সেন্ট লুসিয়ার রডনি বে মেরিনায় সূর্যাস্তের সৌন্দর্য
সেন্ট লুসিয়ার রডনি বে মেরিনায় সূর্যাস্তের সৌন্দর্য

ক্যারিবীয় ডায়েরি

ওয়েস্ট ইন্ডিজের ‘হেলেন’কে নিয়ে যুদ্ধ নেই

ক্যারিবিয়ানের অন্যতম আকর্ষণ ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজের হেলেন’ সেন্ট লুসিয়া। আসল হেলেনের জন্য যুদ্ধে ট্রয় নগরী ধ্বংস হয়েছিল।

২০১৪ সালে এখানে এসে লিখেছিলাম ‘হেলেন অব ওয়েস্ট ইন্ডিজ’। এবার কী লিখব?

এবার সেন্ট লুসিয়া নিয়ে লিখলে মেঘ-বৃষ্টির কথাই আগে লিখতে হয়। এখানে ৮-৯ দিন থেকে আবহাওয়ার এই রূপই তো বেশি দেখলাম। টেস্ট ম্যাচে বৃষ্টিতে ভাসতে ভাসতেই ১০ উইকেটের হারে ভেসে গেল বাংলাদেশ। পরশু থেকেই ‘হেলেন অব ওয়েস্ট ইন্ডিজ’–এ আলোচনা আটলান্টিকে সৃষ্ট সাইক্লোন নিয়ে। স্থানীয় সময় মঙ্গলবার রাত থেকে বুধবার ভোরের মধ্যে সেটির সেন্ট লুসিয়া, মার্টিনেক, ডমিনিকাসহ আরও কয়েকটি দ্বীপের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়ার কথা। জারি হয়েছে জরুরি আবহাওয়া সতর্কবার্তা।

রডনি বের যে গেস্টহাউসে আছি, তার মালকিন সকালেই হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা পাঠালেন যেন রুমে পানি আর খাবারদাবারের ব্যবস্থা রাখি। ঝড়ের ঝাপটায় যদি বিদ্যুৎ চলে যায়, সেই চিন্তা থেকে দুপুরে নিজে এসে দিয়ে গেলেন মোমবাতি। সন্ধ্যার পরই হোটেল-রেস্তোরাঁ-মার্কেট বন্ধ করে দিয়ে সবাই যেন সাইক্লোনের অপেক্ষায় এখন। মঙ্গলবার রাতে যখন এ প্রতিবেদন লিখছি, তখনো বৃষ্টি হচ্ছিল, মাঝেমধ্যে বইছিল দমকা হাওয়া।

ক্যারিবিয়ানরা অবশ্য এতেই অভ্যস্ত। প্রাকৃতিক দুর্যোগে তাঁরা শুধু সাবধানতাই অবলম্বন করেন, খুব একটা ভয়-টয় পান না। ঝড় আসবে আবার চলেও যাবে—এ–ই তো! ঝড়ঝাপটা সহ্য করেও সেন্ট লুসিয়া তাই এখনো সেই ২০১৪ সালের মতোই আছে। একই রকম সুন্দর, মনোমুগ্ধকর। একই রকম সবুজে সাজানো। সেই আগের মতোই মাতাল হাওয়া দোলা দিয়ে যাওয়া নয়নাভিরাম এক দ্বীপ, যার সৌন্দর্য আসলে নতুন করে বর্ণনার কিছু নেই।

রডনি বে শপিং মলের একটি ভারতীয় রেস্তোরাঁয় চুড়ির সমাহার

সেন্ট লুসিয়াকে ‘হেলেন অব ওয়েস্ট ইন্ডিজ’ নাম দিয়েছিলেন ব্রিটিশ এক ইতিহাসবিদ। কারণ, ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে সবচেয়ে ‘সুন্দরী’ দ্বীপের খ্যাতি ছিল এটির। আর সেই ‘সুন্দরী’কে পেতে ১৪ বার যুদ্ধ লেগেছিল ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের মধ্যে, স্পার্টার রানি হেলেনকে নিয়ে যেমন যুদ্ধ বাধিয়েছিল স্পার্টা আর ট্রয়। ‘হেলেন অব ওয়েস্ট ইন্ডিজ’–এর দখল শেষ পর্যন্ত পায় ইংল্যান্ড। এরপর ১৯৭৯ সালে স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ৬১৭ বর্গকিলোমিটারের সেন্ট লুসিয়া। ১ লাখ ৮০ হাজারের কিছু বেশি জনসংখ্যার দ্বীপের এক পাশে উথাল-পাতাল আটলান্টিক মহাসাগর, অন্যদিকে শান্ত ক্যারিবিয়ান সাগর।

ড্যারেন স্যামি ক্রিকেট গ্রাউন্ড, সেন্ট লুসিয়ার আরেক পরিচয়

সমুদ্র আর পাহাড়ঘেরা সেন্ট লুসিয়ার রাজধানী ক্যাস্ট্রিস। তবে জর্জ এফ এল চার্লস বিমানবন্দরে নামার পর আপনাকে ক্যাস্ট্রিস যতটা না টানবে, তার চেয়ে বেশি টানবে ক্যারিবিয়ান সমুদ্রের তীর ঘেঁষে রডনি বে মেরিনা হয়ে গ্রস আইলেটের দিকে চলে যাওয়া সড়কটি। ডান দিকে পাহাড় আর বাঁ দিকে সমুদ্র, রাস্তার দুই ধারে আয়েশের আবাহন নিয়ে দাঁড়িয়ে সৃদুশ্য সব হোটেল আর গেস্টহাউস। আপনি ছুটে চলবেন সম্মোহিতের মতো। প্রকৃতি তার এতটা সৌন্দর্য কী করে ঢেলে দেয় সমুদ্রের বুকে জেগে থাকা এমন ছোট্ট এক ভূখণ্ডেই!

ড্যারেন স্যামি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে পরিচয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের একসময়ের পৃষ্ঠপোষক হোটেল-রিসোর্ট ব্যবসার প্রতিষ্ঠান স্যান্ডালসের কর্মকর্তা সুনীল রামদিনের সঙ্গে। স্যান্ডালসের করপোরেট বক্সে বসে তাঁর কাছেই প্রশ্ন রাখলাম, সেন্ট লুসিয়ার সৌন্দর্যের আসল রহস্য কী? শুনে গর্বের হাসি হাসা সুনীলের কথা, ‘আমিও আসলে জানি না কেন এত সুন্দর, সবাই কেন এত সুন্দর বলে। কোনো কিছুই তো এখানে পরিকল্পিত নয়, তারপরও সুন্দর।’

ক্যারিবিয়ান সমুদ্রে পা ভিজিয়ে সেন্ট লুসিয়া উঠে গেছে পাহাড়ে। এই দেশের মানুষ না হলে সেই পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথে ঘুরে আপনি শুধু চমকেরই দেখা পাবেন। চমক বলতে প্রকৃতি আর আধুনিকতার যুগলবন্দী। পাহাড় থেকে নামবেন, সমতল ভূমি পাবেন, সেটি পেরিয়ে আবার পাহাড়ে উঠে যাবেন। পাহাড়ের গা বেয়ে মসৃণ রাস্তা, ফাঁকফোকরে প্রাসাদের মতো বাড়ি। সেদিন মাঠ থেকে হোটেলে ফেরার পথে পাহাড়চূড়ার সে রকমই এক বাড়ি দেখিয়ে ট্যাক্সিচালক বলছিলেন, ‘ওই বাড়িটা রডনি বের সবচেয়ে বড় শপিং মলের মালিকের, উনি একজন সিরিয়ান।’

পাহাড়ের কোলে চোখ জুড়ানো ড্যারেন স্যামি ক্রিকেট গ্রাউন্ড

পাহাড়ে ওঠানামা করতে করতে দ্বীপের অন্য পাশ দিয়ে নামতে থাকলে নিজেকে একসময় আবিষ্কার করবেন সীমাহীন নীল জলরাশির আরেক তীরে, ওটা আটলান্টিক। আর যদি ইচ্ছা হয় ক্যারিবিয়ান সমুদ্র আর আটলান্টিক—দুটোই একসঙ্গে দেখার, তাহলে উঠতে হবে পিজিয়ন আইল্যান্ডের ফোর্ট রডনির চূড়ায়। সেই চূড়া থেকে দেখা যায়, এক পাশে আটলান্টিক এবং আরেক পাশে ক্যারিবিয়ান সমুদ্র রেখে মাঝ দিয়ে চলে গেছে সড়ক, ১৯৭২ সালে যেটি বানানো হয়েছিল একটি লেগুন খুঁড়তে গিয়ে ওঠানো মাটি ফেলে। সেই লেগুনের নামই এখন রডনি বে, যার আশপাশের পরিবেশ সেন্ট লুসিয়ায় আসা পর্যটকদের চুম্বকের মতো টানে। এখান থেকে ইয়ট বা ছোট বোট ভাড়া করে চলে যাওয়া যায় ক্যারিবিয়ান সমুদ্রের আরও ভেতরে।

তবে দিনটা শুক্রবার হলে ভিন্ন কথা। সেদিন এখানকার পর্যটকদের সব আকর্ষণই থাকে ‘ফ্রাইডে নাইট স্ট্রিট পার্টি’র দিকে। গ্রস আইলেটের ডওফিন স্ট্রিটে প্রতি শুক্রবার সন্ধ্যায় শুরু হয়ে পার্টি চলে মধ্যরাত পর্যন্ত। সন্ধ্যা থেকে রাত যত এগোয়, লাউড স্পিকারে বাজতে থাকা ক্যালিপসো আর র‌্যাগে মিউজিকের ছন্দে দর্শনার্থীদের নাচ-গান ততই জমে ওঠে। স্থানীয় স্ট্রিট ফুডের স্বাদ আর রঙিন পানীয়তে ভেসে কেটে যায় উইকেন্ড নাইট।

সেন্ট লুসিয়ার পর্যটকদের ভ্রমণসূচিতে ফ্রাইডে নাইট স্ট্রিট পার্টি থাকবেই। তবে একসময় স্থানীয় লোকজন এটি শুরু করেছিলেন নিজেদের আড্ডা, গল্প আর চিত্তবিনোদনের জন্য। সারা সপ্তাহ কাজ করে শেষ দিন সন্ধ্যায় একটু ফুর্তি করে ঘুমাতে যাওয়া, এটাই ছিল স্ট্রিট পার্টির শুরুর উদ্দেশ্য। আর এখন এটি শুধু পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রই নয়, এই পার্টির উদ্দেশ্যই হয়ে গেছে পর্যটকদের কাছে টানা। আশপাশের দোকানপাট, বার-রেস্তোঁরাগুলো টিকে আছে সপ্তাহের এই একটা দিনের ব্যবসার ওপর।

বিকেল–সন্ধ্যায় পর্যটকেরা জায়গাটাকে করে তোলেন জমজমাট

পর্যটন ব্যবসা গোটা ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জেরই অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি। ম্যারিয়ট, হিলটন, স্যান্ডালসের মতো বিলাসবহুল হোটেল-রিসোর্টের পাশাপাশি প্রতিটি দ্বীপেই আছে অসংখ্য ছোট-মাঝারি হোটেল আর গেস্টহাউস। অনেকে নিজ বাড়িরও একটা অংশ বরাদ্দ রেখেছেন পর্যটকদের কাছে ভাড়া দিতে। ব্যক্তিগত গাড়িও এসব দ্বীপে দিনের একটা সময় হয়ে যায় ট্যাক্সি। সারা বছরই ‘সামার’ বলে পর্যটক আসার নির্দিষ্ট কোনো মৌসুম নেই ক্যারিবিয়ানে। মানুষ বেড়াতে আসছেন বছরের ১২ মাসই।

সেই আদিকাল থেকে ক্যারিবিয়ানের অন্যতম আকর্ষণ হয়ে আছে ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজের হেলেন’ সেন্ট লুসিয়া। আসল হেলেনের জন্য যুদ্ধে ট্রয় নগরী ধ্বংস হয়েছিল। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ‘হেলেন’–এর জন্য এখন আর কোনো যুদ্ধ নেই। এই ‘হেলেন’ বিলিয়ে দেয় সম্প্রীতির সৌহার্দ্য, যার প্রতি ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবাই তাঁর মোহনীয় রূপেই মুগ্ধ। সৌন্দর্যের বাগান ‘হেলেন অব ওয়েস্ট ইন্ডজ’–এর দুয়ার কারও জন্যই বন্ধ নয়।