মসজিদে নববীর সবুজ গম্বুজ, যার তলে শুয়ে আছেন মহানবী মুহাম্মদ (সা.)
মসজিদে নববীর সবুজ গম্বুজ, যার তলে শুয়ে আছেন মহানবী মুহাম্মদ (সা.)

রকিব হাসানের লেখা

আরবের অন্ধযুগ ও মহানবী স. এর আগমন

সদ্য প্রয়াত তিন–গোয়েন্দার অমর লেখক রকিব হাসান মহানবীর (সা.) জীবনীর একটি অংশ লিখেছিলেন, যা ২০১২ সালে মাসিক রহমত পত্রিকার ‘সিরাতুন্নবী’ সংখ্যায় মুদ্রিত হয়। ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, প্রিয় পাঠক, এতদিন শুধু রহস্য, অ্যাডভেঞ্চার, সাইন্স ফিকশন আর ভূতের গল্প লিখেছি। সম্পাদক মনযুর আহমাদ আমাকে মহানবী (স)-কে নিয়ে লেখার অনুরোধ করলেন। থমকে গেলাম। আমি কি পারব? দ্বিধাদ্বন্দ্ব করতে করতে শেষে সাহস করে লিখেই ফেললাম। মহানবী (স)-কে নিয়ে এটাই আমার প্রথম লেখা। ভুলভ্রান্তি থাকতে পারে। তাই, আমার এই লেখাটিকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখলে বাধিত হব। আপনাদের সহযোগিতা ও উৎসাহ পেলে অবশ্যই আমাদের প্রিয় নবীকে নিয়ে ভবিষ্যতে আরও লেখার প্রেরণা পাব।—রকিব হাসান। দীর্ঘ লেখাটি মাসিক রহমত সম্পাদকের অনুমতিক্রমে প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য পুনরায় প্রকাশ করা হল।

ইসলাম-পূর্ব সময়ে এক ভয়ঙ্কর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছিল যেন আরবরা। সমগ্র আরব জুড়ে চলছিল ভয়ানক অরাজকতা। গোত্রে গোত্রে শত্রুতা। সারাক্ষণ একে অন্যের ক্ষতি করার চেষ্টায় রত। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটি, মারামারি থেকে শুরু করে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া। বছরের পর বছর ধরে সেই যুদ্ধ চলা।

কত তুচ্ছ ঘটনা থেকে যুদ্ধের সূত্রপাত হতো, তার একটা উদাহরণ দেয়া যাক। একদিন এক বিদেশী পথিক ক্ষুধাতৃষ্ণায় কাতর হয়ে বসুস নামে এক বুড়ির মেহমান হলো। পথিকের উটটা গা চুলকানোর জন্য কুলায়ব নামে এক লোকের বাগানে ঢুকে একটা গাছের সঙ্গে গা ঘষতে লাগল। তাতে গাছের ওপরের একটা পাখির বাসা থেকে একটা ডিম মাটিতে পড়ে ভেঙে গেল।

পাখির চিৎকারে কি হয়েছে, দেখতে এসে প্রচণ্ড রেগে গিয়ে তীর মেরে উটাকে জখম করল কুলায়ব, আর চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘কার এত্তবড় সাহস যে আমার আশ্রিত পাখির ডিম ভেঙে পাখিকে কষ্ট দেয়?’ বসুসও কম যায় না। সে-ও সমান তেজে জবাব দিল, ‘আমার মেহমানের উটকে জখম করে তাঁকে অপমানিত করে আমাকেও অপমান করা হয়েছে। আমি অবলা নারী। দুনিয়ায় আপন বলতে আমার কেউ নেই। আমার এই অপমানের প্রতিশোধ নেয়ার মত কোন পুরুষ মানুষ কি নেই?’

বুড়ির কথা শুনে রেগে গেল তার এক আত্মীয়। সে এসে কুলায়বকে মেরেই ফেলল। ব্যস, শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ, কারণ কুলায়ব আর বুড়ির আত্মীয় দুজন দুই গোত্রের লোক। একজন বনু বকর গোত্রের, অন্যজন বনু তাগলব গোত্রের। আশি বছর ধরে চলল এই বিবাদ।

সামান্য কারণে এমন বিবাদ আরও বহু সংঘটিত হয়েছে তৎকালীন আরবে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বলতে তখন কিছুই ছিল না সেখানে। আরবের বেশিরভাগ গোত্রের মানুষই লুটতরাজ আর চুরি করে জীবিকা নির্বাহ করত। সুযোগ পেলেই এক গোত্র আরেক গোত্রের ধন-সম্পদ, গৃহপালিত পশু, এমনকি মেয়েদেরকেও লুট করে নিয়ে যেত, তারপর সেসব মেয়েদের হয় নিজেরা বিয়ে করত কিংবা দাসী-বাঁদী হিসেবে বিক্রি করে দিত।

ডাকাতরা বনে-জঙ্গলে, পর্বতের গুহায় লুকিয়ে থাকত। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় নিরীহ পথিক ও ব্যবসায়ীদের কাফেলা আক্রমণ করে তাদের সর্বস্ব ছিনিয়ে নিত, তাদের খুন করে লাশ ফেলে রাখত শিয়াল-শকুনে খাওয়ার জন্য। তাদের মধ্যে যে যত বড় ডাকাত, সে তত বড় বীর-বাহাদুর বলে বিবেচিত হত।

অনাচার করতে করতে তাদের অন্তর হয়ে গিয়েছিল ভয়ানক নিষ্ঠুর, মায়া–মমতাহীন। জ্যান্ত উট কিংবা দুম্বার গা থেকে মাংস কেটে নিয়ে কাবাব বানিয়ে খেত।

অনাচার করতে করতে তাদের অন্তর হয়ে গিয়েছিল ভয়ানক নিষ্ঠুর, মায়া–মমতাহীন। জ্যান্ত উট কিংবা দুম্বার গা থেকে মাংস কেটে নিয়ে কাবাব বানিয়ে খেত। বেচারা অসহায় প্রাণীগুলো যন্ত্রণায় ছটফট করে রক্তপাতে মারা যেত, তাতে ভ্রূক্ষেপও করত না ওইসব আরবরা। জ্যান্ত পশুকে গাছে বেঁধে তার ওপর তীর ছোঁড়া চর্চা করত। যুদ্ধে বন্দি অন্তঃসত্ত্বা মেয়েদের পেট কেটে বাচ্চা বের করে মেরে ফেলত।

শত্রুকে শাস্তি দিতে নানারকম নিষ্ঠুর উপায় বের করত। দুটো চারাগাছ বাঁকিয়ে এনে, দুই গাছে শত্রুর দুই পা বেঁধে আচমকা গাছ দুটোকে ছেড়ে দিত। গাছ দুটো সজোরে সোজা হওয়ার সময় এমন টান লাগত, শত্রুর দেহটা দুই পায়ের মাঝখান থেকে ফেঁড়ে গিয়ে দুই ভাগ হয়ে যেত। মানবদেহের সেসব খণ্ডাংশ গাছেই ঝুলে থাকত, পচে গিয়ে শেষ না হওয়া পর্যন্ত।

মেয়েদের শাস্তি দিতে হলে তার পা ঘোড়ার লেজের সঙ্গে বেঁধে পাথুরে জায়গার ওপর ছুটিয়ে দিত। অসহ্য যন্ত্রণা পেয়ে ক্ষতবিক্ষত হয়ে মারা যেত সেসব মেয়ে। ধনী লোককে কবর দেয়ার পর তার কবরের পাশে উট বেঁধে রাখত। খাবার-পানি না পেয়ে তিলে তিলে ওখানেই মারা যেত উটটা। লোকের বিশ্বাস ছিল পরকালে এই উট মৃত লোকটার বাহন হবে।

ব্যভিচার আর মেয়েদের প্রতি অন্যায় করার প্রবণতা ঢুকে গিয়েছিল সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। যিনা করাকে হারাম ভাবা তো দূরের কথা, সেটাকে গোপন না করে বরং গর্ব করে প্রচার করত। কাউকে ধর্ষণের পর প্রকাশ্য সভায় নিজের বদমাশিকে ফলাও করে বর্ণনা করে আত্মতৃপ্তি লাভ করত।

কিন্দা রাজ্যের যুবরাজ ইমরুল কায়েস কিন্দিকে তৎকালীন আরবের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি মনে করা হত। সে তার ফুফাত বোন ও অন্যান্য যে সব মহিলার সঙ্গে কুকর্ম করেছে, সেগুলো তার নিজের রচিত ‘কাসিদায়ে লামিয়া’ কবিতায় বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছে। গভীর রাতে দারোয়ানের চোখে ধুলো দিয়ে কিভাবে ঘরে ঢুকে কাকে ধর্ষণ করেছে, কোথায় বিবস্ত্র হয়ে গোসলরত মেয়েদের কাপড়চোপড় নিয়ে গাছে উঠে বসে থেকেছে, উলঙ্গ যুবতী মেয়েরা তার কাছ থেকে কিভাবে কাপড়গুলো উদ্ধার করেছে, শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে থাকা মা কিংবা গর্ভবতী মহিলারা তার ইশারায় কিভাবে নিজেদেরকে তার কাছে বিলিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে, এ সব কাহিনী বিস্তারিত লেখা রয়েছে তার কবিতায়।

আরবের তৎকালীন খ্যাতনামা কবিদের কবিতা প্রতিযোগিতায় এই কবিতাটি প্রথম স্থান অধিকার করেছিল। কবির সম্মানে তাই কবিতাটি পবিত্র কাবার দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। লোকে এই কবিতা আবৃত্তি করে আনন্দ পেত।

রকিব হাসান

সেই ভয়ঙ্কর অন্ধকার যুগে মেয়েরা ছিল চরম অসহায়, অবহেলা, নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতার শিকার। যা ইচ্ছে করা হতো তাদের নিয়ে। বিয়ের স্বাভাবিক প্রচলিত নিয়ম ছাড়াও আর কয়েক ধরনের অস্বাভাবিক বিবাহপ্রথা চালু ছিল। যেমন, স্বাস্থ্যবান সন্তান লাভের আশায় স্বামী তার নিজের স্ত্রীকে কোনও বলিষ্ঠ পুরুষের সঙ্গে দৈহিক মিলনের অনুমতি দিত। এই অনুমতিকে ‘বিয়ে’ বলা হতো। ওই স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা না হওয়া পর্যন্ত এ বিয়ে স্থায়ী হতো।

আবার, মেয়ে বিয়ের উপযুক্ত হলে তাকে কয়েকজন যুবকের সঙ্গে দৈহিক মিলনের অনুমতি দেয়া হতো। নিয়ম ছিল এই যুবকদের সংখ্যা দশজনের বেশি হতে পারবে না। মিলিত হওয়ার পর মেয়েটি গর্ভবর্তী হয়ে সন্তান প্রসব করলে সেই যুবকদের ডেকে আনা হতো। মেয়েটি যে যুবককে তার সন্তানের পিতা বলে চিহ্নিত করত—সে পিতা হোক বা না হোক, তার সঙ্গেই মেয়েটির বিয়ে দেয়া হত। এটাও এক ধরনের বিয়ে।

আরেক ধরনের বিয়ে ছিল পতিতার সঙ্গে বিয়ে। কোনও পতিতার বাচ্চা হলে সেই বাচ্চার চেহারার সঙ্গে যে পুরুষমানুষের মিল থাকত, তাকেই শিশুর বাবা বলে চিহ্নিত করা হতো, লোকটা তখন ওই পতিতাকে বিয়ে করতে বাধ্য হতো। আর এই চিহ্নিত করার কাজটা যে করত, তাকে বলা হতো কিয়াফা-শেনাস।

এই অসভ্য আরবরাও কাবাঘরকে পবিত্র বিবেচনা করে হজ করাকে পুণ্যের কাজ বলে মনে করত। লজ্জা বলতে কিছু ছিল না ওদের। একমাত্র কুরায়শ বংশীয়রা ছাড়া বাকি সবাই উলঙ্গ হয়ে কাবাঘর তাওয়াফ করত। মহিলারাও এর ব্যতিক্রম ছিল না। খোলা জায়গায় উলঙ্গ হয়ে গোসল করত এইসব লোকেরা। পিতার মৃত্যুর পর সৎমাকে জোর করে বিয়ে করত। যুদ্ধে পরাজিত শত্রুপক্ষের মেয়েদের ধর্ষণ করত। সেই বিবরণ আবার কবিতা লিখে গর্বের সঙ্গে পাঠও করত।

কন্যাসন্তানকে বোঝা মনে করে জন্মের পর পরই তাকে মেরে ফেলত তার বাবা, বিশেষ করে যারা খুব গরীব ছিল। মেয়েকে জ্যান্ত মাটিতে পুঁতে ফেলত। তাদের যুক্তি ছিল, এ সব ঝঞ্ঝাট বাঁচিয়ে রেখে লাভ নেই। জ্যান্ত দাফন করে আল্লাহ্‌র জিনিস আল্লাহ্‌র কাছে ফেরত পাঠানোই ভাল।

নির্দিষ্ট দিনে মা আমেনার কোল আলো করে জন্ম নিলেন এক পুত্রসন্তান। নাতিকে বুকে জড়িয়ে পুত্রশোক অনেকখানি কাটালেন বৃদ্ধ। নবজাতককে কোলে নিয়ে কাবাঘর তাওয়াফ করলেন।

মেয়েসন্তানকে হত্যা করতে গিয়ে কেউ কেউ আরও ভয়ঙ্কর কাণ্ড করত। মেয়ে ছয় বছর বয়েসী হলে বাবা গিয়ে নির্জন মাঠে একটা গর্ত খুঁড়ে রেখে আসত। বাড়ি এসে স্ত্রীকে বলত, মেয়েকে ভাল জামাকাপড় পরিয়ে দাও। তাকে নিয়ে আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে যাব। সাজিয়ে-গুছিয়ে সেই মেয়েকে নিয়ে গিয়ে গর্তের পাড়ে দাঁড়াত বাবা। বলত, ‘দেখ তো মা, এই কুয়ার ভিতর কি আছে?’ মেয়ে উঁকি দিয়ে দেখতে গেলে পিছন থেকে তাকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে মাটি দিয়ে গর্তটা ভরাট করে দিত বাবা।

কায়েস বিন আসিম নামে এক লোক মুসলমান হওয়ার পর রসুলুল্লাহ (স)-এর নিকট স্বীকার করেছিল, এ ভাবে সে তার আটটা মেয়েকে গর্তে ফেলে মেরেছে। কথিত আছে, রসুলুল্লাহ (স) লোকটাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘এ সব করতে তোমার মায়া লাগত না?’ লোকটা জবাব দিয়েছিল, 'হ্যাঁ, একটা মেয়ের জন্য খারাপ লেগেছিল। আমি যখন তাকে গর্তে ফেলে মাটিচাপা দিচ্ছিলাম, সে তখন হাত বাড়িয়ে আমার দাড়ি ঝাড়তে ঝাড়তে বলেছিল, আব্বা, আপনার দাড়িতে ধুলো লেগেছে। শেষে মায়া করে মেয়েটাকে তুলে নিয়ে আসি এই ভয়ে তাড়াতাড়ি গর্তটা মাটি দিয়ে ভরে ফেলেছিলাম।’

মদ খাওয়া, জুয়া খেলা, সুদ খাওয়া, এ সব যেন এই বর্বর মানুষগুলোর জন্য কোন ব্যাপারই ছিল না। হেন অনাচার আর কুকর্ম নেই, যা তার করত না। আর এই ভয়ানক অন্ধকার যুগে পৃথিবীতে এসেছিলেন মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স)।

চব্বিশ বছর বয়েসে হযরত মুহাম্মদ (স)-এ পিতা আব্দুল্লাহ বিবি আমেনাকে বিয়ে করেন। আরবের অভিজাত গোত্রের অভিজাত হাশেম পরিবারের এই বিয়েতে তৎকালীন রীতি অনুযায়ী ধুমধামের কমতি হয়নি। সুখেই দিন কাটাতে লাগলেন নবদম্পতি। কিন্তু বেশিদিন সুখ সইল না বিবি আমেনার কপালে। অল্পবয়েসে বিধবা হলেন। তাঁর স্বামী যুবক আব্দুল্লাহ মদিনায় ব্যবসার কাজে গিয়ে এমন অসুস্থ হলেন, আর ফিরে এলেন না, মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে ইহলোক ত্যাগ করলেন।

প্রাণে প্রচণ্ড ব্যথা পেলেন আব্দুল্লাহর পিতা আবদুল মুত্তালিব। মনের কষ্ট কমাতে প্রায়ই তিনি নির্জন মরুরাতের তারাভরা আকাশে দিকে বিষণ্ন হয়ে তাকিয়ে থাকতেন। কি ভাবতেন, তিনিই জানেন।

নির্দিষ্ট দিনে মা আমেনার কোল আলো করে জন্ম নিলেন এক পুত্রসন্তান। নাতিকে বুকে জড়িয়ে পুত্রশোক অনেকখানি কাটালেন বৃদ্ধ। নবজাতককে কোলে নিয়ে কাবাঘর তাওয়াফ করলেন। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে শিশুকে আবার ফিরিয়ে দিলেন মায়ের কোলে। শিশুর নাম রাখা হলো মুহাম্মদ মোস্তফা (স)। মাত্র কয়েক দিন মায়ের দুধ পান করার পর আরবের সম্ভ্রান্ত পরিবারের প্রথা অনুযায়ী শিশু মুহাম্মদ (স)-কে তুলে দেয়া হলো তায়েফের অধিবাসী দুধমা হযরত হালিমার (রা) হাতে।

নিয়ম অনুযায়ী মাঝে মাঝে ছেলেকে দেখানোর জন্য তাঁকে মায়ের কাছে নিয়ে আসতেন হালিমা (রা)।

হযরত হালিমার (রা) ঘরে থাকার সময় হযরত মুহাম্মদ (স)-এর জীবনে একটা বিশেষ ঘটনা ঘটেছিল। দুধভাইদের সাথে তিনিও মাঠে মেষ চরাতে যেতেন। একদিন হঠাৎ মাঠ থেকে তাঁর এক দুধভাই দৌড়ে বাড়ি এসে উত্তেজিত হয়ে বলতে লাগলেন, ‘সাদা পোশাক পরা দুজন লোক এসে আমার কুরায়শ ভাইকে মাটিতে শুইয়ে ফেলে তাঁর পেটে কেটে ফেলেছে।’

এ খবর শোনামাত্র ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে হযরত হালিমা (রা) তাঁর স্বামীকে নিয়ে সেখানে ছুটলেন। এ বিষয়ে পরে হযরত হালিমা (রা) বলেছেন, ‘আমি আর আমার স্বামী হারিস ভেড়া চরানোর মাঠে ছুটে গেলাম। গিয়ে দেখি, মুহাম্মদ (স) ফ্যাকাশে মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। আমার স্বামী তাঁকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে, বাবা? তিনি জবাব দিলেন, সাদা পোশাক পরা দুজন লোক আমাকে মাটিতে শুইয়ে আমার পেট কেটে কি যেন বের করে ফেলে দিয়েছে। তারপর আমার পেট জোড়া লাগিয়ে যেমন ছিল তেমন করে দিয়েছে।’

যাই হোক, ছয় বছর পর শিশু মুহাম্মদ (স) আবার মায়ের কোলে ফিরে এলেন। মরুপ্রান্তরের বেদুইন জীবন ছেড়ে মক্কায় এসে শুরু হলো তাঁর শহুরে জীবন।

কিন্তু মায়ের কাছে থাকার সুখ বেশিদিন স্থায়ী হলো না। একদিন ছেলেকে নিয়ে স্বামীর কবর জিয়ারত করতে চললেন মা আমেনা। ফেরার পথে দুর্গম মরুভূমিতে ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লেন তিনি। আর সুস্থ হলেন না। নির্জন মরুর বালিতে পড়ে রোগযন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে পরপারে চলে গেলেন।

বাবা গেছেন, মা গেছেন, নাতির দায়িত্ব নিলেন আব্দুল মুত্তালিব। কিন্তু তিনিও বেশিদিন রইলেন না। প্রিয়তম দাদাও যখন চলে গেলেন, একেবারে অসহায় হয়ে গেলেন বালক মুহাম্মদ (স)। কে দায়িত্ব নেবে এই এতিম বালকের? নিলেন চাচা আবু তালিব। আর্থিক সচ্ছলতা ছিল না তাঁর, তার ওপর বেশ বড় একটি পরিবারে ভরণ-পোষণ করতে হতো। বিরাট দায়িত্ব। কিন্তু তিনি পিছপা হলেন না। তাঁর হাতেই ব্যবসার হাতেখড়ি হলো মুহাম্মদ (স)-এর।

সময় বসে থাকে না। ধীরে ধীরে বড় হচ্ছেন মুহাম্মদ (স)। তাঁর সত্যবাদিতা, বিশ্বস্ততা আর বুদ্ধিমত্তার জন্য সবাই তাঁকে ভালবাসে। শ্রদ্ধা করে। সততার জন্য তাঁর নামই হয়ে গেল ‘আল-আমিন’।

চমকে গেলেন তিনি। শিউরে উঠল দেহ। এ কার কণ্ঠ। কে কথা বলে নির্জন পর্বতগুহায়? চোখ মেলে দেখতে পেলেন, আজব জ্যোতিতে আলোকিত হয়ে উঠেছে গুহার ভিতরটা।

এ সময় কাবাঘরকে নিয়ে ঘটল একটা বিশেষ ঘটনা। কালের বিবর্তনে ভেঙেচুরে এতই জরাজীর্ণ হয়ে পড়ল কাবাঘর, যে মেরামত করা অনিবার্য হয়ে পড়ল। আর তা করার জন্য কোরেশদের সকল শাখা সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ নিল। কিন্তু বিবাদ শুরু হলো হাজরে আসওয়াদ বা ‘কালোপাথর’ পুনঃস্থাপন নিয়ে। কারণ নিজের হাতে এই পাথর স্থাপন করাটা ছিল তাদের কাছে একটা বিরাট গৌরব আর মর্যাদার বিষয়। তাই কোরেশদের প্রতিটি গোত্র রক্তের পাত্রে হাত ডুবিয়ে শপথ করল, ‘রক্তের শেষ বিন্দু দেব, তবু এ মর্যাদা হাতছাড়া করব না । কালো পাথর শুধু আমাদের হাতেই পুনঃস্থাপিত হবে, আর কারও হাতে নয়।’

ভীষণ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের আশঙ্কা দেখা দিল। খুব সহজেই মীমাংসা করে দিলেন হযরত মুহাম্মদ (স)। অথচ বয়েসে তিনি তখন একেবারেই তরুণ, কুরায়শদের বহু প্রবীণ ও প্রাজ্ঞ ব্যক্তিদের চেয়ে তাঁর বয়েস অনেক কম। একটা চাদর বিছিয়ে নিজের হাতে পাথরটাকে তিনি সেটার ওপর তুলে দিয়ে গোত্রপ্রধানদের ডেকে বললেন, এখন তোমরা একেকজন এসে চাদরের একেক কোণ ধরো। তারপর পাথরটাকে নিয়ে চলো যেখানে নিয়ে যেতে চাও। নেয়ার পর আবার তিনি পাথরটাকে তুলে যথাস্থানে বসিয়ে দিলেন। এই রক্তপাতহীন সমাধানে বিস্মিত হলো সবাই। হযরত মুহাম্মদ (স)-এর প্রতি ভক্তি আরও বাড়ল তাদের।

পঁচিশ বছর বয়েসে হযরত মুহাম্মদ (স) বিয়ে করলেন তাঁর চেয়ে অন্তত পনেরো বছরের বড় ধনী মহিলা হযরত খাদিজা (রা)-কে। মানুষের অসততা ভীষণ কষ্ট দিত হযরত মুহাম্মদ (স)-কে। কষ্ট পেতেন যখন দেখতেন বিধবা ও শিশুদের কাছ থেকে অন্যায়ভাবে তাদের সম্পত্তি কেড়ে নিচ্ছে প্রভাবশালী কিংবা বলশালীরা। বাবার হাতে কন্যাসন্তানের জ্যান্ত কবর দেয়া ভীষণ ব্যথিত করত তাঁকে। দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচারসহ মানুষের নানা অনাচার দেখে তিনি সহ্য করতে পারতেন না । সবসময় ভাবতেন, কিভাবে এর প্রতিকার করা যায়।

ছোটবেলা থেকেই নির্জনতা পছন্দ করতেন হযরত মুহাম্মদ (স)। লোকালয় থেকে দূরে গিয়ে ধ্যান করতে তাঁর ভাল লাগত। সংসারের দায়দায়িত্ব সেরে ও ব্যবসার ফাঁকে ফাঁকে সুযোগ পেলেই তাই মক্কার অদূরে নির্জন মরুভূমির কোল ঘেঁষে থাকা হেরা পর্বতের এক গুহায় গিয়ে বসতেন।

একদিন হযরত মুহাম্মদ (স) হেরার গুহায় গভীর ধ্যানে মগ্ন—তখন তাঁর বয়েস চল্লিশ—হঠাৎ গমগমে কণ্ঠে ডাক শোনা গেল, ‘হে মুহাম্মদ (স)।’

চমকে গেলেন তিনি। শিউরে উঠল দেহ। এ কার কণ্ঠ। কে কথা বলে নির্জন পর্বতগুহায়? চোখ মেলে দেখতে পেলেন, আজব জ্যোতিতে আলোকিত হয়ে উঠেছে গুহার ভিতরটা। সামনে দাঁড়ানো এক আজব মূর্তি—তিনি আল্লাহ্‌র বাণীবাহক ফেরেশতা হযরত জিবরাঈল (আ)। ফেরেশতার কণ্ঠে আবার শোনা গেল, ‘পড়ুন হে মুহাম্মদ (স)।’

ভয়ে ভয়ে জবাব দিলেন হযরত মুহাম্মদ (স), ‘আমি তো পড়তে জানি না!’

হযরত জিবরাঈল (আ) তাঁকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললেন, 'পড়ুন!'

হযরত মুহাম্মদ (স) একই জবাব দিলেন, ‘আমি পড়তে জানি না।’

হযরত জিবরাঈল (আ) পরপর তিনবার একই কথা বললেন, ‘আপনি পড়ুন।’ তারপর কোরানের একটি আয়াত পড়ে শোনালেন।

হযরত জিবরাঈল (আ) চলে গেলে দুরুদুরু বুকে বাড়ি ফিরে এলেন হযরত মুহাম্মদ (স)। হযরত খাদিজা (রা)-কে বললেন, ‘আমাকে ঢেকে দাও! আমার ভীষণ ভয় করছে।’

হযরত খাদিজা (রা) স্বামীর গায়ে কম্বল জড়িয়ে দিয়ে, তাঁর পাশে বসে, কি হয়েছে জানতে চাইলেন। কিছুটা সামলে নিয়ে হযরত মুহাম্মদ (স) সবকথা খুলে বললেন।

তাঁকে শান্ত থাকতে অনুরোধ করলেন হযরত খাদিজা (রা)।

কিছুক্ষণ পর ক্লান্ত মুহাম্মদ (স) ঘুমিয়ে পড়লে চাচাত ভাই ওয়ারাকা ইবনে নওফলের কাছে ছুটে গেলেন হযরত খাদিজা (রা)। হেরা পর্বতের গুহায় ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনার কথা জানালেন তাঁকে। ওয়ারাকা ছিলেন তাওরাত- ইঞ্জিল ধর্মগ্রন্থের গবেষক। তিনি নিজে ইঞ্জিলের অনুসারী। হযরত খাদিজা (রা)-এর কথা শুনে হাসলেন, যেন এক মহাপ্রাপ্তি ও আবিষ্কারের হাসি। বললেন, ‘শোনো, খাদিজা, এ তো সুসংবাদ। ভয়ের কিছু নেই। যাঁর হাতে আমার জীবন সেই আল্লাহ্‌র নামে শপথ করে বলছি—তুমি আমায় যা যা বললে, তা যদি সত্য হয়ে থাকে তো মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে যিনি এসেছিলেন, তিনি জিবরাঈল (আ), যিনি আসতেন মুসা নবীর কাছে। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও নবী। তাঁকে বোলো, যেন বিপদে-আপদে অটল থাকেন, ভেঙে না পড়েন।’

খুশিতে উদ্বেলিত হয়ে বাড়ি ফিরে এলেন হযরত খাদিজা (রা)।

*লেখকের বানানরীতি অক্ষুণ্ন রাখা হয়েছে।