‘রংপুর অঞ্চলে মা ও নবজাতকের স্বাস্থ্যসেবা: বিদ্যমান অবস্থা, চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা। ২৭ আগস্ট ২০২৫ রাজধানীর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সভাকক্ষে
‘রংপুর অঞ্চলে মা ও নবজাতকের স্বাস্থ্যসেবা: বিদ্যমান অবস্থা, চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা। ২৭ আগস্ট ২০২৫ রাজধানীর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সভাকক্ষে

গোলটেবিল বৈঠক

রংপুর অঞ্চলে মা ও নবজাতকের স্বাস্থ্যসেবা: বিদ্যমান অবস্থা, চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

‘রংপুর অঞ্চলে মা ও নবজাতকের স্বাস্থ্যসেবা: বিদ্যমান অবস্থা, চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় গত ২৭ আগস্ট রাজধানীর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সভাকক্ষে। কোরিয়া ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি ‘কোইকা’র সহযোগিতায় সেভ দ্য চিলড্রেন বাংলাদেশ- এর ‘জননী প্রকল্প’ এ গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। এ আয়োজনে প্রচার সহযোগী ছিল প্রথম আলো।

আলোচনা

ডা. এস এম আবদুল্লাহ আল মুরাদ

লাইন ডিরেক্টর (এমএনসি অ্যান্ড এএইচ), স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

বাংলাদেশের মাতৃস্বাস্থ্য ও শিশুস্বাস্থ্যে আমরা উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছি। এই সাফল্য এসেছে সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। আমাদের লক্ষ্য—২০৩০ সালের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব ৮৫ শতাংশে উন্নীত করা, দক্ষ প্রসবকারীর মাধ্যমে প্রসব ৯০ শতাংশে পৌঁছানো এবং অন্তত ৮৮ শতাংশ গর্ভবতী মায়ের কাছে গর্ভকালীন সেবা পৌঁছে দেওয়া। একই সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের শতভাগ প্রসবপরবর্তী সেবা নিশ্চিত করাও আমাদের উদ্দেশ্য।

দেশব্যাপী জরুরি প্রসূতিসেবা, মাতৃস্বাস্থ্য ভাউচার স্কিম, এমবিডিআরএস প্রোগ্রাম ও এএনসি কার্যক্রম চালু রয়েছে। অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান কমাতে প্রশিক্ষণ ও সচেতনতামূলক কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি জরায়ু ও স্তন ক্যানসার স্ক্রিনিং এবং এইচপিভি ভ্যাকসিন কার্যক্রমও চলছে।

রংপুর অঞ্চলের মাতৃস্বাস্থ্যবিষয়ক তথ্য জাতীয় গড়ের তুলনায় পিছিয়ে থাকায় সেখানে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে দুটি জেলায় কার্যক্রম শুরু হয়েছে, ধাপে ধাপে তা বিস্তৃত করা হবে। এ অঞ্চলে বাল্যবিবাহ, অল্প বয়সে গর্ভধারণ ও এএনসি-পিএনসি সচেতনতা কম থাকায় স্কুলভিত্তিক ও কমিউনিটি পর্যায়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। ২৪/৭ সেবা, আউটরিচ ক্লিনিক ও মোবাইল হেলথ সার্ভিসের মাধ্যমে দুর্গম ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকেও সেবা দেওয়া হচ্ছে। আমরা বিশ্বাস করি, এসব পদক্ষেপ ভবিষ্যতে মাতৃস্বাস্থ্য ও শিশুস্বাস্থ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে।

ডা. সোহেল হাবিব

লাইন ডিরেক্টর, এমসিআর এএইচ, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর

বিডিএইচএস ২০২২ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী রংপুর অঞ্চলে শিশুবিবাহের হার ৫৮ শতাংশ। সেখানে গিয়ে আমি দেখেছি ১৫ বছরের কিশোরীরা দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার গর্ভবতী হয়েছে। আমি মনে করি, বাল্যবিবাহই এখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা। বাল্যবিবাহ রোধ করতে না পারলে শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যু বাড়বে। এ জন্য উন্নয়ন সহযোগী, প্রশাসন ও সবাইকে নিয়ে আমাদের এটি বন্ধ করতে হবে।

আমাদের ডেলিভারি সেন্টারগুলোয় ২৪ ঘণ্টা বিনা মূল্যে সেবা দেওয়া হচ্ছে এবং এই সেবায় জননী প্রজেক্টের যৌথ উদ্যোগে ভালো ফল পাওয়া যাচ্ছে। রংপুর অঞ্চলে গাইবান্ধা এফডব্লিউসি সারা দেশে নরমাল ডেলিভারিতে প্রথম স্থান অর্জন করেছে। তবে পোস্টপার্টাম ফ্যামিলি প্ল্যানিং সেবায় আইইউডি সরবরাহে ঘাটতি আছে। লজিস্টিক ও আর্থিক সহায়তা না থাকায় আমরা কষ্টে কোনোভাবে চালাচ্ছি। আমাদের সহযোগিতা প্রয়োজন।

জননী প্রজেক্টের সঙ্গে আমাদের কার্যক্রম ভালোভাবে অ্যালাইন হয়েছে। আমরা বিভিন্ন জায়গায় পথনাটক ও বউ-শাশুড়ির মেলা করেছি, যা ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। তবে স্থায়ী পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতিতে (এলএএম (ল্যাম), লাইগেশন, ইমপ্লান্ট) স্বাস্থ্য বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় নেই। মাঠপর্যায়ে আমাদের এফডব্লিউএরা শতভাগ কাজ করলেও স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মীরা নিয়মিতভাবে রোগী রেফার করছেন না। আমি আশা করি, ভবিষ্যতে জননী প্রকল্প, পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ ও স্বাস্থ্য বিভাগ একসঙ্গে কাজ করে সমন্বয় জোরদার করবে এবং রংপুরের চ্যালেঞ্জগুলো দূর করবে।

ডা. জয়নাল আবেদীন টিটো

লাইন ডিরেক্টর (হসপিটাল সার্ভিসেস ম্যানেজমেন্ট), স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

উত্তরাঞ্চলের অনেক মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা দুর্বল হওয়ায় তাঁদের পক্ষে প্রাইভেট হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করা সম্ভব হয়না। তাই ওই সব এলাকার মাতৃস্বাস্থ্য সেবা ও শিশুস্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে হলে সরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো শক্তিশালী করতে হবে। বর্তমানে কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন সাব সেন্টার, ইউনিয়ন হেলথ অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার সেন্টার ও উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সের মাধ্যমে সেবা দেওয়া হলেও তা আরো উন্নত করার সুযোগ রয়েছে।

মাতৃমৃত্যু হ্রাসের জন্য অ্যান্টিনাটাল কেয়ারটা অত্যন্ত জরুরি। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ পাওয়া মিডওয়াইফ থাকলেও পর্যাপ্ত নেই। উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সে আলট্রাসাউন্ড, ব্লাড টেস্টসহ প্রয়োজনীয় ইনভেস্টিগেশন নিশ্চিত করা দরকার। নবজাতকের মৃত্যু কমাতে স্পেশাল কেয়ার ইউনিট ফর নিউবর্ন প্রয়োজন।

প্রাইমারি হেলথ কেয়ারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে দেখতে হবে। এ সেবাকে কার্যকর করতে হলে দরকার অবকাঠামো উন্নয়ন, দক্ষ জনবল, পরীক্ষা–নিরীক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ, নিয়মিত এএনসি, সাশ্রয়ী ইনভেস্টিগেশনের ব্যবস্থা ও বেসরকারি ক্লিনিকের জবাবদিহি নিশ্চিত করা। পাশাপাশি পাবলিক–প্রাইভেট পার্টনারশিপ ও এনজিওদের সম্পৃক্ততা থাকলে মাতৃস্বাস্থ্য ও শিশুস্বাস্থ্যে আমরা আরও অগ্রগতি অর্জন করতে পারব।

ডা. গওসুল আজিম চৌধুরী

ডিভিশনাল ডিরেক্টর (রংপুর), স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

আমরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এএনসি ও পিএনসি সেবা বাড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছি। এতে ঝুঁকিপূর্ণ মায়েদের চিহ্নিতকরণ এবং প্রাতিষ্ঠানিক ডেলিভারি নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে, যা মা ও শিশুমৃত্যু কমাতে সহায়ক। কমপ্লেক্সগুলোয় প্রশিক্ষিত নার্স ও চিকিৎসক রয়েছেন।

দূরবর্তী অঞ্চল থেকে মায়েদের আনতে অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা জরুরি। পরিবহন–সুবিধা ও অ্যাম্বুলেন্সে বিশেষ ব্যবস্থা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। পুষ্টিহীন মায়েদের পুষ্টি বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শিশু ও কিশোরীদের বিবাহ প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধি ও কাউন্সেলিং কার্যক্রম চলছে।

গাইনি, শিশুবিশেষজ্ঞ ও অ্যানেসথেসিওলজিস্টের শূন্য পদ পূরণে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে। মাঠপর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীর ঘাটতি পূরণে নিয়োগপ্রক্রিয়া চলছে। কমিউনিটি ক্লিনিক ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মধ্যে সমন্বয়হীনতা দূর করতে কাজ করা হচ্ছে।

সিজারিয়ান সেকশন শুধু প্রয়োজন অনুযায়ী হবে। তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ মায়েদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা হবে। সরকারি স্বাস্থ্যপ্রতিষ্ঠান যেন নিরাপদ ও আস্থার স্থল হিসেবে কাজ করে, তা নিশ্চিত করা আমাদের লক্ষ্য। আজকের বৈঠকের মাধ্যমে আমরা নতুন স্বাস্থ্য দিগন্ত উন্মোচনের অঙ্গীকার করছি। আমাদের লক্ষ্য—সুস্থ মা ও সুস্থ শিশুর জন্ম নিশ্চিত করা।

দেওয়ান মোর্শেদ কামাল

ডিভিশনাল ডিরেক্টর (রংপুর), পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর

রংপুর অঞ্চলে মা ও নবজাতকের স্বাস্থ্যসেবা জাতীয় গড়ের তুলনায় পিছিয়ে। বিশেষ করে বাল্যবিবাহ ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে। সম্প্রতি গাইবান্ধার চর এলাকায় দেখা গেছে, ২৫ জন গর্ভবতীর মধ্যে ১৮ জন অল্পবয়সী, যা মা ও শিশুর জন্য বিপজ্জনক। আমরা চেষ্টা করছি কাউন্সেলিং করতে, কিন্তু আর্থসামাজিক ও প্রশাসনিক সীমাবদ্ধতায় কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাচ্ছে না।

পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের কাজের অন্যতম লক্ষ্য কিশোরীদের প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন করা। স্কুল-কলেজ পর্যায়ে কিশোরীদের প্রশিক্ষিত ও সচেতন করে আমরা তাদের সুস্থ মা হওয়ার জন্য প্রস্তুত করছি। প্রাতিষ্ঠানিক ডেলিভারির প্রসার ও প্রাক্‌-ডেলিভারি সেবা বৃদ্ধি করার জন্য আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে হোম ডেলিভারি শূন্য করার লক্ষ্য নিয়েছি। রংপুর, লালমনিরহাট ও গাইবান্ধায় ইতিমধ্যেই সফল মডেল তৈরি হয়েছে, যা বিভাগের সব ইউনিয়নে ছড়ানো হবে।

প্রাতিষ্ঠানিক সেবা, ডেলিভারি, এএনসি ও পিএনসি উন্নয়নে স্থানীয় সরকারসহ সব অংশীদারের সহযোগিতা জরুরি। আমাদের এফডব্লিউভিরা শিক্ষিত ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাঁদের সক্ষমতা, যথাযথ সরঞ্জাম ও জনবল পেলে আমরা গরিব জনগোষ্ঠীর জন্য কার্যকর ফল আনতে পারব। এই পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়িত হলে রংপুরসহ পুরো বিভাগের মা ও শিশুস্বাস্থ্য উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হবে।

সাইফুল ইসলাম মজুমদার   

সিনিয়র সহকারী সচিব, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় 

রংপুরে পরিবার পরিকল্পনা জাতীয় পর্যায়ের তুলনায় ভালো ফলাফল করছে। এটিকে স্বাস্থ্যসেবার অন্যান্য ইন্ডিকেটরের সঙ্গে সংযুক্ত করে আরও শক্তিশালী করতে হবে। উপজেলা পর্যায়ে দেখা যায় সেবার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা আছে—অ্যাম্বুলেন্স নেই, রাতের সেবা কম, জনবল ও সরঞ্জাম সীমিত। তবে মোটিভেশন ও তথ্য-শিক্ষা প্রচারণায় অনেক সুযোগ আছে। প্রিভেন্টিভ কেয়ার ও নিউট্রিশন বিষয়ে একাধিক মন্ত্রণালয় একসঙ্গে কাজ করলেও সরকারি যন্ত্রপাতি বা সরঞ্জাম পর্যাপ্ত নয়।

প্রিভেন্টিভ কেয়ারের ক্ষেত্রে নিউট্রিশনের গুরুত্ব বেশি। শুধু সাপ্লিমেন্টেশন নয়, গর্ভবতী ও শিশুদের খাদ্য, রোদ ও প্রাকৃতিক উপাদানগুলোকে নজরে রাখতে হবে। এ ধরনের কার্যক্রম শুধু সরঞ্জাম বা ট্যাবলেট দিয়ে সম্ভব নয়, শিক্ষিত ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ জনবল, সচেতনতা ও স্থানীয় অংশীদারদের সমন্বয় প্রয়োজন।

স্থানীয় সরকার, যুব ও মহিলা বিষয়ক দপ্তর, এনজিও ও ডেভেলপমেন্ট পার্টনারদের একীভূত করতে হবে। উপজেলা ও জেলা কো–অর্ডিনেশন মিটিংয়ে ইন্টারডিপার্টমেন্টাল সমন্বয় করলে কার্যকারিতা বাড়ানো সম্ভব। আমি আশা করি, এই সমন্বিত প্রচেষ্টায় রংপুরে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম আরও কার্যকর হবে।

ডা. আ ন ম মোস্তফা কামাল মজুমদার 

উপপরিচালক (সার্ভিসেস) ও প্রোগ্রাম ম্যানেজার (মাতৃস্বাস্থ্য), পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর

মাতৃমৃত্যু, নবজাতক মৃত্যু ও পাঁচ বছরের নিচে শিশুদের মৃত্যুহার কমানোর পাশাপাশি আধুনিক পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতির ব্যবহার বাড়াতে কাজ করছে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর।  

দেশের ১ হাজার ২৫৩টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রে আমরা কৈশোরবান্ধব কর্নার স্থাপন করেছি। সেখানে প্রজনন ও মানসিক স্বাস্থ্য, সহিংসতা প্রতিরোধ, পুষ্টি সচেতনতা এবং বাল্যবিবাহের ক্ষতি নিয়ে পরামর্শ দেওয়া হয়। কোনো কারণে বিয়ে হয়ে গেলে অন্তত ২০ বছরের আগে যাতে গর্ভধারণ না হয়, সে বিষয়ে আমরা পরামর্শ ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা দিচ্ছি। আমরা প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় পদ্ধতিও প্রদান করি।

এ কাজে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর, মহিলা ও শিশুবিষয়ক অধিদপ্তর, শিক্ষা অধিদপ্তর, সমাজসেবা অধিদপ্তরসহ এনজিও ও দাতা সংস্থাগুলোকে সঙ্গে নেওয়া হয়েছে। নতুনভাবে আমরা প্রি-মেরিটাল ও প্রি-প্রেগনেন্সি কাউন্সেলিং যোগ করেছি। কিশোরীদের বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সাম্প্রতিক সময়ে মেডিকেল শিক্ষার্থীদের একটি সোসাইটি গড়ে উঠেছে। তারা, গার্ল গাইডস ও বিএনসিসির সদস্যরা মিলে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে প্রচার চালাচ্ছে। আমাদের দেশের ৩ হাজার ২৯১টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রে এ কার্যক্রম বিস্তৃত।

ডা. মোয়াজ্জেম হোসেন সরকার

প্রোগ্রাম ম্যানেজার (মাতৃস্বাস্থ্য), স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

মাতৃস্বাস্থ্য–সংক্রান্ত সমস্যাগুলোর মূল চ্যালেঞ্জ হলো সমাধানের বাস্তবায়ন। একেক ক্ষেত্রে ভিন্ন ধরনের সুনির্দিষ্ট সমাধান প্রয়োজন হয়। কোয়ালিটি এএনসির সঙ্গে ল্যাব–সুবিধা নিশ্চিত করা না হলে সেটাকে মানসম্মত বলা যায় না। একই সঙ্গে হাসপাতালে ২৪ ঘণ্টার সেবা নিশ্চিত করতে হবে। মায়েরা যদি রাতে এসে সেবা না পান, তবে তাঁরা অনিরাপদ প্রতিষ্ঠানে চলে যাবেন। এ জন্য আমরা স্থানীয়ভাবে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার না থাকলে সার্ভিস পারচেজ মডেল পরীক্ষা করছি। সরকারি হাসপাতালে মিডওয়াইফ ও নার্স আছেন, তবে জটিল ক্ষেত্রে বাইরের বিশেষজ্ঞকে এনে সেবা দেওয়া হয়। এতে খরচও কমে, আবার কার্যকর সেবা দেওয়া যায়। যদিও দুর্গম এলাকায় এ মডেল কাজ করবে না, তবে অর্থ ব্যবস্থাপনায় এটি কার্যকর হতে পারে।

আমাদের রেফারেল সিস্টেমেও ঘাটতি আছে। হাসপাতালে ন্যূনতম সেবা নিশ্চিত করতে হবে এবং মনিটরিং জোরদার করতে হবে। সরকারি–বেসরকারি দুই ধরনের প্রতিষ্ঠানই মাতৃসেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেরও সক্ষমতা ও মান উন্নয়নে মেন্টরিং দরকার। আমরা অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসকেও সিস্টেমে আনার উদ্যোগ নিচ্ছি, যাতে মা দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন।

আমাদের মূল কাজ হলো সমস্যা চিহ্নিত করে কার্যকর সমাধান তৈরি করা, সেটি পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা এবং পরে সরকারি সিস্টেমে নিয়ে আসা। সমস্যার সমাধান একেক ক্ষেত্রে ভিন্ন হতে পারে, তবে সমাধান ছাড়া এগোনো সম্ভব নয়।

নাসিমা খাতুন

প্রোগ্রাম অফিসার, মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচি, মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর

বাংলাদেশ সরকার অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলে মা ও শিশুদের পুষ্টি চাহিদা পূরণ এবং শিশুদের সার্বিক বিকাশের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। এই উদ্দেশ্যে মহিলা শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর মা ও শিশুসহায়তা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এই কর্মসূচির মাধ্যমে সুবিধাবঞ্চিত পরিবারের ২০ থেকে ৩৫ বছর বয়সী গর্ভবতী নারী প্রথম ও দ্বিতীয় গর্ভধারণ সময়ে কর্মসূচির ভাতাভোগী হিসেবে অন্তর্ভুক্তি হতে পারবেন। নির্বাচিত হওয়ার পরবর্তী মাস থেকে ৮৫০ টাকা হারে ৩৬ মাসব্যাপী ভাতা পেয়ে যাবেন।  গর্ভকালীন পর্যাপ্ত পুষ্টি, সঠিক পরিচর্যা খাদ্য অভ্যাসের পরিবর্তন ইত্যাদি বিষয়ে মা ও শিশুসহায়তা কর্মসূচি ভাতাভোগীদের প্রশিক্ষণ প্রদান করে থাকেন।

মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের ইউনিয়ন পর্যায়ে কোনো কর্মী না থাকায়, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মাঠকর্মীদের মাধ্যমে ভাতাভোগীদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়ে থাকে। সঠিক ভাতাভোগী নির্বাচনের সঙ্গে পরিবার পরিকল্পনা এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহযোগিতা রয়েছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের এএনসি ছাড়া ভাতাভোগী নির্বাচন করা সম্ভব নয়। মা ও শিশুর সহায়তা কর্মসূচির একটি নিজস্ব এমআইএস আছে। এএনসি–সংক্রান্ত ডেটা সংশ্লিষ্ট দপ্তরের এম আই এসে থাকলে ইন্টার অপারাবিলিটির মাধ্যমে মা ও শিশুসহায়তা কর্মসূচি সঠিক ভাতাভোগী নির্বাচন করতে পারবে।

ডা. শাহীন সুলতানা

সিভিল সার্জন, রংপুর

আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো মা ও নবজাতকের মৃত্যুহার কমানো। এ জন্য গর্ভকালীন ও প্রসবপরবর্তী অন্তত চারবার চেকআপ করা দরকার। একই সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক ডেলিভারি নিশ্চিত করতে হবে। এগুলো বাস্তবায়িত হলে মা ও শিশুর মৃত্যুহার উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে।

কিন্তু বাস্তবে সমস্যা অনেক। ইনস্টিটিউশনাল ডেলিভারির ক্ষেত্রে বিভিন্ন উপজেলায় পেডিয়াট্রিক কনসালট্যান্ট নেই। একটি শিশুর জন্মের পর তাকে দেখার জন্য বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দরকার, সেটাই অনেক জায়গায় পাওয়া যাচ্ছে না। কোথাও গাইনোকোলজিস্ট আছেন, কোথাও অ্যানেস্থেসিয়া কনসালট্যান্ট নেই—এ সমস্যাও গুরুতর।

রংপুর জেলায় আমার আটটি উপজেলা আছে। এখানে যাঁরা দক্ষ সেবাদানকারী হিসেবে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, তাঁরা বছরের পর বছর বসে আছেন, কাজে লাগানো যাচ্ছে না। কোথাও লেবার, টেবিল ও অবকাঠামো থাকলেও তাঁরা ব্যবহার করতে পারছেন না। যদি তাঁদের সঙ্গে মিডওয়াইফ যুক্ত করা যেত, তাহলে অফিস সময়ের মধ্যে অনেক কাজ করা সম্ভব হতো। এরপর রোগীকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রেফার করা যেত।

আমি মনে করি, সব দিক বিবেচনা করে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সক্ষম জনবল, সঠিক অবকাঠামো, বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ও সামাজিক সচেতনতা—সবকিছু মিলিয়ে আমরা মা ও শিশুর মৃত্যুহার কমাতে পারব।

ডা. গোলাম মোদাব্বীর

ডিরেক্টর (হেলথ অ্যান্ড নিউট্রিশন), সেভ দ্য চিলড্রেন বাংলাদেশ

রংপুর অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবার কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। এ অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থান, সমতল ভূমি, চর ও মিশ্র এলাকার উপস্থিতি এবং ঋতুভিত্তিক ভিন্নতা; শীতকাল, বর্ষাকাল, শুষ্ক মৌসুম—সব মিলিয়ে চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।

এখানকার দারিদ্র্য ও অপুষ্টির হার অনেক বেশি, যা মা ও কিশোরীদের জন্য স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে। স্থানীয় বিশ্বাস, প্রথা ও আচরণগত অভ্যাসের কারণে অনেক মা সেবা গ্রহণে অনীহা দেখাচ্ছেন। পরিবহন ব্যবস্থার দুর্বলতা, ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতা ও প্রাতিষ্ঠানিক সেবার কম উপস্থিতি নবজাতক ও মায়ের স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করছে। স্বাস্থ্যকর্মীরা ২৪/৭ থাকার কথা থাকলেও অনেকেই অনুপস্থিত থাকেন। অবকাঠামোগত প্রস্তুতিতেও ঘাটতি আছে।

এই সীমাবদ্ধতা মোকাবিলায় উন্নয়ন সহযোগীদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। উন্নয়ন সহযোগীদের কাজ হলো সরকারের সীমাবদ্ধতা পূরণ করা। রেফারেল মেকানিজম এবং বিকল্প সেবা প্রদান মডেল নিয়ে গবেষণা করা দরকার। চর অঞ্চলের মতো দুর্গম এলাকায় স্বাস্থ্যসুবিধা না থাকায় আমরা স্থানীয় সমিতি বা পরিবহন ব্যবস্থার মাধ্যমে জরুরি পরিবহন ব্যবস্থা উন্নত করার চেষ্টা করছি। তহবিল বরাদ্দ ও সামাজিক আচরণ পরিবর্তনের ওপর মনোযোগ দেওয়াও গুরুত্বপূর্ণ।

ডা. শামস এল আরেফিন

ইমেরিটাস বিজ্ঞানী, আইসিডিডিআরবি

আমাদের একই ধরনের কৌশল নয়, এলাকাভিত্তিক ভিন্ন কৌশল প্রয়োজন। কারণ, কোথাও চর আছে, কোথাও দুর্গম এলাকা আছে। এ ধরনের ভৌগোলিক ও সামাজিক বাস্তবতাকে বুঝতে পারবেন কেবল স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীরা। তাই সমাধানও তাঁদের কাছ থেকেই আসা উচিত।

আমার অভিজ্ঞতায় দেখি, বহুবছর ধরে সরকার রিসোর্স বরাদ্দ দেয়, কিন্তু স্থানীয়ভাবে কীভাবে তা ব্যবহার হবে, সে স্বাধীনতা সীমিত থাকে। অথচ সমস্যা সমাধানের মূল চাবিকাঠি এই অটোনমির মধ্যেই। কোনো কোনো জেলায় সেবা গ্রহণ শতভাগ, আবার কোথাও খুবই কম। এই বৈষম্যের কারণ বোঝার জন্য স্থানীয় পর্যায়ে গভীর বিশ্লেষণ দরকার।

আমি বলব, সমস্যাটা কেবল মানুষদের অশিক্ষা বা দারিদ্র্যে নয়, বরং সিস্টেমের ভেতরের বাধাগুলোতে। এগুলো ভাঙতে হলে স্থানীয় পর্যায়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। যেমন চরাঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছানো যায় কি না, তার জন্য বিকল্প পরিবহন বা হাসপাতালের মডেল তৈরি হতে পারে।

সবশেষে আমি মনে করি, সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের আস্থা এখনো যথেষ্ট তৈরি হয়নি। সেবা বাড়লেও প্রাইভেট খাতে বেশি হয়েছে। তাই আস্থা পুনরুদ্ধারই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আমার মতে, এই আস্থাই হবে ভবিষ্যতের টেকসই সমাধানের ভিত্তি।

ডা. ইখতিয়ার উদ্দিন খন্দকার

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ

জাতীয় তথ্যের তুলনায় রংপুর অনেক ক্ষেত্রেই পিছিয়ে আছে—স্বাস্থ্য, মাতৃত্ব, শিশু স্বাস্থ্য ও বাল্যবিবাহের সূচকে। তাই রংপুরকে আলাদা করে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। সরকারের নেতৃত্ব সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর আরও সক্রিয়তা প্রয়োজন।

বাস্তবায়নের জন্য তিনটি ধাপে মনোযোগ দিতে হবে। প্রথম, ডিমান্ড সাইড—যাদের কাছে সেবা প্রয়োজন, যেমন গর্ভবতী মা, কিশোরী বা শিশু—তাদের আইডেন্টিফিকেশন করা। দ্বিতীয় ধাপ হলো সাপ্লাই সাইড। সার্ভিস প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ও হেলথ পয়েন্ট, যেমন ইউনিয়ন হেলথ, কমিউনিটি ক্লিনিক, উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্স—এখানকার হিউম্যান রিসোর্স সীমিত।

তৃতীয় ধাপ হলো লিডারশিপ ও কো–অর্ডিনেশন। ইউনিয়ন হেলথ ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার সেন্টার ম্যানেজমেন্ট কমিটি, কমিউনিটি ক্লিনিক গ্রুপ এবং স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোকে কার্যকর করতে হবে।  উন্নয়ন সহযোগীরা অবিরাম প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে পারে, যাতে সরকারি পরিকল্পনা ও বাজেটে প্রতিফলিত হয়। এই দুই উপায়ে রংপুরকে বিশেষভাবে সংজ্ঞায়িত ও সমাধানমুখীভাবে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব।

ডা. অনিমেষ বিশ্বাস

প্রোগ্রাম স্পেশালিস্ট, মাতৃস্বাস্থ্য, ইউএনএফপিএ বাংলাদেশ

রংপুর অঞ্চলের মাতৃমৃত্যু পরিস্থিতি মোকাবিলা এখনো অনেক চ্যালেঞ্জিং। মাতৃমৃত্যুর কারণ আমরা জানলেও কার্যকর পদক্ষেপের ঘাটতির কারণে এখনো অনেক মা মারা যাচ্ছেন।

আমাদের মূল লক্ষ্য হলো এসডিজি অর্জন অর্থাৎ মাতৃমৃত্যুর অনুপাত ২০ বা তার নিচে এবং নবজাতক মৃত্যুর হার ১২ বা তার নিচে নামিয়ে আনা। এ জন্য কৌশলগত বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি। গাইডলাইন, কৌশল ও নীতি যথেষ্ট আছে, এখন সেগুলোকে প্রাসঙ্গিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। বিশেষ করে ইউনিয়ন পর্যায়ে ২৪/৭ সেবা নিশ্চিত করতে মিডওয়াইফদের সঠিকভাবে নিয়োগ ও নিয়মিত প্রশিক্ষণ জরুরি।

আমি মনে করি, তথ্যনির্ভর পদক্ষেপ নিতে হবে। কর্মের এলাকা চিহ্নিত করে সেখানে অগ্রাধিকারমূলক কাজ হাতে নিতে হবে। প্রসবজনিত ফিস্টুলার মতো দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতাকেও সমাধান করতে হবে। পাশাপাশি ভাতা ও অন্যান্য সহায়তা সঠিকভাবে লক্ষ্যভিত্তিক গোষ্ঠীতে পৌঁছানো জরুরি। সেবার মান সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। গর্ভকালীন, প্রসবকালীন ও প্রসবোত্তর সেবার মান বাড়িয়ে মাতৃমৃত্যু কমানো সম্ভব।

ধারণাপত্রের সারমর্ম

ডা. উজ্জ্বল কুমার রায়

প্রকল্প পরিচালক, জননী প্রকল্প

আজকের আলোচনায় চারটি মূল বিষয় নিয়ে কথা বলেছি। প্রথমেই আমি সংক্ষেপে জননী প্রকল্প সম্পর্কে ধারণা দিয়েছি। জননী প্রকল্পের নাম হচ্ছে স্ট্রেনদেনিং দ্য নিউনেটাল হেলথ সিস্টেম ইন রংপুর বাংলাদেশ। এটি মূলত স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থা শক্তিশালীকরণের উদ্যোগ। দাতা সংস্থা হলো দক্ষিণ কোরিয়ার KOICA, আর কারিগরি সহযোগিতা দিচ্ছে সেভ দ্য চিলড্রেন বাংলাদেশ। আমরা কাজ করছি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, পরিবার কল্যাণ অধিদপ্তর ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে। প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে আরডিআরএস বাংলাদেশ এবং গবেষণা পার্টনার হলো আইসিডিডিআরবি। প্রকল্পটি ২০২৩ সালের মার্চে শুরু হয়েছে এবং ২০২৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে। প্রথম ধাপে রংপুর ও লালমনিরহাট জেলার ১৩টি উপজেলার ৪০টি ইউনিয়নে কার্যক্রম চলছে।

আমাদের লক্ষ্য হলো রংপুরের পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর মাতৃ ও নবজাতক স্বাস্থ্যসেবায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনা। এর মাধ্যমে এএনসি, পিএনসি ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিরাপদ ডেলিভারি নিশ্চিত করা। একই সঙ্গে নীতিগত ঘাটতি চিহ্নিত করে সুপারিশ দেওয়া। প্রকল্পের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হলো স্বাস্থ্য সিস্টেমে টেকসই পরিবর্তন আনা, মাতৃ ও নবজাতক মৃত্যুহার কমানো এবং এসডিজি-৩ অর্জনে অবদান রাখা।

আমাদের কাজের চারটি মূল উপাদান হলো—প্রথমত, মাতৃ ও নবজাতক স্বাস্থ্যসেবা জোরদার করা; দ্বিতীয়ত, সামাজিক আচরণ পরিবর্তন যোগাযোগ; তৃতীয়ত, স্থানীয় সরকার সম্পৃক্তকরণ; এবং চতুর্থত, মনিটরিং, মূল্যায়ন ও নীতি-অ্যাডভোকেসি। আমরা ‘লাইফ সাইকেল অ্যাপ্রোচ’ ব্যবহার করি, যেখানে গর্ভবতী নারী, নবজাতক, কিশোরী ও পরিবার—সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

জননী প্রকল্পের বেজলাইন সার্ভের ডেটার ভিত্তিতে দেখা গেছে, রংপুর বিভাগ জাতীয় গড়ের তুলনায় পিছিয়ে আছে। এএনসি, পিএনসি, ফ্যাসিলিটি ডেলিভারি ও স্কিলড বার্থ অ্যাটেনডেন্ট ব্যবহার—সব ক্ষেত্রেই ঘাটতি রয়েছে। বিশেষ করে কোয়ালিটি অব কেয়ারে রংপুর মাত্র ১০ শতাংশে আছে, যেখানে জাতীয় গড় অনেক বেশি। নবজাতক মৃত্যুহার রংপুরে প্রতি হাজারে ৩০, কিন্তু জাতীয় গড় ২০। শিশুমৃত্যু ও আন্ডার-ফাইভ মৃত্যুও বেশি।

আরেকটি বড় সমস্যা হলো প্রারম্ভিক বিয়ে ও কিশোরীদের গর্ভধারণ। আমাদের বেজলাইনে আরও দেখা গেছে, ১৮ বছরের আগে বিয়ের হার ৬৩ শতাংশ, যা জাতীয় গড়ের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। কিশোরীদের মধ্যে গর্ভধারণের হারও জাতীয় গড়ের দ্বিগুণের বেশি। এগুলো স্পষ্টতই স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায়।

সবশেষে আমি বলেছি, আজকের গোলটেবিল আলোচনার উদ্দেশ্য হলো রংপুরের বর্তমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সমন্বিত পরিকল্পনা তৈরি করা। আর্থিক, কারিগরি ও মানবসম্পদ ব্যবহারে সমন্বয়, সেবা প্রদানের সক্ষমতা বৃদ্ধি, কমিউনিটি সম্পৃক্তকরণ এবং নীতি-অ্যাডভোকেসি—এই তিনের সমন্বয়ে একটি দীর্ঘমেয়াদি কৌশল গড়ে তুলতে হবে। লক্ষ্য হলো রংপুরকে জাতীয় গড়ের সমপর্যায়ে কিংবা আরও উন্নত অবস্থানে নিয়ে যাওয়া।

সুপারিশ

  • নারীর প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের হার বৃদ্ধি ও দক্ষ প্রসবকারীর মাধ্যমে প্রসব নিশ্চিত করা।

  • ইউনিয়ন পর্যায়ে ২৪/৭ সেবা প্রদানের জন্য প্রশিক্ষিত মিডওয়াইফ নিয়োগ ও সক্ষমতা বৃদ্ধি।

  • স্থানীয় সরকার, এনজিও, উন্নয়ন সহযোগী ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় জোরদার করা।

  • বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ ও কিশোরীদের প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি।

  • হাসপাতাল ও উপজেলা পর্যায়ে অবকাঠামো ও জনবলের ঘাটতি পূরণ করা, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ প্রদান।

  • বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতালের মানোন্নয়ন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা।

  • দুর্গম এলাকা (চর, সীমান্ত ও গ্রামীণ অঞ্চল) অনুযায়ী বিকল্প স্বাস্থ্যসেবা ও জরুরি পরিবহনব্যবস্থা তৈরি করা।

এ ছাড়া গোলটেবিল বৈঠকে আরও অংশগ্রহণ করেন:   স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেপুটি ডিরেক্টর (রংপুর) মো. ওয়াজেদ আলী, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের প্রোগ্রাম ম্যানেজার (নবজাতক ও শিশুস্বাস্থ্য) ও সহকারী পরিচালক (সার্ভিসেস) মো. নাসির আহমেদ, লালমনিরহাটের সিভিল সার্জন আব্দুল হাকিম, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাতৃস্বাস্থ্যের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার (মনিটরিং) সেলিনা আক্তার, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (সমন্বয়) মো. নুরুল হক , সহকারী পরিচালক (বিদ্যালয় স্বাস্থ্য)  আসিফ ইকবাল,  পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের লালমনিরহাটের উপপরিচালক (পরিবার পরিকল্পনা) মো. শাহ জালাল, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের রংপুরের উপপরিচালক (পরিবার পরিকল্পনা) মো. সাইফুল ইসলাম, আরডিআরএস বাংলাদেশের সামাজিক উন্নয়ন বিভাগের প্রধান মজিবুল হক মনির, জননী প্রকল্পের ম্যানেজার-ফিল্ড অপারেশনস গোলাম ফখরুদ্দীন, ম্যানেজার-পলিসি অ্যাডভোকেসি মুশাররাত জাহান, টেকনিক্যাল স্পেশালিস্ট-কমিউনিকেশন অ্যান্ড ডকুমেন্টেশন জাহানারা হৃদিতা, প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর মোহাম্মদ ফরাজদুক ভূঞা প্রমুখ। সঞ্চালক: ফিরোজ চৌধুরী, সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো।