‘জলবায়ু পরিবর্তন: উত্তরাঞ্চলে এর প্রভাব ও প্রতিকারের উপায়’ শীর্ষক বিভাগীয় সংলাপে অংশগ্রহণকারীরা। ২৪ ডিসেম্বর রংপুরের একটি হোটেলের মিলনায়তনে
‘জলবায়ু পরিবর্তন: উত্তরাঞ্চলে এর প্রভাব ও প্রতিকারের উপায়’ শীর্ষক বিভাগীয় সংলাপে অংশগ্রহণকারীরা। ২৪ ডিসেম্বর রংপুরের একটি হোটেলের মিলনায়তনে

জলবায়ু পরিবর্তন, উত্তরাঞ্চলে এর প্রভাব ও প্রতিকারের উপায়

হ্যালভেটাস বাংলাদেশের সহযোগিতায় ইএসডিওর একসেস প্রকল্প ও প্রথম আলোর উদ্যোগে ‘জলবায়ু পরিবর্তন: উত্তরাঞ্চলে এর প্রভাব ও প্রতিকারের উপায়’ শীর্ষক বিভাগীয় সংলাপ অনুষ্ঠিত হয় ২৪ ডিসেম্বর রংপুরে।

অংশগ্রহণকারী

জিলুফা সুলতানা

পরিচালক, বিভাগীয় সমাজসেবা কার্যালয়, রংপুর

নূর আলম

পরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তর, রংপুর বিভাগীয় কার্যালয়

মো. সিরাজুল ইসলাম

উপপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, রংপুর

মো. আবু সায়েম

উপপরিচালক, হর্টিকালচার সেন্টার, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বুড়িরহাট, রংপুর

সেলোয়ারা বেগম

উপপরিচালক, মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর, রংপুর

মো. রেজওয়ানুর রহমান

সিনিয়র কো–অর্ডিনেটর, ইএসডিও

এ কে এম জাহেদুল ইসলাম

ডিভিশনাল ম্যানেজার, ব্র্যাক

ফিরোজ আলম

সভাপতি, জলবায়ু পরিষদ, উলিপুর, কুড়িগ্রাম

খাদিজা পারভীন খুশি

সাধারণ সম্পাদক, কুড়িগ্রাম জলবায়ু পরিষদ

চাষী নূরন্নবী সরকার

যুগ্ম আহ্বায়ক, জলবায়ু কাউন্সিল, কুড়িগ্রাম

রশিদা বেগম,

সভাপতি, উদ্যোক্তা গ্রুপ, একসেস প্রকল্প, কুড়িগ্রাম

ফরিদা ইয়াসমীন

নির্বাহী পরিচালক, উন্নয়ন সংস্থা ‘নারী’, কুড়িগ্রাম

জুলেখা খাতুন

সাধারণ সম্পাদক, চর টুপামারী যুব ফোরাম, বেরুবাড়ি, কুড়িগ্রাম

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন:

গোলাম ফারুক

প্রজেক্ট অপারেশন ম্যানেজার, ইএসডিও, কুড়িগ্রাম

সঞ্চালনা

ফিরোজ চৌধুরী, সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনা

মূল প্রবন্ধ:

গোলাম ফারুক

প্রজেক্ট অপারেশন ম্যানেজার, ইএসডিও

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব উত্তরাঞ্চলে দিন দিন তীব্র হচ্ছে। আর এই অভিঘাত সবচেয়ে বেশি পড়ছে প্রান্তিক মানুষদের ওপর—বিশেষ করে দরিদ্র কৃষক পরিবারগুলোর ওপর। এছাড়া অনগ্রসর জনগোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ওপরও এর প্রভাব অনেক বেশি। এই সব বাস্তবতা মাথায় রেখেই আমরা, হ্যালভেটাস বাংলাদেশ ও ইএসডিওর একসেস প্রকল্পের মাধ্যমে কাজ করছি।

অভিযোজনের ক্ষেত্রে আমরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি কৃষিতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের ওপর। এ জন্য কৃষিতে আগ্রহী মানুষদের নিয়ে স্থানীয় সেবা প্রদানকারী সমিতি গঠন করা হয়েছে। প্রতিটি ওয়ার্ডে একজন করে স্থানীয় সেবা প্রদানকারী চিহ্নিত করে তাদের মাধ্যমে কৃষি ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সঙ্গে সমন্বয় করা হচ্ছে। একই সঙ্গে সমবায় গড়ে তুলে সঞ্চয় ও আয়বর্ধক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ার সুযোগ তৈরি করা হয়েছে।

বন্যাদুর্গত চরাঞ্চলে বীজ নষ্ট হয়ে যাওয়ার সমস্যা সমাধানে আমরা প্রতিটি ইউনিয়নে বীজ সংরক্ষণাগার ও পরামর্শকেন্দ্র স্থাপন করেছি। কৃষকেরা সেখানে বীজ সংরক্ষণ ও প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারছেন। অভিযোজনমূলক কৃষির অংশ হিসেবে রাস্তার পাশে মাচা দিয়ে সবজি চাষ, সোলার সেচব্যবস্থা চালু এবং জলবায়ু কৃষি হাব গড়ে তোলা হয়েছে। এসব হাবে নিয়মিত কৃষি কর্মকর্তারা এসে কৃষকদের পরামর্শ দেন।

আমাদের কর্ম–এলাকায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠন (ওপিডি) গড়ে তোলা হয়েছে তিনটি উপজেলায়, যারা এখন সক্রিয়ভাবে স্থানীয় পর্যায়ে কাজ করছে। পাশাপাশি ইউনিয়ন, ওয়ার্ড ও উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটিগুলো পুনর্গঠন ও তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যাতে জলবায়ুঝুঁকি মোকাবিলায় স্থানীয় কাঠামোগুলো কার্যকর হয়।

আমাদের কাজের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো জলবায়ুবান্ধব বাজেট নিশ্চিত করা। ইউনিয়ন পরিষদের বার্ষিক বাজেটে জলবায়ু কার্যক্রমে বরাদ্দ বাড়ানো এবং তা বাস্তবায়নের জন্য আমরা নিয়মিত তদারকি করছি। উন্মুক্ত বাজেট ঘোষণার মাধ্যমে জনগণকে যুক্ত করা হচ্ছে এবং ত্রৈমাসিক ও বার্ষিক পর্যালোচনায় অংশীজনদের সঙ্গে বসে বাজেট বাস্তবায়ন যাচাই করা হচ্ছে।

যোগাযোগব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে গ্রামীণ রাস্তা মেরামত, কাঠের সেতু নির্মাণ এবং স্কুল–কাম–বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র সংস্কারে আমরা সহায়তা করছি। স্কুলে শিক্ষার্থী ব্রিগেড গড়ে তুলে দুর্যোগ মহড়া ও নিরাপত্তা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। পাশাপাশি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পানির সুবিধা ও স্কুলের পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা সংস্কার করা হয়েছে, বিশেষ করে কিশোরীদের ঋতুস্রাবকালীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে।

এ প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা তিনটি উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে জলবায়ু পরিষদ গঠন করেছি। ৯টি ইউনিয়ন ও ২৭টি ওয়ার্ড দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি এবং যুব নেতৃত্বাধীন জলবায়ু ফোরাম সক্রিয় হয়েছে। ৯ মাসে ১৫ হাজার ৪২৮টি পরিবারকে উঠান বৈঠকের মাধ্যমে জলবায়ু অভিযোজন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, জলবায়ু অভিবাসন ও স্মার্ট কৃষি বিষয়ে ধারণা দেওয়া সম্ভব হয়েছে।

আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে, সরকারি–বেসরকারি ও স্থানীয় জনগণের যৌথ উদ্যোগেই জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলা করা সম্ভব। উত্তরাঞ্চলে টেকসই অভিযোজন গড়ে তুলতে এই সমন্বিত পথেই আমরা এগোচ্ছি।

জিলুফা সুলতানা

পরিচালক, বিভাগীয় সমাজসেবা কার্যালয়, রংপুর

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণ হচ্ছে গ্রিনহাউস গ্যাস, বিশেষ করে কার্বন ডাই–অক্সাইড। আমাদের প্রতিদিনের জীবন ও জ্বালানি ব্যবহারের ফলে এটি বাড়ছে। তাই আমাদের ছোট হলেও স্থানীয়ভাবে বনায়ন, অক্সিজেন উৎপাদন ও সোলার শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করা জরুরি। জীবাষ্ম জ্বালানির বিকল্প হিসেবে সোলার ব্যবহারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং কৃষিকাজে পানি সাশ্রয় করা সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, কুড়িগ্রামে নদীর পানি সোলার পাম্পের মাধ্যমে কৃষিতে ব্যবহার করা হচ্ছে।

উষ্ণতা বৃদ্ধি ও আবহাওয়ার পরিবর্তন গ্রামীণ ও শহুরে জীবনের ওপর ভিন্নভাবে প্রভাব ফেলছে। চরাঞ্চল, পাহাড়ি এলাকা ও ঘনবসতিপূর্ণ শহরে মানুষ ভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাই স্থানীয় পরিস্থিতি অনুযায়ী অভিযোজনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য। সুপেয় পানির অভাব মোকাবিলায় সোলারের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ ও নদীর পানি কৃষিতে ব্যবহার করা, বন্যায় আক্রান্ত এলাকায় পানি সংরক্ষণ ও বিতরণ এবং পানির সাশ্রয়ী কৃষিপদ্ধতি প্রবর্তন করা হচ্ছে।

আমরা স্বাস্থ্যঝুঁকি হ্রাসে স্কুল ও আশ্রয়কেন্দ্রকে কার্যকর করছি। স্কুলে স্টুডেন্ট ব্রিগেডের মাধ্যমে দুর্যোগ মহড়া, নিরাপত্তা পরিকল্পনা ও ঋতুস্রাবকালীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা হচ্ছে। কৃষি হাব ও সাধারণ শিক্ষা কেন্দ্র গড়ে তুলে কৃষকদের স্মার্ট কৃষি, জৈব বীজ সংরক্ষণ ও আয় বৃদ্ধিমূলক কর্মকাণ্ডের শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে।

এ ছাড়া জন্মদিন, উৎসব বা স্থানীয় উদ্যোগের মাধ্যমে বৃক্ষরোপণ ও পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধিতে ছোট পরিসরের উদ্যোগও গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে সুষম সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে হলে পরিবারকেন্দ্রিক সমাধান জরুরি।

নদী খনন ও পরিবেশ সংরক্ষণেও নতুন পদ্ধতি প্রয়োগ করা হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, হবিগঞ্জে বালুমহাল ও পানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সমন্বয়ে নদী উন্নয়ন ও খনন কার্যক্রমের মাধ্যমে খরচ কমানো ও প্রকৃতির ওপর প্রভাব হ্রাস করা সম্ভব হয়েছে। উত্তরাঞ্চলের নদীগুলোতে খনন কার্যক্রমে গুরুত্ব দেওয়ার সময় এসেছে।

উত্তরাঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় পরিবারকেন্দ্রিক সমাধান, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি সক্রিয় করা, কৃষিতে অভিযোজনমূলক প্রযুক্তি ও পানিসাশ্রয়ী–পদ্ধতি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য কার্যক্রম, নদী খনন ও বনায়নসহ ছোট– বড় উদ্যোগের সমন্বিত প্রয়োগ জরুরি। স্থানীয় সচেতনতা ও সোলার, জৈব কৃষি, বৃক্ষরোপণ ও স্বাস্থ্যবিধি কার্যক্রমের মাধ্যমে মানুষের জীবনমান রক্ষা ও পরিবেশ সংরক্ষণ সম্ভব।

নূর আলম

পরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তর, রংপুর

বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের বেশির ভাগ দেশ বায়ুদূষণের মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে। বাংলাদেশের শহরগুলোতে বায়ুদূষণ বিশ্বের শীর্ষস্থানীয়, যা মূলত গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত। শুষ্ক মৌসুমে ইটভাটা, কঠিন জ্বালানি পোড়ানো, যানবাহনের কালো ধোঁয়া এবং রান্নার কাজে লাকড়ি ব্যবহারের কারণে কার্বন ডাই–অক্সাইডসহ বিভিন্ন ক্ষতিকর কণা বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে নারী ও শিশুদের শ্বাসকষ্ট, শারীরিক অসুস্থতা এবং দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে।

দূষণ রোধে পরিচ্ছন্ন জ্বালানির ব্যবহার জরুরি। যারা এলপিজি গ্যাস ব্যবহার করতে সক্ষম, তারা যেন রান্নায় তা ব্যবহার করেন। অন্যদিকে যাঁদের সামর্থ্য কম, তাদের জন্য উন্নত চুলা যেমন বন্ধু চুলা—উপযুক্ত বিকল্প। এই চুলার দক্ষতা ৫০ শতাংশের বেশি, ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রয়েছে, ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকি উল্লেখযোগ্য হারে কমানো সম্ভব।

উত্তরাঞ্চলের চরাঞ্চল ও ফাঁকা জায়গাগুলোতে বৃক্ষরোপণ এবং পরিচর্যা পরিবেশ ও অক্সিজেনের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে সামাজিক পর্যায়ে কম্পোস্টিং প্রয়োগে রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমানো সম্ভব। সোলার প্যানেল ব্যবহার এবং স্থানীয় জলাধার নির্মাণের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানি সাশ্রয় করা যায়।

প্লাস্টিক দূষণও গুরুতর সমস্যা। একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক, যেমন বোতল; ১০০ থেকে ২০০ বছর পর্যন্ত পরিবেশে থাকে। এটি মাইক্রোপ্লাস্টিক হয়ে কৃষিজমি, জলাশয় ও খাদ্যচক্রে প্রবেশ করে মানবদেহে ক্ষতি করে। তাই প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো ও প্রাকৃতিক পণ্য ব্যবহারে উৎসাহিত করা প্রয়োজন। সরকার ইতিমধ্যে ১৭টি একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক চিহ্নিত করেছে এবং তিনটি নিষিদ্ধ করেছে।

কৃষিতে কীটনাশক ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্কতা জরুরি। বাতাসের বিপরীতে দাঁড়িয়ে স্প্রে করা হলে কীটনাশক সরাসরি ব্যবহারকারীর শরীরে প্রবেশ করে। এই বিষয়গুলো শিক্ষার মাধ্যমে প্রচার করা প্রয়োজন, যাতে মানুষ স্বাস্থ্য এবং পরিবেশ সচেতন হতে পারে।

ফিরোজ আলম

সভাপতি, জলবায়ু পরিষদ, উলিপুর কুড়িগ্রাম

দীর্ঘদিন ধরে উত্তরাঞ্চলের চরাঞ্চলে যাতায়াতের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, বিশেষ করে উলিপুরের ভারতসংলগ্ন ইউনিয়নগুলো একসময় ভয়াবহভাবে বন্যাকবলিত ছিল। তখন বন্যাকে আমরা প্রায় ভাগ্যের লিখন হিসেবেই মেনে নিতাম। কিন্তু এখন জলবায়ু পরিবর্তন একটি সুস্পষ্ট বাস্তবতা হিসেবে মানুষের কাছে পরিচিত হচ্ছে। জলবায়ুজনিত অভিঘাতের কারণেই যে এসব দুর্যোগ বাড়ছে, সেই উপলব্ধি মানুষের মধ্যে তৈরি হচ্ছে—এটাই আমার কাছে সবচেয়ে ইতিবাচক দিক।

এই সচেতনতার ফলে অভিযোজন নিয়ে নতুন চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে। এনজিও, সরকারি কর্মসূচি ও স্থানীয় উদ্যোগের মাধ্যমে কৃষি, আবাসন, ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া—এসব বিষয়ে বিকল্প কর্মপন্থা গড়ে উঠছে। জলবায়ুজনিত সমস্যাকে চিহ্নিত করে কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে এবং জরুরি বিষয়গুলো অগ্রাধিকার পাচ্ছে। আমরা নিজেরাও এসব উদ্যোগে যুক্ত হয়ে সরকারি ও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ওকালতি ও তদবির করছি।

আমাদের ফোরামে প্রতিটি ইউনিয়নের ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিনিধিরা নিয়মিত বসে আলোচনা করেন। সেখান থেকেই সমস্যার তালিকা ও কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে জরুরি দুটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বুড়াগুড়ি ও ধরবাড়ি ইউনিয়নে। বন্যায় ভেঙে যাওয়া যাতায়াত সড়ক দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়ায় জনদুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছিল। ভুক্তভোগী জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আমরা ইউএনওর সঙ্গে আলোচনা করি। এর ফল হিসেবে সড়কটি প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, দরপত্র আহ্বানও সম্পন্ন হয়েছে। পাশাপাশি স্থানীয় সংহতি তহবিল ও সম্মিলিত সহযোগিতায় সড়কটি আপাতত মেরামত করা হয়েছে।

এই অভিজ্ঞতা আমাকে আশাবাদী করে, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় সমন্বিত উদ্যোগ নিলে উত্তরাঞ্চলেও টেকসই সমাধান সম্ভব।

রশিদা বেগম

সভাপতি, উদ্যোক্তা গ্রুপ, একসেস প্রকল্প

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমরা চরাঞ্চলের মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। আমাদের আবাদ, কৃষিকাজ, জীবন–জীবিকা—সবকিছুই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। কখন বন্যা আসবে, কখন আসবে না, এটার আর কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই। কখনো বন্যা আসে না, আবার ঘন ঘন বন্যা এসে সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ধানগাছ বড় হওয়ার সময় বন্যার পানিতে ডুবে যায়, আমরা আর ফসল তুলতে পারি না। বন্যার তোড়ে আমাদের রাস্তাঘাট ভেঙে যায়, যাতায়াত বন্ধ হয়ে পড়ে।

অন্যদিকে অতিরিক্ত গরমেও আমাদের বড় ক্ষতি হচ্ছে। আমরা গাছ লাগাই, কিন্তু প্রচণ্ড তাপে সেই গাছ টিকে থাকতে পারে না। আবার শীতও এখন আগের মতো নেই, অতিরিক্ত শীত পড়ে। খুব সকালে বাড়ি থেকে বের হলে দেখা যায়, সকালে অনেক দেরিতে রোদ ওঠে। এই শীতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশু, বৃদ্ধ মা–বাবা ও অসহায় মানুষ। গবাদিপশুও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শীতের কারণে অনেক গবাদিপশু মারা যাচ্ছে, অথচ চরাঞ্চলে আমরা সময়মতো টিকা বা প্রয়োজনীয় সেবা পাই না। ফলে যা আছে, সেটুকুও ধরে রাখতে পারছি না।

এই বাস্তবতায় আমরা একসেস প্রকল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ পেয়েছি। সেই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিখেছি কীভাবে বাড়ির আশপাশে শাকসবজি উৎপাদন করা যায়। এখন আমরা বাড়ির আঙিনা, আনাচকানাচে কোনো জায়গা ফাঁকা রাখছি না। নিজেরাই শাকসবজি লাগাচ্ছি, যাতে অন্তত খাবারের নিরাপত্তা থাকে।

পাশাপাশি আমি চরাঞ্চলের মানুষের প্রয়োজন বিবেচনায় ল্যাট্রিনের রিং–স্ল্যাব তৈরির একটি ছোট উদ্যোগ নিচ্ছি। আমাদের মানুষের সামর্থ্য কম, তাই কম দামে এসব সরঞ্জাম বিক্রির ব্যবস্থা করছি, যেন আমরা নিজেরাই নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে পারি। জলবায়ু পরিবর্তনের এই কঠিন বাস্তবতায় টিকে থাকতে এসব উদ্যোগই আমাদের ভরসা।

খাদিজা পারভীন খুশি

সাধারণ সম্পাদক, কুড়িগ্রাম জলবায়ু পরিষদ

জলবায়ু পরিবর্তন একটি বৈশ্বিক সমস্যা। আমরা একা এটি বদলাতে পারি না; কিন্তু মোকাবিলায় যতটুকু সম্ভব উদ্যোগ নিলে স্থানীয় সম্প্রদায় সুরক্ষিত থাকতে পারে। কুড়িগ্রাম জেলার চরাঞ্চলগুলোতে নদীভাঙন এবং বন্যা নারীদের জন্য বিশেষ চ্যালেঞ্জ। এ সময়ে কিশোরী ও নারীরা মাসিকের সময়ে দ্বিধা ও অস্বস্তিতে পড়েন। তাই বন্যার সময়ে স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার এবং পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা অপরিহার্য।

আমাদের উদ্যোগের মাধ্যমে চরাঞ্চলে নারী ও কিশোরীরা সচেতন হচ্ছে, স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের অভ্যাস গড়ে তুলছে এবং পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার শিক্ষাও পাচ্ছে। এটি শুধু স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় একটি ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

যাত্রাপুর চরসহ বিভিন্ন এলাকায় আমরা পণ্য বিতরণ করেছি এবং প্রচারণা চালিয়েছি। নারীরা কীভাবে বন্যার সময় নিজেদের স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করতে পারে, তা নিয়ে তাদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা হয়েছে। এই উদ্যোগ নারী ক্ষমতায়ন, স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং স্থানীয় জলবায়ু অভিযোজনের সঙ্গে একযোগে কাজ করছে।

নদীভাঙন ও বন্যার ঝুঁকিতে নারীদের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে সচেতনতা, পরিচ্ছন্নতা, স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার এবং সম্প্রদায়ভিত্তিক উদ্যোগ অপরিহার্য। আমাদের কার্যক্রম স্থানীয় স্তরে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় কার্যকর ভূমিকা রাখছে।

জুলেখা খাতুন

সাধারণ সম্পাদক, চর টুপামারী তরুণ দল, বেরুবাড়ি, কুড়িগ্রাম

আমাদের বাড়ি চর টুপামারি দুধকুমার নদের মুখে অবস্থিত। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখানে বারবার বন্যা, খরা ও ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব পড়ছে। এলাকার মানুষ প্রতিনিয়ত এই দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে চলেছে। শিক্ষা ও চিকিৎসার সুযোগ সীমিত; ভালো স্কুল বা কমিউনিটি ক্লিনিক নেই। যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে হলে ভাঙা রাস্তা পার করতে হয়, যেখানে আগে নৌকা চলাচল করত, এখন বন্যার সময় নৌকা নেই। মানুষকে ঝুঁকি নিয়ে বাঁশের সাঁকো পার হতে হয়, যা অনেক বৃদ্ধ ও গর্ভবতী নারী পার হতে পারেন না।

এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমরা স্থানীয় তরুণদের নিয়ে ‘জলবায়ু তরুণ দল’ গঠন করেছি। দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমি এলাকার প্রতিটি বাড়ি থেকে বাঁশ সংগ্রহ করে ভাঙা রাস্তায় বাঁশের সাঁকো নির্মাণ করি। বর্তমানে প্রায় ২০ হাজার মানুষ এ সাঁকো ব্যবহার করছে। সাঁকোর স্থায়ী সেতু নির্মাণের জন্য আমরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সহায়তায় উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে দরখাস্ত দিয়েছি, তবে এখনো ফলাফল মেলেনি।

যাতায়াতের অসুবিধার কারণে শিক্ষার সুযোগও সীমিত। আমি ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় সহপাঠীর সংখ্যা প্রায় ৭০ ছিল, এখন সরকারি কলেজে স্নাতক প্রথম বর্ষে মাত্র কয়েকজন। যদি নিরাপদ ও সহজ যাতায়াতের ব্যবস্থা থাকত, অনেক শিক্ষার্থী পড়াশোনা থেকে বাদ পড়ত না।

আমাদের আবেদন, উদ্যোগ এবং স্থানীয় প্রচেষ্টা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ। সাঁকো, নিরাপদ যাতায়াত ও সহযোগিতার মাধ্যমে শিক্ষার সুযোগ বাড়ানো সম্ভব। স্থানীয় প্রশাসন ও সহযোগী সংস্থার সমর্থন পেলে চরাঞ্চলের মানুষ, বিশেষ করে নারী ও শিক্ষার্থী, দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়ে জীবন ও শিক্ষার সুযোগ পেতে পারবে।

চাষী নূরন্নবী সরকার

যুগ্ম আহ্বায়ক, জলবায়ু কাউন্সিল, কুড়িগ্রাম

উত্তরাঞ্চলের কুড়িগ্রাম, রংপুর, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড় ও দিনাজপুর অঞ্চলে শিল্প বা কলকারখানা নেই। এখানকার আয়ের বড় উৎস কৃষি। চরাঞ্চলের ৪০১টি চর সম্পূর্ণ প্রকৃতিনির্ভর; জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বন্যা, খরা ও ঘূর্ণিঝড় এই মানুষের জীবন কঠিন করে তোলে। নদী নিয়ন্ত্রণ ও ড্রেজিং চেষ্টা থাকলেও পরিবেশগত ও প্রশাসনিক কারণে কার্যকর হয়নি। এতে আরও দারিদ্র্য ও বৈষম্য বেড়ে গেছে।

কুড়িগ্রামের মানুষ মাথাপিছু আয় মাত্র ২১৮০ ডলার; একই দেশে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লার মানুষ আয় করছেন ৫২৬৩ ডলার। অর্থনৈতিক সুযোগের অভাব, শিল্প না থাকা ও বিনিয়োগ সীমিত হওয়ায় এই অঞ্চলের দারিদ্র্য সর্বোচ্চ। পরিকল্পনা ও নীতি প্রণয়নের সময় কৃষকের উপস্থাপনাও নেই, ফলে জলবায়ু অভিযোজন প্রায় কার্যকর হচ্ছে না।

অঞ্চলের কার্বন নির্গমন তুলনামূলকভাবে খুব কম। প্রযুক্তিগত উন্নতি হলেও অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার কারণে উত্তরের মানুষ বড় উন্নতি করতে পারবে না। কপ সম্মেলন বা বৈশ্বিক উদ্যোগ থেকে বাস্তব পরিবর্তন আসে না; স্থানীয় পরিস্থিতি মোকাবিলায় নিবিড় ভর্তুকি ও সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি।

অঞ্চলের টেকসই উন্নয়নের জন্য সরকারের পাশাপাশি উদ্যোক্তা, এনজিও ও স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীদের সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন। সীমিত সম্পদ ও প্রকৃতিনির্ভর জীবনে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকারের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ ছাড়া উন্নয়ন অসম্ভব। দক্ষিণাঞ্চলের প্রযুক্তিগত অগ্রগতি উত্তরের জন্য সহজ সমাধান নয়; সমন্বিত, অর্থনৈতিকভাবে সহায়ক ও স্থানীয়ভাবে বাস্তবায়নযোগ্য উদ্যোগই কেবল এই অঞ্চলের মানুষকে বাঁচাতে পারে।

ফরিদা ইয়াসমীন

নির্বাহী পরিচালক, উন্নয়ন সংস্থা ‘নারী’, কুড়িগ্রাম

নারী যেন পরিবেশ এবং জীবিকায় বঞ্চিত না হয়, তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আমরা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছি। এই কাজে আমরা পরিবেশবান্ধব চুলা ব্যবহার করি, যা নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে এবং পরিবেশ রক্ষা করে। পাশাপাশি সোলার ব্যবস্থার মাধ্যমে বন্যা বা খরার সময় আশ্রয়কেন্দ্রে নারীরা আলো পায়। চিলমারীর তিনটি বাঁধে ভ্রাম্যমাণ সোলার পাওয়ার ব্যাংক স্থাপন করেছি।

আমরা জলবায়ু সহনশীল কৃষি কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে নারীদের সহায়তা দিচ্ছি। বন্যা বা খরার সময় নারীরা যেন সবজি চাষ চালিয়ে যেতে পারে, সে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী প্রধান গ্রিনহাউস গ্যাস-কার্বন ডাই–অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস-দূষণ হ্রাসে স্থানীয় উদ্যোগ জরুরি। বিশেষ করে মিথেন উৎপন্ন হয় বর্জ্য থেকে; তাই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা হলে পরিবেশ সুরক্ষা সম্ভব এবং সার উৎপাদনও হয়।

নারীদের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য সোলার ওভেন ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছি; কারণ, লাকড়ি বা পাতা পোড়ানো স্বাস্থ্য ঝুঁকি সৃষ্টি করে। সরকারের কাছে অনুরোধ, দ্রুত সোলার ওভেন গ্রামীণ নারীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হোক। ইএসডিও প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকের বিশ্রামাগার তৈরি হচ্ছে; এগুলো নারীবান্ধব ও পলিথিন মুক্ত হওয়া প্রয়োজন।

স্থানীয় অভিযোজন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে স্থানীয় জনপদ, সংগঠন, সাংবাদিক ও ক্লাইমেট কাউন্সিল সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করবে। নারী, প্রতিবন্ধী ও অন্য সুবিধাবঞ্চিতদের অন্তর্ভুক্ত করে এই পদক্ষেপগুলো কার্যকর করা জরুরি। এভাবে জলবায়ু সহনশীল, নারীকেন্দ্রিক ও পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ উন্নয়ন সম্ভব।

এ কে এম জাহেদুল ইসলাম

ডিভিশনাল ম্যানেজার, ব্র্যাক

কুড়িগ্রাম এবং রংপুর অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব স্পষ্ট। বন্যার সময় মানুষ ও গবাদিপশু বিপদে পড়ে। এ কারণে ব্র্যাক ইতিমধ্যে আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ শুরু করেছে এবং সরকারি কেন্দ্রগুলোর মেরামত করা হবে, যাতে সেগুলো বসবাসযোগ্য হয়। গবাদিপশু রক্ষার জন্য গোয়ালঘর তৈরি করা হচ্ছে। এ ছাড়া বন্যার সময় পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে টিউবওয়েলগুলো উঁচু করে পাকা করা হয়েছে। বজ্রপাতের ঝুঁকি কমাতে লাইটিং অ্যারেস্টার স্থাপন করা হচ্ছে।

চরাঞ্চলের মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে অনেকাংশে বঞ্চিত। ব্র্যাকের উদ্যোগে চরনারায়ণপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। মেডিকেল অফিসারদের ব্যবস্থা করা হয়েছে যাতে তারা সেবা প্রদান করতে আগ্রহী হয়। এ ছাড়া জলাবদ্ধতা কমাতে ড্রেনেজ ব্যবস্থা ও রাস্তা সংস্কার করা হচ্ছে।

রংপুর বিভাগে সেচের জন্য সোলার পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। এক পাম্পে ১০ থেকে ১৫ বিঘা জমি সেচ করা যায়, এটি কৃষকদের বিনা মূল্যে দেওয়া হচ্ছে। নতুন উদ্যোগ হিসেবে বিদ্যুৎবিহীন আলু সংরক্ষণাগার তৈরি করা হয়েছে, যেখানে চার–পাঁচ মাস আলু সংরক্ষণ করা সম্ভব। এটি পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে এবং ফলাফল সন্তোষজনক হলে ভবিষ্যতে কৃষকদের জন্য আরও সম্প্রসারণ করা হবে।

বৃক্ষরোপণেও ব্র্যাক নিয়মিত কার্যক্রম চালাচ্ছে। প্রতিবছর লাখ লাখ চারা রোপণ করা হয়। প্রথম আলোসহ অন্যান্য অংশীদারের সহযোগিতায় এ বছর রংপুরে প্রায় এক লাখ চারা বিতরণ করা হয়েছে।

মো. সিরাজুল ইসলাম

উপপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, রংপুর

আমাদের উত্তরাঞ্চলের কুড়িগ্রাম, রংপুর, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট ও ঠাকুরগাঁও অঞ্চলে কৃষিনির্ভর জীবনযাপন প্রধান। এ অঞ্চলে ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা ও দুধকুমার নদ–নদীর কারণে বারবার বন্যা হয়। বিশেষ করে কুড়িগ্রামে বছরে তিনবারের মতো বন্যা ফসল ও জীবনযাত্রাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে। অক্টোবর মাসে বন্যার কারণে নভেম্বরে রবি ফসল লাগানো সম্ভব হয় নয়, ফলে ফলন কমে যায়। এ ছাড়া খরা, তাপমাত্রা ওঠানামা ও পোকা–বালাইও ফসলকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

এ পটভূমিতে কৃষিকে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে অভিযোজন প্রযুক্তি গ্রহণ করা হয়েছে। বন্যা সহনশীল ধান, তাপসহিষ্ণু গমসহ বিভিন্ন ফসলের জাত সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির স্তর নেমে যাওয়া এবং মাটির উর্বরতা হ্রাসের সমস্যার মোকাবিলায় এডব্লিউডি পদ্ধতি, সোলার সেচ, পলি মালচিং এবং নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রায় নেট হাউস প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে।

চরাঞ্চলে কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্পের মাধ্যমে ১ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর জমির প্রায় ৭৮ শতাংশ আবাদি ভূমিতে এই প্রযুক্তি প্রয়োগ করা হচ্ছে। ফসল সংরক্ষণ, রোগনিয়ন্ত্রণ এবং সঠিক সার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও খুদে বার্তার মাধ্যমে আবহাওয়ার পূর্বাভাস প্রদান করা হচ্ছে।

এ ছাড়া নদীভাঙন রোধ, সেচ ও জলাধার বৃদ্ধির জন্য তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি। স্থানীয় নদীর গভীরতা বৃদ্ধি ও নিয়ন্ত্রণে আনা হলে কৃষি উৎপাদন ও জীবনমান—দুটোই উন্নত হবে।

এসব প্রযুক্তি ও কার্যক্রমের লক্ষ্য হলো কৃষিকে জলবায়ু সহনশীল করা, ক্ষতি হ্রাস করা এবং উত্তরাঞ্চলের কৃষকদের আয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সমন্বিত প্রচেষ্টা, সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার অংশগ্রহণ এবং স্থায়ী অভিযোজন কৌশলের মাধ্যমে এখানকার মানুষ বন্যা, খরা ও জলবায়ুঝুঁকি মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে।

সেলোয়ারা বেগম

উপপরিচালক, মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর, রংপুর

উত্তরাঞ্চলের চরাঞ্চলগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে নারী ও শিশু সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও দুর্যোগে নারীরা খাদ্য ও পানি সংগ্রহ, আশ্রয়কেন্দ্র ভ্রমণসহ নানা ঝুঁকিতে পড়ে। এসব কেন্দ্রের স্যানিটেশন ও নিরাপত্তা প্রায়ই অপর্যাপ্ত থাকায় নারী নিরাপদভাবে আশ্রয় নিতে পারেন না। বিশেষ করে ঋতুস্রাবের সময় স্যানিটেশন সরঞ্জামের অভাবে নারীদের মানসিক ও শারীরিক চাপ বৃদ্ধি পায়।

এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্থানীয় পর্যায়ে নারী দল ও সংগঠন গঠন করে সচেতনতা বাড়ানো হচ্ছে। নারী উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ ও অর্থনৈতিক সমর্থনের মাধ্যমে তাঁরা ঝুঁকিপূর্ণ সময়েও স্বাবলম্বী হতে পারছেন। মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নে কিশোর-কিশোরী ক্লাব এবং জেন্ডার প্রমোটারদের মাধ্যমে সচেতনতা কার্যক্রম চালাচ্ছে। এ ছাড়া গর্ভবতী মায়েদের সেবা, খাদ্যনিরাপত্তা, ভাতার আওতায় সহায়তা এবং ভিডব্লিউবির মাধ্যমে মাসিক খাদ্য বিতরণ পরিচালিত হচ্ছে, যা নারী ও শিশুদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করছে।

জলবায়ু প্রভাবের কারণে বাল্যবিবাহ ও মানব পাচারও বৃদ্ধি পায়। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর ১০৯ হেল্পলাইন এবং স্থানীয় ক্লাবগুলোর মাধ্যমে দ্রুত ব্যবস্থা নিচ্ছে। নারীর ক্ষমতায়ন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাদের শিক্ষার সুযোগ, স্বাস্থ্যসেবা ও অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও প্রকল্প কার্যকর করা হচ্ছে।

জলবায়ুঝুঁকিতে নারী ও শিশুরা সবচেয়ে দুর্বল। তাদের সুরক্ষা, খাদ্য ও পানির সহজলভ্যতা, স্যানিটেশন, স্বাস্থ্যসেবা এবং অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এ ঝুঁকি কমানো সম্ভব। স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় সংস্থার সমন্বিত প্রচেষ্টা নিশ্চিত করলে উত্তরাঞ্চলের নারী ও শিশু জলবায়ুর প্রভাবে কম ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং তাদের জীবনমান উন্নত হবে।

মো. আবু সায়েম

উপপরিচালক, হর্টিকালচার সেন্টার, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বুড়িরহাট, রংপুর

উত্তরাঞ্চলে কৃষকেরা বন্যা, খরা, অতিবৃষ্টি ও অনাবৃষ্টির সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করছেন। দীর্ঘমেয়াদি তাপমাত্রা বৃদ্ধি, ঋতুর অনিয়মিত পরিবর্তন এবং স্যালাইন পানির প্রসার কিডনি রোগ এবং ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। অ্যাগ্রোকেমিক্যালস ব্যবহারের কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকিও তীব্র। কৃষিশ্রমিক, রিকশাচালক ও সাধারণ মানুষ অতিরিক্ত ঘর্মাক্ত অবস্থায় দীর্ঘ সময় কাজ করলে শারীরিক ঝুঁকি বাড়ে।

কৃষকেরা তাদের লোকজ প্রযুক্তি ও স্থানীয় অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অভিযোজন করছে। যেমন আমন মৌসুমে বন্যার সময় বীজ সংরক্ষণ এবং তিনবার বীজতলা তৈরি করা। ভাসমান চাষ, খাটিয়াপদ্ধতি, মাটিবিহীন চাষ ও ছাদকৃষি উদ্ভাবন করে ফসল উৎপাদন নিশ্চিত করা হচ্ছে। এগুলো শুধু ক্ষতি এড়াতে নয়; বরং আয় ও পুষ্টি বৃদ্ধিতেও সহায়ক।

সরকারি উদ্যোগ এবং স্থানীয় সমিতি ও কমিটি জলবায়ু অভিযোজনকে সহায়তা করছে। ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠন এবং জলবায়ু কৃষি হাবের মাধ্যমে কৃষকেরা বীজ সংরক্ষণ, পরামর্শ গ্রহণ, রাস্তার ওপর শাকসবজি চাষ এবং সোলার সেচপ্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারছে। রাস্তা ও সেতুর মেরামত, স্কুল ও বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন এবং শিক্ষার্থীদের জন্য ঋতুস্রাবকালীন স্যানিটারি ব্যবস্থার মাধ্যমে স্থানীয় সম্প্রদায়ের সহনশীলতা বৃদ্ধি করা হয়েছে।

জলবায়ুবান্ধব বাজেট কার্যকর করার জন্য ইউনিয়ন পরিষদগুলোর বরাদ্দ নিয়মিত ত্রৈমাসিক ও বার্ষিক পর্যালোচনার মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করা হয়। পরিবারভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রমে ১৫ হাজার ৪২৮ পরিবারকে জলবায়ু পরিবর্তন, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, জলবায়ু অভিবাসন ও স্মার্ট কৃষি বিষয়ে সচেতন করা হয়েছে।

কৃষিবিজ্ঞানীরা রোগ ও পোকা নিয়ন্ত্রণ, সারের ব্যবহার, জৈব পদার্থ বৃদ্ধির কার্যক্রম এবং আবহাওয়া অনুসারে সঠিক চাষাবাদের পরামর্শ দিচ্ছেন। এআই-ভিত্তিক সিদ্ধান্ত সহায়তাব্যবস্থা ও মোবাইল পরামর্শের মাধ্যমে কৃষকেরা সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারছেন। ঘরে মাশরুম চাষ, ছাদকৃষি, কম্পোস্ট ব্যবহার এবং স্থানীয় ও বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির সংমিশ্রণ জলবায়ুসহনশীলতা বৃদ্ধিতে কার্যকর ভূমিকা রাখছে।

মো. রেজওয়ানুর রহমান

সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর, ইএসডিও

আমরা যাঁরা উন্নয়ন–সহযোগী হিসেবে কাজ করি, আমরা নির্দিষ্ট প্রকল্পের উদ্দেশ্যে এলাকায় কাজ করি। প্রকল্প শেষ হলে আমরা চলে আসি, আর ওই প্রকল্পের কার্যক্রম এবং সরকারি সহযোগিতার বিষয়গুলো সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে বুঝিয়ে দিই। কিন্তু অনেক সময় তদারকি বা পরবর্তী সহায়তার অভাবে এই উদ্যোগগুলো হারিয়ে যায়।

ভবিষ্যতে কোনো প্রকল্প আসার আগে, সরকারি দপ্তর এবং উন্নয়ন–সহযোগীরা যদি সমন্বিতভাবে পরিকল্পনা করে এবং টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করে, তাহলে এলাকার মানুষের জীবনমান যথাযথভাবে উন্নত করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশ সরকারের এপি-সিক্স প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই বিষয়গুলো এলাকায় পৌঁছানো যায় এবং সরকারি কর্মকর্তারা এটি টেকসই করার উপায় জানেন।

আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে, উন্নয়ন কার্যক্রম শুধু প্রকল্প পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকলে ফলপ্রসূ হয় না। প্রকল্পের শেষে স্থানীয় সরকার এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে কার্যকর সমন্বয় থাকলে টেকসই প্রভাব নিশ্চিত করা যায়। এভাবেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উত্তরের জেলা ও চরাঞ্চলে মানুষের জীবনমান উন্নত করা সম্ভব।

আজকের বিভাগীয় সংলাপে উপস্থিত সবাইকে কৃতজ্ঞতা জানাই। তাদের সহায়তা ও অংশগ্রহণে এমন সংলাপ সম্ভব হয়েছে। আশা করি ভবিষ্যতে এ ধরনের সহযোগিতা আরও কার্যকর হবে এবং স্থানীয় জনগণের জীবন ও প্রাকৃতিক পরিবেশের টেকসই উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।

এ ছাড়া আরও অংশগ্রহণ করেন:

ইএসডিওর উপজেলা কো-অর্ডিনেটর মৃত্যুঞ্জয় রায়, সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) রংপুর জেলা কমিটির সভাপতি ফখরুল আনাম, রংপুর মহিলা পরিষদের সহসভাপতি আয়েশা সিদ্দিকা, ইয়ুথ নেট গ্লোবালের বিভাগীয় উপদেষ্টা সুজন মোহন্ত, রংপুর সিটি প্রেসক্লাবের সভাপতি স্বপন চৌধুরী। যুগের আলোর বার্তা সম্পাদক নজরুল মৃধা, চ্যানেল আইয়ের সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার মেরিনা লাভলী, লালমনিরহাটের আলোর পাঠশালার শিক্ষক দীপ্ত তালুকদার, রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কামরুল ইসলাম শান্ত, কুড়িগ্রামের সংবাদকর্মী জাহানুর রহমান। স্বাগত বক্তব্য: প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক (রংপুর) জহির রায়হান। সঞ্চালনা: প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী