‘দলিত নারীর অধিকার ও অন্তর্ভুক্তি: চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা
‘দলিত নারীর অধিকার ও অন্তর্ভুক্তি:  চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা

দলিত নারীর অধিকার ও অন্তর্ভুক্তি: চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

দলিত নারী ফোরাম ও প্রথম আলোর উদ্যোগে ‘দলিত নারীর অধিকার ও অন্তর্ভুক্তি:  চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ৩ ডিসেম্বর ২০২৫ ঢাকায় প্রথম আলো কার্যালয়ে।

শিরীন হক

শিরীন হক

প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, নারীপক্ষ। নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সাবেক প্রধান

বর্ণ প্রথার প্রচলন অব্যাহত রেখে দলিত জনগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্য, তাদের ওপর নিপীড়ন ও শোষণের যে সমস্যা তা সমাধান করা সম্ভব নয়। দীনতা বা দারিদ্র্য ও দলিত এক নয়। দলিত পরিচিতির সঙ্গে অস্পৃশ্যের একটি যোগসূত্র রয়েছে, তাই আমরা উচ্চ শিক্ষা অর্জন করা দলিত নারীর কাছেও শুনতে পাই তাঁর প্রতি সমাজের কুৎসিত আচরণের বিবরণ। ‘দলিত’ পরিচিতির সঙ্গে অস্পৃশ্যতার বিষয়টি ঐতিহাসিক ভাবে যুক্ত। তাই দলিত পরিচিতির সঙ্গে দলিত নয় মানুষের, যারা নানা ধর্ম, শ্রেণি, গোত্র, বর্ণের, ভাষার বা পরিচিতির হতে পারে, তাদের এক করে দেখাটা কাম্য নয়।

আমি ব্যক্তিগতভাবে পরিচিতিভিত্তিক রাজনৈতিক বা সামাজিক দাবির ভিত্তিতে হওয়া আন্দোলনে বিশ্বাসী নই। আমার আন্দোলন নাগরিক রাষ্ট্রের পক্ষে, জাতি রাষ্ট্রের পক্ষে নয়; তাই আমি নাগরিক পরিচিতি এবং প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকারভিত্তিক দাবি ও আন্দোলনের পক্ষে।

আলোচনার জন্য যে সংক্ষিপ্ত ধারণাপত্রটি দেওয়া হয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে, মাত্র ৫.৯ শতাংশ দলিত মেয়ে মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করে; কিন্তু একই সূচকে অদলিত মেয়েদের অবস্থান কী, তা থাকলে বৈষম্যের গভীরতা আরও স্পষ্ট হতো।

আপনারা দলিত মানুষদের নিয়ে যে গবেষণা করেছেন, তাকে আমি স্বাগত জানাই। তথাপি  দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের, তথা বাঙালি মুসলমান মানুষের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ সব সূচকে পার্থক্যগুলো কোথায় জানা প্রয়োজন। জনশুমারিতে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে বিভিন্নতার প্রতিফলন থাকাটা আবশ্যক।

নাগরিক হিসেবে সবার মৌলিক অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে হলে প্রথমে বৈষম্যকে স্বীকার করতে হবে। সে কারণেই সংবিধানে দলিত নারীদের স্বীকৃতি গুরুত্বপূর্ণ—এটি ছাড়া বৈষম্য দূর করার দায়ও তৈরি হয় না।

কে এম মামুন উজ্জামান

কে এম মামুন উজ্জামান

পরিচালক (যুগ্ম সচিব), এনজিও–বিষয়ক ব্যুরো

দলিত হওয়া কেবল জন্মগত বা ধর্মীয় পরিচয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; অর্থনীতি, শিক্ষা, চিন্তা–চেতনা ও সামাজিক অবস্থান—সব মিলিয়েই মানুষ দলিত বা বঞ্চিত হতে পারে। এই বিস্তৃত বাস্তবতা মাথায় রেখেই দলিত নারীর অধিকার ও অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নটি দেখতে হবে।

আমরা দলিত নারীদের জন্য আইনি, অর্থনৈতিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাজনৈতিক ও গণমাধ্যমসহ নানা সুরক্ষার কথা বলছি। সবই প্রয়োজনীয়; কিন্তু আমি মনে করি, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ‘ভয়েস রেইজ’। কোনো নারী যদি নিজেই কথা বলার সুযোগ ও সক্ষমতা না পান, তাহলে কাগজে লেখা অধিকার বাস্তবে প্রতিষ্ঠা হবে না। অধিকার আদায়ের জন্য যোগ্যতা অর্জন জরুরি, আর সেই যোগ্যতার ভিত্তি হলো শিক্ষা। শিক্ষা ছাড়া আত্মনিয়ন্ত্রণ বা সচেতন সিদ্ধান্ত সম্ভব নয়। আজও দেখা যায়, শিক্ষিত ও অগ্রসর পরিবারে সন্তানসংখ্যা নিয়ে সচেতন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, কিন্তু অনগ্রসর ও অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীতে সেই নিয়ন্ত্রণ গড়ে ওঠে না। শিক্ষা মানুষকে সংস্কারমুক্ত করে, আত্মতৃপ্তি ও আত্মনিয়ন্ত্রণের শক্তি দেয়—যা দলিত নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

এনজিও কার্যক্রমের অভিজ্ঞতা থেকে আমি দেখেছি, বাংলাদেশে অধিকাংশ এনজিও দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় কাজ করলেও দলিত নারী বা অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর শিক্ষা, জীবিকায়ন ও ক্ষমতায়নমূলক প্রকল্প খুবই কম। অনেক সময় দাতাদের আগ্রহের কারণেই এই খাত উপেক্ষিত থাকে; কিন্তু যদি আমরা দলিত নারীদের পিছিয়ে রাখি, তাহলে দেশের প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়।

তাই আমি অনুরোধ জানাই, দলিত নারীর অধিকার ও অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে শিক্ষা ও ক্ষমতায়নভিত্তিক প্রকল্প আরও বাড়াতে হবে। এ ধরনের উদ্যোগে এনজিওবিষয়ক ব্যুরো ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে—এই আশ্বাস আমি দিতে চাই।

এম এম মাহমুদুল্লাহ

এম এম মাহমুদুল্লাহ

অতিরিক্ত পরিচালক (অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা শাখা), সমাজসেবা অধিদপ্তর

দলিত নারী ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর অধিকার ও অন্তর্ভুক্তি কোনো একক মন্ত্রণালয়ের বিষয় নয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জমির অধিকার, সামাজিক সুরক্ষা—সব মিলিয়ে এটি একটি সমন্বিত প্রচেষ্টার বিষয়। সরকার, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, এনজিও–আইএনজিও ও উন্নয়ন সহযোগীদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে। বড় চ্যালেঞ্জ হলো, আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট ও সমন্বিত ডেটাবেজের অভাব। তবু সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়িয়েছে।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের কার্যক্রমে আগে ১৭টি সম্প্রদায় অন্তর্ভুক্ত ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে এসব কার্যক্রমকে একটি সমন্বিত নীতিমালার আওতায় এনে ৯০টি সম্প্রদায়কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি বলা হয়েছে, ভবিষ্যতে সরকার বা উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ যদি আরও কোনো সম্প্রদায়কে অনগ্রসর হিসেবে নির্ধারণ করে, তারাও এই সুবিধার আওতায় আসবে। এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কারণ দেখা গেছে, নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত না থাকার কারণে অনেক জনগোষ্ঠী সরকারি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল। বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ করে তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমেই নীতিমালাটি সম্প্রসারিত করা হয়েছে।

ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলো আলাদাভাবে গেজেটভুক্ত হওয়ায় তাদের এই কাঠামোর মধ্যে আনা হয়নি। ফলে গেজেটবহির্ভূত অনগ্রসর সম্প্রদায়গুলোকেই এখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এতে কাভারেজ ও সমন্বয়ের ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে। তবে ‘দলিত’, ‘অনগ্রসর’ কিংবা ‘মার্জিনালাইজড’—এই পরিভাষাগুলো নিয়ে এখনো বিভ্রান্তি আছে। ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করতে আমরা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করলেও উপযুক্ত বাংলা পরিভাষা নির্ধারণ জরুরি। সম্মানজনক ও গ্রহণযোগ্য একটি শব্দচয়ন সরকারের পক্ষ থেকে প্রত্যাশিত, আর এ ক্ষেত্রে নাগরিক সমাজের সহযোগিতা প্রয়োজন।

সাবিনা ফেরদৌস

সাবিনা ফেরদৌস

উপসচিব, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়

এখনো অনেক অনগ্রসর ও পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায় আছে, যাদের আমরা এখনো চিহ্নিত করতে পারিনি। ৯০টি সম্প্রদায়কে নিয়ে যে তালিকা করা হয়েছে, সেটি চূড়ান্ত বা পূর্ণাঙ্গ—এমনটি ভাবার সুযোগ নেই। এই অনগ্রসরতার মূল কারণ কেবল অর্থনৈতিক নয়; এর গভীরে রয়েছে আমাদের সামাজিক স্টিগমা ও মানসিকতা। আমরা এখনো মেনে নিতে পারিনি, আমার পাশে একজন দলিত শিক্ষার্থী বসতে পারে, বেদে সম্প্রদায়ের কোনো নারী আমার সহপাঠী বা সহকর্মী হতে পারে। এই মানসিকতা যত দিন না বদলাবে, তত দিন প্রকৃত অন্তর্ভুক্তি সম্ভব নয়।

এখানে সহানুভূতি নয়, দরকার সহমর্মিতা। আমরা মানুষ হিসেবে একে অন্যের কষ্টকে নিজের কষ্ট হিসেবে অনুভব করতে শিখিনি। চা–শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি, কাজের পরিবেশ, বেতন কেটে নেওয়ার বাস্তবতা—এসব আমাদের চোখের সামনেই আছে; কিন্তু আমরা তা স্বাভাবিক ধরে নিয়েছি। এক কাপ চা আমাদের টেবিলে পৌঁছাতে যে শ্রম ও কষ্ট জড়িয়ে আছে, তার ন্যূনতম মর্যাদাও আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি। ঝড়–বৃষ্টি–রোদে কাজ করা নারী চা–শ্রমিকদের জন্য ছাউনি, শৌচাগার, স্যানিটেশন বা স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ—এসব মৌলিক বিষয় এখনো উপেক্ষিত।

আমি মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমের কথা বলি। ভিজিডব্লিউবি ও মা–শিশু সহায়তা কর্মসূচির মাধ্যমে বিপুলসংখ্যক নারী ও শিশু সহায়তা পাচ্ছেন। এখানে নির্দিষ্ট কোনো সম্প্রদায়কে আলাদা করে নয়; বরং যেকোনো যোগ্য ও ঝুঁকিপূর্ণ নারীকে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। পাশাপাশি ক্ষুদ্রঋণ ও অনুদান কার্যক্রমও আছে। সরকারি–বেসরকারি সবাইকে এক ছাতার নিচে এনে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। সহানুভূতি নয়, সহমর্মিতার চর্চাই পারে দলিত নারীর প্রকৃত অধিকার ও অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে।

মনি রানী

মনি রানী

সাধারণ সম্পাদক, দলিত নারী ফোরাম

দলিত নারীর ক্ষমতায়ন ও অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২০১১ সালে মহিলা অধিদপ্তর থেকে রেজিস্ট্রেশন নিয়ে শুরু হয় দলিত নারী ফোরামের কার্যক্রম । বিভিন্ন দাতা সংস্থার সহায়তায় সীমিত সুযোগের মধ্যেও আমরা হাঁটি হাঁটি পা-পা করে দলিত নারীদের জীবনে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালিয়েছি। দলিত সমাজে নারীদের শিক্ষার সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। নিজে প্রথম নারী হিসেবে লেখাপড়া শুরু করেছি, কিন্তু স্কুল, পরিবার ও সমাজের নানা বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে। তবুও হাল ছাড়িনি এবং অন্য নারীদেরও স্বতন্ত্রভাবে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেওয়ার জন্য কাজ করেছি।

আমাদের পথচলা সহজ ছিল না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নানা বাধার মুখোমুখি হতে হয়েছে। অনেকেই বলেছিল আমাদের উদ্যোগ সফল হবে না, কিন্তু আমরা চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে কাজ চালিয়েছি।

আমরা দলিত নারীদের জন্য বয়স্ক ভাতা, শিক্ষা ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা, বাসস্থানের ব্যবস্থা অর্জন করেছি। সচেতনতা বাড়াতে প্রতিমাসে একাধিক সভার আয়োজন করি, এলাকার সমস্যা নিয়ে আলোচনা করি এবং সরকারের কাছে জোরালোভাবে দাবি জানাই। আমাদের লক্ষ্য শুধু অধিকার আদায় নয়; বরং নিশ্চিত করা যে দলিত নারীরা স্বাভাবিকভাবে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সমান সুযোগ পান।

সকল ধরনের বৈষম্য ও বঞ্চনা দূর করতে আমরা নিয়মিত সচেতনতা কর্মসূচি, রোড শো, তথ্যচিত্র ও প্রশিক্ষণ পরিচালনা করি। নারীদের নিজস্ব কণ্ঠের মাধ্যমে তাদের সমস্যার কথা তুলে আনা এবং সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা গুরুত্বপূর্ণ। এই অন্তর্ভুক্তি ও ক্ষমতায়নই দেশের ন্যায়সংগত ও সমৃদ্ধ সমাজ গঠনের ভিত্তি, যেখানে কেউ পেছনে পড়ে থাকবেন না। (অনলাইনে দেওয়া বক্তৃতা)

আলতাফ পারভেজ

আলতাফ পারভেজ

লেখক ও গবেষক 

বাংলাদেশে দলিত জনগোষ্ঠী সম্পর্কে কোনো শুমারি নেই। তাদের সংখ্যা, পেশা বা বৈচিত্র্য—কোনো কিছুরই নির্ভরযোগ্য তথ্য আমাদের কাছে নেই। আমরা চারদিকে শুধু ‘বাঙালি’ পরিচয়ের কথা বলি, অথচ দেশে বিপুলসংখ্যক অবাঙালি ও দলিত জনগোষ্ঠী আছে, যাদের আমরা জানতে চাই না। ঢাকায় ২৮টি দলিত কলোনি আছে—এই তথ্যই অধিকাংশ মানুষ জানে না। অথচ এলডিসি থেকে উত্তরণের সব শর্ত পূরণের দাবি করা হচ্ছে। বাস্তবে কোনো দলিত কলোনিতে গেলে বোঝা যায়, মানবিক জীবনযাপনের ন্যূনতম শর্তও পূরণ হয়নি। কোথাও ৮৫টি পরিবারের জন্য একটি মাত্র শৌচাগার—এই অমানবিক বাস্তবতা আমাদের উন্নয়নের দাবিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

আমরা এখন সংস্কার–পরবর্তী সময়ে আছি, ১১টি সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে; কিন্তু সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার দলিতদের নিয়ে কোনো কমিশন নেই। সংখ্যালঘু, আদিবাসী কিংবা কৃষিজীবীদের বিষয়েও আলাদা কোনো কমিশন হয়নি।

গত ১০ থেকে ১৫ বছরে দলিত নারীদের চলাচল ও শিক্ষায় অগ্রগতি হয়েছে এটি সত্যি; কিন্তু কর্মসংস্থানের অভাবে এখন আবার শিক্ষাবিরোধী মনোভাব তৈরি হচ্ছে। শিক্ষিত দলিত নারীরা চাকরি পাচ্ছেন না, বিয়েতেও সমস্যায় পড়ছেন। ফলে কর্মসংস্থানই এখন সবচেয়ে জরুরি করণীয়। পাশাপাশি সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলো সব দলিতকে অন্তর্ভুক্ত করছে না; কয়েকটি পরিচয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। সব দলিতের জন্য আলাদা বাজেট বরাদ্দ ও সুরক্ষা কর্মসূচি প্রয়োজন।

রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ছাড়া সামাজিক অধিকার নিশ্চিত হয় না। চা–বাগানে শ্রমিকের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ নারী হলেও নেতৃত্বে তাদের কোনো জায়গা নেই। জনপ্রতিনিধি হিসেবে তারা মনোনয়নও পান না। এই অবস্থার পরিবর্তন জরুরি।

সালমা আক্তার

সালমা আক্তার

অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

দারিদ্র্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জেন্ডার রেজিলিয়েন্স—সব ক্ষেত্রেই অর্জনে ঘাটতি তৈরি হয়, যদি দলিত নারীদের যথাযথভাবে অন্তর্ভুক্ত করা না যায়। জেন্ডার–সংবেদনশীল ও বাস্তবভিত্তিক দৃষ্টিতে দেখলে প্রথম প্রশ্ন আসে, তারা কাঠামোগতভাবে প্রয়োজনীয় সেবা ও সুযোগে প্রবেশাধিকার পাচ্ছেন কি না। এরপর আসে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের প্রশ্ন।

দলিত নারীর প্রসঙ্গে ইন্টারসেকশনালিটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষা, কর্মসংস্থান, মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্য—এসব একসঙ্গে যুক্ত হয়ে তাদের জীবনকে প্রভাবিত করে। দলিত নারীদের একরকম সমজাতীয় গোষ্ঠী হিসেবে দেখলে তাদের ভেতরের বৈচিত্র্য ধরা পড়ে না। একদিকে তাদের সাধারণ চাহিদা আছে, অন্যদিকে নিজস্ব সংস্কৃতি ও পেশাভিত্তিক বিশেষ চাহিদাও রয়েছে।

আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো প্রজন্মান্তর দারিদ্র্য। একই পেশায় আটকে থাকা, পেশাগত ও সামাজিক গতিশীলতার সীমাবদ্ধতা থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন হয়ে পড়ে। কেউ ব্যক্তিগতভাবে বেরোতে পারলেও কমিউনিটি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হয়, যা নতুন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংকট ডেকে আনে। অধিকারের বিষয়টি আইনি ও সাংবিধানিক কাঠামো, সরকারি নীতি, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি এবং গণমাধ্যম—সবখানেই গুরুত্বপূর্ণ।  স্কুলে দলিত শিশুদের সঙ্গে বৈষম্য খুব ছোট বয়সেই শুরু হয়—একই গ্লাসে পানি খেতেও বাধা দেওয়া হয়। অথচ শিশুরাই পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় শক্তি। সমাজীকরণের প্রক্রিয়ায় যদি এই বৈষম্য ভাঙা যায়, দীর্ঘমেয়াদে বড় পরিবর্তন সম্ভব।

আইনুন নাহার

আইনুন নাহার

অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

দলিত নারীর অধিকার ও অন্তর্ভুক্তি নিয়ে আলোচনা করতে গেলে আগে বুঝতে হবে—অন্তর্ভুক্তি মানে কেবল সংখ্যা নয়। কতজনকে কোথায় নেওয়া হলো, সেটাই আসল কথা নয়। অন্তর্ভুক্তি মানে হলো অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা, মর্যাদার স্বীকৃতি এবং সমানভাবে নিজের উপস্থিতি তুলে ধরার সুযোগ।

দলিত বা আদিবাসী পরিচয় সংবিধানে নেই—এই যুক্তি দিয়ে তাদের অস্তিত্ব অস্বীকার করা যায় না। বৈচিত্র্যকে স্বীকার না করাই অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রগঠনে সবচেয়ে বড় বাধা। ‘অনগ্রসর’ শব্দ ব্যবহার করে আমরা যেন দায়টা মানুষের ওপর চাপিয়ে দিই, অথচ বাস্তবে এটি একটি কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্যের ফল। এই বৈষম্যের মূল কারণগুলো আড়াল হয়ে যায়।

দলিত নারীরা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভেতর সবচেয়ে প্রান্তিক। শহরকেন্দ্রিক কলোনির বাইরেও গ্রামাঞ্চলে তাদের অবস্থা আরও সংকুচিত। বসবাসের পরিবেশের ভয়াবহ অবনতি, নারী–পুরুষ–শিশু ও পশুপাখির একসঙ্গে গাদাগাদি করে থাকা। এর মধ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার সংকট আরও তীব্র হয় নারীদের ক্ষেত্রে। সাক্ষরতায় নারী–পুরুষের ব্যবধান এবং উচ্চশিক্ষায় নারীর অনুপস্থিতি স্পষ্ট।

দলিতদের একক গোষ্ঠী ধরে নেওয়ায় নারী ও দরিদ্রতমরা সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। পরিচয় কে নির্ধারণ করবে—এ প্রশ্নও গুরুত্বপূর্ণ। দলিত নারীর আন্দোলনকে মূলধারার নারী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। শিক্ষা, ভূমি, সামাজিক সুরক্ষা ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বে স্পষ্ট ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে হবে।

স্নিগ্ধা রেজওয়ানা

স্নিগ্ধা রেজওয়ানা

সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

দলিত নারীর অধিকার ও অন্তর্ভুক্তি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে সবচেয়ে বড় যে সংকটটি সামনে আসে, তা হলো ধারণাগত অস্পষ্টতা। নীতিনির্ধারকদের মধ্যেই অনেক সময় ‘দলিত’ বলতে কাকে বোঝায়—সে বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা থাকে না। এই অস্পষ্টতা নীতিনির্ধারণের পুরো প্রক্রিয়াকে দুর্বল করে দেয়।

দলিতদের একক, সমজাতীয় গোষ্ঠী হিসেবে দেখলে চলবে না। চা–বাগানের নারী শ্রমিক ও সুইপার কলোনির নারীর বাস্তবতা এক নয়। দলিত নারীরা বহুমাত্রিক বৈষম্যের মুখোমুখি—জাত, শ্রেণি, ধর্ম ও লিঙ্গ মিলিয়ে। এই মাল্টিলেয়ার বৈষম্য না বুঝে নীতি করলে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। সামাজিক স্বীকৃতির অভাবে অনেক নারী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাময়িক ক্ষমতায়ন খুঁজে পান, কিন্তু সেটিও পরে ঝুঁকির জায়গা হয়ে ওঠে। পরিবার ও সমাজে দলিত নারীকে বোঝা হিসেবে দেখার প্রবণতা যৌতুক, সহিংসতা ও নিপীড়নকে আরও জটিল করে তোলে।

এসব সমস্যার মূলে রয়েছে কাঠামোগত বৈষম্য। পেশাভিত্তিক অপমান, বিনোদনের সুযোগহীনতা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বৈষম্য—সব মিলিয়ে নারীর জীবন আরও সংকুচিত হয়। দলিত কেবল ধর্মীয় পরিচয় নয়, এটি শ্রেণিগত বাস্তবতাও। তাই আদমশুমারি জরুরি, যাতে বাস্তব চিত্র সামনে আসে।  নীতিগতভাবে সংরক্ষিত নারী আসন বাতিল না করে বরং বেদে, আদিবাসী ও দলিত নারীদের জন্য তা নিশ্চিত করা দরকার। তাহলেই দলিত নারীর অধিকার ও অন্তর্ভুক্তি বাস্তব রূপ পেতে পারে।

নাদিরা পারভীন

নাদিরা পারভীন

কর্মসূচি ব্যবস্থাপক, নাগরিক উদ্যোগ

দলিত নারীর অধিকার ও অন্তর্ভুক্তি নিয়ে বাস্তব চিত্র খুবই জটিল। নারায়ণগঞ্জের দলিত কলোনিগুলোতে কাজ করার সময় দেখা গেছে, ১৮টি কলোনির মধ্যে বহু পরিবার সংকটপূর্ণ অবস্থায় বসবাস করছে। ঘরগুলো খুবই ছোট, পানি ও স্যানিটেশন নেই, প্রেগন্যান্ট নারীসহ শিশুরা অসুস্থ, পুষ্টির অভাব। স্কুল নেই, কাজের জায়গার পাশেই দূষিত পানি ফেলে দেওয়া হয়। বারবার অভিযোগের পরও স্থানীয় প্রতিনিধি বা ফ্যাক্টরি ম্যানেজমেন্ট কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না। ফলে এই মানুষগুলো সারা বছর ক্রনিক পেটব্যথা, স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছে।

দলিত নারীরা বহুস্তরীয় বৈষম্যের শিকার। তাদের বসবাস, শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও সামাজিক স্বীকৃতি—সব ক্ষেত্রেই অবমূল্যায়ন। নৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রান্তিকরা, বিশেষ করে নারীরা, সুযোগ থেকে বঞ্চিত। বিনোদন বা সামাজিক মুক্তির কোনো জায়গা নেই; সীমিত ঘর, পরিবারিক দায় ও সমাজের অবমূল্যায়ন তাদের ওপর চাপ তৈরি করে। পলিসি ও বাজেটের ক্ষেত্রে আদমশুমারি ছাড়া সঠিক সংখ্যার ভিত্তিতে বরাদ্দ ও সেফটি নেটওয়ার্ক তৈরি করা সম্ভব নয়। সংরক্ষিত নারী আসন দলিত, আদিবাসী ও বেদে নারীদের জন্য কার্যকর করা উচিত, যেন তাদের প্রতিনিধি প্রতিষ্ঠিত হয়। শিক্ষার ক্ষেত্রে বিনা খরচে সুযোগ ও পরিবারকে উৎসাহ দেওয়ার মাধ্যমে অংশগ্রহণ বাড়ানো যেতে পারে। সঠিক তথ্য, কার্যকর নীতি ও সমন্বিত প্রয়াস ছাড়া দলিত নারীর অন্তর্ভুক্তি অর্জন সম্ভব নয়।

ইসরাত লাইলা

ইসরাত লাইলা

প্রকল্প সমন্বয়কারী, দলিত নারী ফোরাম

দলিত নারী বাংলাদেশের সমাজে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বৈষম্যের শিকার। প্রায় ছয় মিলিয়ন দলিত সম্প্রদায়ের অর্ধেকই নারী, যাঁদের অধিকাংশই শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের ঝুঁকিতে বসবাস করে। শুধু জাতিগত কারণে নয়, লিঙ্গভিত্তিক নিরাপত্তাহীনতা, অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও সামাজিক বৈষম্য তাদের দৈনন্দিন জীবনকে আরও কঠিন করে তোলে। সংবিধান ও আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার থাকা সত্ত্বেও শিক্ষার সুযোগ, স্বাস্থ্যসেবা, কর্মসংস্থান, আইনি সুরক্ষা ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণে তারা এখনো ব্যাপকভাবে বঞ্চিত।

দলিত নারীরা নানাবিধ বাধার সম্মুখীন। তাদের মজুরি তুলনামূলক কম, জমি ও সম্পত্তি নেই, ব্যাংকঋণ বা উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশের সুযোগ সীমিত। কর্মক্ষেত্রে জাতিগত বৈষম্য, অস্পৃশ্যতার অভিজ্ঞতা ও সামাজিক সুরক্ষা নেটওয়ার্কে অন্তর্ভুক্তির সীমাবদ্ধতা তাদের জীবনকে ঝুঁকিপূর্ণ করে। শিক্ষার ক্ষেত্রে তাদের উপস্থিতি কম; মাধ্যমিক স্তরের মাত্র ৫.৯ শতাংশ মেয়েরা শিক্ষা সম্পন্ন করে। স্বাস্থ্যসেবায় অপমানজনক আচরণ তাদের স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ থেকে বিরত রাখে।

দলিত নারীর অধিকার ও অন্তর্ভুক্তি কোনো দান নয়, এটি তাদের মৌলিক মানবাধিকার। তাদের পেছনে ফেলে বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন অসম্ভব। সরকার, গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ ও নাগরিক সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, সমতাপূর্ণ বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব।

মনীষা বিশ্বাস

মনীষা বিশ্বাস

সিনিয়র অফিসার, লিগ্যাল অ্যান্ড রিসার্চ,  ব্লাস্ট

দলিত নারীরা বাংলাদেশের সমাজে প্রান্তিক অবস্থানে বসবাস করছে। শুধু হিন্দু দলিত নয়, মুসলিম কমিউনিটিতেও লোয়ার কাস্ট নারীরা বৈষম্যের শিকার। তারা শিক্ষার সুযোগ, সরকারি চাকরি, সামাজিক সুরক্ষা ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণে সীমিতভাবে অন্তর্ভুক্ত। প্রান্তিক অবস্থার কারণে অনেকেই মূলধারায় আসতে চায় না, যদিও কিছু সুবিধা ও নিরাপত্তার জন্য তাদের সেখানে থাকার প্রয়োজন হয়।

আইন ও নীতি থাকলেও বাস্তবায়ন সীমিত। বৈষম্য বিরোধী আইন, সামাজিক সুরক্ষা নেটওয়ার্ক ও নারী উন্নয়ন নীতিমালার কার্যকর প্রয়োগ প্রয়োজন। সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি রাষ্ট্র ও নাগরিক সমাজের সমন্বিত প্রচেষ্টা বাধ্যতামূলক।

দলিত নারীর অধিকার নিশ্চিত করা শুধু ন্যায় নয়, এটি তাদের মৌলিক মানবাধিকার। কার্যকর কোটা, শিক্ষার সুযোগ, চাকরিতে প্রবেশাধিকার, সামাজিক সুরক্ষা ও মিডিয়ায় যথাযথ প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করলে তারা সমাজের মূল প্রবাহে আসতে পারবে।

ফোরাম ও আলোচনার মাধ্যমে বৈষম্য চিহ্নিত করে কার্যকর মেকানিজম গঠন অপরিহার্য, যা একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, সমতাপূর্ণ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সহায়ক হবে।

তামান্না সিং বাড়াইক

তামান্না সিং বাড়াইক

প্রোগ্রাম অফিসার, দলিত নারী ফোরাম

শহরের কলোনি থেকে গ্রামাঞ্চল ও চা-বাগান অঞ্চলে দলিত নারীরা দৈনন্দিন জীবনের শ্রমে যুক্ত থাকলেও ন্যায্য মজুরি, সামাজিক মর্যাদা এবং সুযোগ–সুবিধা থেকে বঞ্চিত। পঞ্চায়েত বা রাজনৈতিক কমিটিতে তাঁদের অংশগ্রহণ সীমিত, পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কারণে তাঁরা কথার জায়গা পাচ্ছে না।

স্বাস্থ্য সেবার অবস্থা সংকটাপন্ন। কলোনিতে গণটয়লেট ও পানীয় জলের অভাব, প্লাবিত এলাকা এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার অপ্রতুলতা তাদের জীবন ও গর্ভকালীন স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। চা-বাগানে গাইনি ডাক্তার বা এমবিবিএস ডাক্তারদের অভাব প্রকট, ফলে তথ্য সংগ্রহ ও স্বাস্থ্যপর্যবেক্ষণ ব্যাহত।

অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও শ্রমসংক্রান্ত অধিকারেও সীমাবদ্ধতা। আইনি সহায়তা ও বৈষম্যবিরোধী আইন বাস্তবায়ন এখনও সীমিত।

দলিত নারীদের ক্ষমতায়ন এবং অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে প্রয়োজন কার্যকর কোটা ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য ও শ্রম নীতিতে তাদের স্পষ্ট অন্তর্ভুক্তি, ভূমি ও সম্পত্তিতে সমান অধিকার, আইনি সহায়তা এবং সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করা।

সরস্বতী দাস

সরস্বতী দাস

শিক্ষার্থী প্রতিনিধি, দলিত জনগোষ্ঠী

দলিত নারীরা বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা, কর্মক্ষেত্র ও রাজনৈতিক পর্যায়ে এখনো ব্যাপক বৈষম্যের শিকার। তারা প্রাথমিক শিক্ষা থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি। কলোনিতে জন্ম এবং বসবাস, অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা, এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি তাদের শিক্ষাজীবনকে বাধাগ্রস্ত করে। সহপাঠী ও শিক্ষকেরা কখনো ব্যঙ্গাত্মক আচরণ করে, কখনো ভর্তিপ্রক্রিয়ায় বাধা দেয়।

অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা তাদের পড়াশোনার ধারাবাহিকতাকে প্রভাবিত করে। ঘর ও জমি না থাকায় স্থায়ী বসবাস ও শিক্ষার সুযোগও সীমিত, স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে এখনো সুযোগ–সুবিধা যথেষ্ট নয়।

রাজনৈতিক অংশগ্রহণেও তারা পিছিয়ে। পঞ্চায়েত কমিটি বা স্থানীয় রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণ নেই, বাইরে কাজ করার স্বাধীনতাও সামাজিক নিয়ম ও নিরাপত্তা সীমাবদ্ধতার কারণে সীমিত।

দলিত নারীর ক্ষমতায়ন ও অন্তর্ভুক্তির জন্য প্রয়োজন শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণ, নিরাপদ বসবাস, স্বাস্থ্যসেবা ও স্যানিটেশন সুবিধা নিশ্চিত করা।

সবিতা দাস

সবিতা দাস

সভাপতি, দলিত নারী ফোরাম

সবাইকে ধন্যবাদ জানাই আজকের গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নেওয়ার জন্য। দলিত নারীরা বাংলাদেশের সমাজে বৈষম্য ও সামাজিক বঞ্চনার শিকার। দীর্ঘ সময় ধরে তারা পরিবার ও কর্মক্ষেত্রে সীমিত সুযোগের মধ্যে বাধ্য হয়ে বসবাস করছে। তবে দলিত নারী ফোরামের মাধ্যমে দলিত নারীরা ধীরে ধীরে নিজস্ব ক্ষমতায়ন ও সামাজিক অংশগ্রহণে অগ্রসর হচ্ছে। আগে তারা ঘরবন্দী ছিল, এখন শিক্ষায়, কর্মজীবন ও সামাজিক কার্যক্রমে অনেকেই সক্রিয়।

তবে অন্তর্ভুক্তি এখনো অসম্পূর্ণ। দলিত নারীরা সমাজের মূল ধারায় প্রবেশ করতে পারছে না, পঞ্চায়েত কমিটি ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ সীমিত। স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন ও নিরাপদ বসবাসের সুযোগ এখনো অপর্যাপ্ত। পরিবারিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাধার কারণে তারা প্রায়ই শিক্ষার সুযোগ হারায় এবং শ্রমক্ষেত্রে বৈষম্যের সম্মুখীন হয়। দলিত নারীদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে প্রয়োজন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ। তাদের অধিকার ও অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা শুধু ন্যায়সংগত নয়, দেশের টেকসই উন্নয়নের জন্যও অপরিহার্য।

সুপারিশ

  • সংবিধান ও আইনের মাধ্যমে দলিত নারীর নাগরিক ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

  • দলিত নারীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা, কর্মসংস্থান ও ভূমি–সম্পত্তিতে সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।

  • নির্ভরযোগ্য জনশুমারি ও সমন্বিত ডেটাবেস তৈরি করে নীতি ও বাজেট বরাদ্দের জন্য ব্যবহার করতে হবে।

  • নগর–গ্রাম ও চা–বাগান অঞ্চলে কলোনি এবং সম্প্রদায়ভিত্তিক বৈষম্য চিহ্নিত করে সমন্বিত সমাধান বাস্তবায়ন করতে হবে।

  • স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন ও নিরাপদ বসবাস নিশ্চিত করতে হবে।

 

অংশগ্রহণকারী: শিরীন হক, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, নারীপক্ষ। নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের সাবেক প্রধান; কে এম মামুন উজ্জামান, পরিচালক (যুগ্মসচিব), এনজিও বিষয়ক ব্যুরো; এম এম মাহমুদুল্লাহ, অতিরিক্ত পরিচালক (অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা শাখা), সমাজসেবা অধিদপ্তর; সাবিনা ফেরদৌস, উপসচিব, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়; মনি রানী, সাধারণ সম্পাদক, দলিত নারী ফোরাম; আলতাফ পারভেজ, লেখক ও গবেষক; সালমা আক্তার, অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; আইনুন নাহার, অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়; স্নিগ্ধা রেজওয়ানা, সহযোগী অধ্যাপক,  নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়; নাদিরা পারভীন, কর্মসূচী ব্যবস্থাপক, নাগরিক উদ্যোগ; ইসরাত লাইলা, প্রকল্প সমন্বয়কারী, দলিত নারী ফোরাম; মনীষা বিশ্বাস, সিনিয়র অফিসার, লিগ্যাল অ্যান্ড রিসার্চ,  ব্লাস্ট; তামান্না সিং বাড়াইক, প্রোগ্রাম অফিসার, দলিত নারী ফোরাম, সরস্বতী দাস, শিক্ষার্থী প্রতিনিধি, দলিত জনগোষ্ঠী, সবিতা দাস, সভাপতি, দলিত নারী ফোরাম। সঞ্চালক: ফিরোজ চৌধুরী, সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো।