ইসলামি ইতিহাসের সোনালি যুগে মুসলিম সমাজের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে ওয়াক্ফের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। সে সময় সমাজের বহু মৌলিক প্রয়োজন ও জনসেবামূলক কাজের ব্যয়ভার ওয়াক্ফের মাধ্যমেই বহন করা হতো। ফলে রাষ্ট্রের বা সরকারের বাজেট ও কাঁধের ওপর থেকে বড় ধরনের বোঝা হালকা হয়ে যেত।
অতীতের মতো বর্তমানেও মসজিদ ও ইবাদতখানার খরচের প্রধান উৎস হলো ওয়াক্ফ। ঠিক একইভাবে শিক্ষা কার্যক্রম, বৈজ্ঞানিক গবেষণা, স্কুল–কলেজ, মাদ্রাসা ও লাইব্রেরি নির্মাণ এবং এগুলোর পরিচালনায় ওয়াক্ফ অপরিহার্য।
ছাত্র–শিক্ষকদের আবাসন, পোশাক, খাবার ও চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থাও এর মাধ্যমে করা হয়। স্বাস্থ্য খাতেও ওয়াক্ফের অবদান ব্যাপক। হাসপাতাল নির্মাণ থেকে শুরু করে চিকিৎসার সব সরঞ্জাম জোগানো এর অন্তর্ভুক্ত।
ওয়াক্ফ কি আবশ্যকীয় বিষয়, নাকি নয়? এতে কি ওয়াক্ফকৃত বস্তুর মালিকানা সরে যায়? এটি কি দ্বিপক্ষীয় কোনো চুক্তি, নাকি একতরফাভাবে নিজের অধিকার ত্যাগ করা?
আভিধানিকভাবে ওয়াক্ফ অর্থ হলো, আটকে রাখা বা আবদ্ধ করা। আরবিতে বলা হয়, ‘ওয়াক্ফতুদ দারা’ অর্থাৎ আমি বাড়িটি ওয়াক্ফ করেছি বা হস্তান্তর অযোগ্য করে রেখেছি। (আল–আজহারি, আজ–জাহির, পৃ. ২৬০)
ওয়াক্ফের পারিভাষিক সংজ্ঞা নিয়ে আলেমদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। এই মতভেদের মূল কারণ হলো, ওয়াক্ফ চুক্তির প্রকৃতি সম্পর্কে তাঁদের ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি। যেমন ওয়াক্ফ কি আবশ্যকীয় বিষয়, নাকি নয়? এতে কি ওয়াক্ফকৃত বস্তুর মালিকানা সরে যায়? এটি কি দ্বিপক্ষীয় কোনো চুক্তি, নাকি একতরফাভাবে নিজের অধিকার ত্যাগ করা?
হাম্বলি ফিকহে বলা হয়, ওয়াক্ফ হলো মূল বস্তুকে আটকে রাখা এবং এর উপকার বা আয় মানুষের কল্যাণে উন্মুক্ত (তাসবিল) করে দেওয়া। (ইবনে কুদামাহ, আল–মুগনি, ৮/১৮৪)
বিখ্যাত ইসলামি আইনজ্ঞ আবু জাহরা এই সংজ্ঞাকেই সবচেয়ে ব্যাপক ও পূর্ণাঙ্গ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, ওয়াক্ফের সংজ্ঞায় সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ কথা হলো, মূল বস্তুকে আটকে রাখা এবং এর থেকে লব্ধ ফল বা আয় জনকল্যাণে দিয়ে দেওয়া। অথবা বলা যায়, মূল বস্তু আটকে রেখে সওয়াবের আশায় এর উপকার দান করে দেওয়া। (আবু জাহরা, মুহাজারাত ফিল ওয়াক্ফ, পৃ. ৪৪)
ওয়াক্ফ হলো আল্লাহর নৈকট্য লাভের একটি মাধ্যম এবং একটি পছন্দনীয় বা মুস্তাহাব আমল। পবিত্র কোরআনের সাধারণ নির্দেশনাগুলো এর বৈধতা প্রমাণ করে, আর সুন্নাহ বা হাদিসে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা এসেছে। সাহাবিগণও এ আমল করেছেন। আলেমরা একমত হয়েছেন যে ওয়াক্ফ একটি বৈধ ও স্বীকৃত ইবাদত।
ওয়াক্ফ সম্পর্কে বিভিন্ন ধর্মীয় বর্ণনাও আছে। এর মধ্যে একটি হলো, আনাস ইবনে মালিক (রা.) বলেন, মদিনা মুনাওয়ারায় আবু তালহা (রা.) অধিকসংখ্যক খেজুরগাছের মালিক ছিলেন। তাঁর কাছে সর্বাধিক প্রিয় সম্পত্তি ছিল ‘বাইরুহা’ নামক বাগান। আর তা ছিল মসজিদের সম্মুখে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) সেখানে এসে সেখানকার কূপের সুমিষ্ট পানি পান করতেন। যখন সুরা আলে ইমরানের ৯২ নম্বর আয়াতটি নাজিল হলো, তখন আবু তালহা (রা.) উঠে দাঁড়ালেন এবং বলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা যা ভালোবাসো, তা থেকে ব্যয় না করা পর্যন্ত তোমরা কখনোই কল্যাণ লাভ করতে পারবে না এবং তোমরা যা কিছুই ব্যয় করো, আল্লাহ তা জ্ঞাত আছেন।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ৯২)
আমার সর্বাধিক প্রিয় সম্পত্তি বাইরুহা। এটা আল্লাহর ওয়াস্তে আমি দান (ওয়াক্ফ) করে দিলাম। আমি আল্লাহর কাছে পুণ্য ও সঞ্চয় চাই। আল্লাহ আপনাকে যেখানে নির্দেশ দেন, আপনি সেখানে তা ব্যয় করুন।
রাসুল (সা.) বলেন, ‘বাহ, ওটি তো লাভজনক সম্পদ... ওটি তো লাভজনক সম্পদ। তুমি যা বলেছ, আমি তা শুনেছি। আমি এ রায় দিচ্ছি, তুমি তা তোমার কাছের আত্মীয়কে দিয়ে দাও।’
আবু তালহা (রা.) বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমি তা করব।’ তারপর আবু তালহা (রা.) সেটা তাঁর চাচাতো ভাই–বোন ও আত্মীয়দের মধ্যে বণ্টন (ওয়াক্ফ) করে দিলেন। (বুখারি, হাদিস নম্বর: ৪৫৫৪)
যিনি ওয়াক্ফ করবেন, তাঁকে দান করার পূর্ণ আইনি যোগ্যতাসম্পন্ন হতে হবে। অর্থাৎ তাঁকে সুস্থ মস্তিষ্ক, প্রাপ্তবয়স্ক ও স্বাধীন হতে হবে। নির্বুদ্ধিতা বা উদাসীনতার কারণে তাঁর ওপর সম্পদ খরচে কোনো আইনি নিষেধাজ্ঞা থাকা যাবে না।
একাধিক আলেম স্পষ্টভাবে মত প্রকাশ করেছেন যে ওয়াক্ফ শুদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরামের ‘ইজমা’ (সর্বসম্মত ঐকমত্য) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জাবের (রা.) বলেছেন, নবীজি (সা.)–এর সাহাবিদের মধ্যে যাঁরই আর্থিক সামর্থ্য ছিল, তিনিই ওয়াক্ফ করেছেন।
আর এটি ছিল তাঁদের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত বা ইজমা। কারণ, তাঁদের মধ্যে যাঁরাই সক্ষম ছিলেন, তাঁরা ওয়াক্ফ করেছিলেন এবং বিষয়টি এতটাই প্রচলিত ছিল যে কেউ এর বিরোধিতা করেননি। তাই এটি একটি ইজমায় পরিণত হয়। (ইবনে কুদামাহ, আল–মুগনি, ৮/১৮৬)
অন্যান্য চুক্তি ও অঙ্গীকারের মতোই ওয়াক্ফ শুদ্ধ হওয়ার জন্য এর সুনির্দিষ্ট কিছু রুকন বা মূল উপাদান থাকা জরুরি। সেগুলো হলো মোট চারটি—
১. ওয়াকিফ (দাতার পরিচয়): যিনি সম্পদ ওয়াক্ফ করবেন।
২. মওকুফ (ওয়াক্ফকৃত সম্পদ): যে সম্পদটি ওয়াক্ফ করা হচ্ছে।
৩. মওকুফ আলাইহি (উপকারভোগী): যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের জন্য ওয়াক্ফ করা হচ্ছে।
৪. সিগাহ (বক্তব্য বা প্রস্তাব): অর্থাৎ ওয়াকিফ বা দাতার পক্ষ থেকে ওয়াক্ফ করার স্পষ্ট ঘোষণা।
(ইবনে জুজাই, আল–কাওয়ানিনুল ফিকহিয়্যাহ, পৃ. ২৪৩)
১. ওয়াকিফ (দাতার পরিচয়)
যিনি ওয়াক্ফ করবেন, তাঁকে দান করার পূর্ণ আইনি যোগ্যতাসম্পন্ন হতে হবে। অর্থাৎ তাঁকে সুস্থ মস্তিষ্ক, প্রাপ্তবয়স্ক ও স্বাধীন হতে হবে। নির্বুদ্ধিতা বা উদাসীনতার কারণে তাঁর ওপর সম্পদ খরচে কোনো আইনি নিষেধাজ্ঞা থাকা যাবে না।
তিনি মৃত্যুশয্যায় বা মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হতে পারবেন না। কারণ, মৃত্যুশয্যায় থাকাকালে কেউ ওয়াক্ফ করলে তা সাধারণ ওয়াক্ফ না হয়ে ‘অসিয়ত’ বা মৃত্যুর ইচ্ছাপত্র হিসেবে গণ্য হবে। (মুহাযারাত ফিল ওয়াক্ফ, আবু যাহরা, পৃ. ১২৭)
২. মওকুফ (ওয়াক্ফকৃত সম্পদ)
যে সম্পদ বা বস্তুটি ওয়াক্ফ করা হবে, তা শরিয়তের দৃষ্টিতে মূল্যবান ও ব্যবহারযোগ্য সম্পদ হতে হবে। সুতরাং যা সম্পদ হিসেবে গণ্য নয়, যেমন মরুভূমি বা অনাবাদি জায়গা, তা ওয়াক্ফ করা যাবে না। ঠিক একইভাবে যা সম্পদ হলেও শরিয়তে মূল্যহীন, যেমন মদ বা শূকর, সেগুলোও ওয়াক্ফ করা বৈধ নয়।
যা কারও মালিকানায় নেই, তা ওয়াক্ফ করা সহিহ বা শুদ্ধ নয়। যেমন মরুভূমির মালিকানাবিহীন পতিত জমি, জঙ্গলের বন্য গাছপালা কিংবা শিকার করার আগেই বন্য প্রাণী।
অজানা বা অস্পষ্ট কোনো কিছু ওয়াক্ফ করা শুদ্ধ নয়। যেমন কেউ বলল, ‘আমি আমার সম্পদের কিছু অংশ ওয়াক্ফ করলাম’ কিংবা ‘আমার একটি বাড়ি ওয়াক্ফ করলাম’, কিন্তু কোনটি তা নির্দিষ্ট করল না, তবে এমন ওয়াক্ফ হবে না। (আজ–জারকা, আহকামুল ওয়াক্ফ, পৃ. ৪৫–৫১)
৩. মওকুফ আলাইহি (উপকারভোগী)
যে ব্যক্তি বা যে খাতে ওয়াক্ফ করা হচ্ছে, সেটি অবশ্যই শরিয়তের দৃষ্টিতে পুণ্যের কাজ হতে হবে। তাই কোনো পাপের কাজে, গুনাহগারদের আড্ডায় অথবা ইসলামবিদ্বেষী কোনো যুদ্ধবাজ গোষ্ঠীর জন্য ওয়াক্ফ করা জায়েজ নেই। একইভাবে অন্যান্য ধর্মের কোনো ধর্মীয় আচার–অনুষ্ঠানের জন্যও ওয়াক্ফ করা বৈধ নয়।
যদি কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির জন্য ওয়াক্ফ করা হয়, তবে চুক্তি করার সময় ওই ব্যক্তির অস্তিত্ব থাকতে হবে। তবে যদি ভবিষ্যতে সুবিধাভোগী ব্যক্তি বা বংশধারা বিলুপ্ত হয়ে যায়, সে ক্ষেত্রে ওয়াক্ফের হুকুম কী হবে, তা নিয়ে ফকিহদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।
কেউ কেউ মনে করেন, শুরু বা শেষে সুবিধাভোগী না থাকলে ওয়াক্ফ সহিহ হয় না। আবার অন্য দলের মতে, সর্বাবস্থায় ওয়াক্ফ সহিহ এবং এর আয় তখন গরিবদের বা অন্য জনকল্যাণমূলক খাতে ব্যয় হবে। (আজ–জারকা, আহকামুল ওয়াক্ফ, পৃ. ৫১–৫৪)
৪. সিগাহ (বক্তব্য বা প্রস্তাব)
ওয়াক্ফের ঘোষণা বা প্রস্তাবনাটি ‘মুঞ্জাজ’ হতে হবে অর্থাৎ এটি সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর হতে হবে। এটি ভবিষ্যতের কোনো ঘটনার ওপর নির্ভরশীল বা কোনো শর্তের সঙ্গে যুক্ত রাখা যাবে না; বরং ঘোষণাটি এমন হতে হবে, যা দিয়ে বোঝা যায় যে বলার সঙ্গে সঙ্গেই ওয়াক্ফটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। যেমন কেউ বলল, ‘আমি আমার জমি গরিব ও মিসকিনদের জন্য ওয়াক্ফ করলাম’।
শর্তযুক্ত বাক্য মালিকানা হস্তান্তরের চুক্তিগুলোকে বাতিল করে দেয়। যেমন কেউ যদি বলে, ‘যদি আমি এই জমি ভবিষ্যতে ক্রয় করি, তবে তা গরিবদের জন্য ওয়াক্ফ হবে’, তবে এই ওয়াক্ফ শুদ্ধ হবে না।
ওয়াক্ফ করার সময় এমন কোনো শর্ত জুড়ে দেওয়া যাবে না, যা ওয়াক্ফের মূল দাবির সম্পূর্ণ বিরোধী। যেমন কেউ বলল, ‘আমি আমার জমিটি ওয়াক্ফ করলাম, তবে শর্ত হলো, আমি যখন খুশি এটি আবার বিক্রি করে দিতে পারব’। যেহেতু ওয়াক্ফ সম্পত্তি বিক্রি করা যায় না, তাই এমন শর্তে ওয়াক্ফ হবে না। (আজ–জারকা, আহকামুল ওয়াক্ফ, পৃ. ৩৪)
শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দারিদ্র্য বিমোচন ও জনকল্যাণে রাষ্ট্রীয় বাজেটের ওপর চাপ কমিয়ে ওয়াক্ফ আজও সমাজের ভারসাম্য রক্ষায় বৈপ্লবিক ভূমিকা রাখতে সক্ষম।
ওয়াক্ফ হলো একধরনের পুণ্য বা সওয়াবের কাজ। এর মূল উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা, অভাবগ্রস্ত মানুষের প্রতি দয়া প্রদর্শন এবং নেক ও তাকওয়ার কাজে পরস্পর সহযোগিতা করা।
মানুষ যেহেতু নিজের সম্পদের ওপর কর্তৃত্ব রাখে, তাই জনকল্যাণের উদ্দেশ্যে তা ধর্মীয় সামাজিক বা অর্থনৈতিক যে প্রয়োজনই হোক না কেন, সেই সম্পদ ব্যয় করতে কোনো দোষ নেই। এখানে ওয়াক্ফের কয়েকটি প্রধান লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য তুলে ধরা হলো। তবে এটিই একমাত্র তালিকা নয়।
১. ইসলামের প্রচার–প্রসার
এই উদ্দেশ্যের সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো মসজিদ নির্মাণ। ইতিহাসের শুরু থেকেই মসজিদগুলো ইসলামের দাওয়াত, মানুষের শিক্ষা এবং চরিত্র গঠনের বাতিঘর হিসেবে কাজ করেছে।
এই মসজিদগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ এবং এর ইমাম–মুয়াজ্জিনদের ব্যয় নির্বাহের জন্য দোকান, বাগান ও বাড়িঘর ওয়াক্ফ করে দেওয়া হতো। বর্তমানে মসজিদের পাশাপাশি বিভিন্ন দাওয়াহ সেন্টার বা ইসলাম প্রচার কেন্দ্রও ওয়াক্ফ সম্পত্তির আয়ের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে।
২. সামাজিক নিরাপত্তা ও সেবা
পারিবারিক ওয়াক্ফের মাধ্যমে নিজের সন্তান ও আত্মীয়স্বজনদের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করা হয়, যা আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার অন্তর্ভুক্ত। পাশাপাশি জনকল্যাণমূলক ওয়াক্ফের মাধ্যমে সমাজের এতিম, মুসাফির ও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের সেবা দেওয়া হয়।
ক্ষুধার্তকে খাবার দেওয়া, গরিবদের পোশাক ও শীতের কাপড় দেওয়া এবং অসুস্থ, নিঃস্ব ও ভিনদেশি মুসাফিরদের সাহায্য করা ইত্যাদি এর অন্তর্ভুক্ত।
৩. স্বাস্থ্যসেবা
এটি ওয়াক্ফের অন্যতম বিস্তৃত একটি খাত। অতীতে মুসলমানরা রোগীদের সেবার জন্য অসংখ্য ‘বিমারিস্তান’ (হাসপাতাল), স্বাস্থ্যকেন্দ্র নির্মাণ করেছেন এবং চিকিৎসাবিষয়ক গবেষণা, যেমন রসায়ন ও ফার্মেসি এগিয়ে নেওয়ার জন্য সম্পত্তি ওয়াক্ফ করেছেন।
৪. শিক্ষা বিস্তার
শিক্ষা ক্ষেত্রে ওয়াক্ফের অবদান এত ব্যাপক যে অল্প কথায় তা বলে শেষ করা যাবে না। গোটা মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য ওয়াক্ফিয়া মাদ্রাসা ও স্কুল এর প্রমাণ।
বিশেষ করে বড় বড় মসজিদগুলোই ছিল শিক্ষার প্রধান কেন্দ্র, যেমন মক্কা ও মদিনার দুই পবিত্র মসজিদ, মিসরের আল–আজহার, মরক্কোর আল–কারাউইন, তিউনিসিয়ার আজ–জাইতুনা ও দামেস্কের উমাইয়া মসজিদ। এ ছাড়া অগণিত লাইব্রেরি ও শিক্ষা ইনস্টিটিউট ওয়াক্ফের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
৫. নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা
রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার কাজে ওয়াক্ফ করার ভিত্তি পাওয়া যায় বিখ্যাত সাহাবি হজরত খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.)–এর ঘটনায়। তিনি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের জন্য তাঁর বর্ম ও যুদ্ধের সরঞ্জাম ওয়াক্ফ করে দিয়েছিলেন।
৬. অবকাঠামো উন্নয়ন
জনসাধারণের চলাচলের জন্য রাস্তাঘাট নির্মাণ, সেতু তৈরি ও সুপেয় পানির কূপ খনন করাও ওয়াক্ফের অন্তর্ভুক্ত। এর উদাহরণ হিসেবে মদিনায় হজরত উসমান (রা.) কর্তৃক রুমার কূপ ওয়াক্ফ করার ঘটনাটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
ওয়াক্ফ ইসলামি অর্থব্যবস্থার এক অনন্য ও গতিশীল প্রতিষ্ঠান, যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মুসলিম উম্মাহর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে মেরুদণ্ডের মতো ভূমিকা পালন করেছে।
এটি যেমন সম্পদের সুষম বণ্টন বা সমাজসেবা, তেমনি আল্লাহর নৈকট্য অর্জন ও পরকালীন মুক্তির বা ‘সদকায়ে জারিয়া’র এক শাশ্বত উপায়, যা দাতার মৃত্যুর পরও তাঁর আমলনামায় পুণ্য যোগ করতে থাকে।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দারিদ্র্য বিমোচন ও জনকল্যাণে রাষ্ট্রীয় বাজেটের ওপর চাপ কমিয়ে ওয়াক্ফ আজও সমাজের ভারসাম্য রক্ষায় বৈপ্লবিক ভূমিকা রাখতে সক্ষম।
তাই বর্তমান সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে একটি আত্মনির্ভরশীল ও কল্যাণমুখী সমাজ গঠনে বিত্তবানদের ওয়াক্ফের সংস্কৃতিকে নতুন করে উজ্জীবিত করা এবং সাহাবায়ে কেরামের পদাঙ্ক অনুসরণ করে এই মহৎ ইবাদতে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করা সময়ের একান্ত দাবি।
abdullahalbaqi00@gmail.com
আবদুল্লাহিল বাকি : আলেম ও সফটওয়্যার প্রকৌশলী