সত্যবাদী রাখালের কাহিনি

মিথ্যেবাদী রাখালের গল্প আমরা শুনেছি, যে প্রতিদিন মিছেমিছি ‘বাঘ! বাঘ!’ চিৎকার করে মানুষকে জড়ো করত, আর এভাবেই মজা নিত; এরপর একদিন যখন সত্যি সত্যি বাঘ এলো, মানুষ তার চিৎকার শুনেও বাঁচাতে আসেনি, কারণ তারা ভেবেছিল সেই রাখাল ছেলে আবারও মজা করছে। কিন্তু আমাদের এই গল্পের রাখাল একদমই বিপরীত, যিনি কোনো পরিস্থিতিতেই মিথ্যা বলতে রাজি নন।

গ্রীষ্মের এক ভরদুপুর। তপ্ত রোদের মধ্যে হেঁটে যাচ্ছেন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) ও তার সঙ্গীরা। তারা গিয়েছিলেন মদিনার পার্শ্ববর্তী এক এলাকায়, এখন ফিরতি পথে।

গরমের তীব্রতায় পা চলছে না আর, একটু জিরিয়ে নিতে বসলেন এক জায়গায়। সঙ্গীরা দস্তরখান বিছালেন, ক্ষুধাও লেগেছিল খুব। খাবার সাজানো হলো। এমন সময় চোখে পড়ল—এক রাখাল ছেলের ওপর, যে কতগুলো ভেড়া নিয়ে তাদের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল।

আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) তাকে ডেকে বললেন, ‘এসো, আমাদের সঙ্গে একটু খাওয়া-দাওয়া করো।’

রাখাল বললেন, ‘না, আমার জন্য সম্ভব না। আমি রোজা রেখেছি।’

আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) তাকে ডেকে বললেন, ‘এসো, আমাদের সঙ্গে একটু খাওয়া-দাওয়া করো।’ রাখাল বললেন, ‘না, আমার জন্য সম্ভব না। আমি রোজা রেখেছি।’

আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) অবাক হয়ে গেলেন। বললেন, ‘গ্রীষ্মকালের এমন কাঠফাটা গরমের দিনে তুমি রোজা রেখেছ? রোজা রেখে আবার এই পাহাড়ে ভেড়া চড়াতে এসেছ!’

রাখাল বললেন, ‘আল্লাহর কসম, আমি আমার ফাঁকা দিনগুলো আগেভাগেই কাজে লাগিয়ে নিচ্ছি।’ এ কথা বলে রাখাল বোঝাতে চেয়েছেন—জন্ম ও মৃত্যুর মাঝখানে যে কয়েকটা দিন পেয়েছি, এই দিনগুলো আমি বেকার নষ্ট করতে চাই না। এই দিনগুলো আমল দিয়ে পূর্ণ রাখছি।

তার কথা শুনে আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) খুবই আশ্চর্য হলেন। অল্পবয়সী এক ছেলে, অথচ কত দূরদর্শী চিন্তা। তিনি ভাবলেন রাখাল ছেলের তাকওয়ার পরীক্ষা নেবেন। বললেন, ‘এই ভেড়ার পাল থেকে একটা ভেড়া বিক্রি করবে? আমরা নগদ টাকা দিয়ে কিনে নেব, এবং তোমার ইফতারের জন্য এখান থেকে গোশতও দেব।’

রাখাল বললেন, ‘এই ভেড়াগুলো আমার নয়, আমার মালিকের। আমি অনুমতি ছাড়া তার ভেড়া বিক্রি করতে পারব না।’

আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বললেন, ‘তোমার মালিক যদি দেখে একটা ভেড়া কম, বলবে নেকড়ে খেয়ে ফেলেছে।’

তিনি আকাশের দিকে আঙুল তুলে বললেন, ‘আল্লাহ কোথায়?’ মানে ‘আল্লাহ কি দেখছেন না?’ এই বলে ভেড়া হাঁকিয়ে চলে গেলেন।

কিন্তু রাখাল ভেড়া বিক্রি করতে অস্বীকার করলেন। তিনি আকাশের দিকে আঙুল তুলে বললেন, ‘আল্লাহ কোথায়?’ মানে ‘আল্লাহ কি দেখছেন না?’

এই বলে ভেড়া হাঁকিয়ে চলে গেলেন।

আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) তার কথা শুনে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন। তিনি বারবার রাখালের এ কথা আওড়াতে লাগলেন, ‘আল্লাহ কোথায়’। তিনি যখন মদিনায় ফিরে আসেন, দ্রুত সেই রাখালের মালিকের সাথে দেখা করেন। তার কাছ থেকে সেই রাখালসহ সবগুলো ভেড়া কিনে নেন। এরপর সেই রাখালকে সবগুলো ভেড়া দিয়ে আজাদ করে দেন। (বাইহাকি, শুআবুল ঈমান, ৭/২২৩, হাদিস: ৪৯০৮, প্রকাশনী: মাকতাবাতুর রুশদ)

এই গল্প আমাদের শেখায় আল্লাহর ভয় ও আমানতের খেয়ানত না করা মানুষের সবচেয়ে বড় গুণ। যারা গোপনে সৎ থাকতে পারে, তারাই আসল মুমিন। কেবল মানুষের সামনে নয়, যখন কেউ দেখছে না তখনও ‘আল্লাহ দেখছেন’ বলে অসৎ কাজ থেকে বিরত থাকাই প্রকৃত সততা।

mawlawiashraf@gmail.com

মওলবি আশরাফ: আলেম, লেখক ও সম্পাদক