পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) পরিচালিত বাংলাদেশ পলিসি অ্যাডভোকেসি ইনিশিয়েটিভ প্রকল্প ও প্রথম আলোর আয়োজনে ‘ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস: অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় এর সম্ভাবনা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ২৫ জানুয়ারি ২০২৩। এ আলোচনার বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে ছাপা হলো।

শামসুল আলম
প্রতিমন্ত্রী, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়
আহসান এইচ মনসুর
নির্বাহী পরিচালক, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)
দেবদুলাল রায়
নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক
মোস্তফা কে মুজেরী
নির্বাহী পরিচালক, ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট
খন্দকার সাখাওয়াত আলী
ইমেরিটাস ফেলো, উন্নয়ন সমন্বয়, ভিজিটিং ফেলো, বিআইজিডি, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
আবিদুর রহমান সিকদার
উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, ডাচ্–বাংলা ব্যাংক লি.
মোহাম্মদ আমিনুল হক
নির্বাহী পরিচালক, নগদ লি.
মাহফুজ সাদিক
চিফ কমিউনিকেশন অফিসার, বিকাশ
মঞ্জুর-ই খোদা তরফদার
ট্রেজারার, ক্যাব
নাহিদ শারমীন
জেন্ডার স্পেশালিস্ট, এটুআই (অ্যাসপায়ার টু ননোভেট)
বজলুল হক খন্দকার
পরিচালক, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)
সৈয়দ ইউসুফ সাদাত
রিসার্চ ফেলো সিপিডি
তাহমীনা খান
প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, শৈলী
সূচনা বক্তব্য
আব্দুল কাইয়ুম
সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো
সঞ্চালনা
ফিরোজ চৌধুরী
সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো
■ সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ডিজিটাল পেমেন্টের সমস্যার সমাধান যেমন জরুরি, তেমনি এর পরিধি আরও বাড়ানো প্রয়োজন।
■ সাইবার সিকিউরিটি, গ্রাহকের তথ্য ও আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
■ ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের ক্ষেত্রে তদারকিব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করতে হবে।
■ পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে আমাদের ইন্টারনেট সেবার ব্যয় অনেক বেশি। এটা কমাতে হবে।
■ মোবাইল অপারেটরদের ক্যাশআউট চার্জ কমানোর বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে।
■ ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সেবায় নারীর অংশগ্রহণ ও নারী এজেন্টের সংখ্যা বাড়াতে হবে।
■ কেন্দ্রীয়ভাবে গ্রাহকদের সিআইবি প্রতিবেদন সংরক্ষণের উদ্যোগ জরুরি।
■ গ্রাহকের জন্য ডিজিটাল লোন ও অন্যান্য সেবা গ্রহণ সহজ করতে হবে।
আব্দুল কাইয়ুম
বর্তমান বাস্তবতায় আজকের আলোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ডিজিটাল লেনদেনের কথা বলা হয়েছে। তাহলে তাঁরা কিছুটা উপকৃত হতে পারবেন। এখন ডিজিটাল সেবা মানুষের দোরগোড়ায়।
ডিজিটাল পদ্ধতিতে ছোট-বড় ব্যবসা সহজে আর্থিক লেনদেন করতে পারছে। এখন ব্যাংকিং সিস্টেম বড় হয়েছে। গ্রাম এলাকায় এজেন্ট ব্যাংকিং গেছে। এ জন্য গ্রামের সাধারণ নারী-পুরুষ সবাই সহজে আর্থিক সেবা নিতে পারছেন। আজকের এ অনুষ্ঠানে এসব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে।
দেবদুলাল রায়
আর্থিক অন্তর্ভুক্তির বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করব। আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বলতে ব্যক্তি, পরিবার ও ব্যবসায়িক পর্যায়ে আর্থিক সেবা বোঝায়। খুব কম খরচে এই সেবা দিতে হবে। মানসম্পন্ন সেবা দিতে হবে। যেন কোনো ধরনের ঝুঁকি সৃষ্টি না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখা প্রয়োজন। সঠিক সময়ে দ্রুত সেবা দিতে হবে। এখানে প্রতিটি লেনদেন স্বচ্ছ হবে। সঠিক পরিশোধ ব্যবস্থা থাকতে হবে। বিশ্বব্যাংক থেকে বলা হচ্ছে, প্রতিটি লেনদেন যেন টেকসই ও দায়িত্বশীল হয়।
গ্রামের অর্থনীতিতে যেসব সাধারণ মানুষ অবদান রাখছেন, তাঁদের সেবা দিতে হবে। যাঁরা সেবা গ্রহণের সুযোগের আওতার বাইরে আছেন, তাঁদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে আনতে হবে। ক্রেডিট, সঞ্চয়, ইনস্যুরেন্স পরিশোধসহ সব ধরনের সেবার সুযোগ থাকতে হবে। ইনস্যুরেন্সকে এখন পর্যন্ত জনপ্রিয় করা যায়নি। তবে ২০১৫ সাল থেকে এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি হচ্ছে। আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ভালো হলে গ্রাহকেরা ঋণ গ্রহণসহ সব ক্ষেত্রে ভালো আর্থিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।
আমাদের এখানে অনেকেই এমএফএস (মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস) ও ডিএফএস (ডিজিটাল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস) সেবা দিচ্ছেন। আর্থিক অবকাঠামো প্রতিনিয়ত ভালো করতে হয়। এর থেকে আরও ভালো করা সম্ভব। ভালোর শেষ নেই। আমরা তদারকি ব্যবস্থা পরিবর্তন করে আরও ভালো করার চেষ্টা করছি।
বিভিন্ন খাতের ফি চার্জ, ঋণসহ বিভিন্ন অভিযোগ ও প্রয়োজনকে সমন্বয় করে একটা কমন প্ল্যাটফর্মে আনার চেষ্টা করি। ডিএফএসের প্রয়োগ ভালো হলে ব্যক্তি ও পরিবার পর্যায়ে আয় বৃদ্ধি পাবে। প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও পরিশোধ পদ্ধতি সহজ হয়। তহবিল ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ভালো হয়। আমাদের ইনকাম ও সঞ্চয় বাড়বে।
বাংলাদেশ, ভারত, চীন, নেপালের আর্থিক বাজার একই রকম নয়। তারা আমাদের থেকে ভালো করছে। আমাদের আরও কোথায় ভালো করা দরকার, সেটা জেনে উদ্যোগ নিতে হবে। ভোক্তাদের সুরক্ষা দেওয়ার বিভিন্ন আইন ও সেবা আছে। অবকাঠামো তৈরিতে এমএফএস, ডিএফএস ছাড়াও বিভিন্ন এজেন্টেরও ভূমিকা রয়েছে। তবে অবকাঠামোর বেশ উন্নয়ন হয়েছে। কল ড্রপসহ ইন্টারনেট সেবার কিছু সমস্যা আছে, তবে ঠিক হয়ে যাবে।
আমাদের শহর ও গ্রামে এটিএম বুথের পার্থক্য অনেক বেশি। শহরে অনেক বেশি বুথ কিন্তু গ্রামে কম। একটা উপজেলায় চার থেকে পাঁচ লাখ মানুষ বাস করে। সেখানে চার বা পাঁচটি এটিএম বুথ আছে। তা–ও দু–তিনটি ব্যাংক এ উদ্যোগ নিয়েছে। জেলা পর্যায় বা ঢাকা-চট্টগ্রামে এটিএম বুথের পরিমাণ অনেক বেশি। উপজেলায় এখন বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিমাণ বাড়ছে। আমাদের এখানে ব্যাংক, বিমা কোম্পানি, পোস্ট অফিসসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ধরনের আর্থিক সেবা দিচ্ছে। এদের সঙ্গে সমন্বয় করে এমএফএস ও ডিএফএস আরও কিছু সেবা দিতে পারে।
ব্যাংকের ব্রাঞ্চের সংখ্যা এখন প্রায় ১১ হাজার। খুব বেশি যে বেড়েছে গত পাঁচ বছরে, তা নয়। ডিপোজিট ও লোন অ্যাকাউন্ট বেড়েছে। এমএফএস সেবা গত পাঁচ বছরে দ্বিগুণ হয়েছে। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের সংখ্যা অনেক বেড়েছে।
আমরা বাংলা কিউআর কোড ব্যবহারের উদ্যোগ নিয়েছি। তাহলে গ্রাহকদের আর পজ ব্যবহার করতে হবে না। ফলে তাঁদের খরচ কমবে। ক্যাশ রিসাইকেল মেশিনের (সিআরএম) পরিমাণ অনেক বাড়ছে। অনেকে এখন বুথে না দাঁড়িয়ে সিআরএম মেশিনে টাকা জমা দিচ্ছেন।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় ডিজিটাল আর্থিক সেবা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
সৈয়দ ইউসুফ সাদাত
কয়েক বছর ধরেই মানুষ ব্যাপকভাবে মোবাইল আর্থিক সেবা গ্রহণ করছেন। আর্থিক সেবার উন্নয়ন করতে ব্যাংকিং খাতের কয়েক দশক সময় লেগেছে। অনেক উন্নয়নশীল দেশ থেকেও বাংলাদেশে মোবাইল আর্থিক সেবা দারুণভাবে সফল হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এটা হয়েছে।
আমাদের মোবাইল আর্থিক সেবার বাজার এখনো তেমন প্রতিযোগিতামূলক নয়। কারণ, মাত্র কয়েকটা কোম্পানি এটা নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের মধ্যে যেন একটা সমন্বয় থাকে। কেউ বেশি মুনাফা না করে, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।
গ্রাহকের সেবাপ্রাপ্তির বিষয়টিতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। এ জন্য সঠিক তদারকি ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। ডিজিটাল লেনদেনে যাওয়ার আর একটা সুবিধা হলো, সব লেনদেনের ইলেকট্রনিক রেকর্ড থাকে। মোবাইল আর্থিক সেবার সঙ্গে আমাদের আয়কর বিভাগও এগিয়ে যেতে পারে। কারণ, মোবাইল সেবার অনেক তথ্য তারা কাজে লাগাতে পারে। ট্যাক্স শব্দের মধ্যে একটা ভীতি আছে। সেটা যেন না হয়, এটাও বিবেচনা করতে হবে।
ই-কমার্স নিয়ে মানুষের মধ্যে একধরনের বিশ্বাসের সংকট তৈরি হয়েছে। এমন হলে এটা অন্য খাতকেও প্রভাবিত করতে পারে। এখন ব্যাংক টু মোবাইল ও মোবাইল টু ব্যাংক আর্থিক সেবার বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।
তাহমীনা খান
আমার দুটি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে একটা হলো ‘শৈলী’। এটা প্রায় ১৩ বছর চলছে। এখানে কাজ করতে করতে অনেক কিছু শিখেছি। ২০২২ সালে ‘ট্রেনিং কনসালটিং’ নামে আরও একটি প্রতিষ্ঠান করি। এর উদ্দেশ্য হলো দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষদের প্রশিক্ষণ দেওয়া। এটা একদম হাতে–কলমে প্রশিক্ষণ। আমি ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মে কাজ করি, এখানে লেনদেন খুবই কঠিন। এফ-কমার্স, ই-কমার্স, পেপাল এখনো আমাদের জন্য কঠিন ও দুরূহ ব্যাপার। দেশের বাইরে থেকে সবাই পেপাল পেমেন্ট দিতে চান। আমরা তাঁদের নিরুৎসাহিত করি। কারণ, আমাদের দেশে পেপাল সহজ না।
আবার সবার সব ব্যাংকে হিসাব থাকে না, সেটিও একটি সমস্যা। পণ্য সরবরাহ, গ্রহণ ও টাকা পরিশোধ যত সহজ হবে, লেনদেন তত বাড়বে। কক্সবাজারের একেবারে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কিছু মানুষকে প্রশিক্ষণ দিতে গিয়েছিলাম। এটা ছিল গয়না তৈরি ও উদ্যোক্তা হওয়ার প্রশিক্ষণ।
তাঁদের কারও ব্যাংকে হিসাব নেই। বাড়ির পুরুষ সদস্যরা যখনই জানে যে তাঁদের হিসাব আছে, আয় আছে, তখনই তঁারা কোনো টাকা দেন না। প্রতিদিন মালা গেঁথে ২০০ টাকা পান। অত্যন্ত গোপনে তাঁরা এ কাজ করেন।
আমি ইউএনডিপির একটি প্রকল্পে ১৫ দিন তাঁদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলাম। ঢাকায় এসে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলি। এখানে মাত্র চারজন যুক্ত হয়েছেন। কারণ, তাঁদের মোবাইল ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া হয় না। প্রথমে তাঁদের আলোকিত করা দরকার। তারপর স্থানীয় পর্যায়ে তাঁদের ভাষায় তাঁদের উপযোগী করে ডিজিটাল সেবা নেওয়া প্রয়োজন।
মঞ্জুর-ই খোদা তরফদার
ভোক্তাদের জন্যই সেবার সৃষ্টি হয়। ডিজিটাল সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে একজন ভোক্তা কতটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন, সেটা জরুরি। সম্প্রতি ভোক্তাদের জন্য একটা গবেষণা হয়েছে। এ গবেষণায় তাদের অধিকার সুরক্ষার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণভাবে এসেছে। কিন্তু ভোক্তাদের সুরক্ষার জন্য মানবসম্পদসহ যেসব সাপোর্ট দরকার, সেটি নেই। সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানও ভোক্তাদের সুরক্ষা দিতে পারে। ডিজিটাল সেবা গ্রহণে দুই ধরনের প্রান্তিক মানুষ আছে। লেখাপড়া জানা অনেক বয়স্ক মানুষ আছেন, যাঁদের প্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণা নেই। আবার পাড়াশোনা করেননি এমন মানুষও আছে। তাই ভোক্তাদের জন্য এমন একটা ফ্রেমওয়ার্ক দরকার, যেখানে তাঁরা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন।
নাহিদ শারমীন
গ্লোবাল ফিনডেক্স প্রতিবেদনে দেখা যায়, এমএফএসে আগে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল ২৯ শতাংশ। এখন এটা ২০ শতাংশ। নারীদের ব্যাংক হিসাবও কমেছে। মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস ২০ শতাংশ বেড়েছে। এর কারণ হলো সামাজিক নিরাপত্তা খাত ও পোশাককর্মীদের এমএফএস এই অর্থ দেওয়া। নারীদের সচেতন করতে হবে। কিন্তু এটা দ্রুত হবে না। সময় লাগবে। ডিজিটাল লিটারেসি বাড়তে হবে। নারীদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির জন্য বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেই।
আমরা এটুআই থেকে একটা গবেষণা করেছি, সেখানে দেখেছি অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার জন্য কিছু পণ্য আনা হয়। এটা নারীদের উপকার করবে কি না, সেটা ভাবা হয় না।
নারীদের প্রশিক্ষণের দরকার আছে। ওরিয়েন্টেশনের দরকার আছে। সামাজিকভাবে চলাচলে বাধা আছে। এসব বিবেচনা করে কী করা যায়, সেটি ভাবা হয়নি।
আমরা একটা সাথি নেটওয়ার্ক করেছি। তারা আমাদের নারী উদ্যোক্তা। আমরা তাদের এজেন্টশিপ দেওয়ার জন্য এমএফএস প্রতিষ্ঠানকে অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু তারা কেউ রাজি হয়নি। নারীরা হয়তো বেশি লেনদেন দেখাতে পারবে না। এ জন্য তাদের এজেন্টশিপ দেওয়া হয়নি। কিন্তু নারীরা নারীদের কাছ থেকে সেবা নিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। নারীরা কীভাবে আরও বেশি করে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে অংশগ্রহণ করতে পারেন, সে ব্যাপারে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
মাহফুজ সাদিক
কোটি গ্রাহকই আমাদের প্রেরণা। আমাদের শক্তি। তাঁদের জন্যই আজকের এই আলোচনা। প্রধানত কোভিডের সময় মোবাইল আর্থিক সেবার ব্যাপক প্রসার ঘটে। বাংলাদেশে ডিজিটাল আর্থিক সেবার বিকাশ ঘটেছে একদম সাধারণ মানুষের হাত ধরে। আমাদের গাড়িচালক, শ্রমজীবী মানুষ, গৃহকর্মী তাঁরাই এই সেবাটা প্রথম শুরু করেছিলেন।
এখন নানা অ্যাপভিত্তিক সেবা এসেছে। কিন্তু সবাই অ্যাপ ব্যবহার করেন না। তাঁরা এমএফএসকেই সহজ মনে করেন। আমাদের মোবাইল ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েছে। তারপরও আশপাশের দেশ থেকে ইন্টারনেট সেবার ব্যয় অনেক বেশি। গ্রাহকেরা ডেটা খরচ হয়ে যাওয়ার দুশ্চিন্তায় থাকেন।
আমরা ডিজিটাল ন্যানো লোন, সঞ্চয়সহ কিছু সেবা ইতিমধ্যে চালু করেছি। পুরো বিষয়টি নির্ভর করে গ্রাহকের আস্থা ও বিশ্বাসের ওপর। ই-কমার্সের ক্ষেত্রে আমাদের বিশ্বাসের সংকট তৈরি হয়েছিল। সেটি আবার ফিরে আসছে।
গ্রাহক তাঁর অনেক কষ্টে অর্জন করা অর্থ দিচ্ছেন একটা বিশ্বাস করে। মোবাইল আর্থিক সেবার ক্ষেত্রে সারা দেশে যে বিশ্বাসের জায়গাটা তৈরি হয়েছে, সেটি যেন কোনো কারণে নষ্ট না হয়। এ বিষয়কে খুব গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। দেবদুলাল রায়ের উপস্থাপনায় দেখলাম, গ্রাহক সুরক্ষা ১০০–এর মধ্যে মাত্র ৩২, যেখানে অন্যান্য আর্থিক সব সূচক যথেষ্ট ভালো। ভোক্তার আর্থিক সুরক্ষা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ।
আমরা বাংলা কিউআর কোড চালু করেছি। বাংলাদেশের যেকোনো কিউআর কোড আমাদের অ্যাপ রিড করতে পারে। চীন ও ভারতে মুরগি কিনতে গেলেও কিউআর কোড দিয়ে পেমেন্ট করে। আমাদের একদিন ওখানে যেতে হবে।
বিকাশে প্রতিদিন ৩০ হাজার গ্রাহক ফোন করে জানতে চান, তাঁরা কীভাবে পেমেন্ট করবেন। তাঁরা সবাই ডিজিটাল আর্থিক লেনদেন প্রবেশ করেছেন। এটাই বড় আশার জায়গা।
বজলুল হক খন্দকার
সম্প্রতি দক্ষিণ এশিয়ার ওপর আইএমএফ একটা বই প্রকাশ করেছে। এখানে ছিল ডিজিটাল লেনদেনে কীভাবে জেন্ডার ইকুয়ালিটি বাড়ানো যায় এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তি কী হতে পারে। এখানে জি-২০ দেশের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার লেনদেনের পার্থক্য দেখানো হয়েছে। জি-২০ দেশের ডিজিটাল লেনদেন ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ। সেখানে দক্ষিণ এশিয়ার লেনদেন ২০ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার যদি ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ হয়, তাহলে লেবার ফোর্সের বিশাল অংশগ্রহণ বাড়বে। আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়লে জিডিপি বাড়বে এবং একই সঙ্গে দারিদ্র্য বিমোচন হবে।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে সামাজিক সুরক্ষা ভাতার নোটিশ আসছে, কিন্তু ভাতা আসছে না। এর সমাধান জরুরি। ডিজিটাল খাতে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ জানতে পারলে ভালো হতো। শহর ও গ্রামে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির পার্থক্য হওয়া উচিত কি না, সেটি একটি প্রশ্ন। কারণ, ডিভাইস ব্যবহার ও আয়ের ক্ষেত্রে গ্রাম ও শহরের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। আমাদের ইন্টার অপারেবিলিটি কেমন, সেটা জানা দরকার। এটাকে সহজ করা দরকার। কোনো সমস্যা থাকলে এর সমাধান প্রয়োজন।
মোহাম্মদ আমিনুল হক
আমরা চার বছর আগে যাত্রা শুরু করেছি। সারা দেশে মানুষের আর্থিক অন্তর্ভুক্তিই আমাদের লক্ষ্য ছিল। দেশের ৯০ শতাংশ লেনদেন নগদ হচ্ছে। একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকে তাঁর সব পণ্য বিক্রি করে আবার নতুন করে পণ্য আনতে হয়। এখন অর্ধেক পণ্য বিক্রি করে তিনি অর্ডার দিতে পারেন। বাকি অর্ধেক বিক্রি করতে করতে আবার পণ্য চলে আসে। ফলে কখনোই একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকে বসে থাকতে হয় না। এখন দেশের ৭ কোটি ১৪ লাখ গ্রাহক নগদের সঙ্গে আছেন। তবে গত কয়েক মাসে নারীদের অংশগ্রহণ আমাদেরও কমেছে। এর একটা কারণ নারীরা তাঁদের মোবাইল নম্বর কাউকে দিতে চান না। এই নম্বরের মাধ্যমে পরবর্তী সময়ে তাঁদের বিভিন্ন ধরনের হয়রানির আশঙ্কা থাকে।
এ জন্য আমরা নারীদের মোবাইল নম্বরের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি ইউনিক নম্বর দিয়েছি। বাংলাদেশ ব্যাংক এ প্রস্তাব গ্রহণ করেলে নারীরা তাঁদের ইউনিক নম্বর দিয়ে লেনদেন করতে পারবেন।
আমরা গ্রাহকদের ক্যাশআউট চার্জ অনেক কমিয়েছি। আমাদের প্রান্তিক গ্রাহকদের গত চার বছরে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা খরচ কমেছে। ‘পিটুপি’ ব্যয় সম্পূর্ণ ফ্রি করেছি। আমরা একটা অপারেশন রিস্ক ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করেছি। এটা বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিয়েছি। এ জন্য যাঁরা অস্বাভাবিক লেনদেন করবেন, তাঁদের বিষয়ে সতর্ক থাকার সুযোগ হবে।
আমাদের ৭০ লাখ অ্যাপ ব্যবহারকারী আছেন। কেউ যদি তাঁর পণ্য প্রমোট করতে চান কোনো খরচ ছাড়া, আমরা তাঁদের পণ্য ৭০ লাখ অ্যাপ গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেব। আমরা ডিজিটাল লোন দেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছি। কেন্দ্রীয়ভাবে গ্রাহকদের সিআইবি থাকলে সেটা দারুণভাবে সাহায্য করবে।
আবিদুর রহমান সিকদার
গত ১৫ বছরে আর্থিক খাতে নীরব বিপ্লব ঘটেছে। ব্যাংক খাতে অনেক ধরনের সেবা বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সব ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। প্রচলিত ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এটিএম (অটোমেটেড টেলার মেশিন), সিডিএম (ক্যাশ ডিপোজিট মেশিন), সিআরএম (ক্যাশ রিসাইক্লিং মেশিন) এজেন্ট ব্যাংকিং, বিইএফটিএন (বাংলাদেশ ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার নেটওয়ার্ক), এনপিএসবি (ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচ বাংলাদেশ) কিউআর কোড, বিনিময় ইত্যাদি। ১৫ থেকে ২০ বছরে এই পরিবর্তনগুলো এসেছে। এভাবে আমরা ক্যাশবিহীন লেনদেনের জন্য প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছি।
মোবাইল আর্থিক সেবায় আর কিছুদিনের মধ্যে মাসে এক লাখ কোটি লেনদেন হবে। অক্টোবর মাসে বিভিন্ন সার্ভিস চার্জ পরিশোধ হয়েছে ২ হাজার ২৮৩ কোটি টাকা। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কী পরিমাণ ফি ডিজিটালি পরিশোধ হয়, তা আমরা জানি না। অক্টোবরে ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা মার্চেন্ট পেমেন্ট হয়েছে।
যেসব প্রতিষ্ঠান আজ ডিজিটাল লেনদেনের অবকাঠামো সৃষ্টি করেছে, তাদের অবশ্যই ধন্যবাদ দিতে হবে। সরকারি ভাতা, সামাজিক সুরক্ষা খাতের লেনদেন ডিজিটালি হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী কোভিডের সময় ২ হাজার ৫০০ টাকা করে ৫০ লাখ পরিবারকে ভাতা প্রদান করলেন।
মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আমরা তাদের হিসাব খুলেছি। তিন সপ্তাহের মধ্যে ৪০ লাখ পোশাককর্মীর হিসাব খুলেছি। ডিজিটাল লেনদেনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো যেন প্রতিযোগিতামূলক হয়। সবাই যেন সমান সুযোগ পায়। কর্তৃপক্ষের কাছে আমি এই আবেদন জানিয়ে শেষ করছি।
মোস্তফা কে মুজেরী
ডিজিটাল আর্থিক সেবায় আমাদের আরও অনেক দূর যেতে হবে। ২০২১ সালে বাংলাদেশ আর্থিক কৌশল গ্রহণ করেছে। ২০২৬ সালের মধ্যে শতভাগ মানুষকে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির মধ্যে আনতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক এ লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করছে। আমরা যদি এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে চাই, তাহলে এর প্রধান কাজ হবে সবার আর্থিক অন্তর্ভুক্তি।
ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস একটা নতুন প্রযুক্তি। যেকোনো প্রযুক্তির কিছু কালচার থাকে। সাধারণত প্রযুক্তি শহরভিত্তিক হয়। দরিদ্রদের এ কালচারে প্রবেশ করতে সমস্যা হয়। ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের ক্ষেত্রেও দুর্বলতা আছে। যেমন এখনো শহর ও গ্রামের পার্থক্য আছে। ধনী–দরিদ্রদের পার্থক্য আছে। আবার জেন্ডার বৈষম্যও থাকছে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় আছে কাউকে পেছনে ফেলে রাখা যাবে না। সেখানে একটি বিশাল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে। তাদের সেবার জন্য বিশেষ পরিকল্পনা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে তাদের এন্ট্রি পয়েন্ট ভিন্ন হতে পারে। তাদের উপযোগী প্রোডাক্ট হতে হবে। ডেলিভারি চ্যানেলগুলোও তাদের মতো হতে হবে। এ চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে না পারলে আমাদের অনেক অর্জন ফলপ্রসূ হবে না।
খন্দকার সাখাওয়াত আলী
ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের জন্য আমাদের অর্থনৈতিক কী অগ্রগতি হয়েছে, এর একটা নিরপেক্ষ সামগ্রিক চিত্র থাকা দরকার। বিসিজির ২০২১ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি পথে হাঁটছে। নানামুখী সম্ভাবনার সঙ্গে বহু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। এ চ্যালেঞ্জগুলো কী এবং এর সম্ভাব্য সমাধান কী, সেটা নিয়ে আরও আলোচনা প্রয়োজন। এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে আর্থিক সুশাসনের বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর্থিক খাতের সুশাসনের দুর্বলতা আমাদের সব অর্জনকে ম্লান করে দিতে পারে। দেশের সব অর্জনের পেছনে সাধারণ মানুষের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। গ্রামের সাধারণ মানুষ এই সাফল্যের অংশীদার। ব্যক্তি খাত এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বিদেশি বিনিয়োগ বাড়তি শক্তি জুগিয়েছে। তাই বাজারের ওপর হস্তক্ষেপ কখনোই ভালো লক্ষণ নয়। বাজারে প্রতিযোগিতা ও গ্রাহক যেন তাঁর সেবা গ্রহণের স্বাধীনতা পান, তা নিশ্চিত করতে হবে। ডিজিটাল অবকাঠামোর একটি অসাধারণ ভিত্তি সরকার ইতিমধ্যে তৈরি করেছে। এই অবকাঠামোর ওপর ভিত্তি করে ভবিষ্যৎ ডিজিটাল অর্থনীতি নির্মাণের লক্ষ্যে সাড়ে চার হাজার টাকার মধ্যে অ্যান্ড্রয়েড ফোন পাওয়া গেলে আরও ব্যাপক আর্থিক অন্তর্ভুক্তি সম্ভব হবে।
দেশের ব্যাংকগুলোকেও ডিজিটাল হতে হবে। একসময় ব্যাংকের মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তা জালের নগদ অর্থ প্রদান করা হতো। বিগত ১২ বছরে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ বেড়েছে। বর্তমানে সামাজিক সুরক্ষা খাতের নগদ অর্থ এমএফএসের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সেবার মান বাড়েনি, নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েই গেছে। প্রাথমিক শিক্ষার উপবৃত্তির ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের স্পষ্ট দিকনির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের স্বয়ং প্রতিমন্ত্রী পরিপত্রের নির্দেশনা মানছেন না। ডিজিটালের যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, তা যেন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থে নষ্ট না হয়।
ডিজিটাল পেমেন্টে আমরা সফল। ডিজিটাল বিনিময় এখন ধাপে ধাপে বাড়ছে। ই-কমার্সের জালিয়াতি ও অনিয়ম, আমাদের গড়ে তোলায় আস্থায় চিড় ধরিয়েছে। আমরা সবাইকে যখন ডিজিটাল লেনদেনের দিকে ধাবিত করতে পারব, তখন ক্যাশআউটের প্রয়োজন হবে না। আন্ত–অর্থ সংযোগের ওপর আরও গুরুত্ব দিতে হবে। এই সংযোগ এমএফআই, এমএফএস, এজেন্ট ব্যাংকিং ও ব্যাংকগুলোর মধ্যে গড়ে তুলতে হবে যার মাধ্যমে একটি সামগ্রিক ডিজিটাল ইকোসিস্টেম আমাদের গড়ে উঠবে। একই সঙ্গে আমাদের সাইবার সিকিউরিটির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে এবং প্রযুক্তিগত সেই চ্যালেঞ্জ প্রতিনিয়ত মোকাবিলা করতে হবে। গুরুত্ব দিতে হবে জেন্ডার গ্যাপের দিকে।
আহসান এইচ মনসুর
আমরা এ ধরনের আলোচনা করে থাকি। মোবাইল আর্থিক সেবায় চ্যালেঞ্জ ও পরিবর্তন আসছে। এটা মানুষকে জানানোই এ ধরনের আলোচনার উদ্দেশ্য। তাহলে এ ক্ষেত্রে গুণগত পরিবর্তন আসবে। ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল খাত যেন সঠিকভাবে এগোয়, কোনোভাবে বাধাগ্রস্ত না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখা। আর্থিক বাজারে যেন যথাযথ তদারকি থাকে, সেটাও নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
ব্যাংকিং খাতেও ব্যাংক টু ব্যাংক, ব্যাংক টু নন–ব্যাংকের মধ্যে ডিজিটাল লেনদেন বাড়ছে। আবার এজেন্ট ব্যাংকিংয়েও বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আমার জানামতে, এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে এখন প্রতি মাসে প্রায় ৬৫ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে। আর মোবাইল আর্থিক সেবায় ৯০ হাজার কোটি টাকার বেশি লেনদেন হচ্ছে। হয়তো কিছুদিনের মধে্য এটা এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এখনো ক্যাশইন, ক্যাশআউট বেশি হচ্ছে। ব্যবসায়িক লেনদেনগুলো ডিজিটাল সেবার মধ্যে এলে ডিজিটাল লেনদেনের পরিমাণ অনেক বেড়ে যাবে।
দেব দুলাল রায়ের উপস্থাপনায় দেখা গেছে যে আমরা আর্থিক নিয়ন্ত্রণ ও ভোক্তা অধিকার সুরক্ষায় অনেক পিছিয়ে আছি। এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে নারী-পুরুষের যথেষ্ট পার্থক্য আছে। কী করণে এ পার্থক্য সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। নারীদের বেশি করে এজেন্সিশিপ দিতে হবে। কারণ, নারীরা নারীদের সঙ্গে লেনদেন করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে, তাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বজায় থাকে।
দুর্নীতি হোক বা অন্য কোনো কারণ যা-ই হোক না কেন মানুষ ব্যাংকে বেশি টাকা রাখছে না। এই ইস্যুটা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। এমএফএস, এজেন্ট ব্যাংকিংসহ অর্থিক খাতে অনেক ধরনের সেবা এসেছে। এটা আমাদের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করবে।
শামসুল আলম
২০০৯ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছিল। দেশে অর্থনৈতিক রূপান্তরের ক্ষেত্রে ২০০৯ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশের ধারণা ছিল বড় শক্তি। একে কেন্দ্র করে এযাবৎকাল সরকার অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। প্রত্যেকের আলোচনায় এসেছে আমরা এগিয়েছি। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ভিত্তি হতে হবে ডিজিটাল অবকাঠামো।
বিশ্বব্যাপী ৭০০ বিলিয়ন ডলারের আইটি বাজার রয়েছে। দেশের ৬ লাখ ৫০ হাজার মানুষ আউটসোর্সিংয়ের কাজ করছে। গত অর্থবছরে এরা আয় করেছে প্রায় ৬০০ মিলিয়ন ডলার। ২৮টি হাইটেক পার্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রায় প্রতিটি স্কুলে শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব হয়েছে। ৩ হাজার ইউনিয়নে ৭৯ হাজার কিলোমিটার অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক স্থাপন করা হয়েছে। এ পর্যন্ত দুটি সাবমেরিন কেব্ল স্থাপন করা হয়েছে। ২০১৬-১৭ সাল থেকে বার্ষিক এডিপিতে ৮ শতাংশ আইটি খাতে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে।
২০০৯ সালে আইসিটি পলিসি ঘোষণা করা হয়েছে। ২০১৫ ও ২০১৮ সালে এটা সংশোধন করা হয়েছে। টেলিকমিউনিকেশন অ্যাক্ট হয়েছে। ২০১৮ সালে ই-মেইল পলিসি হয়েছে। ডিজিটাল সিকিউরিটি নীতিমালা প্রণয়ন ও পরিমার্জন করা হয়েছে। দেশে ব্যাপকভাবে মুঠোফোনের ব্যবহার বেড়েছে। দেশের প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন।
২০১১ সাল থেকে দেশে মোবাইল আর্থিক সেবা জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। ২০১৭ সালে ওয়ার্ল্ড ফিনডেক্স তথ্যে দেখা যায়, উন্নয়নশীল দেশের ৫ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ এমএফএসের সেবা গ্রহণ করে। সেখানে বাংলাদেশের ২১ শতাংশেরও বেশি মানুষ এ সুবিধা পায়। কিন্তু এখন এটা অনেক বেশি হয়েছে। নগদের ৭ কোটি ১৪ লাখ গ্রাহক। বিকাশ, রকেটসহ গ্রাহকসংখ্যা অনেক। মনে হয়, প্রায় সব মানুষ কোনো না কোনোভাবে ডিজিটাল আর্থিক সেবার মধ্যে এসেছে। আমার মনে হয়, প্রতি ব্যাংকের বুথ থাকার প্রয়োজন নেই। বিদেশের মতো এক বুথ থেকেই যেন সবাই টাকা তুলতে পারেন।
এজেন্ট ব্যাংকিং ভালো চললে সেখানে ব্রাঞ্চ খুলে দেওয়া অমানবিক। কারণ, যারা এখানে পুঁজি খাটাল, সে বেকার হয়ে গেল। এটা বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করে। সাধারণ মানুষ যেন আরও বেশি করে ডিজিটাল আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে অংশগ্রহণ করতে পারে, সে জন্য সংশ্লিষ্ট সবাই কাজ করবেন বলে আশা করি।
ফিরোজ চৌধুরী
আজকের আলোচনায় যে পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা এসেছে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে বলে আশা করি। প্রথম আলো এবং পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পক্ষ থেকে সবাইকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ।