত পান এবং তাঁর সামনের দাঁত ভেঙে যায়। তাঁর শত্রুদের আক্রমণের সময় তিনি রক্ত মুছে বলেছিলেন: ‘যদি আমার রক্তের এক ফোঁটা পৃথিবীতে পড়ে, তবে এই কাফিররা আল্লাহর ইচ্ছায় ধ্বংস হবে।’
তিনি বলেন: ‘আমি অভিশাপ দিতে আসিনি, আমি রহমত হিসেবে প্রেরিত হয়েছি। হে আল্লাহ, আমার কওমকে হিদায়াত দাও।’
উমর (রা.) তাঁকে তাদের ওপর অভিশাপ দেওয়ার পরামর্শ দিলেন। তিনি বলেন: ‘আমি অভিশাপ দিতে আসিনি, আমি রহমত হিসেবে প্রেরিত হয়েছি। হে আল্লাহ, আমার কওমকে হিদায়াত দাও’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ৩,০০৪)।
নবীজির (সা.)-এর জীবনের এই পরীক্ষাগুলো আমাদের শেখায় যে, কষ্ট ও পরীক্ষা আল্লাহর ভালোবাসার নিদর্শন।
তিনি বলেছেন, ‘সবচেয়ে বড় পুরস্কার সবচেয়ে বড় পরীক্ষার সঙ্গে আসে। যখন আল্লাহ কোনো কওমকে ভালোবাসেন, তিনি তাঁদের পরীক্ষা করেন। যে এটি গ্রহণ করে, সে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করে; আর যে এতে অসন্তুষ্ট হয়, সে তাঁর ক্রোধের সম্মুখীন হয়’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ২,৩৯৬)।