মানুষ একা বাঁচতে পারে না। সম্পর্কই তাকে বাঁচিয়ে রাখে। পরিবার, বন্ধু, প্রতিবেশী ও সমাজ—তাদের সম্মিলনেই মানুষের জীবন গড়ে ওঠে। সম্পর্ক জীবনে প্রশান্তি আনে, জীবনের রঙিনতা বাড়ায় এবং চলার পথকে আরও সহজ ও অর্থবহ করে তোলে। তবে সব সম্পর্ক সর্বক্ষণ মসৃণ থাকে না।
কখনো ভুল–বোঝাবুঝি, ক্ষণিকের রাগ বা অযৌক্তিক প্রত্যাশা সম্পর্ককে দুর্বল করে দেয়। তাই এমন পরিস্থিতি এড়াতে আগেভাগেই সচেতন থাকা উচিত।
ইসলামি জীবনদর্শনে এমন কিছু অনুপম নির্দেশনা রয়েছে, যেগুলো অনুসরণ করলে সম্পর্ক গভীর হয়, পারস্পরিক সৌহার্দ্য বজায় থাকে এবং মানুষ আত্মিক ও নৈতিক উৎকর্ষের পথে এগিয়ে যায়।
সদাচরণ সম্পর্কের প্রাণ। একটি হাসি, একটি ভালো কথা, কিংবা ছোট্ট উপহার—এসব ক্ষুদ্র আচরণ গভীর ভালোবাসা জন্মায়। হাদিসে এসেছে, নবীজি (সা.) বলেন, ‘হে আয়েশা, (মানুষের সঙ্গে) সদয় ও কোমল আচরণ করো। কেননা, এ গুণের উপস্থিতি ব্যক্তির জীবনকে দীপ্তিময় করে তোলে।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ২৪৭৮)
অন্যকে সম্মান দিয়ে কথা বলা, কঠোর ভাষা পরিহার করা এবং ভদ্রতার সঙ্গে মত প্রকাশ করা—এসব রীতি ভালোবাসার আগুনকে জ্বালিয়ে রাখে এবং দাম্পত্য, বন্ধুত্ব ও পারিবারিক বন্ধনকে টেকসই করে।
আর তোমরা মানুষের সঙ্গে উত্তম ভাষায় কথা বলবে।কোরআন, সুরা বাকারা, আয়াত: ৮৩
মানুষ ভুলের ঊর্ধ্বে নয়; তার ভুল হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু সেই ভুলকে অন্তরে জমিয়ে রাখা সম্পর্ক নষ্ট করার অন্যতম কারণ।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘জান্নাত তৈরি করা হয়েছে খোদাভীরুদের জন্য। যারা...এবং যারা মানুষের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে। মূলত আল্লাহ তাআলা সৎকর্মশীলদের ভালোবাসেন।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৩৩-১৩৪)
ক্ষুদ্র ভুলকে বড় না করা, অতীত সমস্যা মনে না রাখা, কষ্ট পেলেও ক্ষমা করা—এসব মহৎ গুণ মুমিনের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে। ক্ষমার ফলে সম্পর্ক বৃদ্ধি পায়, হৃদয় নরম হয় এবং ভালোবাসা ফিরে আসে।
কটু বা রুক্ষ কথা সম্পর্ককে দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এমনকি একটি ছোট একটি বাক্যও বিরোধের সূত্রপাত করতে পারে। এ জন্য ইসলাম মানুষকে সুন্দর, নরম ও মার্জিত ভাষায় কথা বলার নির্দেশ দিয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর তোমরা মানুষের সঙ্গে উত্তম ভাষায় কথা বলবে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ৮৩)
অন্যকে কিছু বলার পূর্বে প্রথমে ভাবা উচিত— ‘কথাটি আমাকে বলা হলে, আমার অনুভূতি কেমন হবে।’ এই সচেতনতাই একজন প্রকৃত মুমিনের পরিচায়। সুন্দর ও সদভাষা হৃদয়ের আবেগ ও অনূভুতি স্পর্শ করে এবং মানুষকে সম্মানের দিকে পরিচালিত করে।
ক্রোধ সম্পর্কের সবচেয়ে বড় শত্রু। এটি দীর্ঘদিনের সম্পর্ক নিমেষেই শেষ করে দিতে পারে। হাদিসে এসেছে, এক ব্যক্তি নবীজিকে বললেন, ‘আমাকে (কিছু বিষয়ে) উপদেশ প্রদান করুন।’ নবীজি (সা.) বললেন, ‘তুমি ক্ষোভ প্রকাশ করো না।’ তিনি কয়েকবার এ কথা বললেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,১১৬)
ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করতে পারা প্রকৃত মুমিনের পরিচয়। রাগের উদ্রেক হলে সহিষ্ণু হওয়া, নীরব থাকা এবং স্থান পরিবর্তন করা—এসব কৌশল ক্রোধকে দ্রুত প্রশমিত করে এবং অনাকাঙ্ক্ষিত ক্ষতি থেকে রক্ষা করে।
আলাপ-আলোচনা কিংবা সাক্ষাতের সময় সালামের আদানপ্রদান মুমিনের সৌন্দর্য। একটি আন্তরিক সালাম সম্পর্কের মলিনতা দূর করে, ভেতরের অহমিকা মেটায়।
মানুষের ছোটখাটো ভুলকে প্রকাশ করা বা তা নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করা সম্পর্ক নষ্ট করার অন্যতম উপায়। ইসলাম এটিকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি একজন মুসলমানের দোষ গোপন রাখবে, আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তার দোষও গোপন রাখবেন।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৪,৮৯৩)
পরিবার, বন্ধু বা সহকর্মীর দুর্বলতাকে প্রকাশ নয়; বরং আড়াল করা—এটাই প্রকৃত বিশ্বস্ততার পরিচয়। এতে পারস্পরিক আস্থা বৃদ্ধি পায় এবং সম্পর্ক আরও গভীর হয়।
সালাম অর্থ শান্তি। অর্থাৎ এটি নিছক অভিবাদন নয়; বরং রহমত-বরকত ও শান্তির অপূর্ব বার্তা। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমি কি তোমাদের এমন একটি আমলের কথা বলব না, যা পালন করলে তোমরা পরস্পরকে ভালোবাসবে? তোমরা নিজেদের মধ্যে সালামের প্রচলন কর।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৫৪)
আলাপ-আলোচনা কিংবা সাক্ষাতের সময় সালামের আদানপ্রদান মুমিনের সৌন্দর্য। একটি আন্তরিক সালাম সম্পর্কের মলিনতা দূর করে, ভেতরের অহমিকা মেটায় এবং সম্পর্কে নতুন মাত্রা যোগ করে।
রায়হান আল ইমরান : লেখক ও গবেষক