
আমার-আপনার প্রতিনিয়ত প্রশ্বাসের বাতাস যে বিষমুক্ত রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, আমার জলের দূষণ যে আত্মস্থ করছে, আমাদের আবহাওয়ার সামঞ্জস্য যে রাখছে, আমাদের উপকূল যে সুরক্ষিত রাখছে, আমাদের দক্ষিণে-পশ্চিমের জন-আয়ের উৎস্য, আবাসনের ব্যবস্থা যে করে দিচ্ছে—সে হচ্ছে সুন্দরবন।
সরকারি খাতাপত্তরে দেশের আকারের তুলনায় বনভূমি আছে ৯ শতাংশ এলাকায়। এর মধ্যে আবার ৪ শতাংশ বেদখল হয়ে আছে। বন বিভাগ যে ৫ শতাংশ বনভূমি শাসন করছে, এর মধ্যে মাত্র ২ শতাংশ এলাকায় প্রাকৃতিক আদিম বনভূমি আছে।
বাংলাদেশের সুন্দরবনের আয়তন ছয় হাজার ২৭ বর্গকিলোমিটার। এই আয়তনের ৭০ শতাংশই গাছপালায় ঢাকা। দেশের যে ২ শতাংশ আদিম অরণ্যানী রয়েছে, সেটার প্রধান দাবিদার সুন্দরবন।
আমাদের মতো ছোট এলাকার দেশ—যেখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে হাজারের বেশি মানুষ, গৃহপালিত পশু বাস করছে, যে দেশের বিশাল অংশ বিলঝিলে পূর্ণ—এখানে কার্বন নিঃসরণ, মিথেন-সালফারসমৃদ্ধ গ্যাস মাটি থেকে প্রতিনিয়ত বের হয়ে আসছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হরেক রকম মানবসৃষ্ট বায়ুদূষণ।
এসব দূষণ থেকে মুক্তি পেতে আমাদের জোরালো ফুসফুস দরকার। একমাত্র সুন্দরবনই এখনো স্বাস্থ্যকর ফুসফুসের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
বঙ্গোপসাগর পৃথিবীর সবচেয়ে বড় উপসাগর। বঙ্গোপসাগরের উত্তরের ত্রিভুজের শীর্ষবিন্দুতে বাংলাদেশ-সুন্দরবনের অবস্থান। উপমহাদেশের বিশাল কয়েকটি নদী গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা, কর্ণফুলী—নদীগুলোর মোহনায় গড়ে উঠেছে সুন্দরবন। এসব নদী বেয়ে প্রতিনিয়ত পলিমাটি জমা হচ্ছে সুন্দরবনের দক্ষিণের মহীঢালে। ফলে সুন্দরবনের মালঞ্চ নদীর মোহনার ৩০ কিলোমিটার দূরের প্রাকৃতিক গহ্বর অতলস্পর্শ (সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড) এলাকা ছাড়া উত্তর বঙ্গোপসাগরের গভীরতা খুব কম।
প্রতিবছর আন্দামান সাগরে অন্তত সাতটি নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়। এদের মধ্যে পাঁচটিই বাংলাদেশ উপকূল দিয়ে ধেয়ে আসে। এদের মধ্যে গড়ে পাঁচ থেকে সাত বছরে অন্তত একটি সাইক্লোন গুরুতর ঘূর্ণনসমৃদ্ধ (ঘণ্টায় ১৬০ থেকে ২২৫ কিলোমিটার) হয়ে আট থেকে বিশ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসসহ উপকূলে আছড়ে পড়ে।
বাংলাদেশের উপকূলীয় বিভাগগুলোর গড় উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে দেড়-দুই মিটারের বেশি হবে না। প্রবল বাতাস, জলোচ্ছ্বাসের বিরুদ্ধে সুন্দরবনের গাছপালা শক অ্যাবজরভারের কাজ করে। সুন্দরবন না থাকলে খুলনা, বরিশাল নগর পর্যন্ত ধুয়েমুছে যেত। গ্রামগঞ্জ তো ধর্তব্যের মধ্যেই নয়।
সুন্দরবনের বনভূমি গড়ে উঠেছে ৩৩৩ প্রজাতির কাষ্ঠল গাছ, লতা, বীরুৎ, গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ নিয়ে। এদের মধ্যে ৩২ প্রজাতির গাছ খাঁটি ম্যানগ্রোভ। ম্যানগ্রোভের এত বৈচিত্র্য বর্নিও দ্বীপের ম্যানগ্রোভ জঙ্গল ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না।
সুন্দরবনের উদ্ভিদের মধ্যে ম্যানগ্রোভ সহবাসী সুন্দরী, খলশী, বিশ্বব্যাপী বিপন্ন উদ্ভিদ। প্রকৃত ম্যানগ্রোভের মধ্যে মটগরান, গোলপাতা বিপন্নপ্রায়। গরানের ওপর নির্ভরশীল হাজারো বাওয়ালি, মহাজন, মধ্যস্বত্বভোগী। আইন করে ১৯৯০ সাল থেকে সুন্দরীগাছ কাটা বন্ধ করা হয়েছে। কিন্তু আগা মরা সুন্দরী আহরণের নামে আইনিভাবেই সুন্দরী কাটা হয়। আর বেআইনি কাটাকাটির কথা পত্রপত্রিকার নিত্যদিনের খবর।
সাতক্ষীরা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত—পুরো উপকূলীয় অঞ্চলের ঘরবাড়ির ছাউনি দেওয়া হয় গোলপাতা দিয়ে। দেশে ব্যবহূত গোলপাতার ৯৫ শতাংশই আসে সুন্দরবন থেকে।
মাঝবসন্ত থেকে সুন্দরবনের গাছে ফুল ফুটতে থাকে। খলসে, গরান, গেওয়া, চেওরা, পশুর, গর্জন, কালালতা, সিঙ্গুর প্রভৃতি ফুলের গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে বনভূমি। এ গন্ধ বনের বাইরে থেকেও পাওয়া যায়। মৃত্যুমাতাল গন্ধে ঘরে থাকতে পারে না মৌয়ালের দল। মহাজনের কাছে দাদন নিয়ে সাত থেকে ১১ জনের দলে মধুর পারমিট নিতে বন অফিসে উপস্থিত হন মৌয়ালেরা। নৌকা একবার দক্ষিণমুখী করলে ১৫ দিনের আগে উত্তরে আসার নিয়ম নেই।
বাংলাদেশ সুন্দরবনের শুরু বুড়িগোয়ালিনী রেঞ্জে মধু পাওয়া যায়। নলিয়ান রেঞ্জে সামান্য পরিমাণে পাওয়া গেলেও মৌয়ালেরা ওদিকটায় খুব বেশি যান না। তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন বাঘের হাতে মারা পড়েন। বর্তমানে বাংলাদেশে মৌয়ালের সংখ্যা ৪০০-এর বেশি হবে না। ২০ বছর আগেও হাজার দুই মৌয়াল ছিলেন। মহাজনের চাপ, বন বিভাগের খাই, বাঘের উৎপাত—সর্বোপরি ডাকাতের অত্যাচারে অনেক মৌয়াল বাদায় নামেন না।
সুন্দরবন পৃথিবীর আদিম অনাবিষ্কৃত বনভূমিগুলোর মধ্যে অন্যতম। দুর্দমনীয় আকর্ষণ সুন্দরবন—আসল বৈশিষ্ট্য ভয়ংকর সৌন্দর্য। পৃথিবীর আর কোনো ম্যানগ্রোভ বনে বাঘ নেই, সুন্দরবনে আছে। তারা বাংলাদেশের মানুষের মতো অত্যন্ত উৎপাদনশীল। পৃথিবীর ১৪টি বাঘের দেশের মধ্যে বাংলাদেশ- ভারতের সুন্দরবনে সবচেয়ে বেশি বাঘ বাস করে। পৃথিবীতে বন্য অবস্থায় এখন বাঘ আছে আড়াই হাজারের মতো। সম্ভবত সুন্দরবনেই (ভারত-বাংলাদেশ মিলিয়ে) ৫০০ বাঘ আছে। অন্য যেকোনো জঙ্গলের বাঘের চেয়ে এ বনের বাঘ কম চাপের মধ্যে আছে। তবে চাপ দিন দিন বাড়ছে।
সুন্দরবন সরীসৃপ, উভচরের আদর্শ জায়গা। পৃথিবীর কতকগুলো অত্যন্ত বিপদাপন্ন, বিরল সরীসৃপ এখানে দেখা যায়। ইন্দোপ্যাসিফিক খাঁড়ির কুমির—৩৬ প্রজাতির কুমিরের মধ্যে আকারে বড় হয়। একসময় অনেক কুমির দেখা গেলেও বর্তমানে ছোট-বড় মিলিয়ে দেড় শর বেশি কুমির বনে আছে বলে মনে হয় না। চামড়ার জন্য কুমির শিকার, চর এলাকার ডিম দেওয়ার এলাকাগুলো চিংড়ি পোনা ধরার দল নষ্ট করে দেওয়ায় অচিরেই কুমির আর বনে দেখা যাবে না।
শঙ্খচূড় সাপের বিশ্ববিস্তৃতি বেশ বড় এলাকা নিয়ে। ভারতের পশ্চিমঘাট পর্বতমালা থেকে ফিলিপাইন পর্যন্ত এ সাপ ছড়িয়ে। কিন্তু দেখতে চাইলে আপনাকে মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হবে। অথচ বসন্তের শুরুতে পূর্ব সুন্দরবনের কটকা-বটিখালীর খালে ঘুরে বেড়ালে দিন দুইয়ের মধ্যেই শঙ্খচূড়ের সাঁতার দেখতে পাবেন।
সুন্দরবনে ২৭০ প্রজাতির পাখি দেখতে পাওয়া যায়। অধিকাংশ পাখিই মাছ বা পোকাখেকো অথবা শিকারি পাখি। ফল খাওয়া পাখি সংখ্যায় অত্যন্ত কম। দেশের ও আন্তর্জাতিকভাবে বিপন্নপ্রায় মদনটাক পাখিদের দু-চারটিকে বনের নাবালো বড় চরাগুলোয় এখনো মাঝেমধ্যে দেখা যায়। অত্যন্ত বিপন্ন বিরল মাস্কড ফিনফুট, ম্যানগ্রোভ হুইসলার, ম্যানগ্রোভ পিটা, বাকি ফিস আউল, রাডি কিংফিশার, স্পুনবিল স্যান্ডপাইপার, গলিয়াথ হেরন কালেভদ্রে সুন্দরবনে দেখা যায়।
একেবারে হালে (২০০৭ সালে সিডরের পর) সুন্দরবনের দুটি পাখির প্রজাতি চোখের সামনে হারিয়ে যেতে দেখলাম। সাদা পিঠের শকুন আর পলাশের কুড়া।
সাম্প্রতিক সময়ে পর্যটনশিল্প সুন্দরবন পর্যন্ত বিকশিত হয়েছে। পর্যটনের মাধ্যমে অনেকের নতুন আয়ের সংস্থানও হয়েছে। কিন্তু অপরিকল্পিতভাবে যে হারে জাহাজ বনে যাতায়াত করছে, তাতে বন আর বনের আবহাওয়ায় থাকে না। বিশেষ করে সার্ভিস লঞ্চগুলো ধারণক্ষমতার কয়েক গুণ মানুষ বোটে তুলে যাত্রীদের জীবন যেমন বিপদাপন্ন করে তোলে, বনের পরিবেশও তেমনি নষ্ট করে দেয়।
প্রায় ৪০ বছর বনে ঘুরতে ঘুরতে আমি যেন বনের ক্লান্ত শ্বাস শুনতে পাই। দিতে দিতে বন ক্লান্ত হয়ে গেছে। একটা দিনই যদি বাংলায় সুন্দরবন না থাকত, তাহলে বিপর্যয়ের মাত্রা বোঝা যেত। আজও তেমন ঠাট্টা সুন্দরবন আমাদের সঙ্গে করেনি। তবে বন ধ্বংস যেভাবে চলছে, তাতে বনকে কিছুই করতে হবে না, এমনিতেই ঘটে যাবে।
কে সুন্দরবনকে ভোট দিল না দিল অথবা বিশ্ব ঐতিহ্য এলাকা হলো, তাতে সুন্দরবনের ক্ষতিবৃদ্ধি কিছু হয় না।
আমাদের প্রয়োজন প্রতিটি ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সজাগ থাকা।
খসরু চৌধুরী: প্রকৃতিবিদ