মানুষের হৃদয় অত্যন্ত রহস্যময় ও প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। একদিন আমরা কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর প্রতি গভীর ভালোবাসা অনুভব করি, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই ভালোবাসা ফিকে হয়ে যেতে পারে। কখনো কোনো নির্দিষ্ট কারণে, আবার কখনো কোনো কারণ ছাড়াই। কখনো অযথা আমাদের হৃদয় কারও প্রতি আকৃষ্ট হয়, আবার কখনো সেই আকর্ষণ হঠাৎ মিলিয়ে যায়।
এই পরিবর্তনশীলতা নারী–পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই স্বাভাবিক। যেমন প্রচলিত কথায় আছে, ‘নারীর মন সহস্র বছরের সাধনার ধন’, তেমনি এই রহস্য শুধু নারীর জন্য নয়, পুরুষের হৃদয়েও এই পরিবর্তনশীলতা লক্ষ করা যায়।
‘আদম সন্তানের অন্তর ফুটন্ত পানির পাত্রের চেয়েও দ্রুত পরিবর্তিত হয়।সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ১,৭১৬
মানব হৃদয়কে একটি নির্দিষ্ট অবস্থায় স্থির রাখা অত্যন্ত কঠিন। পারিপার্শ্বিক অবস্থা, আবেগ, চিন্তাভাবনা ও জ্ঞানের প্রভাবে হৃদয় ক্রমেই পরিবর্তিত হয়। একটি ঘটনায় কেউ হয়তো উৎফুল্ল হয়ে হাসছে, কিন্তু পরক্ষণেই অন্য কোনো ঘটনায় বিষণ্নতায় ডুবে যেতে পারে।
পাঁচ বছর আগে যে বিষয়টি আমাদের তীব্র কষ্ট দিয়েছিল, আজ সেই একই বিষয় মনে করে হয়তো হাসি পায়। যে জিনিসের জন্য একসময় ব্যাকুল হয়েছিলাম, তা না পাওয়া আসলে আল্লাহর রহমত ছিল, তা এখন বুঝতে পারি।
মানুষের হৃদয়ের এই পরিবর্তনশীলতা ইসলামে ‘কলব’ হিসেবে বর্ণিত হয়েছে, যার অর্থ হলো এমন কিছু, যা দ্রুত ঘুরে বা পরিবর্তিত হয়।
রাসুল (সা.) বলেন, ‘মানুষের অন্তরের উদাহরণ যেন একটি পাখির পালকের মতো, যা গাছের ডালে ঝুলে আছে এবং বাতাস তাকে ইচ্ছেমতো এদিক–ওদিক ঘুরিয়ে দেয়।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ১৭,৮১৩)
আরেকটি হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘আদম সন্তানের অন্তর ফুটন্ত পানির পাত্রের চেয়েও দ্রুত পরিবর্তিত হয়।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস: ১,৭১৬)
এই হাদিস দুটির মাধ্যমে হৃদয়ের অস্থির প্রকৃতি অনুমান করা যায়। যেমন ফুটন্ত পানির পাত্র গরম হলে তার আকৃতি ও অবস্থা পরিবর্তিত হয়, তেমনি মানুষের হৃদয়ও পরিস্থিতি ও সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়।
জীবনে আমরা বারবার এই পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করি। কখনো কেউ আমাদের প্রয়োজনে এগিয়ে আসে, আমাদের ডাকে সাড়া দেয়; কিন্তু সময়ের সঙ্গে সেই মানুষ আর সাড়া দেয় না। হয়তো তার সময় বা সুযোগ নেই অথবা তার হৃদয়ের আগ্রহ পরিবর্তিত হয়ে গেছে। এই পরিবর্তন কখনো কষ্টদায়ক হলেও এটি জীবনের স্বাভাবিক নিয়ম।
জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে মানুষ আমাদের জীবনে আসে এবং চলে যায়। কেউ প্রয়োজনে কাছে আসে, আবার অন্য প্রয়োজনে দূরে সরে যায়। এটি পৃথিবীর নিয়ম। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘দুনিয়ার জীবন তো কেবল খেলাধুলা ও তামাশা। আর পরকালই মুত্তাকিদের জন্য উত্তম। তবে কি তোমরা বোঝ না?’ (সুরা আনআম, আয়াত: ৩২)
এই দুনিয়ায় কোনো সম্পর্ক, ভালোবাসা বা মায়া চিরস্থায়ী নয়। মানুষ সময়ের প্রয়োজনে বা জীবনের চাহিদায় পরিবর্তিত হয়। কেউ কেউ এই দুনিয়া ছেড়ে চিরতরে অপার্থিব জগতে চলে যায়, যেখানে এক নতুন জীবন শুরু হয়। এই বিচ্ছেদ কখনো অত্যন্ত কষ্টদায়ক হলেও তা মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না।
মানুষ সময়ের প্রয়োজনে বা জীবনের চাহিদায় পরিবর্তিত হয়। কেউ কেউ এই দুনিয়া ছেড়ে চিরতরে অপার্থিব জগতে চলে যায়, যেখানে এক নতুন জীবন শুরু হয়।
মানুষের হৃদয়ের এই পরিবর্তনশীলতা আমাদের শেখায় যে আমরা কারও ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হতে পারি না। একমাত্র আল্লাহই আমাদের চিরন্তন আশ্রয়। তিনি আমাদের দুর্বল সৃষ্টি হিসেবে সৃজন করেছেন, যাতে আমরা তাঁর ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করি। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ কোনো প্রাণের ওপর এমন দায়িত্ব চাপিয়ে দেন না, যা তার সাধ্যের বাইরে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৮৬)
আমাদের সুখ–দুঃখে, প্রতিটি মুহূর্তে আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন। তিনি কখনো আমাদের ডাকে সাড়া দিতে ব্যস্ত থাকেন না। পবিত্র কোরআনে তিনি বলেন, ‘তোমরা আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব।’ (সুরা মুমিন, আয়াত: ৬০)
আল্লাহ আরও বলেন, ‘যখন আমার বান্দারা আমার সম্পর্কে তোমাকে জিজ্ঞাসা করে, তখন বলো, আমি তো অতি নিকটে। যখন কেউ আমাকে ডাকে, আমি তার ডাকে সাড়া দিই।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৮৬)
যখন আমার বান্দারা আমার সম্পর্কে তোমাকে জিজ্ঞাসা করে, তখন বলো, আমি তো অতি নিকটে। যখন কেউ আমাকে ডাকে, আমি তার ডাকে সাড়া দিই।সুরা বাকারা, আয়াত: ১৮৬
মানুষ হয়তো ব্যস্ততায় বা অনিচ্ছায় আমাদের ডাকে সাড়া দেয় না, কিন্তু আল্লাহ, যিনি আল–মুজিব (ডাকে সাড়াদানকারী) ও আল–ওয়ালী (অভিভাবক), তিনি কখনো আমাদের নিরাশ করেন না। তিনি আমাদের মালিক এবং সব পরিস্থিতিতে আমাদের পাশে থাকেন।
মানুষের হৃদয়ের পরিবর্তনশীলতা জীবনের একটি স্বাভাবিক অংশ। এই পরিবর্তন আমাদের শেখায় যে দুনিয়ার কোনো সম্পর্ক বা আকর্ষণ চিরস্থায়ী নয়। একমাত্র আল্লাহর সঙ্গে আমাদের সম্পর্কই চিরন্তন।
তাঁর কাছে দোয়া করা, তাঁর ওপর ভরসা করা এবং তাঁর স্মরণে মগ্ন থাকা আমাদের হৃদয়কে স্থির রাখে। আমরা কি তাঁকে সেভাবে ডাকছি, যাতে তিনি আমাদের জান্নাতের স্বপ্নগুলো পূরণ করবেন?
আল্লাহ আমাদের হৃদয়কে তাঁর নৈকট্যে স্থির রাখুন এবং তাঁর দয়ায় আমাদের জীবনকে সমৃদ্ধ করুন, আমিন।