‘জলবায়ু পরিবর্তন: উত্তরাঞ্চলে এর প্রভাব ও প্রতিকারের উপায়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে (বাঁ থেকে) জিলুফা সুলতানা, নূর আলম, সিরাজুল ইসলাম, আবু ছায়েম ও সেলোয়ারা বেগম। গতকাল রংপুর শহরের একটি রেস্তোরাঁয়
‘জলবায়ু পরিবর্তন: উত্তরাঞ্চলে এর প্রভাব ও প্রতিকারের উপায়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে 
(বাঁ থেকে) জিলুফা সুলতানা, নূর আলম, সিরাজুল ইসলাম, আবু ছায়েম ও সেলোয়ারা বেগম। 
গতকাল রংপুর শহরের একটি রেস্তোরাঁয়

গোলটেবিল বৈঠক

উত্তরে জলবায়ুর প্রভাব বহুমুখী 

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে  বিভাগীয় গোলটেবিল বৈঠক হ্যালভেটাস বাংলাদেশের সহযোগিতায় আয়োজন করে ইএসডিও ও প্রথম আলো

উত্তরাঞ্চলের জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আওয়াজ তোলার সময় এসেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ অঞ্চলের মানুষ ভয়াবহ অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। নদীভাঙন, বন্যা, অতি বন্যা, খরা, অতিরিক্ত তাপমাত্রা ও তীব্র শীতে জনজীবনে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। এই জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার জন্য দরকার জলবায়ু অভিযোজন ক্ষমতা বাড়ানো। পরিকল্পিতভাবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও মানুষের কর্মসংস্থানকে গুরুত্ব দিতে হবে। একই সঙ্গে নারী ও শিশুর স্বাস্থ্যঝুঁকি নিরসনে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে।

‘জলবায়ু পরিবর্তন: উত্তরাঞ্চলে এর প্রভাব ও প্রতিকারের উপায়’ শীর্ষক বিভাগীয় সংলাপে এমন বক্তব্য উঠে এসেছে। হ্যালভেটাস বাংলাদেশের সহযোগিতায় ইএসডিও এবং প্রথম আলোর উদ্যোগে গতকাল বুধবার রংপুরের রায়ান’স হোটেল মিলনায়তনে এই সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। সংলাপে সরকারের পাঁচ অধিদপ্তরের পরিচালক, উপপরিচালক, নাগরিক সমাজ ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধি, ভুক্তভোগী নারী, পুরুষ, শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমকর্মী অংশ নেন।

আলোচনায় অংশ নিয়ে রংপুর বিভাগীয় সমাজসেবা কার্যালয়ের পরিচালক জিলুফা সুলতানা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উত্তরাঞ্চলের বড় সমস্যা বাস্তুচ্যুতি। নদীভাঙনের কারণে হাজার হাজার মানুষ প্রতিবছর বাস্তুচ্যুতির শিকার হচ্ছেন। কিন্তু নদী খনন ব্যয়বহুল। এ ক্ষেত্রে একটা সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের রংপুর বিভাগীয় পরিচালক নূর আলম বলেন, দেশের প্রধান তিন নদী উত্তরাঞ্চলের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এসব নদীতে অনেক পলি পড়ে। কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধায় প্রচুর নদীভাঙন হয়। তিনি জানান, জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের অধীনে রংপুরের গঙ্গাচড়ায় একটি প্রকল্প চলছে। সেখানে গরিব মানুষকে ঘর করে দেওয়া হবে। সৌরবিদ্যুৎ–চালিত সেচপাম্প ও রাস্তাঘাট করা হবে। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে যেসব উন্নয়ন সংস্থা কাজ করে, তাদের জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্টের অধীনে প্রকল্প করার সুপারিশ করেন নূর আলম।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অসময়ে বন্যা হচ্ছে। এর ফলে যথাসময়ে ফসল রোপণ করতে পারছেন না কৃষকেরা। এতে উৎপাদন কমে যাচ্ছে। কৃষি খুব স্পর্শকাতর। দেখা যায়, আমন মৌসুমে তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রির ওপরে ও ১০ ডিগ্রির নিচে নামলেই ধান চিটা হয়ে যায়। তাপমাত্রা বাড়লে পোকা ও রোগের আক্রমণ বাড়ে।

রংপুরের বুড়িরহাট হর্টিকালচার সেন্টারের উপপরিচালক আবু ছায়েম বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের এই বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা করতে হলে আমাদের সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। আমাদের নারী, পুরুষ, কৃষক, চর, গ্রাম ও শহরের মানুষ—প্রত্যেককে আরও বেশি সচেতন করতে হবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নারী ও শিশুরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন জেলা মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের উপপরিচালক সেলোয়ারা বেগম।

‘ধান বন্যা আসি ডুবি যায়’

জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি হ্রাসে জলবায়ু অভিযোজনের কার্যক্রম তুলে ধরেন ইএসডিওর  একসেস প্রকল্পের প্রজেক্ট অপারেশন গোলাম ফারুক। তিনি বলেন, এ প্রকল্পের আওতায় তাঁরা কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী, উলিপুর ও সদর উপজেলায় কাজ করছেন। জেলা, উপজেলা, ইউনিয়নে জলবায়ু পরিষদ গঠন করা হয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে চরাঞ্চলের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে কথা বলেন নাগেশ্বরীর চর হামারের কুটির বাসিন্দা ও একসেস প্রকল্পের রশিদা বেগম। রশিদা বলেন, ‘হামরা চরের লোক। ধান বন্যা আসি ডুবি যায়। হামরা তো আর উঠতে পারি না। বন্যার কারণে রাস্তাঘাট ভেঙে যায়। চরে গাছ লাগাই। কিন্তু অতি গরমে মরে যায়। এই দ্যাখেন, অতিরিক্ত শীত। বাচ্চা, বৃদ্ধ মা অসুখে পড়ছে শীতের কারণে।’ একই উপজেলার চর টুপামারীর বাসিন্দা ও কলেজশিক্ষার্থী জুলেখা খাতুন বন্যার সময় তাঁদের চরে ভাঙা রাস্তাঘাট মেরামতের উদাহরণ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, তাঁরা একটি রাস্তায় বাঁশের সাঁকো নির্মাণ করেছেন। এতে দুই গ্রামের ২০ হাজার মানুষ চলাচল করেন। নারী উদ্যোক্তা খাদিজা পারভীন বন্যার সময়ে নারীদের স্যানিটারি ন্যাপকিন দিতে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার প্রতি আহ্বান জানান।

কুড়িগ্রামের উন্নয়ন সংস্থা নারীর নির্বাহী পরিচালক ফরিদা ইয়াসমিন তাঁদের সংস্থা থেকে চিলমারীর তিনটি বাঁধে মোবাইল সোলার পাওয়ার ব্যাংক স্থাপনের কথা জানান। এতে বাঁধে বসবাসকারী পরিবারগুলো সুবিধা পাচ্ছে।

উলিপুর উপজেলা জলবায়ু পরিষদের সভাপতি ও অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ফিরোজ আলম জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা মোকাবিলায় তাঁদের তিনটি পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন। তার মধ্যে একটি হলো উপজেলার বুড়াবুড়ি ও ধরণীবাড়ি ইউনিয়নে বন্যার কারণে একটি জনগুরুত্বপূর্ণ রাস্তা ভেঙে গিয়েছিল। তাঁরা স্থানীয় জনগণ ও উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে দ্রুত এটি সংস্কার করেছেন।

কুড়িগ্রাম জেলা জলবায়ু পরিষদের সহসভাপতি চাষি নুরন্নবী সরকার অবশ্য জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কাটাতে কুড়িগ্রাম জেলা প্রণোদনা ও বৈষম্য কমানোর দাবি করেন।

জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন প্রতিষ্ঠানটির বিভাগীয় প্রতিনিধি জাহেদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমরা কুড়িগ্রামের চরনারায়ণপুরে হেলথ কেয়ার সেন্টার স্থাপন করেছি। বন্যার সময় অনেক গবাদিপশু মারা যায়। এ জন্য আমরা “কাউশেড” তৈরি করছি। উত্তরাঞ্চলের কৃষকের ক্ষতি কমাতে বিদ্যুৎ ছাড়া আলু সংরক্ষণাগার করার একটি পাইলট প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। প্রতিবছর ব্র্যাক থেকে লাখ লাখ বৃক্ষ রোপণ করা হচ্ছে।’

প্রতিবছর নদীভাঙন ও বন্যায় তিস্তায় প্রায় এক লাখ কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয়ে যায় বলে উল্লেখ করেন তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও আন্দোলনের সংগঠক বখতিয়ার হোসেন। তিনি তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবি জানান।

মহিলা পরিষদের রংপুরের সহসভাপতি আয়েশা সিদ্দিকা স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীদের পরিবেশ বিষয়ে সচেতন করতে প্রচারণার ওপর জোর দেন। সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) রংপুর জেলা কমিটির সভাপতি ফখরুল আনাম বলেন, রংপুর অঞ্চলে শিল্পকারখানা কম হলেও দূষণ কমাতে সচেতন হতে হবে। শহরের পার্শ্ববর্তী ইটভাটাগুলোর বায়ুদূষণ কমাতে পদক্ষেপ নিতে হবে।

এ ছাড়া ইএসডিওর জ্যেষ্ঠ কো–অর্ডিনেটর রেজানুর রহমান, উপজেলা কো–অর্ডিনেটর মৃত্যুঞ্জয় রায়, লালমনিরহাটের হরিণ চওড়া মাঝের চরের আলোর পাঠশালার শিক্ষক দীপ্ত তালুকদার, রংপুরের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক নজরুল মৃধা, স্বপন চৌধুরী, মেরিনা লাভলী, কুড়িগ্রামের সংবাদকর্মী জাহানুর রহমান ও সুজন মোহন্ত বক্তব্য দেন।

অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী। স্বাগত বক্তব্য দেন রংপুরে কর্মরত প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক জহির রায়হান।