‘জলবায়ু পরিবর্তন: উপকূলীয় অঞ্চলে এর প্রভাব ও প্রতিকারের উপায়’ শীর্ষক বিভাগীয় সংলাপে অংশগ্রহণকারী অতিথিরা, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫ খুলনা প্রেসক্লাবে
‘জলবায়ু পরিবর্তন: উপকূলীয় অঞ্চলে এর প্রভাব ও প্রতিকারের উপায়’ শীর্ষক বিভাগীয় সংলাপে অংশগ্রহণকারী অতিথিরা, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫ খুলনা প্রেসক্লাবে

জলবায়ু পরিবর্তন: উপকূলীয় অঞ্চলে এর প্রভাব ও প্রতিকারের উপায়

হেলভেটাস বাংলাদেশের সহযোগিতায় উত্তরণ, ডর্প, ইএসডিও এবং প্রথম আলোর উদ্যোগে ‘জলবায়ু পরিবর্তন: উপকূলীয় অঞ্চলে এর প্রভাব ও প্রতিকারের উপায়’ শীর্ষক বিভাগীয় সংলাপ অনুষ্ঠিত হয় ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫ খুলনা প্রেসক্লাবে।

অংশগ্রহণকারী

অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির

নির্বাহী পরিচালক, সুন্দরবন একাডেমি

নজরুল ইসলাম

উপপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর

হোসেনুর রহমান

সহকারী পরিচালক, খুলনা জেলা সমাজসেবা কার্যালয়

আব্দুল করিম

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা, খুলনা

নবনীতা দত্ত

উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা, দিঘলিয়া, খুলনা

বেগম রেহানা ঈসা

শিক্ষক ও নারীনেত্রী

গৌরাঙ্গ নন্দী

লেখক ও গবেষক

মাহফুজুর রহমান

খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়কারী, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)

শামিমা সুলতানা

সভাপতি, উইমেন চেম্বার অব কমার্স, খুলনা

আবু ফেরদৌস চৌধুরী

দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস ও ওয়াশ কর্মকর্তা, উত্তরণ, মোরেলগঞ্জ, বাগেরহাট

আবুল হাসনাত

কৃষি কর্মকর্তা, উত্তরণ, মোরেলগঞ্জ, বাগেরহাট

খলিলুর রহমান

প্রকল্প উপকারভোগী, মোরেলগঞ্জ, বাগেরহাট

রনি হাওলাদার

প্রকল্প উপকারভোগী, মোরেলগঞ্জ, বাগেরহাট

সঞ্চালনা: ফিরোজ চৌধুরী

সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনা

আবু ফেরদৌস চৌধুরী

দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস ও ওয়াশ কর্মকর্তা, উত্তরণ, মোরেলগঞ্জ, বাগেরহাট

জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত উপকূলীয় বাংলাদেশে প্রতিদিনই নতুন করে দৃশ্যমান হচ্ছে। লবণাক্ততা, জলাবদ্ধতা, নদীর নাব্যতা হ্রাস আর ঘন ঘন জোয়ার—এসবের সরাসরি প্রভাব পড়ছে মানুষের জীবন ও জীবিকায়। এমন বাস্তবতায় জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ ও টেকসই সমাধান নিশ্চিত করতে হেলভেটাস বাংলাদেশের সহযোগিতায় ‘অ্যাকসেস’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে উত্তরণ। এই প্রকল্পটি বাগেরহাটের উপকূলীয় মোরেলগঞ্জ ও শরণখোলা উপজেলার আটটি ইউনিয়নের ২৪টি ওয়ার্ডে পরিচালিত হচ্ছে। ঝুঁকির মাত্রা বিবেচনায় প্রতিটি ইউনিয়নের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ তিনটি ওয়ার্ড নির্বাচন করা হয়েছে। প্রকল্পের প্রথম বছর শেষের পথে।

এই প্রকল্পের মূল কাজের ক্ষেত্র দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস, পানি ও ওয়াশ, কৃষি, অ্যাডভোকেসি, অভিবাসনকেন্দ্র ও তথ্যকেন্দ্র। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উপকূলীয় অঞ্চলে বহু রাস্তাঘাট ও আবাদি জমি লবণাক্ত ও জলাবদ্ধ হয়ে পড়ছে। জোয়ারের সময় সড়ক ডুবে যায়, সাইক্লোন শেল্টারের সঙ্গে সংযোগকারী রাস্তাগুলো চলাচলের অযোগ্য হয়ে ওঠে। এসব সমস্যা মোকাবিলায় মাটি ও ইটের সলিং রাস্তা মেরামত, ড্রেন নির্মাণ এবং লোহার ও ভাসমান সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে, যাতে দুর্যোগকালে মানুষ সহজে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে পারে এবং কৃষিজমিতে পানি জমে না থাকে।

কাঠামোগত কাজের পাশাপাশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে সচেতনতামূলক কার্যক্রমেও। নিয়মিত প্রশিক্ষণ, সভা, প্রদর্শনী ও দুর্যোগ মহড়ার মাধ্যমে মাঠপর্যায়ে মানুষকে প্রস্তুত করা হচ্ছে সম্ভাব্য বিপদের জন্য।

পানি ও ওয়াশ খাতে স্কুলভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। প্রতিটি স্কুলে গড়ে তোলা হয়েছে স্কুল ব্রিগেড, যাদের মতামতের ভিত্তিতে নতুন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে স্কুলে ভেন্ডিং মেশিন স্থাপন করা হচ্ছে, যাতে শিক্ষার্থীরা নিরাপদে মাসিককালীন ব্যবস্থাপনা করতে পারে। পাশাপাশি স্যানিটারি ন্যাপকিন সরবরাহও নিশ্চিত করা হচ্ছে। স্থানীয় সেবা প্রদানকারীদের প্রশিক্ষণ ও উপকরণ সহায়তা দেওয়া হয়েছে, যাতে স্যানিটেশনসেবা সহজে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে যায় এবং একই সঙ্গে তাদের জীবিকাও টেকসই হয়। স্কুলে নিরাপদ পানির জন্য ট্যাংক ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে ফিল্টার বসানো হয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাড়তে থাকা অভিবাসন ঝুঁকি মোকাবিলায় চালু রয়েছে অভিবাসন কেন্দ্র। এখানে মানুষ কাজের জন্য যাওয়ার আগে প্রয়োজনীয় তথ্য ও সহায়তা পাচ্ছে। পাশাপাশি কৃষি তথ্যকেন্দ্র থেকে কৃষকেরা আধুনিক বীজ, উপকরণ ও সিদ্ধান্তমূলক পরামর্শ পাচ্ছেন—যা জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তাঁদের সহায়ক হচ্ছে।

আবুল হাসনাত

কৃষি কর্মকর্তা, উত্তরণ, মোরেলগঞ্জ, বাগেরহাট

দক্ষিণ উপকূলে কাজ করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় যে পরিবর্তনটি স্পষ্ট হয়ে উঠছে, তা হলো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব—বিশেষ করে লবণাক্ততার বিস্তার। ২০১০ সালে দেশে লবণাক্ত জমির পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ৫৫ হাজার হেক্টর। গত ১৫ বছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ৬০ হাজার হেক্টরে। অর্থাৎ এক দশকের কিছু বেশি সময়ে এক লাখ হেক্টরের বেশি জমি লবণাক্ততার কবলে পড়েছে। এই প্রবণতা নিঃসন্দেহে একটি অশুভ সংকেত।

উপকূলীয় কিছু এলাকায় মাটির লবণাক্ততা ৪০ ডিএস পার মিটার পর্যন্ত পৌঁছেছে, যা কৃষির জন্য ভয়াবহ দুঃসংবাদ। দেশের মোট জমির প্রায় ৩০ শতাংশ উপকূলীয় অঞ্চলে অবস্থিত। সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাটসহ বিভিন্ন উপকূলীয় জেলায় লবণাক্ততা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে ফসল উৎপাদন ও ফলনে। বিশেষ করে পশুর খাবারের সংকট দিন দিন তীব্র হচ্ছে।

এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি ও চলমান পরিকল্পনা। প্রকল্প শেষ হয়ে গেলেই যেন কার্যক্রম থেমে না যায়—এমন একটি প্রক্রিয়া গড়ে তোলাই এখন জরুরি। এতে সরকারি-বেসরকারি সব পক্ষের অংশীদারত্ব দরকার। আন্তর্জাতিক সহায়তা ও গবেষণা সংস্থা, দেশের গবেষণাপ্রতিষ্ঠান এবং কৃষি বিভাগকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

লবণসহনশীল, খরাসহনশীল ও দুর্যোগসহনশীল পশুখাদ্য, খাদ্যশস্য, তেলবীজ ও বিভিন্ন ফসলের জাত উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণের দিকে বিশেষ নজর দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। পাশাপাশি মিঠা পানির সংরক্ষণ, কৃষক প্রশিক্ষণ এবং উন্নত সেচব্যবস্থার দিকে কৃষি মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো দৃষ্টি দিলে উপকূলের কৃষি টিকিয়ে রাখার একটি সুস্পষ্ট পথনির্দেশনা তৈরি হতে পারে।

অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির

নির্বাহী পরিচালক, সুন্দরবন একাডেমী

বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রতিবছর প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে। জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়, লবণাক্ত পানি ও মানুষের কর্মকাণ্ড এ অঞ্চলের পরিবেশ ও জীবনধারায় গভীর প্রভাব ফেলছে। কিন্তু সমস্যাগুলো সমাধানে সরকারি ও এনজিও সংস্থাগুলোর কার্যক্রম অনকে ক্ষেত্রেই সমন্বিত নয়। প্রতিটি অধিদপ্তর আলাদাভাবে কাজ করছে। ফলে উন্নয়ন প্রকল্পগুলো টেকসই হয় না।

চাষাবাদ ও অর্থনীতিক হিসাবেও সমস্যা আছে। যেমন চিংড়ি বা ড্রাগন ফল চাষের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আসে, কিন্তু সামাজিক ও পরিবেশগত ক্ষতিকে দেখা হয় না। খাদ্যনিরাপত্তার ক্ষেত্রেও অনিয়ম। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে নতুন ফসল, যেমন তরমুজ চাষ হচ্ছে, যেখানে অতিরিক্ত সার ও কীটনাশকের ব্যবহার খাদ্যনিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে। শস্য উৎপাদন—চাল, গম—প্রাধান্য দেওয়া প্রয়োজন। খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা নিশ্চিত করা না হলে বিদেশি আমদানির ওপর নির্ভরতা বাড়বে।

উপকূলীয় অঞ্চলে স্বাস্থ্য সমস্যাও গুরুতর। লবণাক্ত পানি ব্যবহারে চর্মরোগ, পেটের পীড়া ও নারীর অসুস্থতা বেশি। দূরত্বজনিত সমস্যায় কারণে নিরাপদ পানি পান করতে পারছে না। যদিও আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি হয়েছে, সেগুলো নারীবান্ধব নয় এবং মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে যেতে চায় না। তাই বড়, মানসম্মত ও নারীবান্ধব আশ্রয়কেন্দ্রের প্রয়োজন।

প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট ঝুঁকির কারণে সুন্দরবন ও নদী পরিবেশ ক্রমশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মোংলা বন্দর, বিদ্যুৎকেন্দ্র ও শিল্পাঞ্চল বনভূমি ও জলসম্পদ নষ্ট করছে। বাঁধ ও খালগুলোর সঠিক ব্যবস্থাপনা, নদীর ড্রেজিং এবং বন সংরক্ষণ না করলে প্রকল্পগুলো কার্যকর হবে না। অভিবাসন, খাদ্য উৎপাদন, পরিবেশ ও সামাজিক ব্যবস্থাপনার মধ্যে সমন্বয় ছাড়া টেকসই সমাধান সম্ভব নয়।

একটি সমন্বিত পরিকল্পনা ছাড়া নদী ব্যবস্থাপনা, কৃষি উন্নয়ন, বন সংরক্ষণ ও নারী ক্ষমতায়ন সব অর্ধেক চেষ্টা হয়ে যাবে। সুন্দরবনের মতো অনন্য বনাঞ্চলের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় প্রয়োজন। এ ছাড়া ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রগুলো বাজার, বিনোদনকেন্দ্র ও নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে পুনঃকাঠামোগত করা যেতে পারে, যাতে ঝুঁকি কমে এবং স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়।

উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সমন্বিত পরিকল্পনা, শক্তিশালী বাঁধ, স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র, খাদ্যনিরাপত্তা ও সুন্দরবন সংরক্ষণ জরুরি। এই পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করলে উপকূলীয় মানুষ নিরাপদ, স্বাস্থ্যসম্মত ও স্থায়ী জীবন যাপন করতে পারবে।

নজরুল ইসলাম

উপপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর

উজানে পানির প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে উপকূলীয় এলাকায় মিষ্টি পানির সংকট বেড়েছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে কৃষিতে। লবণাক্ততা বাড়ায় বহু এলাকায় ফসল উৎপাদন কমে গেছে, অনেক জমি পতিত হয়ে পড়ছে। একসময় যেখানে তিলসহ নানা ফসলের চাষ হতো, সেখানে এখন উৎপাদন নেমে এসেছে উল্লেখযোগ্যভাবে। জলবায়ু পরিবর্তন একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা হলেও স্থানীয়ভাবে মানুষের কর্মকাণ্ডও এই সংকটকে তীব্র করেছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পরিবেশ, কৃষি ও মানুষের জীবনযাত্রায় গভীর সংকট তৈরি হয়েছে। খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট—সুন্দরবনসংলগ্ন এই অঞ্চলটি হাজার বছরের পলি জমে গড়ে উঠলেও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এখন তার স্বাভাবিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।

এই পরিস্থিতিতে কৃষিতে টিকে থাকার জন্য নানা অভিযোজনমূলক উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ফসলের প্রতিস্থাপন এর একটি উদাহরণ। তিল চাষ কমে যাওয়ার পর তরমুজ চাষের প্রসার ঘটেছে, যা একদিকে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করলেও অন্যদিকে ঝুঁকিও বাড়িয়েছে। অতিরিক্ত সার ও কীটনাশকের ব্যবহার ভবিষ্যতের জন্য উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে। অনুমোদিত মাত্রা না মানলে দীর্ঘমেয়াদে কৃষিই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে লবণাক্ততা বাড়ায় প্রচলিত ফসল টেকানো কঠিন হয়ে পড়ছে। তাই বিকল্প ও সহনশীল ফসল—যেমন মিষ্টিকুমড়া, ভুট্টা, সূর্যমুখী, চিনাবাদাম, ড্রাগন ফল কিংবা চুইঝাল—চাষের চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি বস্তাপদ্ধতিতে আদা চাষ, মিনি পুকুর খনন ও ছোট খাল পুনরুদ্ধারের মতো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, যাতে মিষ্টি পানি সংরক্ষণ করা যায়।

তবে এসব উদ্যোগ বেশির ভাগই ক্ষুদ্র পরিসরে। বড় সংকটের সমাধানে প্রয়োজন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমন্বিত পদক্ষেপ। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে অভিযোজনের জন্য স্থানীয় পর্যায়ের উদ্যোগ যেমন জরুরি, তেমনি রাষ্ট্রীয় ও আন্তদেশীয় সহযোগিতাও অপরিহার্য। এই দুইয়ের সমন্বয়েই উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষি, পরিবেশ ও মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব।

রনি হাওলাদার

প্রকল্পের উপকারভোগী, মোরেলগঞ্জ, বাগেরহাট

২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর থেকে দক্ষিণাঞ্চলের কৃষির ওপর যেন একধরনের স্থায়ী চাপ নেমে এসেছে। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও এর ক্ষত পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। এখনো এ অঞ্চলে ধানের উৎপাদন খুবই কম। এর প্রধান কারণ হিসেবে উঠে আসে লবণাক্ততার তীব্র বিস্তার। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে মাটিতে লবণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় ধানসহ প্রচলিত ফসল চাষ ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে।

ধান উৎপাদনের সংকটের পাশাপাশি প্রাণিসম্পদ খাতেও নেমে এসেছে বড় ধরনের বিপর্যয়। একসময় যেখানে গবাদিপশু ছিল জীবিকার গুরুত্বপূর্ণ অংশ, সেখানে এখন প্রাণিসম্পদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। বর্তমানে যেটুকু প্রাণিসম্পদ টিকে আছে, সেগুলোর অস্তিত্বও হুমকির মুখে—কারণ এলাকায় তীব্র পশুখাদ্যের সংকট। এই সংকট অব্যাহত থাকলে প্রাণী খাত প্রায় বিলুপ্তির পথে চলে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

এই বাস্তবতায় জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় কৃষিতে নতুন করে ভাবার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে পশুখাদ্য উৎপাদন এবং আবহাওয়া ও লবণ সহনশীল ফসলের দিকে গুরুত্ব দেওয়া এখন সময়ের দাবি। এ ক্ষেত্রে বিভাগীয় কৃষি দপ্তর ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর সমন্বিত উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

স্থানীয় বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ পশুখাদ্য ও সহনশীল ফসলের সম্প্রসারণ হলে উপকূলের কৃষক ও খামারিরা কিছুটা হলেও স্বস্তি পেতে পারেন। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পুরোপুরি ঠেকানো সম্ভব না হলেও সঠিক পরিকল্পনা ও অভিযোজনমূলক উদ্যোগের মাধ্যমে কৃষি ও প্রাণিসম্পদ খাতকে টিকিয়ে রাখাই এখন উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় প্রতিকার।

খলিলুর রহমান

প্রকল্পের উপকারভোগী, মোরেলগঞ্জ, বাগেরহাট

সুন্দরবনের একেবারে পাশ ঘেঁষে অবস্থিত মোরেলগঞ্জ উপজেলার নিশানবাড়িয়া ইউনিয়ন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর একটি। এ অঞ্চলে কৃষি ও ফসল উৎপাদনের পাশাপাশি গবাদিপশু খাতেও ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। লবণাক্ততা ও জলবায়ুজনিত ঝুঁকির কারণে কৃষকেরা দীর্ঘদিন ধরেই নানা সংকটে রয়েছেন।

এই বাস্তবতায় উত্তরণ এনজিওর মাধ্যমে হেলভেটাসের সহযোগিতায় কৃষি, গবাদিপশু ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এসব প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ের দলগুলোকে দক্ষ করে তোলা সম্ভব হয়েছে। বিশেষ করে নিশানবাড়িয়া ইউনিয়নে কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তনের চিত্র দেখা যাচ্ছে।

আগে যে পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা হতো, তা পরিবর্তন করে নতুন ও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছেন কৃষকেরা। এর ফল হিসেবে কৃষি উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। ২০২৩ সালে পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, শুধু নিশানবাড়িয়া ইউনিয়ন থেকেই শসা, মিষ্টিকুমড়া ও শিম বিক্রি করে প্রায় ২২ কোটি টাকা আয় হয়েছে। এটি প্রমাণ করে, সঠিক প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি প্রয়োগ করলে উপকূলীয় এলাকাতেও কৃষি সম্ভাবনা তৈরি করা সম্ভব।

তবে এই অগ্রযাত্রা ধরে রাখতে আরও উদ্যোগ প্রয়োজন। কৃষকদের উন্নত প্রশিক্ষণ, আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রয়োজনীয় উপকরণ সহায়তা দেওয়া গেলে কৃষি ফলন আরও বাড়বে। এতে শুধু সবজি নয়, ধান চাষেও ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির মধ্যেও প্রশিক্ষণভিত্তিক অভিযোজন ও প্রযুক্তিনির্ভর কৃষিই হতে পারে উপকূলীয় অঞ্চলের টেকসই প্রতিকার।

মাহফুজুর রহমান

খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়কারী, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)

উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা যত বাড়ছে, ততই একটি প্রশ্ন সামনে আসছে—আমরা কেন শুধু প্রভাব মেনে নিচ্ছি, প্রশমনের কথা ভাবছি না? স্থানীয় পর্যায়েই যে সমস্যার সমাধান সম্ভব, তার বাস্তব উদাহরণ আছে। ২০০৭ সালের সিডরের পর দাকোপ উপজেলায় একসময় বলা হয়েছিল, লবণের আস্তরণ পড়ে থাকা একটি মাঠে আর কখনো ধান হবে না। কিন্তু কৃষকেরা হাল ছাড়েননি। লবণাক্ত পানি ঢুকতে না দিয়ে শুধু বৃষ্টির পানি জমতে দেওয়া হয় এবং অতিরিক্ত পানি বের করে দেওয়া হয়। এর ফলেই লবণ ধুয়ে যায়, আর সেই জমিতে আবার ধানের ফলন ফিরে আসে; অর্থাৎ সঠিক ব্যবস্থাপনায় লবণাক্ততাও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

কিন্তু বাস্তবে আমরা অনেক সময় লবণাক্ততা ও জলাবদ্ধতাকে মেনে নিয়েই প্রকল্প গ্রহণ করছি। প্রশ্ন হচ্ছে, জলাবদ্ধতা নিরসনের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কেন তা আগে গুরুত্ব পাচ্ছে না। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আলোচনাও অনেক ক্ষেত্রে শব্দবন্ধে আটকে যাচ্ছে। পরিবর্তন প্রকৃতির নিয়ম, কিন্তু যখন পরিবর্তনের গতি অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে, তখন সেটাই সংকট। এই সংকটের বড় অংশই মানবসৃষ্ট। উজানের পানিপ্রবাহ বন্ধ, নদী ভরাট, গাছ কেটে ফেলা—এসবের দায় শুধু জলবায়ু পরিবর্তনের ঘাড়ে চাপানো যায় না।

খুলনা অঞ্চলের বহু নদী– গড়াই, কপোতাক্ষ, কালীগঙ্গা মরতে বসেছে মূলত অপরিকল্পিত সেচ ও বাঁধ প্রকল্পের কারণে। গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রকল্পের মতো উদ্যোগ নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ নষ্ট করেছে। অথচ দোষ দেওয়া হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনকে। দুর্বল ও অনুপযোগী বাঁধও ঝুঁকি বাড়াচ্ছে, যা নতুন করে ভাবার দাবি রাখে।

সুন্দরবন প্রসঙ্গে আরও স্পষ্ট হয় এই সংকট। এই বন আসলে নোনা ও মিঠাপানির ভারসাম্যের ওপর দাঁড়িয়ে। উজানের পানির অভাবে সেই ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, ফলে গাছ মারা যাচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে অপরিকল্পিত পর্যটন, প্লাস্টিক ও অন্যান্য বর্জ্যের চাপ। নানা প্রকল্প নেওয়া হলেও স্থানীয় মানুষ, গবেষক ও অভিজ্ঞদের মতামত প্রকৃত অর্থে প্রতিফলিত হচ্ছে না।

উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় প্রকল্প হতে হবে পরিবেশবান্ধব, বাস্তবভিত্তিক এবং মানুষের অংশগ্রহণে গড়ে ওঠা। তা না হলে আমরা বারবার একই কথা বলব—সবই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে—কিন্তু সমাধানের পথে এগোতে পারব না।

‘জলবায়ু পরিবর্তন: উপকূলীয় অঞ্চলে এর প্রভাব ও প্রতিকারের উপায়’ শীর্ষক বিভাগীয় সংলাপে অংশগ্রহণকারীরা, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫ খুলনা প্রেসক্লাবে

শামিমা সুলতানা

সভাপতি, উইমেন চেম্বার অব কমার্স, খুলনা

সুন্দরবনসংলগ্ন উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব শুধু প্রকৃতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, এর গভীর অভিঘাত পড়ছে মানুষের জীবন, জীবিকা ও সামাজিক কাঠামোর ওপর। সুন্দরবননির্ভর জীবিকা থেকে মানুষকে বিকল্প আয়ের পথে নিতে নানা উদ্যোগ থাকলেও তা এখনো যথেষ্ট নয়।

এই অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত সবচেয়ে বেশি বহন করছেন নারীরা। কৃষিকাজ, বিশেষ করে তরমুজখেতে শ্রম দেওয়া নারীদের জীবনে রয়েছে বহুমাত্রিক সংকট। অনেক নারী দূরবর্তী এলাকা থেকে এসে অস্থায়ীভাবে বসবাস করেন। নিরাপত্তার অভাব, প্রভাবশালী ও মধ্যস্বত্বভোগীদের চাপ এবং ন্যায্য মজুরি না পাওয়া তাঁদের নিত্যদিনের বাস্তবতা। সমান শ্রম দিয়েও নারীরা পুরুষের তুলনায় কম মজুরি পান,যা দেশের উন্নয়ন ভাবনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

জেন্ডার বৈষম্য এখানে স্পষ্ট। পুরুষেরা দিনের বড় সময় অলসতায় কাটালেও নারীদের দায়িত্ব শেষ হয় না। ঘরের কাজ, সন্তান লালন, খাবার প্রস্তুত—সবকিছুর পরও নারীদের কোমরপানিতে নেমে কাদাজলে কাজ করতে হয়। এতে তাঁদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ে। স্ত্রী রোগসহ নানা জটিলতায় ভুগলেও চিকিৎসার সুযোগ ও সাহস—দুটোই সীমিত। অনেক ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহ এই সংকটকে আরও গভীর করে তোলে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পানির সংকট নারীদের কষ্ট বাড়িয়েছে। দূর–দূরান্ত থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হয়, কারণ পানি সংরক্ষণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। সামাজিক সংস্কারের অভাবে এসব কাজে পুরুষদের অংশগ্রহণও কম।

স্বাস্থ্যসেবার অবস্থা আরও উদ্বেগজনক। গর্ভবতী নারী বা প্রসবকালীন জরুরি পরিস্থিতিতে কমিউনিটি ক্লিনিকে পৌঁছানোর কার্যকর ব্যবস্থা নেই। সামান্য উদ্যোগ—যেমন স্থানীয় পর্যায়ে সহজ পরিবহনব্যবস্থা—পিপিপি বা দানশীল সহায়তায় গড়ে তোলা সম্ভব হলেও তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না।

সব মিলিয়ে উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় নারীকেন্দ্রিক উদ্যোগ জরুরি। প্রয়োজন নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ন্যায্য মজুরি বাস্তবায়ন, স্বাস্থ্যসেবা সহজ করা, বাল্যবিবাহ রোধ এবং স্থানীয় উপযোগী হস্তশিল্প ও কুটিরশিল্পে প্রশিক্ষণ বাড়ানো। জলবায়ু অভিযোজনের সফলতা নির্ভর করবে এই নারীদের মর্যাদা, সুরক্ষা ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার ওপরই।

গৌরাঙ্গ নন্দী

লেখক ও গবেষক

একসময় উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের নিজস্ব পানির ব্যবস্থাপনা ছিল—নোনা ও মিঠাপানির ভারসাম্য রক্ষা করে জীবনযাপন চলত। ১৯৬০-এর উপকূলীয় বাঁধ প্রকল্প এই নোনাপানি রক্ষার প্রচেষ্টা হলেও, নদী ব্যবস্থাপনা ও সেচ প্রকল্পগুলো—বিশেষ করে গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) প্রকল্প—ক্ষতি করেছে। উজানের পানি কমে যাওয়ায় লবণাক্ততা বেড়েছে, নদী ও বনসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

চীন ও ভারতের বাঁধ প্রকল্পও পানিপ্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করছে। ব্রহ্মপুত্রসহ বড় নদীগুলোর পানির হ্রাস উপকূলীয় অঞ্চলের জলের ভারসাম্য নষ্ট করছে। ফলে সুন্দরবনের নোনা-মিঠাপানির ভারসাম্য হারাচ্ছে, গাছপালা মারা যাচ্ছে, নারকেল, খেজুর ও তালগাছ বিলুপ্তির পথে। নদীভাঙন ও বাঁধ দুর্বল হওয়ার কারণে ফসল, বসতি ও জীবনযাত্রায় সরাসরি প্রভাব পড়ছে। আইলা ও সিডরের মতো দুর্যোগে হাজারো পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

উপকূলীয় জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত সমস্যার সমাধান আংশিকভাবে স্থানীয় প্রকল্পে সম্ভব। দাকোপের উদাহরণ উল্লেখযোগ্য—লবণাক্ত জমিতে শুধু বৃষ্টির পানি ধরে রাখার মাধ্যমে ধান উৎপাদন সম্ভব হয়েছে। তবে প্রাকৃতিক পুকুর ও ঐতিহ্যগত পানি ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব অপরিসীম। প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে পানি সংরক্ষণ না করলে কৃত্রিম ব্যবস্থা দীর্ঘ মেয়াদে কার্যকর হবে না।

কাঁকড়া চাষের মতো উদ্যোগ নিলে অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি হয়, কিন্তু সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থানের সংরক্ষণ অপরিহার্য। লবণাক্ততা সহনশীল জাত উদ্ভাবন করা হলেও, স্থানীয় পর্যায়ে কার্যকর বাস্তবায়ন প্রয়োজন।

উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় প্রয়োজন নোনা-মিঠাপানির ভারসাম্য রক্ষা, নদী ও বন সংরক্ষণ, প্রাকৃতিক পানি ব্যবস্থাপনা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং মানুষের অংশগ্রহণভিত্তিক পরিবেশবান্ধব প্রকল্প। শুধু আন্তর্জাতিক বা সরকারি প্রকল্পে নির্ভর করে সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়।

বেগম রেহানা ঈসা

শিক্ষক ও নারীনেত্রী

বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল প্রতিবছরই জলোচ্ছ্বাস ও বন্যার শিকার হয়। বাঁধ নির্মাণের চেষ্টা থাকলেও অতিরিক্ত জলোচ্ছ্বাসে এগুলো টিকছে না। আইলার সময় দেখা গেছে, ছোটবাঁশের ঘরগুলো পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছে; মানুষ অস্থায়ী বেড়িবাঁধের ওপর ছাদ দিয়ে বাস করছে। তাই শক্তিশালী ও কার্যকর বাঁধ নির্মাণে সরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।

উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ত পানি ও মানুষের কর্মকাণ্ডের কারণে পানির মান খারাপ হচ্ছে। এর প্রভাব স্বাস্থ্যক্ষেত্রেও দেখা দেয়। বিশেষ করে নারীদের কষ্ট বেশি। তারা দূরদূরান্ত থেকে খাওয়ার পানি আনে, পরিষ্কার পানির অভাবে সঠিকভাবে বাথরুম ব্যবহার করতে পারে না। ফলে পেটের পীড়া, চর্মরোগ ও অন্যান্য স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যায়। নারীরা ঘরবাড়ি, শিশু দেখভাল ও অন্যান্য দৈনন্দিন কাজের সঙ্গে এসব ঝুঁকিও বহন করে।

আশ্রয়কেন্দ্রের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও জনগণ প্রায়ই সেখানে যেতে চায় না। তারা নিজের ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। শেষ মুহূর্তে ঘর ভাঙা বা পানি ঢোকার আশঙ্কায় মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে আসে। তা ছাড়া বিদ্যমান আশ্রয়কেন্দ্রগুলো নারীবান্ধব নয়; একই রুমে ছেলেমেয়ে, শিশু একসঙ্গে থাকায় সেখানে অনেকে যেতে চায় না। ফলে বড় ও মানসম্পন্ন আশ্রয়কেন্দ্রের অভাব অনুভূত হয়।

উপকূলীয় নদী, বাঁধ ও খালগুলো ক্রমশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আন্তর্জাতিকভাবে নদী বাঁধ দেওয়ার ফলে নদীর প্রবাহও কমছে। এসব প্রকল্পের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব বিবেচনা করে পরিবেশবান্ধব ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।

এ ছাড়া নারীদের কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। তাদের ঘরবাড়ি, কৃষি ও অন্যান্য কাজের সঙ্গে সমন্বয় করে প্রশিক্ষণ ও সুযোগ দিলে নারীর ক্ষমতায়ন ও উপকূলীয় সমাজের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করা সম্ভব। ছোট ছোট উন্নয়নমূলক উদ্যোগ ও এনজিও কার্যক্রম উপকূলীয় মানুষের জীবনযাত্রা উত্তরণে সাহায্য করতে পারে।

হোসেনুর রহমান

সহকারী পরিচালক, জেলা সমাজসেবা কার্যালয়, খুলনা

জলবায়ু পরিবর্তন একটি বৈশ্বিক সমস্যা, যা মরুভূমি থেকে বরফগিরি পর্যন্ত প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে এর প্রভাব বিশেষভাবে প্রকট—কৃষি ও স্বাস্থ্য দুই ক্ষেত্রেই। বর্ষার সময় বন্যা, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, অতিবৃষ্টি বা খরা—সবই ফসল ও মানুষের জীবনযাত্রাকে সংকুচিত করছে। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে চর্মরোগের সমস্যা বাড়ছে, পাশাপাশি ক্যানসার, কিডনি ও লিভারের রোগের প্রভাবও লক্ষ্যযোগ্য। বটিয়াঘাটার মতো এলাকায় এই রোগীর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান।

এ ক্ষেত্রে সরকারি ও এনজিও স্বাস্থ্যসেবা আরও কার্যকর করা দরকার। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়োগ, রোগের সঠিক নিরীক্ষণ ও চিকিৎসা প্রদান জরুরি। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও অন্যান্য সংস্থা ইতিমধ্যেই ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য আর্থিক সহায়তা দিয়ে আসছে, যা আরও বিস্তৃত করার প্রয়োজন রয়েছে।

কৃষিক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ফসল উৎপাদনে বড় ধরনের বাধা দেখা দিচ্ছে। লবণাক্ততা নিয়ন্ত্রণ ও সেচব্যবস্থার উন্নতি অপরিহার্য। বাঁধ নির্মাণ ও মেরামত, নদী ও খাল খনন, ছোট খালগুলোর ড্রেজিং—এসব পদক্ষেপ জলাবদ্ধতা নিরসনে কার্যকর হতে পারে। সুন্দরবনের বিশেষ জলবায়ুর প্রভাব বিবেচনায় এসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

উপকূলীয় কৃষক, বিশেষ করে নারীরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত। তাঁদের সুরক্ষা, নিরাপত্তা ও প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। নারীর অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, স্থানীয় অংশগ্রহণভিত্তিক প্রকল্প এবং ঐতিহ্যগত প্রাকৃতিক ব্যবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠা দীর্ঘ মেয়াদে স্থায়িত্ব আনতে পারে।

নবনীতা দত্ত

উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা, দিঘলিয়া, খুলনা

উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সরাসরি সবচেয়ে বেশি নারীদের ওপর পড়ছে। লবণাক্ততা, আর্সেনিকের বৃদ্ধি, নদীভাঙন ও জলোচ্ছ্বাস—সবই তাঁদের দৈনন্দিন জীবনে সমস্যা সৃষ্টি করছে। আশ্রয়কেন্দ্র থাকলেও স্থানীয় মানুষ, বিশেষ করে নারীরা সেগুলো ব্যবহার করতে চান না; নারীবান্ধব ব্যবস্থা এখনো পর্যাপ্ত নয়।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কৃষি ও জীবনযাত্রার ওপর প্রভাব ক্রমবর্ধমান। লবণাক্ত জমিতে ধান, চিংড়ি ও কাঁকড়া চাষ করা হচ্ছে। তবে নদী ব্যবস্থাপনা ও বাঁধ প্রকল্প—বিশেষ করে জিকে প্রজেক্ট—বাস্তুসংস্থান ও নদীর স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। নদীভাঙন, লবণাক্ততা বৃদ্ধির সঙ্গে মানবসৃষ্ট পরিবর্তন জড়িত, যা শুধু প্রকৃতির ওপর দায় চাপিয়ে সমস্যার সমাধান পেছনে ফেলে।

প্রতিটি প্রকল্পের ক্ষেত্রে স্থানীয় মানুষের অংশগ্রহণ ও প্রাকৃতিক পদ্ধতির গুরুত্ব অপরিসীম। ঐতিহ্যগত পানি ব্যবস্থাপনা, যেমন পুকুর সুপেয় পানির জন্য কার্যকর। বর্তমানে অস্থায়ী প্রকল্প ও এনজিও কার্যক্রম স্থায়িত্ব ও মালিকানা সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হচ্ছে। কংক্রিট এবং আধুনিকায়নের সঙ্গে আমরা প্রকৃতির কাছ থেকে দূরে যাচ্ছি, যার ফলে সমাধান দীর্ঘ মেয়াদে কার্যকর হয় না।

উপকূলীয় নারীদের জন্য প্রশিক্ষণ শুধু সেলাই নয়, ফ্যাশন ডিজাইন ও দরজিবিজ্ঞানেও দেওয়া প্রয়োজন। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে তাঁরা পরিবার ও সমাজে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারেন।

আবদুল করিম

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা, খুলনা।

উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় কৃষি বিভাগ নিজ নিজ দায়িত্ব অনুযায়ী কাজ করছে। আর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় মূলত দুর্যোগ, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি ও অভিবাসনসংক্রান্ত বিষয়গুলোকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দুর্যোগের ধরন ও তীব্রতা বাড়ছে—এই বাস্তবতা সামনে রেখে আগাম সতর্কবার্তা ও দুর্যোগ প্রস্তুতির কার্যক্রম আগের তুলনায় আরও যুগোপযোগী করার চেষ্টা চলছে।

বর্তমানে নির্মিত বহুমুখী ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি কর্নারসহ বিভিন্ন সুবিধা যুক্ত করা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে নারী, বৃদ্ধ, স্তন্যদানকারী মা ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য আলাদা ও উপযোগী ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে। এতে দুর্যোগকালে সবাই নিরাপদ আশ্রয় পাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন।

তবে বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, অনেক মানুষ দুর্যোগের সময় আশ্রয়কেন্দ্রে আসতে চান না। কারণ, তাঁদের স্থায়ী সম্পদ—গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি বা অন্যান্য সম্পদ ফেলে আসার ঝুঁকি নিতে তাঁরা রাজি নন। এই সমস্যা সমাধানে আশ্রয়কেন্দ্রের পাশে গবাদিপশুর জন্য আলাদা শেড ও মাটির কিল্লা নির্মাণ করা হচ্ছে, যাতে মানুষ তাঁদের সম্পদসহ নিরাপদে আশ্রয় নিতে পারেন।

জলবায়ু পরিবর্তনের আরেকটি বড় প্রভাব হলো অভিবাসন। কর্মসংস্থানের অভাবে মানুষ বাধ্য হয়ে এলাকা ছাড়ছে। এই অভিবাসন দুই ধরনের—মৌসুমি অভিবাসন এবং স্থায়ী অভিবাসন। অভিবাসন ঠেকাতে হলে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে কর্মসংস্থান বাড়ানো জরুরি। স্থানীয় সম্পদের উন্নয়ন ঘটিয়ে মানুষ যেন নিজ এলাকাতেই কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে, সে লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদি ও ব্যাপক উদ্যোগ প্রয়োজন। জলবায়ু অভিযোজনের মূল প্রতিকার এখানেই নিহিত।

এ ছাড়া গোলটেবিল বৈঠকে আরও অংশগ্রহণ করেন উত্তরণের টেকনিক্যাল ম্যানেজার রেজওয়ান উল্লাহ, খুলনা প্রেসক্লাবের আহ্বায়ক এনামুল হক, খুলনার সংবাদকর্মী আবু হেনা মোস্তফা জামাল, কৌশিক দে, আহমেদ মুসা, বাগেরহাটের সংবাদকর্মী ইনজামামুল হক, তানজীম আহমেদ। স্বাগত বক্তব্য দেন প্রথম আলোর খুলনা প্রতিনিধি উত্তম মণ্ডল।