‘বাড়ি থেকে বিদ্যালয়: প্রতিবন্ধী শিশুদের একীভূত শিক্ষায় অগ্রগতি’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা
‘বাড়ি থেকে বিদ্যালয়: প্রতিবন্ধী শিশুদের একীভূত শিক্ষায় অগ্রগতি’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা

বাড়ি থেকে বিদ্যালয়: প্রতিবন্ধী শিশুদের একীভূত শিক্ষায় অগ্রগতি

ইউকে এইডের ইনক্লুসিভ ফিউচারের উদ্যোগে সাইটসেভার্স, এডিডি ইন্টারন্যাশনাল, সেন্স ইন্টারন্যাশনাল ও প্রথম আলোর উদ্যোগে ‘বাড়ি থেকে বিদ্যালয়: প্রতিবন্ধী শিশুদের একীভূত শিক্ষায় অগ্রগতি’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ৮ জুলাই ২০২৫ ঢাকার প্রথম আলোর কার্যালয়ে।

আলোচনা

অধ্যাপক ড. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার

মাননীয় উপদেষ্টা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়

আজকে আলোচনায় প্রতিবন্ধী শিশুদের একীভূত শিক্ষার আওতায় আনতে ‘শিখবো সবাই’ প্রকল্পের ‘বাড়ি থেকে বিদ্যালয়’ নামে যে নতুন একটি মডেলের কথা বলা হয়েছে, এর আগে এগুলো আমাদের কেউ জানায়নি। ফলে আমি অনেক সমৃদ্ধ হয়েছি।

প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য বিদ্যালয়গুলোয় উপযুক্ত কাঠামো গড়ে তোলা প্রয়োজন। সেখানে সরকারের শিক্ষা বিভাগের পাশাপাশি সমাজসেবা বিভাগ ও স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সহায়তা থাকতে হবে। প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর সহায়তার জন্য দেশে কমিউনিটিভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন চালুর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। এ ধরনের উদ্যোগ নিলে তা প্রতিবন্ধী শিশুদের পরিবার, সমাজ—সব পক্ষের জন্যই সহায়ক হবে।

আমি আপনাদের পুরো পলিসি পেপার পড়েছি এবং এর সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত পোষণ করছি। তবে এতে খরচ নিয়ে একটা অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ থাকা প্রয়োজন ছিল।

আপনারা এমন মানুষদের নিয়ে কাজ করছেন, যারা সবচেয়ে বেশি অবহেলিত, পরিবারেও যাদের মূল্যায়ন নেই। ‘বাড়ি থেকে বিদ্যালয়’ নামে যে মডেল তৈরি হয়েছে, তা নিয়ে আপনারা সামনে এগিয়ে যান। ছোট ছোট বিষয় সমাধানের মাধ্যমেই বড় লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে। আপনাদের প্রস্তাবনা আমরা আমাদের সীমিত সক্ষমতার দ্বারা সাধ্যমতো বাস্তবায়নের চেষ্টা করব।

মো. সাইদুর রহমান খান

মহাপরিচালক, সমাজসেবা অধিদপ্তর

প্রতিবন্ধী শিশুরা নির্বিঘ্নে বিদ্যালয়ে যাতায়াত করতে পারে—এ লক্ষ্যে সরকার নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের আওতায় ৫২টি কার্যক্রমের মধ্যে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সুরক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মাঝে গত অর্থবছরে ৩২ দশমিক ৩৪ লাখ জনের মধ্যে মোট ৩৩২১ দশমিক ৭৭ কোটি টাকা ভাতা এবং ১ লাখ শিক্ষার্থীকে ১১৩ দশমিক ৭১ কোটি টাকার শিক্ষা উপবৃত্তি প্রদান করা হয়েছে। বর্তমানে ৩৬ লাখ নিবন্ধিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তির মধ্যে প্রায় ৩৪ লাখকে সুরক্ষাবলয়ের আওতায় আনা হয়েছে। ৬৪ জেলায় ৭৬টি কেন্দ্রে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষা কার্যক্রম এবং ১২টি বিশেষ বিদ্যালয়ে দৃষ্টি, বাক্‌ ও শ্রবণপ্রতিবন্ধীদের ব্রেইল ও ইশারা ভাষায় শিক্ষা প্রদান চলছে। মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য রয়েছে আবাসিক শিক্ষা ও থেরাপির সুবিধা। এ ছাড়া রয়েছে ছয়টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও পুনর্বাসনের সুবিধা।

এনজিও প্রকল্পের স্থায়িত্ব নিশ্চিতে সফল প্রকল্পগুলো সরকারিভাবে গ্রহণ ও তথ্যভান্ডার সমৃদ্ধকরণে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এসব উপাত্ত যাতে মুঠোফোনে অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে সহজে অ্যাকসেস করা যায়, আমরা সে বিষয়েও কাজ করছি। সবাইকে প্রতিবন্ধীবান্ধব সমাজ গঠনে এগিয়ে আসতে হবে।

সারোয়ার হোসেন

যুগ্ম সচিব, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ

সমাজে এখনো প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে নানা কুসংস্কার বিরাজ করছে। অনেক শিক্ষিত অভিভাবকও চান না, তাঁদের সন্তানের সঙ্গে একজন প্রতিবন্ধী শিশু একই শ্রেণিকক্ষে পড়াশোনা করুক। এই মানসিকতা একটি বড় প্রতিবন্ধকতা, যা থেকে সমাজকে বেরিয়ে আসতে পরিকল্পিত উদ্যোগ ও সামাজিক সচেতনতা তৈরি জরুরি।

মাঠপর্যায় থেকে মন্ত্রণালয়ে কাজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ছোট পরিসরে কিছু কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা টেকসই হয় না। প্রকল্প শেষে সুবিধাভোগীরা আবার পিছিয়ে পড়েন। তাই বৃহৎ ও টেকসই পরিকল্পনা প্রয়োজন।

প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা-সংযোগ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা ঝরে না পড়ে। কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগে অনেকগুলো প্রকল্প, প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ও শর্ট কোর্স চলমান, যেখানে নারী, প্রতিবন্ধী ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী জনগণের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা রাখা হয়েছে। তবে তাঁদের উপযোগী কাজ নির্ধারণ করাও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তাঁরা দায়িত্বশীলভাবে কাজ করেন। আমাদের লক্ষ্য—কাউকে পেছনে না ফেলে সবাইকে নিয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সুন্দর বাংলাদেশ গড়া।

অধ্যাপক ড. এ কিউ এম শফিউল আজম

পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন), মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর

২০০৪-০৫ সালে দ্বিতীয় প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি (পিইডিপি-২) শুরু করার সময় আমরা একীভূত শিক্ষাবিষয়ক সচেতনতায় লিফলেট ছাপিয়েছিলাম। সেখানে বোঝানো হয়েছিল—একীভূত শিক্ষা কী, কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ এবং কেন প্রতিবন্ধী শিশুরা সাধারণ বিদ্যালয়ে পড়বে। ২০ বছর পরও আমরা একই প্রশ্ন করছি—এর মানে, সমাজে মানসিকতা পরিবর্তনে ঘাটতি রয়ে গেছে। আমাদের আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো জরুরি।

পরিবর্তন শুরু করতে হবে নিজ ঘর থেকে, স্থানীয় স্তর থেকে। একীভূত শিক্ষার ক্ষেত্রে ‘এবিসি’ ধারণাটি গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, অ্যাকসেস—আমাদের নিশ্চিত করতে হবে, সব শিক্ষার্থীর বিদ্যালয়ে আসার যথাযথ সুযোগ ও প্রবেশাধিকার আছে কি না। দ্বিতীয়ত, বিলংগিং—শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে নিজেদের অন্ত ও আপন মনে করতে পারছে কি না। সবশেষে, কমপ্লিশন—অর্থাৎ শিক্ষা সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা, পরিবেশ ও সুযোগ কি তাদের জন্য নিশ্চিত করা হয়েছে?

প্রাথমিক শেষে যদি পরিবার ও সমাজ প্রস্তুত না থাকে, শিক্ষার্থীও ঝরে পড়বে। তাই অন্তর্ভুক্তিমূলক ভবিষ্যৎ গড়তে হলে সমাজকেও হতে হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক।

হামিশ হিগিংসন

গ্লোবাল টেকনিক্যাল লিড, ইনক্লুসিভ এডুকেশন, সাইটসেভার্স

একীভূত শিক্ষা বাস্তবায়নে স্থানীয় পর্যায়ে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর মধ্যে যে আগ্রহ, উদ্দীপনা ও সহনশীলতা আমি দেখেছি, তা থেকে আমি অনুপ্রাণিত বোধ করছি। আমার বিবেচনায় ডিআইডির ‘শিখবো সবাই’ কর্মসূচি দারুণভাবে সফল হয়েছে। এটি একীভূত শিক্ষার জন্য একটি ‘সূচনা নকশা’, যা বাংলাদেশের নিজস্ব সমস্যা সমাধানের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে।

এই কার্যক্রম শিক্ষার সর্বস্তরের অংশীজনদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সক্ষমতা তৈরি করেছে। শিক্ষকদের ঝুঁকি নিতে ও নতুন কৌশলের মাধ্যমে একীভূত শিক্ষায় উৎসাহ দিয়েছে। সব মিলিয়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠন (ওপিডি)গুলোর সক্ষমতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করেছে। এই ওপিডিগুলো এখন কমিউনিটি, অভিভাবক ও বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করছে। শিশুরা এখন বাড়ি থেকে বিদ্যালয়ে যেতে অনুপ্রাণিত হচ্ছে। এই কার্যক্রম থেকে অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা এখন সরকারের সরাসরি তত্ত্বাবধানে পরবর্তী স্তরে নিয়ে যাওয়া উচিত। এর জন্য মডেলটিকে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে খাপ খাইয়ে নেওয়া প্রয়োজন। এই বিষয় একীভূত শিক্ষা বাস্তবায়নের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

তাহেরা জাবিন

অ্যাডভাইজার, সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট

ব্রিটিশ হাইকমিশন, ঢাকা

গ্লোবাল ডিসঅ্যাবিলিটি সামিটে সভাপতি হিসেবে গ্লোবাল অ্যাকশন অন ডিসঅ্যাবিলিটি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে নেতৃত্ব দিচ্ছে যুক্তরাজ্য। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সমন্বয়নির্ভর বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম।

বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী শিশুরা সংবিধান ও আইনগত অধিকার থাকা সত্ত্বেও শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। বাংলাদেশে আমরা (ব্রিটিশ হাইকমিশন) ইউনিসেফের মাধ্যমে সরকারকে বিভিন্ন বিষয়ে সহায়তা করছি। সরকার একটি বিশেষ শিক্ষা চাহিদা ও প্রতিবন্ধীবিষয়ক জাতীয় কাঠামো তৈরি করেছে। এই কর্মসূচিতে এক লাখ তিন হাজারের বেশি শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। সারা দেশে প্রতিবন্ধিতা পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা করেছে।

প্রাথমিক শনাক্তকরণ, পারিবারিক সহায়তা ও কমিউনিটির সম্পৃক্ততার মাধ্যমে অন্তর্ভুক্তি শুরু করতে হবে। একীভূত শিক্ষাদান বাড়াতে হবে। প্রবেশগম্য অবকাঠামো তৈরি ও সহমর্মিতার সংস্কৃতির মাধ্যমে এসব স্কুল টিকিয়ে রাখতে হবে।

আন্তমন্ত্রণালয়কেন্দ্রিক শক্তিশালী সমন্বয়, কেন্দ্রীভূত ডেটা সিস্টেম ও উপযুক্ত প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের কিছু ভুল ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে। একীভূতকরণ ব্যয়বহুল, এমন ধারণা বদলাতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাদ দিয়ে রাখাই প্রকৃতপক্ষে ব্যয়বহুল।

অমৃতা রেজিনা রোজারিও

কান্ট্রি ডিরেক্টর, সাইটসেভার্স

‘শিখবো সবাই’ প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা একটি কার্যকরী মডেল তৈরি করতে পেরেছি। এ মডেলটি  শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্য সম্ভাব্য মডেল হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। একীভূত শিক্ষা বাস্তবায়নের জন্য এ মডেলটি প্রতিস্থাপন করতে পারে। এ প্রকল্পের একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে গুরুতর ও বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধী শিশুদের শনাক্ত করে তাদের চাহিদা অনুযায়ী বাড়িভিত্তিক শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করা। নানান পর্যায়ের মাধ্যমে তাকে স্কুল গমনোপযোগী করে তোলা হয়। আবার স্কুলভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রমেও আমরা নানান কাজ করেছি।

আমাদের এই কার্যক্রমের বিভিন্ন পর্যায়ে ওপিডি সংগঠনগুলো নিরবচ্ছিন্নভাবে সহযোগিতা করেছে। আমাদের এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল, বিদ্যালয়ে প্রতিবন্ধী শিশুদের ভর্তির হার বৃদ্ধি করা এবং ভর্তি করা শিক্ষার্থীরা যেন ঝরে না পড়ে।

আমরা যে একীভূত শিক্ষাপদ্ধতির বিস্তার করেছি, তা নানা অংশীজনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে, জাতীয় পর্যায়েও ছড়িয়ে পড়েছে। সব মিলিয়ে একটা সক্ষমতা তৈরি হয়েছে। সরকার একে স্বীকৃতি দিয়ে এটি বাস্তবায়নে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। বাড়িভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে ৫২ শতাংশ শিক্ষার্থীকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করা গেছে। এই ব্যবস্থা না থাকলে হয়তো তারা শিক্ষার আওতায় আসতে পারত না। একীভূত শিক্ষার অগ্রগতির জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় থাকা জরুরি।

গোলাম ফারুক হামিম

টিম লিড, বাংলাদেশ প্রোগ্রাম, এডিডি ইন্টারন্যাশনাল

‘শিখবো সবাই’ প্রকল্পের অন্যতম সফলতা হলো প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও শিশুদের সার্বিকভাবে যুক্ত করা। প্রকল্পের প্রতিটি পর্যায়ে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়েছে, অভিভাবক ও সংগঠনগুলোর সম্পৃক্ততাও ছিল প্রশংসনীয়। শিক্ষা ও সমাজসেবা কর্মকর্তারা মাঠপর্যায়ে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করায় বাস্তবায়ন হয়েছে সুসংগঠিতভাবে।

তবে এখনো অনেক বিদ্যালয়ের ভৌত অবকাঠামো প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীবান্ধব নয়। প্রবেশপথ, ওয়াশ ব্লক, শ্রেণিকক্ষ—সব জায়গায় সুবিধাজনক পরিবেশ গড়ে তোলা জরুরি। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও উপকরণ ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি রয়ে গেছে। যাঁরা প্রতিবন্ধী শিশুদের সঙ্গে কাজ করেন, তাঁদের আরও সংবেদনশীল ও দক্ষ করে তুলতে হবে।

আমাদের ভাবতে হবে, বিদ্যালয়গুলোর রিসোর্স কতটা কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। একজন প্রতিবন্ধী শিশুর সার্বিক উন্নয়নের জন্য ও তার বিশেষ চাহিদাগুলোর ব্যবস্থা করার জন্য ব্যক্তিগত শিক্ষা পরিকল্পনা (আইইপি) করা যেতে পারে। আমাদের পর্যাপ্ত আইন ও নীতিকাঠামো রয়েছে। এগুলোকে কার্যকর করা গেলে আমাদের এ দেশটা অনেক বেশি প্রতিবন্ধীবান্ধব হয়ে উঠত।

নাজমুল বারী

এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর, সেন্টার ফর ডিসঅ্যাবিলিটি ইন ডেভেলপমেন্ট

২০০২ সালে প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার ছিল মাত্র ৪ শতাংশ। ২০২৩ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৪০ দশমিক ৫৫ শতাংশে। তবে একই সময়ে স্বাভাবিক শিশুদের মধ্যে এই হার ৯৮ শতাংশ। ফলে স্পষ্ট বৈষম্য এখনো রয়ে গেছে। বিশেষ করে প্রাথমিকের পর মাধ্যমিকে এ হার কমে দাঁড়ায় মাত্র ২৪ শতাংশে, যা উদ্বেগজনক।

এই ঝরে পড়ার প্রবণতা রোধে সবার জন্য এক পদ্ধতির বাইরে প্রতিবন্ধিতার ধরন ও তীব্রতা অনুযায়ী শিক্ষার পদ্ধতি নির্ধারণ জরুরি। এর একটি কার্যকর উদাহরণ হচ্ছে বাড়িভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম। বহু শিশু আছে, যারা কখনো বিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগই পায় না। তাদের জন্য বাড়িভিত্তিক শিক্ষা একটি কার্যকর বিকল্প। এই কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হওয়া ৫২ শতাংশ শিশু পরে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পেরেছে।

পরিবারের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী শিশুদের বোঝাতে হবে যে তারাও শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। আমাদের দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা করতে হবে। তারা শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে মূলধারায় আসতে পারলে পরিবারের বোঝা হওয়ার পরিবর্তে পরিবারের জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবে। আমাদের চাই বাড়িভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রমকে সরকারিভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হোক।

মো. জয়নাল আবেদীন                         

উপপরিচালক (সমন্বিত শিক্ষা), প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর

শিক্ষা মূলত সামঞ্জস্যপূর্ণ বিকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। কোনো একটি দেশকে ভালোভাবে চলতে হলে শিক্ষাকে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। এ জন্য সব মানুষের অংশগ্রহণ প্রয়োজন। শরীরের একটি পা কাজ না করলে, অন্য পা সে পায়ের ভার নেয়। আমাদেরও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভার ভাগাভাগি করে নিতে হবে।

আমাদের নীতিমালা অনেক আছে। সমস্যা হচ্ছে মালিকানার জায়গায়। জাপানে দেখেছি, সেখানের প্রতিটি নাগরিক মনে করেন, প্রাক্‌-প্রাথমিক শিক্ষাকে জোরদার না করলে ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত না করলে তার জাতীয় আয় ৩৬ ভাগ কমে যাবে এবং তাঁরা বেতন পাবে না। ফলে তাঁরা নিজেদের পুরো সামর্থ্য দিয়ে পূর্ণ উদ্যমের সঙ্গে কাজ করেন।

আমাদেরও এ ধরনের একীভূতমূলক মানসিকতা তৈরি করার পাশাপাশি বিদ্যালয়গুলোকেও একীভূত করতে হবে। এ জন্য প্যারেন্টিং, সমাজ, পরিবেশ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন হতে হবে একীভূত। এর মধ্যে অন্যান্য পিছিয়ে পড়াদেরও নিয়ে আসতে হবে। তাদের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে মূলধারায় নিয়ে আসতে হবে।

রুখসানা পারভীন

সহকারী পরিচালক (সমন্বিত শিক্ষা), প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর

আমাদের কারিকুলামে শ্রেণিকক্ষের ভেতরের শিখন-শেখানো কার্যক্রম অনেকটাই ধরাবাঁধা। সেই কাজ অনেক সময় প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য আনন্দদায়ক হয় না। আমাদের উদ্দেশ্য কেবল শিক্ষার্থী ভর্তি করা নয়। পিইডিপি-২ এ যখন একীভূত শিক্ষার কাজ শুরু হয়, আমরা তখন বলেছি আগে তাদের বিদ্যালয়ে আনতে হবে। এ জায়গায় আমরা অনেকখানি উন্নতি করতে পেরেছি।

বর্তমানে একজন প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী প্রাক্‌–প্রাথমিক থেকে শুরু করে সহজেই প্রাথমিকের গণ্ডি পার হতে পারে ঠিকই, কিন্তু পরবর্তী সময়ে উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত না করা গেলে ওই শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। বিদ্যালয়ের বিভিন্ন উৎসব বিশেষ করে পয়লা বৈশাখ বা বিজয় দিবসের মতো বর্ণিল উৎসবগুলোয় প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা সব শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একসঙ্গে মিলেমিশে যুক্ত হয়। ফলে তখন বিদ্যালয়কে তার অনেক বেশি আপন মনে হয়। এই দিনগুলোয় যেন তারা বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত না থাকে, সে বিষয়ে অভিভাবকদের সচেতন করতে হবে।

মাসুদুল হাসান তাপস

উপপরিচালক, জেলা সমাজসেবা কার্যালয়, নরসিংদী

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় বর্তমানে প্রতিবন্ধীবিষয়ক তথ্য সংগ্রহে  ডিজঅ্যাবিলিটি ডিটেকশন ইনফরমেশন সিস্টেম (ডিআইএস) ব্যবহার করছে। ডিআইএস অনুযায়ী, নরসিংদী জেলায় এখন পর্যন্ত ৬৬ হাজার ৭০৫ জন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি নিবন্ধিত হয়েছে।

৬৪ জেলায় চালু থাকা সমন্বিত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে তারা নিকটবর্তী বিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পড়াশোনা করছে। তবে বাস্তবে তাদের নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। যেমন—স্কুলজীবনে তারা ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়লেও এসএসসি পরীক্ষায় শ্রুতিলেখকের ওপর নির্ভর করতে হয়। এর ফলে ফলাফল ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

প্রতিটি জেলায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন অনুযায়ী জেলা কমিটির উল্লেখ থাকলেও, বাস্তবে তা কার্যকর নয়। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সুবর্ণ নাগরিক পরিচয়পত্র প্রক্রিয়ায় সমাজসেবা ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যুক্ত থাকায় একটি সমন্বিত টাস্কফোর্স গঠন করা গেলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, সমাজসেবা, স্বাস্থ্য ও অভিভাবকদের একসঙ্গে নিয়ে একীভূত শিক্ষাকে আরও কার্যকর করা সম্ভব।

মো. হারুনর রশিদ

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার, সিরাজগঞ্জ

বিশ্বব্যাপী প্রতিবন্ধিতার হার বাড়ছে, তাই এটি শুধু জাতীয় নয়, একটি বৈশ্বিক ইস্যু। উন্নত দেশগুলো তাদের প্রতিবন্ধীদের মেইনস্ট্রিমিং করে উন্নয়ন নিশ্চিত করছে আর আমরা এখনো সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। সাইটসেভার্স বা এডিডির প্রকল্প এলাকাগুলো শতভাগ সফল—এ অভিজ্ঞতা জাতীয় পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে হবে। সরকার অনেক চ্যালেঞ্জে থাকলেও এ উদ্যোগ অবহেলা করা যাবে না।

প্রতিটি বিদ্যালয়ে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য বাজেট বরাদ্দ, নমনীয় পরীক্ষা পদ্ধতি ও হোমবেজড শিক্ষাকে গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষক, সমাজ ও সরকার মিলে কাজ করলে এই শিশুরাও পিছিয়ে থাকবে না। এখনই সময় জাতির জন্য কিছু করার, অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষাকে এগিয়ে নেওয়ার। তাই উদ্যোগকে ধরে রাখতে ও সম্প্রসারণে সক্রিয় ভূমিকা জরুরি।

আজকে যে প্রকল্প নিয়ে আমরা আলোচনা করছি, তা টেকসই করতে হবে। প্রকল্প শেষ হলে যেন তার অবদান হারিয়ে না যায়, সেদিকে নজর দিতে হবে।

নিরঞ্জন কুমার রায়

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার, নরসিংদী

দ্বিতীয় প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি (পিইডিপি-২) থেকে শুরু করে চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচিতেও (পিইডিপি-৪) অ্যাসিসটিভ ডিভাইস নামে একটি কম্পনেন্ট আছে। এতে মূলত চাহিদার ভিত্তিতে তহবিল সরবরাহ করা হয়। পাঁচ হাজার টাকা থেকে শুরু করে পরবর্তী সময় চাহিদার ভিত্তিতে উপজেলাভিত্তিক তহবিল বরাদ্দ দেওয়া হয়। এ তহবিল এখন মোটামুটি পর্যাপ্ত বলা যায়। সবাইকে এটি দেওয়া যায়। পিইডিপি-৪–এ এই জায়গায় আরেকটু বড় পরিসরে কাজ করার জন্য ইতিমধ্যে ওয়ার্কিং পেপার তৈরি করা হয়েছে।

২০১৫ সালে একটি ইফেক্টিভনেস স্টাডির আলোকে বিদ্যালয় পর্যায়ে উন্নয়ন পরিকল্পনার (স্লিপ) গাইডলাইন করা হয়েছিল। সম্প্রতি নতুন ইফেক্টিভনেস স্টাডি প্রায় সম্পন্ন হয়ে গেছে। এখন তা অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। সবার কাছ থেকে প্রস্তাব এসেছে, স্লিপের অর্থ অনুদান শিক্ষার্থীভিত্তিক করার। এটি সত্যিই সময়ের দাবি।

নরসিংদীর চরাঞ্চলের প্রতিবন্ধী শিশুদের কীভাবে বিদ্যালয়ে অন্তর্ভুক্ত করা যায়, সে বিষয়ে আমি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

জন ইকাজু

এডুকেশন ম্যানেজার, ইউনিসেফ বাংলাদেশ

আমরা ইউনিসেফ থেকে শিক্ষাকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছি। শিশুদের কেন্দ্র করেই আমাদের কাজ, বিশেষ করে প্রাথমিক পর্যায়ে। পিইডিপি–৪ প্রকল্পসহ আমরা নীতি-কাঠামোতে কাজ করছি এবং এসইএনডি কর্মপরিকল্পনা তৈরিতে ডিপিইর সঙ্গে কাজ করেছি। ইকিউআইপি কর্মসূচির মাধ্যমে ইতিমধ্যে এক লাখের বেশি শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।

আমরা জানি, প্রত্যেকটি শিশুর কাছে পৌঁছাতে শুধু অংশীদারদের পক্ষে সম্ভব নয়, এটা সরকারের সক্ষমতা ও দায়িত্ব। তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের ক্ষেত্রেও ইউনিসেফ ডিপিইকে সহায়তা করছে, বিশেষ করে বার্ষিক প্রাথমিক বিদ্যালয় শুমারি ও এসএলআইপি কাঠামোতে। বাড়িভিত্তিক শিক্ষার মতো বিষয় পিইডিপি-৫-এ অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ রয়েছে। সরকারের আন্তরিকতা ও অংশগ্রহণ আমাদের আশাবাদী করে তোলে।

আমরা চাই, উন্নয়ন অংশীদারেরা একসঙ্গে কাজ করে একটি সমন্বিত বার্তা দিক, যাতে প্রতিটি শিশুর কাছে পৌঁছানো সম্ভব হয়। এটা একক কোনো মডেল নয়; বরং কার্যকর কৌশলের সমন্বয়।

খোন্দকার সোহেল রানা

কো–অর্ডিনেটর, অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড কমিউনিকেশন, সাইটসেভার্স

নীতিনির্ধারকদের জন্য কিছু সুপারিশ রাখতে চাই।

১. একীভূত শিক্ষায় প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, আমলাতান্ত্রিক বিভাজন মোকাবিলার মাধ্যমে সমাজকল্যাণ, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মধ্যে কার্যকর সহযোগিতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

২. প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের বাড়ি থেকে বিদ্যালয়ে অন্তর্ভুক্ত করার একটি সহজ কাঠামো নীতিসমূহে নিশ্চিত করতে হবে এবং মাধ্যমিক, কারিগরি ও উচ্চশিক্ষা নীতিমালার মাধ্যমে তাদের একীভূত করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।

৩. ইউএনসিআরপিডি অনুচ্ছেদ ২৪-এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রতিবন্ধীবিষয়ক জাতীয় কর্মপরিকল্পনায় একীভূত শিক্ষা বাস্তবায়নে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ দিতে হবে।

৪. প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের তথ্যের ঘাটতি ও ব্যবধান পূরণে নীতিগত সিদ্ধান্ত এবং বাজেট বরাদ্দের মাধ্যমে একটি সক্রিয় ও কেন্দ্রীভূত তথ্য ভান্ডার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

৫. পিইডিপি-৫ পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন ও পর্যবেক্ষণে ওপিডির দক্ষতা ও স্বীকৃতি নিশ্চিত করতে হবে।

লুসি রিভ

প্রোগ্রাম ম্যানেজার, ডিজঅ্যাবিলিটি ইনক্লুশন, সাইটসেভার্স

এবার আমার বাংলাদেশ সফরে সিরাজগঞ্জ ও নরসিংদী জেলার ওপিডি, বাড়িভিত্তিক শিক্ষা, বিদ্যালয়, সরকারি কর্মকর্তা ও কমিউনিটির বিভিন্ন চিন্তাভাবনা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছে। অংশীজনের মধ্যে প্রতিবন্ধিতা–সম্পর্কিত অধিকার ও দায়িত্বশীলতার মাধ্যমে সবার কাজের সমন্বয় ও সহযোগিতার ফলে দৃশ্যমান পরিবর্তন লক্ষ করলাম।

আসলে সরকারের উচিত স্থানীয় পর্যায়ের মানুষের কথা শোনা ও অংশীজনদের সম্পৃক্ত করার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা। আমার পরামর্শ হলো, পিইডিপি–৫-এ স্থানীয় ওপিডিগুলোকে সম্পৃক্ত করা দরকার, তারা প্রতিবন্ধী শিশুদের ঘিরে সব কার্যক্রম পরিচালনায় সহায়তা করতে পারে। ডিআইডি প্রকল্পটি মাত্র তিন বছরে কিছু বাস্তব অগ্রগতি অর্জন করেছে, কিন্তু এই নীতিগুলোর মূল অংশীজনদের নিয়ে বৃহত্তর পরিসরে বাস্তবায়নের অনেক পথ বাকি।

খন্দকার জহুরুল আলম

কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ, আইসিইভিআই ও এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর, সিএসআইডি

২০০১ সালে ঢাকায় আয়োজিত একটি কনফারেন্সে একীভূত শিক্ষা নিয়ে বিভিন্ন মতামত উঠে আসে, কিন্তু তখনো এ ধারণা পরিষ্কার ছিল না। ২০০২ সালে পিইডিপি-২–এর সময় একটি গবেষণার মাধ্যমে বিষয়টি স্পষ্ট হয়—একীভূত শিক্ষা মানে, প্রতিবন্ধী শিশুরা নিজেদের বাড়ির পাশের স্কুলেই পড়বে। তখন থেকেই স্কুলে প্রবেশগম্যতা, শিক্ষক উপস্থিতি ও যোগাযোগ সক্ষমতা—এসব বিষয়ের গুরুত্ব সামনে আসে।

প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের শিক্ষার বিষয়টি সমাজসেবা অধিদপ্তরের নাকি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের, সে বিরোধের নিষ্পত্তি প্রয়োজন। প্রতিবন্ধিতার মাত্রাভেদে শিক্ষার সুযোগ নির্ধারণ না করে সবার জন্য সুযোগ নিশ্চিত করা জরুরি। প্রাথমিক স্তরে কর্মরত প্রতিবন্ধী শিক্ষকদের প্রমোশন ও রিসোর্স পারসন হিসেবে কাজে লাগানো উচিত। এ ছাড়া সরকার ও এনজিওগুলোর মধ্যে সমন্বয় হলে নীতি বাস্তবায়ন সহজ হবে।

মো. সাইদুল হক

এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর, ব্লাইন্ড এডুকেশন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন

অবশেষে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ব্রেইল নির্দেশিকা সরকার অনুমোদন করেছে। এটি কোনো আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়; বরং এটি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য শিক্ষায় সমতা আনার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। বর্তমানে বিভিন্ন কোড ব্যবহারে বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে, যা নিরসনে ব্রেইল নির্দেশিকা প্রণয়ন করা হয়েছে। বাংলা, ইংরেজি, গণিত,আরবি—সব ভাষার জন্য একক কোড নির্ধারণই এই নির্দেশিকার মূল লক্ষ্য। এটি বর্তমানে ছাপানোর কাজ চলছে।

একীভূত ও বিশেষ শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে পিটিআই ও বিএড পর্যায়ে প্রতিবন্ধী শিক্ষাকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি দক্ষ শিক্ষক গড়ে তুলতে যথাযথ প্রশিক্ষণ, ব্রেইল যন্ত্রপাতি ও বিজ্ঞানশিক্ষার উপকরণ তৈরিতে সরকারের সক্রিয়তা প্রয়োজন। আইনে যেসব কমিটির কথা বলা হয়েছে, তার অধিকাংশই কার্যকর নেই। প্রতিবন্ধী মানুষের সত্যিকারের উন্নয়ন চাইলে তাদের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় করতে হবে ও প্রতিবন্ধী মানুষের নেতৃত্বকে স্বীকৃতি দিতে হবে।

ওয়াদুদ হাসান

সিএসটি মেম্বার, স্পন্দন

আমি ২০২২ সালে স্পন্দন প্রতিবন্ধী উন্নয়ন সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হই। তখন জরিপের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী শিশুদের শনাক্ত করে তাদের শিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত করার কাজ শুরু করি। প্রথম দিকে অনেক পরিবার আমাদের বিশ্বাস করেনি। তবে আমাদের ধারাবাহিক কাজ তাদের ভুল ভাঙাতে সক্ষম হয়।

আমরা বাড়িভিত্তিক শিক্ষা দিই, উপকরণ ও প্রশিক্ষণ সরবরাহ করি এবং শিশুদের প্রাথমিক প্রস্তুতি, যেমন পরিচ্ছন্নতা, পোশাক সচেতনতা শিখাই। স্থানীয় সংগঠন যেমন পাপড়ি, সিডিডির সঙ্গে কাজ করি। আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে, শিশুকে প্রস্তুত করে বিদ্যালয়ে পাঠালে সে ঝরে পড়ে না। তবে সমস্যা আছে, বিদ্যালয়গুলো এখনো প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীবান্ধব নয়। আমার এলাকার ১৩৮টি বিদ্যালয়ের ৬৬টি ঘুরে দেখেছি। সেগুলো মধ্যে বেশ কটির শৌচাগার, শ্রেণিকক্ষ, খেলার মাঠ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের উপযোগী নয়। তাই প্রশ্ন থেকে যায়, এ পরিবর্তনের সূচনা কবে হবে?

আল আমিন শেখ

সভাপতি, আলোর প্রদীপ প্রতিবন্ধী অধিকার সংস্থা, সিরাজগঞ্জ

আমরা কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, কোনো পরিবারে যদি প্রতিবন্ধী সন্তান থাকে, তাকে পিছিয়ে রাখা হয়। অনেক সময় মা–বাবা প্রতিবন্ধী সন্তানকে ঘরের বাইরে বের করতে চান না।

আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, বিদ্যালয়, বাক্‌প্রতিবন্ধী, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ভর্তি করাতে চান না। কারণ, অন্যদের তুলনায় এ ধরনের প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের পাঠদান করানো বা সামগ্রিক কার্যক্রম পরিচালনা করা একটু জটিল। তারপরও আমরা অভিভাবকদের সচেতন করে, শিক্ষা কর্মকর্তাদের সঙ্গে অ্যাডভোকেসি করে কাজ করে যাচ্ছি। শিক্ষা অধিদপ্তরে অবশ্যই প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ পরিকল্পনা ও বরাদ্দ রাখতে হবে। শিক্ষা অর্জন করলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি কারও বোঝা হয়ে থাকবে না, সে নিজের কর্মসংস্থান করতে পারবে। আমি স্বপ্ন দেখি, একদিন এ দেশের সব প্রতিবন্ধী শিশু শিক্ষা লাভের সুযোগ পাবে।

এ ছাড়া গোলটেবিল বৈঠকে আরো অংশগ্রহণ করেন: জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের (সিরাজগঞ্জ) উপ পরিচালক মো. হাবিবুর রহমান, সহকারী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (সিরাজগঞ্জ) বিশ্বজিৎ কুমার সাহা, উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা (তাড়াশ সিরাজগঞ্জ) আপেল মাহমুদ, উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (নরসিংদী) নূর মো. রুহুল সগীর, বোয়ালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের (তাড়াশ সিরাজগঞ্জ) প্রধান শিক্ষক শীলা রানী দাস। ফারুক আজিজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (নরসিংদী সদর) প্রধান শিক্ষক জয়শ্রী সাহা, চর হাজীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের (নরসিংদী সদর) পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থী সাহিদা আক্তার স্বর্ণা। আনন্দী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের (নরসিংদী সদর) দ্বিতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী অর্পণ চন্দ্র দাস। এডিডি ইন্টারন্যাশনালের প্রজেক্ট কো অর্ডিনেটর লিটন বারুরী, সেন্স ইন্টারন্যাশনালের প্রতিনিধি সিডিডির ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার সাজ্জাদ কবির। সাইটসেভার্সের ডিআইডি প্রোগ্রামের এমইএল ম্যানেজার এমোস কিবেট, কনসোর্টিয়াম প্রজেক্ট অ্যান্ড এমইএল ম্যানেজার মৃণাল কান্তি দাস, ডিআইডি ইনক্লুসিভ এডুকেশনের টেকনিক্যাল এক্সপার্ট এওয়ানা মার্জিয়া, সেন্টার ফর ডিজঅ্যাবিলিটি ইন ডেভেলপমেন্ট–সিডিডির সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর জাহাঙ্গীর আলম। গণ উন্নয়ন সংস্থার প্রকল্প ব্যবস্থাপক শামসুজ্জোহা মো. সরওয়ার হাবিবুল্লাহ, রাইটস অ্যান্ড এমপাওয়ারমেন্ট অরগানাইজেশন অফ পারসন উইথ ডিজঅ্যাবিলিটিস– আরইপিডির (তাড়াশ, সিরাজগঞ্জ) প্রেসিডেন্ট মোতাহার হোসেন, সমন্বয় প্রতিবন্ধী অধিকার সংস্থার (তাড়াশ, সিরাজগঞ্জ) প্রেসিডেন্ট আব্বাস উদ্দিন, সফল প্রতিবন্ধী অধিকার সংস্থার (সিরাজগঞ্জ) প্রেসিডেন্ট শম্পা খাতুন।  সঞ্চালনা: ফিরোজ চৌধুরী, সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো