ওয়াটারএইড বাংলাদেশ, উন্নয়ন সংস্থা ভূমিজ ও প্রথম আলো আয়োজিত ‘নগরের স্যানিটেশন ব্যবস্থার উন্নয়নে স্থানীয় সরকার সংস্কার প্রস্তাব’ গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা। ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪ প্রথম আলো কার্যালয়
ওয়াটারএইড বাংলাদেশ, উন্নয়ন সংস্থা ভূমিজ ও প্রথম আলো আয়োজিত ‘নগরের স্যানিটেশন ব্যবস্থার উন্নয়নে স্থানীয় সরকার সংস্কার প্রস্তাব’ গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা। ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪ প্রথম আলো কার্যালয়

নগরের স্যানিটেশন ব্যবস্থার উন্নয়নে স্থানীয় সরকার সংস্কার প্রস্তাব

প্যানেল আলোচক

ড. তোফায়েল আহমেদ

প্রধান, স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন

হাসিন জাহান

কান্ট্রি ডিরেক্টর, ওয়াটারএইড বাংলাদেশ

মোহাম্মদ ফিদা হাসান

প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন

মোতাকাব্বীর আহমেদ

নির্বাহী পরিচালক, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন

মো. মইনুল ইসলাম

নগর পরিকল্পনাবিদ, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন

ফারহানা রশীদ

প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও, ভূমিজ

এম এ হাকিম

পরিচালক, ওয়াশ, দুস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্র

মীর তানভীর আহমেদ চৌধুরী

ব্যবসাবিষয়ক উপদেষ্টা, এসএনভি বাংলাদেশ

ফজলুর রহমান

উপপ্রধান নির্বাহী, সাজিদা ফাউন্ডেশন

সানিউল আওয়াল

গাবতলী টয়লেট ইজারাদার

পার্থ হেফাজ সেখ

পলিসি অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি পরিচালক, ওয়াটারএইড বাংলাদেশ

সঞ্চালনা

ফিরোজ চৌধুরী

সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনা

ড. তোফায়েল আহমেদ

ড. তোফায়েল আহমেদ

প্রধান, স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন

পাবলিক টয়লেট বা গণশৌচাগার হবে সেবা। অথচ আমরা একে কয়েক স্তরবিশিষ্ট ব্যবসায় রূপ দিয়েছি। স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে নাগরিকবান্ধব করতে হলে গণশৌচাগারকে সেবা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এখানে সমস্যাগুলো সহজ। কিন্তু এ সহজ সমস্যাগুলোকে আমরা এতটা জটিল করেছি যে তার সমাধান জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের সামনে এখন ভালো একটা সুযোগ এসেছে। এ সুযোগ কত দিন থাকবে, তা আমরা জানি না। তাই সমস্যাগুলো ধরে ধরে তা সমাধানে দ্রুত কাজ করা জরুরি।

গণশৌচাগার পরিচালনায় রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন উৎখাত করতে হবে। পাশাপাশি সিটি করপোরেশন, পৌরসভার কোন বিভাগ কীভাবে কাজ করবে, সেটা ঠিক করতে হবে। ময়লা নিয়েও এ রকম ব্যবসা হচ্ছে। এদিকেও নজর দিতে হবে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে নাগরিকদের শিক্ষিত করা। পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যসম্মত গণশৌচাগার সভ্যতার মাপকাঠি। সমাজ সভ্য না হলে এগুলো ঠিক করা কঠিন। আমরা সুযোগ পেলেই যত্রতত্র থুতু ফেলি। একটি শহরের অনেক অংশীজন থাকে। ব্যবসাকেন্দ্র, বাণিজ্য বিতান, শপিং মল, স্কুল-কলেজ, বাস ও রেলস্টেশন, মসজিদ, মন্দির—সবার জন্য সিটি করপোরেশনের একটা নীতি থাকা উচিত। প্রতিটি শপিং মলে পর্যাপ্ত শৌচাগারের ব্যবস্থা করতে হবে। মেয়েরা স্কুলের গণশৌচাগার ব্যবহার করে না। কারণ, স্কুলের গণশৌচাগার অপরিষ্কার ও গন্ধযুক্ত। সুতরাং গণশৌচাগারের পাশাপাশি প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে গণশৌচাগার স্থাপনে জোর দিতে হবে। শপিং মলে এত দোকান, কত মানুষ কাজ করে, তাদের জন্য গণশৌচাগার নেই। এ জায়গায় প্রয়োজনে শক্ত ভূমিকা রাখতে হবে। পাশাপাশি পানির বন্দোবস্তও করতে হবে।

আমরা ভালো কাজ বলতে কেবল মসজিদ, মাদরাসা বা স্কুল-কলেজ নির্মাণকে বুঝি। গণশৌচাগার নির্মাণকে ভালো কাজের উদ্যোগ হিসেবে দেখতে হবে। এটা নিয়ে প্রচার করতে হবে। একে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও ভালো কাজ হিসেবে উপস্থাপন করতে হবে। এতে ব্যবসায়ীসহ অনেকেই গণশৌচাগার নির্মাণে এগিয়ে আসবেন। তাঁদের সত্যিকার অর্থে বোঝানো গেলে জায়গা দেওয়ার পাশাপাশি তাঁরা অবকাঠামো নির্মাণ করে দেবেন।

সব কাজের জন্য সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না। সিটি করপোরেশন ও এনজিও সব কাজ করতে পারবে না। সেবামূলক এসব কাজে স্থানীয় কমিউনিটিকে যুক্ত করতে হবে। উন্নত স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার আবশ্যিক কাজ। তারা এককভাবে এ কাজ করতে পারবে না। তার সঙ্গে কমিউনিটি, এনজিও, সংশ্লিষ্ট সংগঠন, কেন্দ্রীয় সরকারসহ অনেকেরই সংযোগ প্রয়োজন।

হাসিন জাহান

হাসিন জাহান

কান্ট্রি ডিরেক্টর, ওয়াটারএইড বাংলাদেশ

ওয়াটারএইড বাংলাদেশে অনেক দিন ধরে কাজ করলেও গণশৌচাগার–সংক্রান্ত কাজে যুক্ত হয় ২০১১ সালে। ওই সময় জরিপ করে দেখা যায়, ঢাকা শহরে সর্বসাকল্যে গণশৌচাগার ছিল মাত্র ৬৯টি। এর ৯২ শতাংশ ব্যবহার অনুপযোগী, অর্থাৎ ব্যবহারযোগ্য শৌচাগারের সংখ্যা ছিল মাত্র ছয়। আবার এর কোনোটিই নারীবান্ধব নয়। এ ধরনের শোচনীয় পরিস্থিতির একটি বড় কারণ ছিল এর ইজারা ব্যবস্থাপনা। গণশৌচাগার রাজনৈতিক বিবেচনায় ইজারা দেওয়া হতো। পাশাপাশি সিটি করপোরেশন এ গণশৌচাগার ব্যবস্থাপনাকে আয়ের উৎস হিসেবে দেখত। এটি একধরনের সেবা এবং নারীরাও এটি ব্যবহার করতে পারেন—এমন ভাবনা ছিলই না। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে যিনি গণশৌচাগার ইজারা নেন তিনি আবার আরেকজনকে ইজারা দেন। এভাবে বেশ কয়েকবার ইজারার হাত বদল হয়। এভাবে শৌচাগারের মান কমে যাওয়ার কারণে মানুষ সেবা নিতে পারে না।

এমন পরিস্থিতিতে আমরা স্থানীয় সরকার বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করে একটি চুক্তি করি। চুক্তির বিষয়বস্তু ছিল গণশৌচাগার ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করে টেকসই একটা মডেল তৈরি করা। পরে আমাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয় দুস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্র, সাজেদা ফাউন্ডেশন, ভূমিজ ও এসএনভি। পরবর্তী সময়ে উল্লিখিত প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই ঢাকা শহরে উন্নতমানের গণশৌচাগার ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। এ ক্ষেত্রে আমরা গুণগত মানে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পেরেছি, কিন্তু সংখ্যাগত মান খুব একটা বাড়েনি।

আমরা যেসব গণশৌচাগার ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত আছি, সেখানে উন্নতমানের সুবিধা রয়েছে। নারী ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাও সেগুলো ব্যবহার করতে পারেন। নারীরা যাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, সে জন্য নারী তত্ত্বাবধায়ক রাখা হয়েছে। গণশৌচাগার মানেই দুর্গন্ধময় একটা জায়গা, এ ধরনের ধারণা থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পেরেছি। নিরাপদ পানি, বুকের দুধ পান করানোর জায়গা, স্যানিটারি ন্যাপকিনের মতো অনেক সুবিধাই সেখানে আছে।

আমাদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে গণশৌচাগারের অপ্রতুলতা। আমরা যেসব গণশৌচাগার ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে আছি, এর বাইরের গণশৌচাগারগুলো সঠিকভাবে পরিচালনা করা হয় না এবং সেগুলো নারীবান্ধবও নয়। সিটি করপোরেশন গণশৌচাগার ব্যবস্থাপনাকে আয়ের উৎস বলে মনে করে। অথচ শুরুর দিকে আমাদের গণশৌচাগারগুলোয় ৩০ শতাংশ ভর্তুকি দিতে হতো। এর একটি কারণ ছিল সে সময় ঢাকা ওয়াসা আমাদের কাছ থেকে বাণিজ্যিক হারে বিল আদায় করত। পরবর্তী সময়ে নানা প্রচেষ্টার পর আমরা একে গৃহস্থালি পর্যায়ের বিলে নামিয়ে আনতে সমর্থ হয়েছি। আবার কিছুক্ষণ পরপর একে পরিষ্কার করার জন্য বেশ কয়েকজন পরিছন্নতাকর্মী রাখতে হয়। সবকিছু মিলিয়ে এটি খুব লাভজনক ব্যবসা নয়। এ জন্য একে সেবা হিসেবে বিবেচনা করা জরুরি। পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় সিটি করপোরেশন এ প্রক্রিয়ায় না গিয়ে সরাসরি ইজারা দিয়ে দায়মুক্ত হয়। তারা মনে করে গণশৌচাগার ব্যবস্থাপনার জন্য কোনো অভিজ্ঞতার প্রয়োজন নেই। অথচ এতে পেশাদারত্ব অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

সিটি করপোরেশন স্থানের বিবেচনায় ইজারা মূল্য নির্ধারণ করে না। কখনো কখনো তারা আকাশছোঁয়া মূল্য নির্ধারণ করে। সে জন্য অনেক গণশৌচাগার কেউ ইজারা না নেওয়ায় তালাবদ্ধ হয়ে পড়ে থাকে। নগরজুড়ে স্যানিটেশন–বিষয়ক কোনো সমন্বিত মাস্টারপ্ল্যান (মহাপরিকল্পনা) না থাকায় পর্যাপ্ত পরিমাণ গণশৌচাগার নিশ্চিত করা যায়নি। বর্তমান রাজউক ঢাকা নগরীর জন্য একটা মহাপরিকল্পনা করছে। সেখানে যানবাহন ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে সবকিছুই আছে। অথচ তারা এখন পর্যন্ত সিটি করপোরেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। সুতরাং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়ের যে অভাব রয়েছে, তা সমাধান করতে হবে। দেশের জনসংখ্যার ৫১ শতাংশ নারী। সুতরাং নারীদের জন্য নিরাপদ ও ব্যবহারযোগ্য স্যানিটেশনের ব্যবস্থা করতে হবে।

ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ ফিদা হাসান

ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ ফিদা হাসান

প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন

আমাদের সিটি করপোরেশনে নারীবান্ধব পাবলিক টয়লেটের সংখ্যা অপ্রতুল। এ ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রণী ভূমিকা রাখা উচিত ছিল। নারী সমাজের জন্য কিছু না করতে পারায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি। একে আমি নিজের ব্যর্থতা হিসেবেই দেখছি। আমরা এ ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে অগ্রসর হতে চাই। আমরা এ বিষয়ে কাজ করতে সবাইকে আলোচনায় আমন্ত্রণ জানাই।

গণশৌচাগারকে কেবল গরুর হাটের মতো ইজারা দেওয়ার চেয়ে এটাকে সেবা হিসেবে দেখা যেতে পারে। পাশাপাশি সিটি করপোরেশনের কোন বিভাগ এর দেখভাল করবে, তা নির্ধারণ করা জরুরি। সিটি করপোরেশনে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ প্রতিদিন সাড়ে তিন হাজার মেট্রিক টন বর্জ্য এ শহর থেকে অপসারণ করে।

গণশৌচাগারকে গুরুত্ব দিতে হবে। গণশৌচাগার ব্যবহার করা শেখার বিষয়। পাঁচ তারকা হোটেলে গিয়েও দেখেছি, অনেকে ঠিকমতো গণশৌচাগার ব্যবহার করতে জানেন না। শিশুকাল থেকে শিক্ষাব্যবস্থায় এ বিষয়গুলো আসা উচিত। কারণ, এটি পরিবেশের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। কেবল সকাল-বিকেল নয়, নির্দিষ্ট একটা সময় বা নির্দিষ্টসংখ্যক কয়েকজন মানুষ ব্যবহারের পরই গণশৌচাগার পরিষ্কার করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ায় জনবল কাজে লাগানো যেতে পারে।

রাজনৈতিক দখলবাজি, চাঁদাবাজির বিষয়গুলো থাকলে কিছুই করা যাবে না। এখন পরিবর্তনের জন্য দেশে ভালো সময় বিরাজ করছে। সব কিছু না হোক, অন্তত এ জরুরি পরিষেবা নিশ্চিত করতে এখনই এর সঠিক ব্যবস্থাপনায় নজর দেওয়া দরকার। এ বিষয়গুলো আমলে নিয়ে সিটি করপোরেশনের মাস্টারপ্ল্যানে কোন জায়গায় গণশৌচাগার হওয়া প্রয়োজন, সে বিষয়ে অতি দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা দরকার। আমাদের প্রকৌশল বিভাগের অন্তর্ভুক্ত বেশ কয়েকটি মোবাইল টয়লেট রয়েছে। জাতীয় অনুষ্ঠানগুলোয় আমরা বিনা মূল্যে পরিছন্নতাকর্মীসহ মোবাইল টয়লেট সরবরাহ করি।

মোতাকাব্বীর আহমেদ

মোতাকাব্বীর আহমেদ

নির্বাহী পরিচালক, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন

সবার আগে আমাদের নিজেদের বদলাতে হবে। আমরা সব সময় কেবল অন্যের দোষ ধরতে ব্যস্ত থাকি। সব দায়িত্ব সরকারের না, সব দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের নয়। আমাদের নিজেদেরও কিছু দায়িত্ব আছে। গণশৌচাগার ব্যবহারের পর প্রাথমিক পরিচ্ছন্নতার কাজ আমাদের নিজেদেরই করতে হবে। সিটি করপোরেশন বাড়ি বাড়ি গিয়ে গৃহস্থালির ময়লা সংগ্রহ করে না। আমরা ইজারাদারের মাধ্যমে ময়লা রাখার ঘরে (সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন) তা জমা করি ও সেখান থেকে ময়লা সংগ্রহ করি। ইজারাদারের ময়লা সংগ্রাহককে ২০০ টাকা দিতে কেউ আগ্রহী নয়। ফলে সবাই বাড়ি থেকেই ময়লার প্যাকেট নিচে ফেলেন। এতে আশপাশের পরিবেশ নষ্ট হয়, নানা ধরনের রোগজীবাণু সৃষ্টি হয়। সুতরাং আমাদের এ ধরনের মানসিকতা পরিবর্তন করা জরুরি।

২০১৮ সালে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে গণশৌচাগার পরিচালনা নির্দেশিকা প্রণয়ন করা হয়েছে। এখানে পরিচালনা–সংক্রান্ত বিষয়গুলো বিস্তারিত বলা আছে। এখানে নিয়মিত নিরীক্ষা করা হয়। সত্যি কথা বলতে গণশৌচাগার থেকে উপার্জন করার ইচ্ছা সিটি করপোরেশনের কখনো ছিল না, এখনো নেই। আমরা চাই সেবা ও পরিচালনা দুটোই যেন সঠিকভাবে হয়। তহবিলে থাকা অর্থ শৌচাগারের উন্নয়নে ব্যয় করা যায়। বিষয়টি নীতিমালায় বলা আছে। এটি সিটি করপোরেশনে জমা হয় না। দাতা সংস্থাও এটি খরচ করতে পারে।

গণশৌচাগারকে সেবাবান্ধব করতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা লাগবে। এমনো দেখেছি, অনেক মানুষ গণশৌচাগার ব্যবহার করছেন, কিন্তু টাকা জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে মাত্র ২০ বা ৩০ জন ব্যবহারকারী দেখানো হচ্ছে। তাঁরা নিজেরা জালিয়াতির মাধ্যমে আলাদা রশিদও তৈরি করেছেন। এর পেছনে রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী কেউ জড়িত থাকতে পারেন। ভাবতে অবাক লাগে, আমরা গণশৌচাগার নিয়েও ব্যবসা করতে চাই। এখানেও আমাদের কাজ করতে হবে।

ঢাকা শহরে দৃষ্টিনন্দন পার্ক হয়, কিন্তু ইজারার কারণে অনেক সময় পার্কের ফটক বা শৌচাগারের ফটক বন্ধ রাখা হয়। এগুলো উন্মুক্ত থাকা উচিত। এমনকি বিদ্যালয়ের খেলার মাঠপর্যায়ে ইজারা দেওয়া হয়। ইজারাদারেরা ঠিক করেন শিশুরা কখন খেলবে। গণশৌচাগার ব্যবস্থাপনায় আরও তদারকি প্রয়োজন উন্নয়ন সহযোগীদের এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে। এ ছাড়া গণশৌচাগার নির্মাণের ক্ষেত্রে চাহিদা বিবেচনা করে স্থান নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ। গণশৌচাগার ব্যবহারে সচেতনতা সৃষ্টি করতে সড়কে সিটি করপোরেশনের বিজ্ঞাপন মনিটরগুলো ব্যবহার করা যেতে পারে।

মো. মইনুল ইসলাম

মো. মইনুল ইসলাম

নগর–পরিকল্পনাবিদ, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন

প্রতিবছর বাংলাদেশের ৪০ হাজার মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। দেশে বর্তমানে ৩ কোটি ৮০ লাখ কিডনি রোগী রয়েছে, যা মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশের বেশি। এ উপাত্তগুলো উদ্বেগজনক। এর একটি বড় কারণ হলো গণশৌচাগার না থাকা বা অপ্রতুল। বাংলাদেশের যে ১১টি নগরী রয়েছে, সেখানে এ সেবা অপ্রতুল। বাইরে নারীদের জন্য গণশৌচাগার সুবিধা না থাকা বা স্বল্প যে সুবিধা রয়েছে, তা নারীবান্ধব না হওয়ায় তাঁরা এসব গণশৌচাগার ব্যবহার করেন না।

সম্প্রতি আমি গণশৌচাগারের দুজন ইজারাদারের সঙ্গে কথা বলেছি। যদিও তাঁরা প্রকৃত ইজারাদার নন, তিন-চারজনের হাত ঘুরে তাঁদের কাছে দায়িত্ব এসেছে। তাঁরা কেবল বিদ্যুৎ ও পানির বিল পরিশোধ করেন। তাঁরা জানান, প্রতিদিন প্রায় ১ হাজার ৭০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ মানুষ গণশৌচাগার ব্যবহার করেন। এর মধ্যে নারীর সংখ্যা সর্বোচ্চ ৩০ জনের মতো। সুতরাং এটা বোঝা যায় যে নারীরা এখনো গণশৌচাগার ব্যবহারে অভ্যস্ত নন। কারণ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এ গণশৌচাগারগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যকর থাকে নয়। এ জন্য তাঁরা এগুলো ব্যবহারে উৎসাহ বোধ করেন না। পাশাপাশি নিরাপত্তার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

নারায়ণগঞ্জ নগরীতে প্রায় ২০ লাখ মানুষের বসবাস। সেখানে মাত্র ১৩টি গণশৌচাগার আছে। এর মধ্যে কার্যকর আছে ৪টি। বাকি ৯টি ব্যবহার করার মতো পরিস্থিতিতে নেই। ভূমিজের সহায়তা আমরা দুটি গণশৌচাগার পরিচালনা করছি। এ দুটি বেশ ভালোভাবেই চলছে। এর একটি থেকে লাভ ভালোই হয়, অন্যটি থেকে কম হয়। দুটি মিলে মোটামুটি ভালোই চলে। নারায়ণগঞ্জ নগরীতে গণশৌচাগারের সংখ্যা আরও কীভাবে বাড়ানো যায়, সে বিষয়ে আমরা কাজ করছি।

গণশৌচাগার ইজারা দেওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই গণশৌচাগার পরিচালনা এবং রক্ষণাবেক্ষণ নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। স্থানীয় সরকার আইনে স্যানিটেশন বিষয়ে কেবল দুটি ধারা রয়েছে। এতে পর্যাপ্তসংখ্যক গণশৌচাগার ও প্রস্রাবখানার ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে। এখানে স্যানিটেশন–সংক্রান্ত আরও অনেক বিষয় আসা উচিত। এখন স্থানীয় সরকার সংস্কার হচ্ছে। সুতরাং আমাদের সামনে সুযোগ আছে এ বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করার।

স্কুল পর্যায়ে বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে আমরা স্যানিটেশন কার্যক্রম পরিচালনা করি। হাত ধোয়া কর্মসূচির মতো স্যানিটেশন কার্যক্রম পরিচালনা করা জরুরি। আর গণশৌচাগার ইজারার ক্ষেত্রে কোনো প্রতিষ্ঠানকে কেবল অলাভজনকগুলো দিলেই হবে না, লাভজনক ও অলাভজনক একসঙ্গে দিলে পরিচালনা করা সহজ হয়। পাশাপাশি এতে আর্থিকভাবেও কিছুটা সুবিধা পাওয়া যায়, যা এ কার্যক্রম পরিচালনায় উৎসাহ সৃষ্টি করে।

ফারহানা রশীদ

ফারহানা রশীদ

প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও, ভূমিজ লিমিটেড

আমরা সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় সরকার বিভাগের সঙ্গে সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ করে গণশৌচাগার নির্মাণ করেছি, এখনো করছি। সঠিক জায়গা, নকশা ও পরিচালনার পদ্ধতি না থাকা সত্ত্বেও আমাদের কাজটা করতে হচ্ছে। আমরা চাই সরকারিভাবে সঠিক জায়গায় ও সঠিক নকশায় গণশৌচাগার হতে হবে। তাহলে গণশৌচাগারগুলো পরিচালনা করা সুবিধাজনক হবে। পাশাপাশি বেশিসংখ্যক মানুষের কাছে এ সেবা পৌঁছে দেওয়া যাবে।

গণশৌচাগার ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। তাহলে শৌচাগারে নারী না পুরুষ কারা বেশি আসছেন, তা জানা যাবে। পাশাপাশি চুরি প্রতিরোধ করার বিষয়টিও সমাধান করা যাবে। অনেক গণশৌচাগার ৫০ শতাংশ নারীদের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়। কিন্তু দেখা যায়, সেখানে মাসে একজন নারীও আসেন না। সে ক্ষেত্রে এসব গণশৌচাগার পুরুষদের ব্যবহার করতে দেব কি না, সে বিষয়ে প্রযুক্তি আমাদের সাহায্য করতে পারে। কত মানুষ ব্যবহার করছে, কোন শৌচাগারের পরিচ্ছন্নতার মান কেমন—এসব তদারক করা গেলে ঘাটতি ও অনিয়ম মোকাবিলা করা সম্ভব। অনেক সময় পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি বুঝতে পারেন না ভেতরে গন্ধ আছে কি না। সে জায়গায় আমরা সেন্সর নিয়ে কাজ করছি। এই সেন্সরের তথ্য সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষই দেখতে পারবে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে পারবে।

ইজারা নেওয়া শৌচাগারের প্রয়োজনীয় সংস্কার সরকারকেই করতে হবে এবং খুব দ্রুতই তা করতে হবে। এ ছাড়া ইজারা নেওয়ার শর্তগুলোতে গণশৌচাগার পরিচালনার অভিজ্ঞতাকে কোথাও গুরুত্ব দেওয়া হয় না। সুতরাং গণশৌচাগার পরিচালনায় অভিজ্ঞতার মাপকাঠি যুক্ত করা জরুরি৷

এম এ হাকিম

এম এ হাকিম

পরিচালক, ওয়াশ, দুস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্র

৩৫ বছর ধরে দুস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। আমরা ওয়াটারএইডের সঙ্গে ২৮ বছর ধরে যুক্ত আছি। আমরা মূলত ওয়াটার স্যানিটেশন ও হাইজিন নিয়ে কাজ করছি। আমরা বস্তির জনগোষ্ঠীদের নিয়ে কাজ শুরু করেছি, তারপর স্কুলে কাজ করেছি। এখন গণশৌচাগার নিয়ে কাজ করছি। আমাদের প্রচেষ্টা হচ্ছে এ সেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছানো। ওয়াটারএইডের আর্থিক সহায়তায় গণশৌচাগার তৈরি হলেও সিটি করপোরেশন এ জন্য জায়গা প্রদান করেছে। সিটি করপোরেশন এগিয়ে না এলে এটি করা সম্ভব হতো না। গণশৌচাগার ব্যবস্থাপনার মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ। গণশৌচাগার কেবল সাধারণ একটি সেবা নয়, এর ব্যপ্তি অনেক বড়।

আমরা ঢাকায় সাতটি ও চট্টগ্রামে আটটি গণশৌচাগার পরিচালনা করি। ২০১৩ সাল থেকে গাবতলীতে একটা গণশৌচাগার পরিচালনা করি। একটি আদর্শ মান মেনেই আমরা গণশৌচাগারগুলো পরিচালনা করি। আমাদের অভিজ্ঞতা অনুসারে, দু–একটি গণশৌচাগার ব্যতীত এখান থেকে একটা ভালো অর্থ আসে, যা দিয়ে গণশৌচাগারের দেখভাল করা কর্মীদের বেতন দিতে পারছি।

সেবা দিতে চাইলে ইজারাপদ্ধতি কাজ করবে না। এটি ব্যবসার দিকে চলে যায়। স্যানিটেশনের এ সুবিধা সঠিকভাবে প্রদান করতে হলে ইজারাপদ্ধতি পরিবর্তন করতে হবে। একে সেবা পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাই, তাহলে বিকল্প মডেল ব্যবহার করা যেতে পারে। এর পরিবর্তে এনজিও বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় ইতিমধ্যে পরীক্ষা করাছে এমন নতুন কিছু মডেল গণশৌচাগার পরিচালনায় অন্তর্ভুক্ত করা যায় কি না, ভাবতে হবে।

মীর তানভীর আহমেদ চৌধুরী

মীর তানভীর আহমেদ চৌধুরী

ব্যবসাবিষয়ক উপদেষ্টা, এসএনভি বাংলাদেশ

এসএনভি ২০০৬ সালে বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করে। তবে ২০১৪ সাল থেকে আমরা স্যানিটেশন ব্যবস্থাপনায় সহযোদ্ধা হিসেবে কাজ করছি। আমরা শুরুতে খুলনা সিটি করপোরেশন এবং দুটি পৌরসভা নিয়ে কাজ শুরু করি। এখন আমরা চারটি সিটি করপোরেশন ও আটটি পৌরসভার সঙ্গে কাজ করছি। ঢাকা শহরের গণশৌচাগারের চিত্র সম্পর্কে আমরা কিছুটা ধারণা পেয়েছি। ঢাকার বাইরে গণশৌচাগারের পরিস্থিতি আরও খারাপ।

কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে গণশৌচাগার নির্মাণ করা হয়। যদিও ২০১১ সালের পর থেকে উন্নয়ন সহযোগীরা কিছু ক্ষেত্রে সহযোগিতা করছে। কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থায়নে পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনে গণশৌচাগার নির্মিত হয়। এটি পরিচালনার দায়িত্ব পড়ে পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের ওপর। কিন্তু তাদের কাছে হস্তান্তর করার ক্ষেত্রে কোনো গাইডলাইন ও ব্যবস্থাপনা মডেল দেওয়া হয় না। ফলে পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন প্রচলিত পদ্ধতিতেই এ গণশৌচাগারগুলো পরিচালনা করে।

শৌচাগারের স্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের সমস্যা রয়েছে। ধরা যাক, কোনো সিটি করপোরেশনে আটটি গণশৌচাগার নির্মাণ করার বরাদ্দ হয়েছে। সরকার করপোরেশনকে জায়গা দিতে বলে। কিন্তু কোথায় গণশৌচাগার করা হবে, এ নিয়ে সিটি করপোরেশনের কোনো মাস্টারপ্ল্যান নেই। এ বিষয়গুলো না ঠিক করেই তড়িঘড়ি করে কোনোমতে জায়গার ব্যবস্থা করা হয়। সে জায়গায় শৌচাগারের চাহিদা আছে কি না, তা ঠিকমতো যাচাই-বাছাই করা হয় না। গণশৌচাগার কোথায় হবে, সে বিষয়ে প্রতিটি নগরীরই একটি মাস্টারপ্ল্যান থাকা উচিত। সেবামূলক কাজগুলো পরিচালনার জন্য সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার জন্য একটি সঠিক নীতি ও পরিকল্পনা থাকা জরুরি।

ফজলুর রহমান

ফজলুর রহমান

উপপ্রধান নির্বাহী, সাজেদা ফাউন্ডেশন

সাজেদা ফাউন্ডেশন বাংলাদেশে প্রায় ৩৩ বছর ধরে কাজ করছে। আমাদের মূলনীতি হচ্ছে, সুস্বাস্থ্য, আনন্দময় ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন। গণশৌচাগার–সংক্রান্ত কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হতে পেরে আমরা নিজেদের সৌভাগ্যবান মনে করছি। এর মাধ্যমে সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা যাবে, আনন্দময় পরিবেশে মর্যাদা নিয়ে মানুষ গণশৌচাগার ব্যবহার করতে পারবে। আমরা ওয়াটারএইডের সহযোগিতায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১১টি গণশৌচাগার নিয়ে কাজ করি। কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, কার কী ভূমিকা, তা নির্ধারণে অস্পষ্টতা রয়েছে।

গণশৌচাগার শব্দের গণ (পাবলিক) শব্দটির মধ্যে একটা নেতিবাচক ভাব রয়েছে। গণশৌচাগার শব্দটি শুনলেই মনে হয়, এটি একটা নোংরা জায়গা হবে। সুতরাং এর অন্য কোনো নাম দেওয়ার বিষয়টি ভাবা যেতে পারে। অনেকে মনে করেন, গণশৌচাগার হওয়ায় এটি ব্যবহারে কোনো অর্থ দিতে হয় না। আবার দরিদ্র মানুষ যাঁরা পথে থাকেন, তাঁরা জানেন এটি ব্যবহার করলে অর্থ দিতে হয়। তাঁদের সে সামর্থ্য নেই। সুতরাং আমি মনে করি, ইজারা দেওয়ার পরপরই স্থানীয় সরকারের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। ভাসমান মানুষ অর্থাভাবে গণশৌচাগারে যান না, আবার উচ্চ শ্রেণি মনে করেন, এটি একটি নোংরা জায়গা—এ দুই শ্রেণিকে এটি ব্যবহারে আকৃষ্ট করতে হলে করণীয় ঠিক করে প্রচারণা করা প্রয়োজন। মানুষকে আকৃষ্ট করার এ দায়িত্ব সিটি করপোরেশনেরই। গণশৌচাগার ব্যবহারে নারীসহ সব শ্রেণির মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য ক্যাম্পেইন (প্রচারণা) ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নারীদের আগ্রহী করার পাশাপাশি তাঁদের সুরক্ষার বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে।

সানিউল আওয়াল

সানিউল আওয়াল

গাবতলী টয়লেট ইজারাদার

আমি গাবতলী গরুর হাটের কাছাকাছি স্থানে একটি টয়লেট ইজারা নিয়েছি। এই টয়লেট–ব্যবস্থাপনার সঙ্গে আমি জড়িত। এ জায়গায় সব সময় মানুষের ভিড় থাকে না। তাই টয়লেট ব্যবহার করতে বেশি মানুষ আসে না। প্রতিদিন ২০০ জনেরও কম মানুষ এখানে টয়লেট ব্যবহার করতে আসে। তবে কোরবানির ঈদের সময় এখানে অনেক মানুষের ভিড় হয়। তখন টয়লেট ব্যবহার করতেও অনেক মানুষ আসে। তাই ঈদের সময় কিছুটা লাভ হয়। এ ছাড়া অন্য সব সময় আমার লোকসান হয়। সিটি করপোরেশনের কাছে আমার কথা হচ্ছে, টয়লেটগুলো এমন জায়গায় তৈরি করতে হবে যেখানে অনেক মানুষের সমাগম থাকে। তাহলে এগুলো আমরা আরও সুন্দরভাবে পরিচালনা করতে উৎসাহ পাব। কারণ, তখন বেশি মানুষ এর সুবিধা নিতে পারবে।

ভূমিজ কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাই, তারা আমাদের সহযোগিতা করে। কীভাবে টয়লেট ভালো রাখা যায়, সে বিষয়ে আমাদের কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ দেয়। গণশৌচাগার পরিচালনা করার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, মানুষ গণশৌচাগার কীভাবে ব্যবহারের করতে হয়, তা জানেন না। এসব বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে। একবার একটি টয়লেটে ময়লা জমে যায়। আমরা ভেবেছি, হয়তো পাইপ বা অন্য কোনো সমস্যা হয়েছে। পরে দেখি সেখানে একটি পুরো টিস্যু রোল আটকে আছে। এ জন্য মানুষ যেন সচেতন হয়, সে রকম কোনো কাজ করতে হবে। অনেক মানুষ একসঙ্গে অনেকগুলো টিস্যু নিয়ে নেন। এসব টিস্যু আবার কমোডে ফেলেন। এতে পাইপ বন্ধ হয়ে যায়। অতিরিক্ত টিস্যু অপচয়ের কারণে আমার অনেক লোকসানও হয়। পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রেও মানুষ সচেতন নয়। অনেকে পানির কল ছেড়ে রেখে চলে যান। এতে পানিরও অনেক অপচয় হয়। এসব বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে হবে।

পার্থ হেফাজ সেখ

পার্থ হেফাজ সেখ

পলিসি অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি পরিচালক, ওয়াটারএইড বাংলাদেশ

বাংলাদেশে স্যানিটেশন নিয়ে আমরা অনেক কাজ করেছি। স্থানীয় সরকার বিভাগ ও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আমরা কাজ করি। আমরা পাবলিক টয়লেট কন্সট্রাকশন অপারেশন অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট নিয়ে জাতীয় নীতিমালা তৈরিতে স্থানীয় সরকার বিভাগকে সহায়তা করেছি। এটার এখন পর্যালোচনা চলছে।

আমরা বাংলাদেশে বিভিন্ন জায়গায় ৪৮টি গণশৌচাগার করেছি। এর মধ্যে ৩৫ গণশৌচাগার আমাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠান নিয়ে পরিচালনা করছি। এখানকার সম্মিলিত অভিজ্ঞতা নিয়ে জাতীয় নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে। স্যানিটেশন–ব্যবস্থার উন্নয়নে স্থানীয় সরকার সংস্কারের ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখতে হবে।

গণশৌচাগার ইজারা দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা রয়েছে। ইজারা দেওয়ার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ গুণগত মান নিশ্চিত করছে না৷ এ জায়গাগুলোর পরিবর্তন দরকার। ইজারা ব্যবস্থাপনা কীভাবে আরও উন্নত করা যায়, সে বিষয়ে ভাবতে হবে। গণশৌচাগার ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ইজারা দেওয়ার বিষয়টি পরিবর্তন করা দরকার। কারণ, একসঙ্গে সব গণশৌচাগার একটি প্রতিষ্ঠানকে ইজারা না দিলে তা লাভজনক হবে না। গণশৌচাগার পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সিটি করপোরেশনের কারা এ কাজগুলো করবে, তা নির্ধারণ করা জরুরি। তদারকির ব্যবস্থাও থাকা জরুরি। একটা নির্মাণকাজ করাই যায়; কিন্তু কারা এর ব্যবস্থাপনা করবে, তা ঠিক করা জরুরি। বর্তমান পরিস্থিতি বুঝে গণশৌচাগার আরও আধুনিক, নান্দনিক ও উন্নত করা যায়।

স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকে একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা দরকার, যেখানে তারা নাগরিকদের সেবাগুলো নিশ্চিত করবে। এ ক্ষেত্রে গণশৌচাগার, ওয়াশ ও স্যানিটেশনকে সেবাকেন্দ্রিক করে গড়ে তোলার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।

সুপারিশ

  • স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে নাগরিকবান্ধব করতে হলে গণশৌচাগারকে সেবা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।

  • নারীবান্ধব পর্যাপ্ত গণশৌচাগার বৃদ্ধি করতে উদ্যোগ নিতে হবে।

  • গণশৌচাগারকে সেবাবান্ধব করতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন।

  • স্থানীয় সরকার আইনে স্যানিটেশন-সংক্রান্ত স্পষ্ট নির্দেশনা থাকা প্রয়োজন।

  • গণশৌচাগার ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে, তাতে নিরাপত্তার বিষয়টিও সমাধান করা সহজ হবে।

  • গণশৌচাগার কোন কোন স্থানে হবে, সে বিষয়ে প্রতিটি নগরীর একটি মাস্টারপ্ল্যান থাকা উচিত।

  • গণশৌচাগার ইজারা ব্যবস্থাপনা কীভাবে আরও উন্নত করা যায়, সে বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে।