‘জলবায়ু পরিবর্তনে নিরাপদ পানির সংকট ও নারীর বিপন্নতা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা। ১৭ আগস্ট ২০২৫ ঢাকার প্রথম আলো কার্যালয়ে
‘জলবায়ু পরিবর্তনে নিরাপদ পানির সংকট ও নারীর বিপন্নতা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা। ১৭ আগস্ট ২০২৫ ঢাকার প্রথম আলো কার্যালয়ে

জলবায়ু পরিবর্তনে নিরাপদ পানির সংকট ও নারীর বিপন্নতা

সুইডিশ সরকারের সহযোগিতায় মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ও প্রথম আলোর আয়োজনে ‘জলবায়ু পরিবর্তনে নিরাপদ পানির সংকট ও নারীর বিপন্নতা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ১৭ আগস্ট ২০২৫ ঢাকার প্রথম আলো কার্যালয়ে।

আলোচনা

 আইনুন নিশাত

ইমেরিটাস অধ্যাপক ও উপদেষ্টা,

সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট রিসার্চ (সিথ্রিইআর), ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

জলবায়ু পরিবর্তন কোনো ভবিষ্যৎ আশঙ্কা নয়; বরং এক কঠিন বাস্তবতা। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় নীতিনির্ধারণে জেন্ডার-রেসপনসিভ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা জরুরি। বাস্তবতা বিবেচনা না করে অতিরঞ্জিত প্রতিশ্রুতি দিলে ভবিষ্যতে তা আমাদের জন্য বড় বিপদের কারণ হতে পারে।

বাংলাদেশে, বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকায় নিরাপদ পানির সংকট দীর্ঘদিনের। সেখানে খাওয়ার পানির অভাবের পাশাপাশি গোসল ও ব্যবহারযোগ্য পানির তীব্র সংকট রয়েছে। অনেক জায়গায় বৃষ্টির পানি ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। অথচ পানি একটি স্বীকৃত মানবাধিকার, যা জাতিসংঘ ২০১১ সালে অনুমোদন করেছে, আর বাংলাদেশ ছিল এর অন্যতম প্রবক্তা। দুঃখজনক হলো, ২০১৩ সালের পানি আইনে এ অধিকার বাদ দেওয়া হয়। তাই নিরাপদ পানিকে মানবাধিকার হিসেবে পুনঃস্বীকৃতি দিতে হবে।

জলবায়ু পরিবর্তন ও পানিসংকট সরাসরি নারীর বিপণ্নতার সঙ্গে সম্পর্কিত। উপকূলীয় অঞ্চলে নারীরা পানির জন্য দূরে যেতে বাধ্য হন, যা তাঁদের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও মর্যাদাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে। প্রজননস্বাস্থ্য সমস্যা আরও জটিল হয়ে উঠছে। শ্যামনগরে অনেক নারী মাসিকজনিত ব্যথায় জরায়ু অপসারণে বাধ্য হচ্ছেন, যা আমাদের সামাজিক ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা তুলে ধরে। এ ছাড়া অভিবাসনের চাপ, পারিবারিক নির্যাতন ও আর্থিক দুর্বলতা নারীদের জন্য ত্রিমুখী ঝুঁকি তৈরি করেছে।

সমাধানের পথও আছে। খাসজমি ও দখল হওয়া বিল পুনরুদ্ধার করে জলাধার তৈরি, বৃহৎ আকারে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও নারীদের ব্যবস্থাপনায় সম্পৃক্ত করা জরুরি। তবে এর দায়িত্ব শুধু নারীর ওপর নয়, পুরুষদেরও সমান ভূমিকা নিতে হবে।

পরিশেষে বলব, জলবায়ু পরিবর্তন, নিরাপদ পানি ও নারীর বিপন্নতা—তিনটি ইস্যু একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। এগুলো মোকাবিলায় আমাদের প্রয়োজন বাস্তবসম্মত নীতি, সঠিক দিকনির্দেশনা ও সর্বস্তরের সম্মিলিত উদ্যোগ।

শাহীন আনাম

নির্বাহী পরিচালক, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খরা, মরুকরণ ও অনিয়মিত বৃষ্টিপাত (যা বন্যা সৃষ্টি করে) বেড়ে যাওয়ায় পানির সংকট আরও গভীর হচ্ছে। এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা, যা বাংলাদেশে চর, হাওর, উপকূলীয় অঞ্চল ও পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষভাবে প্রকট।

খাদ্য, পানি ও বিশুদ্ধ বাতাস—এগুলো মানবাধিকারের অন্তর্ভুক্ত বিষয়। যখন এই অধিকারগুলো থেকে মানুষ, বিশেষত নারীরা বঞ্চিত হয়, তখন তার জীবন ও স্বাস্থ্যের ওপর অপরিসীম প্রভাব পড়ে। আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, এর প্রভাব পুরুষের চেয়ে নারীর ওপর বেশি পড়ে।

পানি–সংকটের কারণে পুরুষেরাও সমস্যার সম্মুখীন হন। তবে পারিবারিক ও গৃহস্থালি কাজের দায়িত্বের কারণে নারীরা বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। পানির অপ্রতুলতা তাঁদের বিভিন্নভাবে বঞ্চনার সম্মুখীন করে, সহিংসতার ঝুঁকিতে ফেলে এবং তাঁদের স্বাস্থ্য ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়। এর সঙ্গে তাদের যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্যেরও গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এই সংকট নারীদের আরও প্রান্তিক সীমায় দিকে ঠেলে দেয়, ফলে তাঁদের সামাজিক, শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি ঘটে।

এ সমস্যা নিরসনে বিশাল রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও বিনিয়োগের প্রয়োজন। সরকার এ ব্যাপারে কতটা আগ্রহী বা রাজি, তা আমি জানি না। আমরা এক জায়গায় এসে থেমে গেছি। শুধু নারীর পানির সংকট দেখলেই চলবে না। নারীর ক্ষমতায়ন, সম্মান ও স্বীকৃতি—এই সবকিছু নিয়েও ভাবতে হবে। এই বাধা কীভাবে অতিক্রম করব, তা আমাদের ভাবতে হবে। যদিও বেসরকারি সংস্থাগুলো (এনজিও) অনেক ছোট ছোট ও ভালো প্রকল্প পরিচালনা করে, যা মডেল হিসেবে কাজ করতে পারে; কিন্তু ব্যাপকভাবে এর প্রসার ও বাস্তবায়ন কেবল সরকারের পক্ষেই সম্ভব।

বিভিন্ন বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ। শুধু সরকারই নয়, এনজিওগুলোও অনেক সময় নিজেদের গণ্ডির মধ্যে কাজ করতে পছন্দ করে; কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের এই সংকট একটি অস্তিত্বের সংকট, যা নিরসনে সমন্বয় অত্যন্ত জরুরি।

মুহাম্মদ আব্দুল হাই আল মাহমুদ

যুগ্মসচিব ও জাতীয় প্রকল্প পরিচালক, জেন্ডার রেসপনসিভ কোস্টাল অ্যাডাপটেশন (জিসিএ) প্রকল্প,

মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর

দেশকে উন্নত করতে হলে, বিশেষ করে নারীদের বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। নারীরা পুরুষদের চেয়ে অনেক বেশি কর্মক্ষম। আমরা যত বেশি নারীকে ক্ষমতায়ন করব, তা জাতির স্বার্থেই হবে। দেশকে আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে হলে নারীকে সংগঠিত করা, গড়ে তোলা, পৃষ্ঠপোষকতা করা ও সহায়তা করা বাধ্যতামূলক।

জলবায়ু পরিবর্তন ও পানির সংকটে কেবল নারীই বিপণ্ন নয়; বরং পাহাড়, হাওর, চর ও উপকূলীয় এলাকার সব জনগোষ্ঠীই ভুক্তভোগী। তবে বাস্তবে আমি দেখেছি যে নারীরা আমাদের দেশের বাস্তবতায় অনেক বেশি পরিশ্রমী ও নিবেদিতপ্রাণ, তাই তাঁদের অবদান বিশেষভাবে তুলে ধরা প্রয়োজন।

আমাদের জেন্ডার রেসপনসিভ কোস্টাল অ্যাডাপটেশন (জিসিএ) প্রকল্পের অধীন ৪৩ হাজার নারী নিয়ে কাজ করছি। এ প্রকল্পের আওতায় আমরা সম্প্রতি ২৮ কোটি টাকা জীবিকা উন্নয়নের জন্য বিতরণ করছি। এ ছাড়া জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের মাধ্যমে ১৩ হাজার ৩০৮টি পরিবারভিত্তিক রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং সিস্টেম ও ১২১টি কমিউনিটিভিত্তিক সিস্টেম হস্তান্তর করেছি। এ ট্যাংকগুলোতে ২০০০ লিটার পানীয় জল সংরক্ষণ করা যায়, যা মূলত খাওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়।

এই পাইলট প্রকল্পগুলো থেকে আমরা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি ও তা সারা দেশে কার্যকরভাবে সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করতে পারি। আমাদের একটি জাতীয় নীতি থাকা উচিত, যেখানে জনস্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকার, সমবায়, পানিসম্পদ, দুর্যোগ ও ত্রাণ—এই প্রধান মন্ত্রণালয়গুলো একত্র হয়ে কাজ করবে। এ সমস্যাগুলো যেহেতু দীর্ঘমেয়াদি, তাই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা আবশ্যক।

সেখ ফরিদ আহমেদ

যুগ্মসচিব, ত্রাণ কর্মসূচি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলাফলের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে আমরা অন্যতম। আমাদের দেশে যাঁরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন, তাঁদের মধ্যে যাঁরা বয়স্ক, শিশু ও নারী, তাঁরা আরও বেশি মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আমাদের পানির সংকট হচ্ছে এবং আমাদের নারীরা যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বা তাঁরা সবচেয়ে বিপণ্ন গোষ্ঠীর অন্যতম, সে বিষয়ে কারও কোনো দ্বিমত নেই।

পানিসংকটের ক্ষেত্রেও এই চিত্র স্পষ্ট—উপকূলীয় এলাকায় নিরাপদ পানির অভাব নারীদের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও মর্যাদাকে গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বাস্তবে দেখা যায়, পরিবারে যে সামান্য নিরাপদ পানি মেলে, তা পুরুষেরা ব্যবহার করেন; নারীরা বাধ্য হয়ে লবণাক্ত পানি খেতে থাকেন। এটি আমাদের সমাজব্যবস্থার এক কঠিন সত্য, যা নারীকে দ্বিগুণ ক্ষতির মুখে ঠেলে দেয়।

শুধু সমস্যা চিহ্নিত করলেই হবে না; বরং সঠিক সুপারিশ ও দীর্ঘমেয়াদি সমাধান বের করতে হবে। নীতি প্রণয়নের সময় নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের ঝুঁকিকে আলাদা করে বিবেচনায় আনা প্রয়োজন।

সরকার হয়তো সব সময় সঙ্গে সঙ্গে সুপারিশ গ্রহণ করতে পারে না। কিন্তু ধারাবাহিক আলোচনা ও গবেষণার মাধ্যমে যখন একটি শক্তিশালী প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়, তখন সেটি ধীরে ধীরে নীতিতে প্রতিফলিত হয়। তাই আমাদের দায়িত্ব হলো এমন একটি সুপারিশ তৈরি করা, যা ভবিষ্যৎ নীতি ও কার্যক্রমে দীর্ঘ মেয়াদে প্রভাব ফেলতে সক্ষম।

যদি আমরা সঠিকভাবে সমস্যার সমাধান করতে পারি, তাহলে আমাদের আলোচনা অনেক কাজে আসবে, এটা আমার বিশ্বাস।

শর্মিষ্ঠা দেবনাথ

নির্বাহী প্রকৌশলী, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নাম শুনে অনেকে মনে করেন, আমরা সরাসরি স্বাস্থ্য খাতে কাজ করি। আসলে আমরা স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীন থেকে সারা দেশে পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশনের দায়িত্ব পালন করি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে নিরাপদ পানির সংকট ও নারীর বিপণ্নতা বিষয়ে আমাদের কিছু অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে চাই।

উপকূলীয় অঞ্চলে নিরাপদ পানির সংকটের কারণে আমরা বিভিন্ন অভিযোজনমূলক ব্যবস্থা নিয়েছি, যেমন বৃষ্টির পানি সংগ্রহ (রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং), পন্ড স্যান্ড ফিল্টার ও নলকূপ স্থাপন। সাম্প্রতিক সময়ে আকস্মিক বন্যায় আমরা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছি। তবে ক্লোরিন, বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ও মোবাইল ওয়াটার ট্রাকের ডিস্যালিনেশন ইউনিটের মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দিতে পেরেছি। প্রথমবারের সুনামগঞ্জে মতো আমরা ভাসমান টয়লেটও স্থাপন করেছি।

আমরা বর্তমানে উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় ৮১ হাজার বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ইউনিট স্থাপনের কাজ করছি। ইতিমধ্যে ৪৪ হাজার ইউনিট সম্পন্ন হয়েছে। প্রকল্পটি ২০২৫ সালের মধ্যে শেষ করার লক্ষ্য আছে। সরকারি প্রক্রিয়ার জটিলতার কারণে দ্রুত উদ্ভাবনী সমাধান বাস্তবায়নে কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও আমরা তা অতিক্রমের চেষ্টা করছি।

পানিসংকট নারীদের সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করছে। কারণ, পরিবারের পানির দায়িত্ব মূলত তাঁদের ওপরই বর্তায়। নিরাপদ পানি না থাকলে তাঁদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক মর্যাদা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমি বিশ্বাস করি, সরকার, এনজিও ও গবেষকদের যৌথ প্রচেষ্টায় আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম হব ও নারীর বিপণ্নতা কমাতে পারব।

নুজহাত জাবিন

কান্ট্রি ডিরেক্টর, ক্রিশ্চিয়ান এইড বাংলাদেশ

আমরা জানি, দক্ষিণাঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান। ঘূর্ণিঝড়, লবণাক্ততা, জোয়ারের পানি—সবকিছু মিলেই মানুষকে স্থানান্তরে বাধ্য করছে। আমার কাজের অভিজ্ঞতা বলছে, অনেক পরিবার একবার স্থানান্তরিত হলে আর ফিরে আসে না।

এ প্রেক্ষাপটে আমার প্রশ্ন—পানি সংগ্রহের ক্ষেত্রে নারীদের যে ‘ডিফল্ট ভূমিকা’ আছে, সেটি কীভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে? পুরুষেরা যখন স্থানান্তরিত হন অথবা নতুন এলাকায় চলে যান, তখন কি পানির দায়িত্ব পুরোপুরি নারীর কাঁধেই থেকে যায়? এ বিষয়টি নিয়ে আরও বিশদ আলোচনার প্রয়োজন। এ প্রেক্ষাপটে নারীর পানি সংগ্রহের ভূমিকা ও চাপ নিয়ে আরও নির্দিষ্ট তথ্য সামনে এলে ছবিটা আরও স্পষ্ট হতো।

আমরা জানি, পানি সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনায় নারীর ওপর প্রথাগতভাবে যে দায়িত্ব চাপানো হয়, সেটি তাঁদের জীবনে বাড়তি বোঝা তৈরি করে। শুধু দৈনন্দিন কাজই নয়, পানির সংকট জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতার আশঙ্কাও বাড়ায়। তাই পানি প্রাপ্যতা নিয়ে কথা বলতে গেলে শুধু সরবরাহ বা ঘাটতি নয়; বরং স্থিতিশীলতা, জীবিকার সুযোগ এবং আয়মূলক কর্মকাণ্ডকেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে।

আমার আরেকটি প্রশ্ন—পানি সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনায় যে গৎবাঁধা ধারণা বা স্টেরিওটাইপ রয়েছে, সেগুলো কি নারীদের নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকেই উঠে এসেছে? পানি আনতে না পারা, গৃহস্থালিকাজ বিঘ্নিত হওয়া কিংবা সেখান থেকে সহিংসতা তৈরি হওয়ার সম্পর্কগুলোও পরিষ্কারভাবে উঠে আসা জরুরি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আর পানি প্রাপ্যতা নিয়ে কথা বলতে গেলে নারীর জীবিকা, আয় ও স্থিতিশীলতার প্রসঙ্গ একসঙ্গে না দেখলে আসল চিত্রটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

সুবর্ণ বড়ুয়া

অধ্যাপক, ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আমি মূলত ক্লাইমেট ফাইন্যান্স নিয়ে কাজ করি। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে চাই, নারীর ক্ষমতায়নের জন্য ফাইন্যান্স অ্যাক্সেস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন ও নিরাপদ পানির সংকটের কারণে নারীরা একদিকে পরিবেশগতভাবে ভঙ্গুর, অন্যদিকে পারিবারিক সহিংসতার ঝুঁকিতে, আবার আর্থিকভাবে বিপন্ন। অর্থাৎ তারা একসঙ্গে তিনটি ভ্যালনারেবিলিটিতে ভোগে। আমি মনে করি, বড় ছবি দেখতে হলে জেন্ডার দৃষ্টিভঙ্গিকে আরও কেন্দ্রীয়ভাবে আনতে হবে।

বাংলাদেশের এখনো কোনো জাতীয় ক্লাইমেট ফাইন্যান্স স্ট্র্যাটেজি নেই। আমরা বর্তমানে ইউএনডিপির সহায়তায় একটি জাতীয় স্ট্র্যাটেজি প্রণয়নের দিকে এগোচ্ছি। এই স্ট্র্যাটেজিতে নারী, পানি ও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি ও অর্থনৈতিক মূল্যায়নের বিষয়গুলোকে অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। এ জন্য আমি মনে করি, আপনাদের মতামত ও ভয়েস রেইজ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আমি গ্লোবাল শিল্ড মেকানিজমের কথা উল্লেখ করতে চাই। এটি মূলত ডিজাস্টার রিস্ক ফাইন্যান্সিংয়ের জন্য একটি নতুন ব্যবস্থা। আশা করা হচ্ছে আগামী বছর থেকে বাংলাদেশ এই সাপোর্ট পাওয়া শুরু করবে। ইতিমধ্যেই আমরা স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছি। এই মেকানিজমকে যদি আমরা আমাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে ট্যাগ করতে পারি, তাহলে এটি বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সুযোগ হয়ে উঠতে পারে।

বনশ্রী মিত্র নিয়োগী

পরিচালক, রাইটস এন্ড গর্ভনেন্স, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন

জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলগুলোর মধ্যে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা, সাইক্লোন, নদীভাঙন, হাওরের আকস্মিক বন্যা, বরেন্দ্র অঞ্চলের খরা, পাহাড়ি ভূমিধসসহ নানা দুর্যোগ নারীদের ওপর অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে প্রভাব ফেলে তাঁদের বেশি সময় ব্যয় করতে হয় পানি আনতে, শিক্ষায় ও আয়ে বিঘ্ন ঘটে, স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ে এবং সহিংসতার ঝুঁকি বেড়ে যায়। বিদ্যমান পানিশাসন কাঠামোতে দায়িত্বে ভাগ রয়েছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে।

আবার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়হীনতাও প্রকট। এ ছাড়া রয়েছে অর্থায়নের ঘাটতি, ডেটা শেয়ারের দুর্বলতা ও নারীর সীমিত অংশগ্রহণ সমস্যা। তাই নারীর সমান অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব নিশ্চিত করা জরুরি—ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন পর্যায়ের পানি কমিটিতে কয়েকটি নির্দিষ্ট আসন ও অন্তত একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ নারীর জন্য সংরক্ষণ করতে হবে, সঙ্গে শিশুযত্ন ও যাতায়াত ভাতা দিয়ে তাঁদের নিরাপদ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

অঞ্চলভেদে প্রযুক্তিগত সমাধান, যেমন উপকূলে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও সৌর-ডেস্যালিনেশন, হাওরে উঁচু টিউবওয়েল ও ভাসমান সিস্টেম, বরেন্দ্র অঞ্চলে সৌর সেচ ও মাইক্রো-ইরিগেশন, পাহাড়ে স্প্রিং সংরক্ষণ এবং শহরে নিরাপদ পানির ব্লক ও ড্রেনেজ পুনর্গঠন প্রয়োজন।

সর্বোপরি, পানিশাসনকে হতে হবে অধিকারভিত্তিক, জবাবদিহিমূলক, পরিবেশ সমন্বিত এবং নারীবান্ধব, যা বাস্তবায়িত হলে নারীর সময় ও স্বাস্থ্যঝুঁকি কমবে, সহিংসতা হ্রাস পাবে এবং আমরা পাব ন্যায়সংগত, সহনশীল ও টেকসই পানিশাসনব্যবস্থা।

জুলিয়েট কেয়া মালাকার

নির্বাহী পরিচালক, সিসিডিবি

মাঠের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, কোস্টাল ‘এক্সপোজড’ কমিউনিটি, বিশেষ করে যাঁরা বাঁধের বাইরে থাকেন, তাঁদের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। সুরক্ষা নেই, নিরাপদ পানি নেই, কৃষি ক্ষেত্রে প্রবেশাধিকারও সীমিত। সেখানে আমরা দেখেছি, বিধবা নারীরাই বেশি, যাঁরা একরকম সামাজিকভাবে পরিত্যক্ত।

গবেষণায় দেখা গেছে প্রায় ৯ শতাংশ কিশোরী পানি সংগ্রহে যায়। আমি জানতে আগ্রহী, তাদের স্কুল ছাড়ার হার কত? কারণ, ৯১ শতাংশ নারী যখন দীর্ঘ সময় পানি আনতে ব্যয় করেন, তখন পরিবারের যত্ন, পড়াশোনা ও নিরাপত্তায় প্রভাব পড়ে; বাল্যবিবাহের ঝুঁকিও বাড়ে। এসব সংযোগ নজরে আনা জরুরি।

শ্যামনগরের রিভার্স অসমোসিস প্ল্যান্টে আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে, নারীরাই পানি সংগ্রহকারী ও তত্ত্বাবধায়ক, কিন্তু সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা প্রায় নেই। অনেক সময় ভালো পানি পরিবারের পুরুষ সদস্যদের জন্য বরাদ্দ হয়, আর নারীরা লবণাক্ত পানি খেতে বাধ্য হন, এটি কঠিন বাস্তবতা।

নীতিমালা আমাদের দেশে কম নয়। সমস্যা হলো, যাঁদের জন্য নীতিমালা, তাঁরা কতটা অবগত। ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচিত নারী সদস্যরা অনেক সময় নিজেরা মতপ্রকাশের সুযোগ পান না। শক্তিশালী পুরুষ আত্মীয়স্বজনই প্রতিনিধিত্ব করেন। তাই নারীদের অধিকারজ্ঞান ও কণ্ঠস্বর তৈরি করা এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ।

মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান

সিনিয়র পলিসি অ্যাডভাইজার–ক্লাইমেট, নেদারল্যান্ডস দূতাবাস

আমি নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের পক্ষ থেকে বলতে চাই, বাংলাদেশে ওয়াশ (পানি, পয়ঃনিষ্কাশন ও স্বাস্থ্যবিধি) প্ল্যাটফর্মে আমরা বেশ কিছু দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একযোগে কাজ করছি, যা মূলত জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলা ও টেকসই সমাধান খোঁজার জন্য। স্বাধীনতার আগে থেকেই নেদারল্যান্ডস বাংলাদেশের পানি খাতে কারিগরি সহযোগিতা দিয়ে আসছে, যা আজও অব্যাহত রয়েছে।

আমরা প্রায়ই শুধু পানির অভিগম্যতা নিয়েই আলোচনা করি, কিন্তু সহজলভ্যতা একটি বড় ইস্যু। বিশেষত উপকূলীয় অঞ্চলে পানীয় জলের সংকট ক্রমেই তীব্র হচ্ছে, যা এখন দেশের অন্যান্য অংশেও ছড়িয়ে পড়েছে। এই চ্যালেঞ্জকে গবেষণা ও আলোচনায় স্পষ্টভাবে তুলে ধরা প্রয়োজন।

বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা ও জাতিসংঘের সংস্থাগুলোও বলছে, সবকিছু এখন দ্বিমুখী পথে এগোচ্ছে—একদিকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ, অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি। এই অবস্থায় তহবিল সংগ্রহ ও যথাযথ ব্যবহার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

সবশেষে আমার মনে হয়, আমাদের ভবিষ্যৎ কাজের জন্য খুবই কৌশলগতভাবে এখন থেকেই পরিকল্পনা করা দরকার। কীভাবে বেসরকারি খাত ও অন্য স্টেকহোল্ডারদের সম্পৃক্ত করা যায়, যাঁরা বাস্তবিক অর্থে অবদান রাখতে পারেন, সেটিই হবে টেকসই সমাধানের চাবিকাঠি।

মোস্তাফিজুর রহমান

সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার – জলবায়ু ও পরিবেশ, সুইডেন দূতাবাস

পানির সংকট আমাদের বাস্তবতা, আর জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই সংকট দিন দিন আরও তীব্র হচ্ছে। অনিয়মিত বৃষ্টি ও পানিচক্রের অস্থিরতা পানির ঘাটতিকে ভয়াবহ আকার দিচ্ছে। ভবিষ্যতে পানি নিয়ে সংঘাত শুরু হওয়ার আশঙ্কাও অস্বীকার করা যায় না। তাই কেবল লিঙ্গভিত্তিক দৃষ্টিকোণ নয়, সবার পানির অধিকারই এখন প্রধান প্রশ্ন।

আমরা জানি, নারীরা প্রতিদিন পানি সংগ্রহ করতে সময় ব্যয় করছে। এটি একটি বাস্তবতা। কিন্তু এই বাস্তবতাকে বারবার পুনরাবৃত্তি করলেই সমস্যার সমাধান হবে না। সমস্যার গভীরে যেতে হবে—কীভাবে নীতি, আইন ও সম্পত্তির অধিকার মানুষের পানির প্রাপ্যতাকে প্রভাবিত করছে, তা বিশ্লেষণ জরুরি। শুধু নারীর দৈনন্দিন দুর্ভোগকে সামনে আনা যথেষ্ট নয়; এর পেছনে থাকা কাঠামোগত দুর্বলতা দূর করতে হবে।

পানি একটি মৌলিক সম্পদ। এটিকে সঠিকভাবে ব্যবহারের নিশ্চয়তা এবং সবার সমান প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা, এটাই মূল চ্যালেঞ্জ। জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের সেই চ্যালেঞ্জকে আরও গভীর করছে। তাই গবেষণা ও আলোচনা শুধু নারীর সংগ্রাম নয়; বরং বৃহত্তর কাঠামোগত পরিবর্তন এবং নীতিগত দুর্বলতা চিহ্নিত করার দিকে মনোযোগী হতে হবে।

রুমানা খান

জিবিভি ক্লাস্টার কো–অর্ডিনেটর, ইউএনএফপিএ, বাংলাদেশ

আমাদের এ মুহূর্তে জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, কারণ, বর্তমান পরিকল্পনাটির মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমরা দেখছিলাম যে আসলে কতটুকু জেন্ডার ভায়োলেন্স বর্তমান পরিকল্পনাটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং আমরা কত দূর এ জায়গা থেকে কাজ করেছি। তাই আমি অনুরোধ করব, দুর্যোগ মন্ত্রণালয় যেন অন্তত এই বিষয়গুলোতে মনোযোগ দেয় এবং সুনির্দিষ্টভাবে ফোকাস করে।

নতুন জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনাতে জেন্ডার মেইনস্ট্রিমিং, জেন্ডার ইন্টিগ্রেশন কতটুকু অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে, শুধু কথায় নয়, বরং কর্মের মাধ্যমে। আমরা এই প্রক্রিয়ায় সরকারকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।

আমাদের যে জলবায়ু তহবিলগুলো আছে, সেগুলোকে আসলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে আরও সংযুক্ত করা উচিত। জলবায়ু সহনশীল প্রোগ্রামিং এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সমান্তরালভাবে চলছে। ভবিষ্যতে মানবিক তহবিল অনেক কমে যাবে, এটা আমরা দেখতে পাচ্ছি। সুতরাং, যখন আমরা এই প্রোগ্রামগুলো করছি, তখন আমাদের জেন্ডার ইনক্লুসিভ অ্যাপ্রোচ নিতে হবে। আমরা যখন দুর্যোগে সাড়া দান করছি, তখন আমাদের জাতীয় স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যবিধির মানদণ্ড অনুসরণ করার চেষ্টা করা উচিত, যা নারী ও মেয়েশিশুদের ঝুঁকিগুলোকে বিবেচনা করে।

মো. মাহমুদুল হাসান

হেড অব প্রোগ্রাম, ওয়াটার ফুড অ্যান্ড ক্লাইমেট, হেলভেটাস

জলবায়ু পরিবর্তনে পানি প্রশ্নে দেখা যাচ্ছে, সবচেয়ে বিপন্ন অবস্থায় আছেন প্রবীণ নারীরা । পানির সমস্যা আসলে সর্বত্র। পার্থক্য শুধু প্রকৃতির। হাওরে হয়তো এক লিটার ভালো পানি পাওয়া যায়, কিন্তু উপকূলে সেই একই এক লিটার পানিও শেষ পর্যন্ত লবণাক্ত হয়ে যায়। মানুষকে সেখান থেকে সরানো যায় না। ঢাকায় আমরা তুলনামূলক ভালো মানের পানি ব্যবহার করি, কিন্তু দক্ষিণবঙ্গের অবস্থাই আসল চ্যালেঞ্জ।

গবেষণা বলছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পানীয় জলের প্রাপ্যতা ব্যাপকভাবে কমেছে। উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় ৯৭ শতাংশ এলাকায় পানি সংকট, হাওর ও চট্টগ্রাম পার্বত্য জেলাতেও পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে।

আমার কাছে পানি মানুষের মৌলিক অধিকার—এটা কোনো ব্যবসার পণ্য নয়। বিশেষ করে নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। একজন নারীকে যেন ভাবতে না হয় সারা বছরের পানি কোথা থেকে আসবে, এটা আমাদের নীতি-পরিকল্পনায় অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত।

আমাদের মনে রাখতে হবে, পানি শুধু টিকে থাকার উপকরণ নয়, এটি সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রশ্ন। জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় পানিকে কেন্দ্রীয় অধিকার হিসেবে বিবেচনা করতে পারলেই নারীর বিপন্নতা কিছুটা হলেও লাঘব করা সম্ভব।

আজরীন করিম

সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, বিআইডিএস

আমরা জলবায়ু পরিবর্তনকে দুটি কারণে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিই—বৈশ্বিক থেকে আঞ্চলিক প্রভাব ও তাপমাত্রা বৃদ্ধি। পানি শুধু একটি প্রাকৃতিক সম্পদ নয়, বরং এটি একটি মৌলিক মানবাধিকার। তবে সামাজিক ও পারিবারিক কাঠামোর কারণে এর সংগ্রহ ও ব্যবহারে নারীরা বেশি চাপের মুখে পড়ে। পানি সংগ্রহ নারীর প্রধান দায়িত্ব, আর এ কাজে কতটুকু সময় ব্যয় হচ্ছে সেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সূচক।

নিরাপদ পানির উৎস খুঁজে পাওয়া, সেখানে পৌঁছাতে সময় ব্যয়, পথের নিরাপত্তা, পরিবহন—সবকিছুই নারীর জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে রাত বা সন্ধ্যার পর নারীর জন্য পানির উৎসে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। এর সঙ্গে নিরাপত্তা ও সহিংসতার ঝুঁকি যুক্ত হয়, যা বাড়ির ভেতরে ও বাইরের উভয় ক্ষেত্রেই বিদ্যমান।

নীতিগত সুপারিশে শুধু কাঠামোগত বা সরবরাহমুখী দিকের ওপর নির্ভর না করে চাহিদামুখী দিককেও সমান গুরুত্ব দেওয়া উচিত। বিশেষ করে গৃহস্থালি পর্যায়ে নারীদের সম্পৃক্ত করেই পানি শাসন ও ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা হতে হবে। আমার গবেষণা, যা জার্নাল অব ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টে প্রকাশিত হয়েছে, সেখানে দেখা গেছে, যদি চাহিদাভিত্তিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তবে অন্তত ৬৪ শতাংশ পানি অপচয় রোধ করা সম্ভব।

সোমা দত্ত

প্রোগ্রাম ম্যানেজার, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন

বাংলাদেশের চর, হাওর, পাহাড় আর উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তন নারীর জীবনকে সবচেয়ে বেশি আঘাত করছে। বিশেষ করে পানির সংকট তাঁদের দৈনন্দিন সংগ্রামকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, হাওর অঞ্চলে অবকাঠামোগত ক্ষতি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ (৮০ শতাংশ), আবার উপকূলে লবণাক্ততা আর চর এলাকায় রাস্তাঘাট ভাঙন পানির উৎসে পৌঁছানোকে কঠিন করে তুলছে। পাহাড়ে খরা ও অনিয়মিত বৃষ্টিপাত প্রচলিত উৎস শুকিয়ে দিয়েছে। ফলে নারীদের অনেক দূর হাঁটতে হচ্ছে, সময় ব্যয় করতে হচ্ছে।  সেই সঙ্গে বাড়ছে গৃহস্থালিকাজের চাপ ও পারিবারিক সহিংসতা।

পানির দায়িত্বকে এখনো নারীর কাজ হিসেবেই দেখা হয়। একটি পরিবারে অঞ্চলভেদে দৈনিক মাথাপিছু ৯ থেকে ১২ লিটার নিরাপদ পানির চাহিদা থাকলেও প্রাপ্যতা প্রয়োজনের তুলনায় কম। পানির প্রাপ্যতা ও ব্যবহারে নারী ও পুরুষের বৈষম্য দৃশ্যমান। সরকারি ও বেসরকারি কিছু উদ্যোগ আছে, যেমন চর এলাকায় কমিউনিটি টিউবওয়েল, হাওরে পানির সংরক্ষণ ও সাবমারসিবল পাম্প, উপকূলে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ। তবে হাওর অঞ্চলে সহায়তা সবচেয়ে কম, ১৪ দশমিক ১ শতাংশ।

আমি মনে করি, শুধু অবকাঠামো নয়, জলবায়ু অভিযোজন পরিকল্পনায় নারীর নেতৃত্ব, জেন্ডার বাজেট, সহিংসতা মোকাবিলা ও বৈষম্য হ্রাসের বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

সুপারিশ

  • নারীর অংশগ্রহণ, নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে সমন্বিত পানি ব্যবস্থাপনা ও শাসনকাঠামো শক্তিশালী করা।

  • জলবায়ু অভিযোজন প্রকল্পগুলোতে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ ও সুরক্ষাব্যবস্থা সংযোজন।

  • জেলা–উপজেলা ও ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্তিমূলক পানি ব্যবস্থাপনা ও নারীর প্রতিনিধিত্ব বাধ্যতামূলক করা।

  • বাংলাদেশের পার্সপেকটিভ প্ল্যানে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধমূলক কর্মসূচি অন্তর্ভুক্ত করা।

  • বাংলাদেশ ডেলটা প্ল্যান ২১০০-এ নারী নেতৃত্বাধীন পানি ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন ও লিঙ্গভিত্তিক তথ্য সংরক্ষণ।

  • জাতীয় স্যানিটেশন কৌশলে নারী-সংবেদনশীল নিরাপত্তা অডিট অন্তর্ভুক্ত করা, যাতে স্যানিটেশন অবকাঠামোয় নারীর মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।

  • পানি সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব শুধু নারীর নয়। পানি ব্যবস্থাপনায় বাড়ির কাছাকাছি পানির উৎস স্থাপন, নিরাপদ আলোকসজ্জা, পুরুষ সদস্যদের সম্পৃক্ত করা।

  • অঞ্চলভিত্তিক বিশেষত চর, পাহাড়, হাওর ও উপকূলীয় অঞ্চলের বিশেষ চাহিদা অনুযায়ী পানি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন।

  • পানি, জলবায়ু ও দুর্যোগ–সম্পর্কিত সব মন্ত্রণালয়ের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় কাঠামো    গড়ে তোলা।

অংশগ্রহণকারী: আইনুন নিশাত, ইমেরিটাস অধ্যাপক ও উপদেষ্টা, সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট রিসার্চ (সিথ্রিইআর), ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়। শাহীন আনাম, নির্বাহী পরিচালক, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন। মুহাম্মদ আব্দুল হাই আল মাহমুদ, যুগ্মসচিব ও জাতীয় প্রকল্প পরিচালক, জেন্ডার রেসপনসিভ কোস্টাল অ্যাডাপটেশন (জিসিএ) প্রকল্প, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর। সেখ ফরিদ আহমেদ, যুগ্মসচিব, ত্রাণ কর্মসূচি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। শর্মিষ্ঠা দেবনাথ, নির্বাহী প্রকৌশলী, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। নুজহাত জাবিন, কান্ট্রি ডিরেক্টর, ক্রিশ্চিয়ান এইড বাংলাদেশ। সুবর্ণ বড়ুয়া, অধ্যাপক, ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বনশ্রী মিত্র নিয়োগী, পরিচালক, রাইটস অ্যান্ড গর্ভনেন্স, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন। জুলিয়েট কেয়া মালাকার, নির্বাহী পরিচালক, ক্রিশ্চিয়ান কমিশন ফর ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ (সিসিডিবি)। মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান, সিনিয়র পলিসি অ্যাডভাইজার–ক্লাইমেট, নেদারল্যান্ডস দূতাবাস। মোস্তাফিজুর রহমান, সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার – জলবায়ু ও পরিবেশ, সুইডেন দূতাবাস। রুমানা খান, জিবিভি ক্লাস্টার কো–অর্ডিনেটর, ইউএনএফপিএ, বাংলাদেশ। মো. মাহমুদুল হাসান, হেড অব প্রোগ্রাম, ওয়াটার ফুড অ্যান্ড ক্লাইমেট, হেলভেটাস বাংলাদেশ। আজরীন করিম, সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস)। সোমা দত্ত, প্রোগ্রাম ম্যানেজার, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন।  সঞ্চালক: ফিরোজ চৌধুরী, সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো।