আমার হারানো সন্তানের কাছ থেকে জীবনের তিনটি শিক্ষা

বদিউজ্জামান সাইদ নুরসি বলেছেন, ‘যদি উপদেশ চাও, তাহলে মৃত্যুই যথেষ্ট।’ তিনি সত্য বলেছেন। আমার তিন বছরের মিষ্টি মেয়ে মারিয়ামের কবর জিয়ারত করার সময় প্রতিবার নতুন করে এই সত্য অনুভব করি। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সে যেন আমার এক আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক হয়ে উঠেছে। আমাকে জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা দিয়েছে সে। আমি বুঝতে শিখেছি, মৃত্যুর প্রতি সচেতন ভয় জীবনের গুণমান বাড়ায়।

মানুষের চিরাচরিত অভ্যাস হলো, বিপদ বা বেদনার কথা বেশি দিন মনে রাখেন না, সুন্দর সময় এলে অল্পতেই ভুলে যায়। তাই আল্লাহ আমাদের সতর্ক করে দিয়েছেন, ‘এবং তোমরা তাদের মতো হয়ো না, যারা আল্লাহকে ভুলে গেছে, ফলে তিনিও তাদের নিজেদেরকেই ভুলিয়ে দিয়েছেন।’ (সুরা আল-হাশর, আয়াত: ১৯)

আরও বলেছেন, ‘যখন মানুষের ওপর বিপদ আসে, তখন সে শুয়ে, বসে, দাঁড়িয়ে আমাকে ডাকে। কিন্তু আমি যখন তার বিপদ দূর করে দিই, সে এমনভাবে চলে যায় যেন সে কখনো তার বিপদ দূর করার জন্য আমাদের কাছে প্রার্থনা করেনি। এভাবে অসতর্কদের কাজ তাদের কাছে আকর্ষণীয় করে দেওয়া হয়।’ (সুরা ইউনুস, আয়াত: ১২)

যদি উপদেশ চাও, তাহলে মৃত্যুই যথেষ্ট।
বদিউজ্জামান সাইদ নুরসি (রহ.)

আমি তাই মৃত্যুকে নিয়ত স্মরণে রাখি, যা আমাকে জীবন সম্পর্কে আরও স্পষ্টতা, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এবং গভীর বোঝাপড়া দিয়েছে। অনেক চিন্তাবিদ উপসংহারে পৌঁছেছেন যে মৃত্যু ছাড়া জীবনের কোনো অর্থ নেই।

মেয়ের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আমি যে তিনটি শিক্ষা পেয়েছি, তা হলো:

১. আমরা সবাই প্রবাসী

মানুষ হিসেবে আমরা মৌলিকভাবে প্রবাসী। মৃত্যু একটি অনিবার্য বাস্তবতা। আমাদের কেউই এই পৃথিবীতে চিরকাল থাকার জন্য নয়। আমরা পৃথিবীতে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বাস করি এবং শেষ পর্যন্ত আমাদের চূড়ান্ত গন্তব্যে ফিরে যেতে হবে। তবু আমরা ভান করি যে আমরা আমাদের শরীর, প্রিয়জন, সম্পদ এবং আল্লাহ প্রদত্ত সম্পদের ওপর সম্পূর্ণ মালিকানা আছে আমাদের। এর কিছুই সত্যিকারের আমাদের নয়। প্রকৃত মালিক আমাদেরকে এই সর্বজনীন যাত্রায় ডাকেন এবং স্মরণ করিয়ে দেন, ‘আমরা আল্লাহর এবং তাঁর কাছেই আমরা ফিরে যাব।’

হ্যাঁ, পরিবর্তন, চলাচল এবং গতিশীলতা মানুষের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য। কিন্তু সেটা একজন অতিথি বা প্রবাসী হিসেবে। যেমন আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘দুনিয়াতে এমনভাবে থাকো, যেন তুমি অচেনা বা মুসাফির। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৪১৬)

এই বোধ যখন জাগরূক থাকবে, তখন আমরা এই গ্রহে নম্রভাবে চলাফেরা করব এবং সবকিছু আল্লাহর কাছে সর্বোত্তমভাবে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব; যেন, যখন আমি চলে যেতে বাধ্য হব, তখন আর কিছুতে আফসোস না জাগে। যা থাকবে, তা আমার উত্তরাধিকারীরা ব্যবহার করবে।

প্রায়ই মেয়ের সঙ্গে আমার শেষ মুহূর্তের কথা আমি ভাবি এবং কৃতজ্ঞতা বোধ করি তখন, যা যা করতে পেরেছি এবং যা যা বলতে পেরেছি সে জন্য। বুঝতে পেরেছি, আমাকেও একইভাবে শান্তিতে আমার স্রষ্টার কাছে ফিরতে হবে।

২. এই মুহূর্তটাই জীবন

অতীত চলে গেছে। আগামীকাল অস্তিত্বহীন, ভবিষ্যতের ঠিক নেই। অতীত নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা, ভবিষ্যৎ নিয়ে অত্যধিক উদ্বেগ মানসিক শক্তির অপচয় ঘটায়, অথচ এই শক্তি আমার এখনের জন্য প্রয়োজন। বদিউজ্জামান নুরসি বলেন, ‘আঘাত পাওয়ার আগে কেঁদো না।’

মৃত্যু আমাদের তীব্রভাবে সচেতন করে যে আমাদের কাছে আছে কেবল এখনকার এই মুহূর্ত। বর্তমান সত্যিই একটি উপহার—একটি নিয়ামত যাকে আমরা হালকাভাবে নিতে পারি না।

প্রায়ই মেয়ের সঙ্গে আমার শেষ মুহূর্তের কথা আমি ভাবি এবং কৃতজ্ঞতা বোধ করি তখন, যা যা করতে পেরেছি এবং যা যা বলতে পেরেছি সে জন্য। আমি বুঝতে পেরেছি, আমাকেও একইভাবে শান্তিতে আমার স্রষ্টার কাছে ফিরতে হবে। তাই আমি আরও দয়ালু, ক্ষমাশীল হওয়ার চেষ্টা করছি এবং ক্ষোভ ধরে রাখি না। আল্লাহর নির্ধারিত তকদিরের ওপর ভরসাই আমার হৃদয়কে এখন শান্তি দেয়। ভাবি, তিনি যা লিখে রেখেছেন, তা আমার মঙ্গলের জন্যই।

৩. নিয়ামতের দিকে মনোযোগী হোন

মারিয়ামের মৃত্যু আমাকে ধীর হতে, আরও মনোযোগ দিতে, মননশীলভাবে বাঁচতে, প্রতিদিনকে গুরুত্ব দিতে এবং আমাকে দেওয়া আল্লাহর নিয়ামতের প্রতি আরও সচেতন হতে শিখিয়েছে।

দুনিয়াতে এমনভাবে থাকো, যেন তুমি অচেনা বা মুসাফির।
সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৪১৬

এখন একটা আপেল বা কফি খেলেও এর সৃষ্টি, আকৃতি, গন্ধ, স্বাদ এবং এই নিয়ামতের উৎস নিয়ে ভাবি। ভাবি, দয়ালু আল্লাহর ভালোবাসা এবং আমাদের প্রতি তাঁর যত্নের কথা। তাঁর ভালোবাসার প্রতিদান দেওয়ার চেষ্টা করি তাঁর সঙ্গে এবং সৃষ্টির সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং তাদের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করা মাধ্যমে।

এই ভ্রান্ত ধারণাও ত্যাগ করেছি যে আমার করণীয় সব কাজ সম্পূর্ণ করতেই হবে। না, সারা বিশ্বের ভাগ্য আমার কাঁধে অর্পণ করা হয়নি। আমার কাজ সাধ্যমতো চেষ্টা করা মাত্র। এই অনুভূতি আমার মানসিক চাপ কমিয়ে দিয়েছে ও তৃপ্তি বাড়িয়েছে। এখন আর আমি যা পাই না বা করতে পারি না, তার জন্য অভিযোগ করি না।

মৃত্যু সত্যিই সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক। যদি আমরা সাহসের সঙ্গে মৃত্যুর মুখোমুখি হই, তবে তা আমাদের জীবনকে আরও দীপ্তিমান করবে। বিষাক্ত সম্পর্ক এবং অপ্রয়োজনীয় বিভ্রান্তি থেকে মুক্তি দেবে। তাই আমাদের নবী মুহাম্মদ (সা.) আমাদেরকে এই দুনিয়ায় একজন যাত্রী বা অপরিচিতের মতো থাকতে উৎসাহিত করেছেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৪১৬)

ড. জয়নেব সাইলগান: যুক্তরাষ্ট্রের ইনস্টিটিউট ফর ইসলামিক, ক্রিশ্চিয়ান, জ্যুইশ স্টাডিজে (আইসিজেএস) ইসলামি ধর্মতত্ত্ব ও অধ্যাত্মবাদের গবেষক

মুসলিম ম্যাটার্স থেকে অনুবাদ: মনযূরুল হক