ইসলামে সাহসিকতা

সাহাবিরা কেন এত সাহসী ছিলেন

ইসলামের প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের সঙ্গে আজকের মুসলমানদের অন্যতম একটি পার্থক্য হলো তাঁদের দৃঢ়তা ও সাহসিকতায়। ইসলামের সূচনালগ্নে যে সমাজ গড়ে উঠেছিল, তা ছিল এমন কিছু মানুষের দ্বারা নির্মিত, যাঁরা ছিলেন আত্মত্যাগে প্রস্তুত, আল্লাহর নির্দেশে সমর্পিত, আদর্শে অটল, আর সাহসিকতায় অনন্য। এই সাহস কেবল বাহ্যিক দৃঢ়তা নয়, বরং ইমান ও তাওয়াক্কুল থেকে উৎসারিত এমন এক শক্তি, যা তাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছে, সত্য প্রতিষ্ঠায় উৎসর্গ করেছে এবং মৃত্যুর মুখেও ভীতসন্ত্রস্ত করেনি।

কোরআনে সাহসিকতার শিক্ষা

পবিত্র কোরআনে সাহসিকতা ও দৃঢ়তার প্রতি উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ, ধৈর্য অবলম্বন করো, মোকাবিলার সময় অবিচলতা প্রদর্শন করো এবং সীমান্ত রক্ষায় স্থিত থাকো। আর আল্লাহকে ভয় করে চলো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ২০০)

তারা যদি আমার ডান হাতে সূর্য আর বাঁ হাতে চাঁদ এনে দিয়ে বলে যে তুমি তোমার এই দাওয়াত থেকে বিরত হও, তাহলেও আমি এ কাজ থেকে বিরত হব না, যতক্ষণ না আল্লাহ আমাকে জয়ী করেন অথবা যদি এ কাজের জন্য আমার মৃত্যুও হয়।
(ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন-নাবাবিয়্যাহ, ১/২৬৬)

এই আয়াতে আল্লাহ চারটি নির্দেশ দেন—সবই সাহসিকতারই অনুষঙ্গ: ধৈর্য, অবিচলতা, সীমান্তে পাহারায় থাকা (জিহাদ বা আত্মরক্ষা) এবং আল্লাহভীতি। এগুলোর সমন্বয়েই গঠিত হয় একজন মুমিনের সাহসিকতা।

আবার অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে যে সবর অবলম্বন করে ও ক্ষমা প্রদর্শন করে, সেটা অবশ্যই অত্যন্ত সাহসের কাজ।’ (সুরা শুরা, আয়াত: ৪৩)

এখান থেকে বোঝা যায়, ইসলামে সাহস কেবল বাহ্যিক বীরত্বে নয়, বরং পাশাপাশি ধৈর্য ও ক্ষমাতেও মুসলমানদের সাহসিকতা নিহিত।

রাসুল (সা.)-এর জীবনে সাহসিকতা

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবন সাহসিকতার এক পরিপূর্ণ প্রতিচ্ছবি। তিনি একা একটি গোটা জাতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন, যখন পুরো কুরাইশ বংশ তাঁর দাওয়াত বন্ধ করতে চেয়েছিল। আবু তালিবের কাছে যখন কুরাইশ নেতারা চূড়ান্ত প্রস্তাব দেয়, তখন তিনি বলেন, ‘তারা যদি আমার ডান হাতে সূর্য আর বাঁ হাতে চাঁদ এনে দিয়ে বলে যে তুমি তোমার এই দাওয়াত থেকে বিরত হও, তাহলেও আমি এ কাজ থেকে বিরত হব না, যতক্ষণ না আল্লাহ আমাকে জয়ী করেন অথবা যদি এ কাজের জন্য আমার মৃত্যুও হয়।’ (ইবনে হিশাম, আস-সিরাতুন-নাবাবিয়্যাহ, ১/২৬৬)

এখান থেকে বোঝা যায়, ইসলামে সাহস কেবল বাহ্যিক বীরত্বে নয়, বরং পাশাপাশি ধৈর্য ও ক্ষমাতেও মুসলমানদের সাহসিকতা নিহিত।

তিনি আরও বলেছেন, ‘সর্বোত্তম জিহাদ হলো একজন জালিম শাসকের সামনে সত্য কথা বলা।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ২,১৭৪)

আনাস (রা.) বলেন, ‘নবীজি ছিলেন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম, সবচেয়ে সাহসী এবং সবচেয়ে উদার।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২,৮২০, সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,৩০৭)

সাহাবিদের সাহসিকতা

রাসুলের সাহাবিদের জীবন তাঁদের দৃঢ়তা ও সাহসিকতার সাক্ষ্য দেয়। তাঁদের সাহসিকতা ছিল এমন, যা মানুষকে পার্থিব জীবনকে তুচ্ছ করে উচ্চতর আদর্শে নিবেদিত হতে শেখায়।

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, “প্রথম যাঁরা প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, তাঁরা ছিলেন সাতজন—আল্লাহর রাসুল (সা.), আবু বকর, আম্মার, তাঁর মা সুমাইয়াহ, সুহাইব, বিলাল ও মিকদাদ। রাসুল (সা.)-কে আল্লাহ তাঁর চাচা আবু তালিবের মাধ্যমে নিরাপত্তা দিয়েছিলেন। আবু বকরকে তাঁর গোত্র রক্ষা করেছিল। আর বাকি সবাইকে মুশরিকরা ধরে নিয়ে লোহার বর্ম পরিয়ে রোদে পোড়াত।

তাঁদের মধ্যে এমন কেউ ছিলেন না, যিনি কিছুটা হলেও মুশরিকদের দাবি মেনে নেননি—শুধু বিলাল ছাড়া। আল্লাহর পথে তাঁর নিজের জীবন তাঁর কাছে তুচ্ছ ছিল এবং তিনি তাঁর জাতির কাছে কোনো মর্যাদার দাবিদার ছিল না।

তারা তাঁকে ধরে শিশুদের হাতে তুলে দেয়, তারা তাকে মক্কার পাহাড়ি গলিতে টেনে নিয়ে বেড়াত, আর তিনি বলতেই থাকতেন: ‘আহাদ, আহাদ (আল্লাহ এক, আল্লাহ এক)।’” (ইবনে মাজাহ, হাদিস: ১৫০)

তাঁর এই সাহসিকতা ছিল আল্লাহর একত্বের প্রতি অটলতা ও দৃঢ়তার ফল।

তারা তাঁকে ধরে শিশুদের হাতে তুলে দেয়, তারা তাকে মক্কার পাহাড়ি গলিতে টেনে নিয়ে বেড়াত, আর তিনি বলতেই থাকতেন: ‘আহাদ, আহাদ (আল্লাহ এক, আল্লাহ এক)।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস: ১৫০)

উমর ইবনে খাত্তাব (রা.)-এর সাহসিকতা ইসলামের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী অধ্যায়। তিনি ইসলাম গ্রহণ করার পর প্রকাশ্যে কাবায় নামাজ আদায় করেছিলেন। হিজরতের সময় তিনি ঘোষণা করে মক্কা ত্যাগ করেছিলেন এবং বলেছিলেন, ‘যে চায় তার মা সন্তানহারা হোক, স্ত্রী বিধবা হোক অথবা সন্তান এতিম হোক, সে যেন আমার পিছু পিছু আসে!’ (উসদুল গাবাহ, ৪/১৪৫)

তিনি আপন সাহস প্রকাশ করেছিলেন ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক ও বিচারিক ক্ষেত্রেও। তিনি এক খুতবায় বলেছিলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল ব্যক্তিটিই আমার কাছে সবচেয়ে শক্তিশালী, যতক্ষণ না আমি তার হক আদায় করে দিই। আর তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তিটিও আমার কাছে সবচেয়ে দুর্বল, যতক্ষণ না আমি তার কাছ থেকে অন্যের হক আদায় করে নিই।’ (আল-কামিল ফিল-লুগাহ ওয়াল-আদাব, ১/১৪)

তিনি অভিভাবকদের উদ্দেশে বলেন, ‘তোমরা তোমাদের সন্তানদের সাঁতার, তিরন্দাজি ও ঘোড়সওয়ারি শেখাও, আর তাদের এমন কবিতা শেখাও, যা চরিত্রকে শোভন করে।’ (আল-কামিল ফিল-লুগাহ ওয়াল-আদাব, ১/২১১)

সাহসী ব্যক্তির গুণমুগ্ধ হয়ে যিয়াদ বিন আবদিল মালিক বলতেন, ‘আমি সেই ব্যক্তিকে পছন্দ করি, যে অবমাননাকর প্রস্তাব পেলে স্পষ্টভাবে জোর দিয়ে “না” বলতে জানে।’ (আল-কামিল ফিল-লুগাহ ওয়াল-আদাব, ১/২৩৯)

আমি সেই ব্যক্তিকে পছন্দ করি, যে অবমাননাকর প্রস্তাব পেলে স্পষ্টভাবে জোর দিয়ে ‘না’ বলতে জানে।
যিয়াদ বিন আবদিল মালিক, আল-কামিল ফিল-লুগাহ ওয়াল-আদাব

ইসলামের ইতিহাসে নারীদের সাহসিকতারও অনেক উদাহরণ রয়েছে। হজরত আসমা বিনতে আবু বকর (রা.), যিনি হিজরতের রাতে খাবার ও গোপন তথ্য পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছিলেন, মৃত্যুভয়কেও জয় করেছিলেন। হজরত খাউলা বিনতে আযওয়ার (রা.) যুদ্ধক্ষেত্রে পুরুষ যোদ্ধাদের পাশে দাঁড়িয়ে লড়েছেন।

আবার ইয়াসির পরিবার—যাদের ওপর এমন নির্যাতন চালানো হয়েছিল, সেই পরিবারের সুমাইয়া (রা.) ইসলামের প্রথম নারী হিসেবে শহীদ হন। তাঁরা আল্লাহর দ্বীনের প্রতি অবিচল থেকেছেন মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও। তাঁদের এই সাহসিকতা ছিল এমন এক আত্মবিশ্বাসের ফল, যা দুনিয়ার কোনো শক্তিকে ভয় পায় না।

ইসলামে সাহসিকতা কেবল বাহ্যিক বীরত্ব নয়, বরং অন্তরের দৃঢ়তা, সত্যের প্রতি নিষ্ঠা ও আল্লাহর ওপর নির্ভরতার ফল। এটি এমন এক গুণ, যা মানুষকে নিজের সীমা ছাড়িয়ে ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে শেখায়, জীবনকে অর্থবহ করে তোলে এবং ইহকালে-পরকালে সাফল্য এনে দেয়। আমাদের নিজেদের সেই সাহসিকতার আদর্শে নিজেকে গড়ে তুলতে হবে, যা রাসুল (সা.), সাহাবায়ে কেরাম ও আমাদের পূর্বসূরিরা রেখে গেছেন।