সিরাতে রাসুলের (সা.) অনালোচিত বিষয়: ২

রাসুলুল্লাহ (সা.) কি ব্যবসা করেছেন

রাসুলুল্লাহ (সা.) ব্যবসার মাধ্যমে উপার্জন করেছেন। তাঁর বয়স যখন পঁচিশের কাছাকাছি, তখন কুরাইশের অন্য যুবকদের মতো তাঁকেও ব্যবসায় মনোযোগ দিতে হয়। রাসুলুল্লাহকে (সা.) প্রশ্ন করা হয়েছিল, কোন ধরনের উপার্জন উত্তম ও শ্রেষ্ঠ? প্রত্যুত্তরে তিনি বলেছেন, ‘মানুষের নিজ হাতে করা কাজ এবং সৎ ব্যবসা।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ১৭,২৬৫; মুসনাদে বাযযার, হাদিস: ৭৮৪)

মিকদাদ (রা.) বর্ণনা করেছেন যে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘নিজ হাতে উপার্জিত খাবারের চেয়ে উত্তম কোনো খাবার কেউ কখনো আহার করে না। নবী দাউদ (আ.)–ও নিজ হাতে উপার্জন করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।’ (বুখারি, হাদিস: ২,০৭২)

ব্যবসাকে উপার্জনের সবচেয়ে উত্তম মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)। অন্য আরেকজনের সঙ্গে মিলে অংশীদারত্বে ব্যবসা করেছেন। আবার মুদারাবার (পরিচালক ও মালিকের মধ্যে এই পদ্ধতিতে মুনাফা বণ্টনের চুক্তি হতো এবং চুক্তিমতো লাভের একটা অংশ পরিচালক পেত) ভিত্তিতেও ব্যবসা করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে সায়েব (রা.)-এর সঙ্গে অংশীদারত্বে ব্যবসা করেছেন রাসুলুল্লাহ (সা.)।

আবদুল্লাহ ইবনে সায়েব (রা.) বলেন, ‘আমি জাহেলিয়াতের যুগে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে ব্যবসায় অংশীদার ছিলাম। আমি যখন মদিনায় গেলাম তখন তিনি বললেন, আমাকে চিনেছেন? আমি বললাম, কেন চিনব না? আপনি তো আমার ব্যবসার ভালো একজন অংশীদার ছিলেন। না কোনো অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছেন; না কোনো কিছু নিয়ে আমার সঙ্গে ঝগড়া করেছেন!’ (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, আবুল ফিদা হাফিজ ইবনে কাসীর আদ-দামেশকী (র.), ইসলামিক ফাউণ্ডেশন, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা: ৪৮০)

ব্যবসা পরিচালনার দায়িত্ব: রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চাচা আবু তালিব একদিন রাসুলুল্লাহ (সা.)–কে বললেন, ‘ভাতিজা, তুমি তো দেখছ আমার আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো না। একের পর এক মন্দার বছর আসছে। না আছে সম্পদ, না আছে ব্যবসা। বাণিজ্য কাফেলা শামে যাওয়ার সময়ও আসছে। বাণিজ্য কাফেলার সঙ্গে পাঠানোর জন্য খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ উপযুক্ত পুরুষ খুঁজছেন। এর আগেও অনেকে খাদিজার হয়ে তার ব্যবসা পরিচালনা করে উপার্জন করেছে। লভ্যাংশ প্রদানের বিনিময়ে তিনি লোকবল নিয়োগ করেন। আমি বলি, তুমি একবার খাদিজার কাছে নিজের আগ্রহের কথা জানাও। আমার মনে হয় তিনি তোমাকে নির্দ্বিধায় গ্রহণ করবেন এবং ব্যবসা পরিচালনার দায়িত্ব দেবেন।’

চাচার সব কথা রাসুলুল্লাহ (সা.) শুনে কোমল কণ্ঠে বললেন, ‘দুশ্চিন্তা করবেন না চাচাজান; আমার বিশ্বাস, খাদিজা নিজেই আমার কাছে ব্যবসার প্রস্তাব পাঠাবেন।’

কথাবার্তা শেষে দুজন যে যার মতো চলে গেলেন। খাদিজার কাছে চাচা-ভাতিজার এই কথোপকথনের বার্তা পৌঁছে গিয়েছিল। দেরি না করে তিনি লোক মারফত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে প্রস্তাব পাঠালেন। প্রস্তাবের ভাষ্য ছিল অনেকটা এমন, আপনার সত্যবাদিতা, আমানতদারি ও চারিত্রিক সৌন্দর্য সম্পর্কে আমি অবগত। আপনার এসব গুণ আমাকে এ প্রস্তাব পাঠাতে উৎসাহিত করেছে। আর হ্যাঁ, আপনি ব্যবসা করতে সম্মত হলে অন্যদের চেয়ে আপনাকে আমি দ্বিগুণ লভ্যাংশ দেব।

রাসুলুল্লাহ (সা.) খাদিজার প্রস্তাব গ্রহণ করলেন। তারপর চাচা আবু তালিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিস্তারিত জানালেন। সব শুনে আবু তালিব বললেন, ‘নিঃসন্দেহে এই রিজিক আল্লাহতায়ালাই তোমার কাছে টেনে এনেছেন।’ (খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ (রা.),  শাইখ আবদুল হামিদ মাহমুদ তাহমাজ ও শাইখ ইবরাহিম মুহাম্মাদ হাসান আল জামাল, অনুবাদ: মাহমুদ সিদ্দিকী, দ্বীন পাবলিকেশন্স, পৃষ্ঠা: ৮৪-৮৫)

তৎকালীন আরবদের অন্যতম বাণিজ্যরীতি ছিল মক্কার ধনী ব্যবসায়ীদের মধ্যে যারা দূরবর্তী সফরে যেতে পারতেন না, বাজারের কার্যক্রমে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে পারতেন না কিংবা নানা কারণে নিজে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করতে পারতেন না; তারা কর্মতৎপর, দক্ষ, পরিশ্রমী ও আমানতদার ব্যক্তিকে পরিচালক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করতেন। অনেকটা আধুনিক কালে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য নিয়োগ করা প্রধান নির্বাহীর পদের মতো। পরিচালক ও মালিকের মধ্যে মুদারাবা পদ্ধতিতে মুনাফা বণ্টন করা হতো। এতে উভয় পক্ষই লাভবান হতো। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আমানতদারিতা ও সততায় মুগ্ধ হয়ে খাদিজা (রা.) তাকে প্রথমে ব্যবসার পরিচালক পরে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করেন। এ ছাড়া খাদিজা (রা.)-এর সঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.) লভ্যাংশে অংশীদারত্বের চুক্তিতেও ব্যবসা করেছেন। (সীরাতে ইবনে হিশাম, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা: ১৬৬)

এ ছাড়া আবু জুবাইর ও জাবির (রা.) সূত্রে ইমাম বাইহাকি বর্ণনা করেছেন যে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘একটি জোয়ান মাদি উটের বিনিময়ে দুটি বাণিজ্য সফরে আমি খাদিজার জন্য শ্রম দিয়েছি।’ (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, আবুল ফিদা হাফিজ ইবনে কাসীর আদ-দামেশকী (রহ.), ইসলামিক ফাউণ্ডেশন, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা: ৫৮২)

 মিরাজ রহমান: লেখক