কিংবদন্তির মহাপ্রয়াণ

মোহাম্মদ আলী, জন্ম: ১৭ জানুয়ারি, ১৯৪২ মৃত্যু: ৩ জুন, ২০১৬
মোহাম্মদ আলী, জন্ম: ১৭ জানুয়ারি, ১৯৪২  মৃত্যু: ৩ জুন, ২০১৬

মোহাম্মদ আলী আর নেই। বক্সিং রিংয়ে প্রজাপতিনৃত্য, মৌমাছির হুল ফোটানো ক্ষিপ্রতা, যুদ্ধ ও আগ্রাসনবিরোধী মানবতাবাদ, প্রতিপক্ষকে কথার তিরে বিদ্ধ করা বাকপটুতা, বক্সিংয়ের বুনো আদিমতাকে শিল্পে রূপ দেওয়ার ক্ষমতাকে অ্যারিজোনার ফিনিক্স এরিয়া হাসপাতালে চিরতরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে চলে গেলেন পরশু (যুক্তরাষ্ট্রের সময় ৩ জুন রাতে)। জন্মস্থান কেন্টাকির লুইসভিলে আগামী শুক্রবার তিনি সমাহিত হবেন, তবে পেছনে রেখে যাবেন ১৯৭১ সালের ‘শতাব্দীসেরা লড়াই’, ১৯৭৪ সালের ‘রাম্বল ইন দ্য জাঙ্গল’ ১৯৭৫-এর ‘থ্রিলা ইন ম্যানিলা’র মতো দুনিয়া কাঁপানো অজস্র গল্প।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বেশ কয়েকবারই হাসপাতালে যেতে হয়েছে এই মহান মার্কিন বক্সারকে। গত বছর অক্টোবরে নিউমোনিয়া নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর ধরা পড়ল মূত্রনালির সংক্রমণ। সে-যাত্রায় মৃত্যুর মুখে ছাই দিয়ে ফিরলেন বটে, কিন্তু চলাফেরা হয়ে পড়ল সীমিত। সর্বশেষ জনসমক্ষে আসেন এই এপ্রিলে। পার্কিনসন্স রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য তহবিল গঠনকল্পে বার্ষিক ‘ফাইট নাইট সেলিব্রিটি’ ডিনারে। কালো চশমায় চোখ ঢাকা। কিন্তু ধ্বস্ত শরীর। রুদ্ধবাক। সর্বকালের সেরা মুষ্টিযোদ্ধা আর চিরবিজয়ী এক মানুষের এক ছায়ামূর্তি যেন। তখন থেকেই সারা বিশ্বে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা। কখন কী হয়ে যায়! বৃহস্পতিবার শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর দ্বিতীয় দিনে এল সেই মর্মান্তিক খবরটি। ১৯৬৪ সালে ক্যাসিয়াস ক্লে ছেড়ে মোহাম্মদ আলী এক্স নাম নিয়ে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত আর ১৯৭৫ সালে সুন্নি পন্থার অনুসারী হওয়া বক্সার লোকান্তরিত। বয়স হয়েছিল ৭৪। পরিণত বয়সেই বিদায়।
কিন্তু মোহাম্মদ আলীকে কি বয়সের সীমায় বাঁধা যাবে? এখনকার সংঘাতময় পৃথিবীটা চেয়েছিল তিনি হাজার বছর বাঁচুন। সারা বিশ্বের অধিকারহারা, বর্ণবাদবিরোধী আর স্বাধীনতাকামী মানুষের আকাঙ্ক্ষা ছিল তিনি অমর থাকবেন। আর বক্সিং চেয়েছিল খেলাটি যত দিন আলোকিত থাকে, থাকবেন তত দিন। বাস্তবতা হলো, নশ্বর শরীরটা অত দীর্ঘায়ু পেল না। জীবনের স্মৃতিগুলোকে আলোর বিভায় রাঙিয়ে দিয়ে ১৯৪২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের লুইসভিলে ক্যাসিয়াস মার্সেলাস ক্লে নামে পৃথিবীর প্রথম আলো দেখা মানুষটি চলে গেলেন।
একটা সময় মনে হতো, আলী নিজেই বক্সিং বা বক্সিং নামের খেলাটার সমার্থক। ইতিহাসের উন্মাতাল সেই সময়কাল—সত্তর থেকে আশির দশক। যখন ভিয়েতনামে রক্ত ঝরছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর সোভিয়েত ইউনিয়ন—দুই বড় শক্তির স্নায়ুযুদ্ধ ঘোর কালো ছায়া ফেলেছে পৃথিবীর প্রতিটি কোণে। তখন এ-ও মনে হতো, মোহাম্মদ আলী মানে মোহাম্মদ আলী ক্লে, ওরফে ক্যাসিয়াস ক্লে না থাকলে বক্সিং খেলাটাই ধরণি থেকে বেমালুম লোপাট হয়ে যাবে। তা অবশ্য হয়নি। মোহাম্মদ আলী ৩২ বছর ধরে পারকিনসন্স রোগের কাছে ন্যুব্জ থাকার পরও বক্সিং টিকে আছে। টিকেই আছে আসলে। এ বাক্যটির সমর্থনে একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। তিনটি বিশ্ব বক্সিং সংগঠনের বিশ্ব হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন এখন যুক্তরাজ্যের অ্যান্টনি জোসুয়া, যুক্তরাষ্ট্রের ডিওন্টে ওয়াইল্ডার ও যুক্তরাজ্যের টাইসন ফিউরি। প্রথমজন আন্তর্জাতিক বক্সিং ফেডারেশনের, দ্বিতীয়জন ওয়ার্ল্ড বক্সিং কাউন্সিলের, তৃতীয়জন ওয়ার্ল্ড বক্সিং অ্যাসোসিয়েশনের। কজন এঁদের নাম জানেন? আর আলী যখন ১৯৬৪ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে সনি লিস্টনকে হারিয়ে বিশ্ব হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন হলেন, আলোড়িত হলো গোটা বিশ্ব। ১৯৭৪ সালে সেই সময়কার জায়ারে আর অধুনা কঙ্গো রিপাবলিকে ‘রাম্বল ইন দ্য জাঙ্গল’খ্যাত লড়াইয়ে জর্জ ফোরম্যানকে নকআউট করে যখন চ্যাম্পিয়ন হলেন, রীতিমতো সুনামি বয়েছিল এই গ্রহে। ১৯৭৩ সালে কেন নর্টনের কাছে শিরোপা খুইয়ে ওই বছরই সেটি পুনরুদ্ধার করেন। তখন থেকেই আলী বক্সিংয়ের অলংকার। আর ১৯৭৫ সালে যখন চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী জো ফ্রেজিয়ারকে ম্যানিলায় ‘থ্রিলা ইন ম্যানিলা’য় নকআউট করে শোধ নিলেন ১৯৭১ সালের হারের, তিনি ‘ব্ল্যাক সুপারম্যান’—যাঁকে হারানো যায় না। সেই প্রমাণ তিনি তিন বছর পরও দিয়েছেন, ১৯৭৮ সালে লিওন স্পিংকসের কাছে খেতাব হারানোর ছয় মাসের মধ্যেই সেটি পুনরুদ্ধার করে। তিনি সর্বোচ্চ তিনবারের হেভিওয়েট বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। তিনবার খেতাব খুইয়েও তা পুনরুদ্ধার করেছেন। বক্সিংকে রাঙিয়ে দিতেই যেন তাঁর আবির্ভাব ঘটেছিল খেলাটির ‘আলোর ঈশ্বর’ হয়ে। হেভিওয়েট বক্সিং কতটা আলী প্রভাবিত, তা পরিষ্কার ছোট্ট এই পরিসংখ্যানেই—৬১টি বাউটে হেরেছেন মাত্র পাঁচবার। ৩৭টি বাউটেই ভূপাতিত করেছেন প্রতিপক্ষকে।
১৯৭৯ সালে বক্সিং থেকে অবসর নিয়ে দ্রুতই সেটি ভেঙে আবার রিংয়ে ফেরেন ১৯৮০ সালে। তখন তাঁর বয়স ৩৮, আর চ্যালেঞ্জার ল্যারি হোমসের ৩১। তত দিনে ক্ষিপ্রতা হারিয়ে ফেলেছেন, সেই ভয়ংকর লেফট হুক হারিয়ে গেছে, রাইট জ্যাবেরও ধার নেই। প্রজাপতিনৃত্য তো অতীতের স্মৃতি। তবু মানুষ মনে করেছিল, আলীই জিতবেন, তিনি যে অজেয়! কিন্তু এক হেমন্তের বিকেলে হোমস নির্মমভাবে হারিয়ে দিলেন আলীকে। জয়ের পর হোমস লকাররুমে গিয়ে নীরবে কেঁদেছিলেন। চিরবিজয়ী আলীকে যে এভাবে হারতে দেখতে চাননি তিনি! ১৯৮১ সালে জীবনের শেষ বাউটটিতেও হেরেছেন, জ্যামাইকার ট্রেভর বারবিকের কাছে। ওই বছরই চিরবিদায় জানিয়েছেন বক্সিং রিংকে। মস্তিষ্কের বৈকল্যজনিত রোগ পারকিনসন্স তাঁকে রিংয়ে আর নামতে দেয়নি। সারা জীবন প্রতিপক্ষের যত আঘাত সয়েছেন, সেটির মূল্য না চুকিয়ে পারেননি। এই শুক্রবার জীবনকেই জানিয়ে দিলেন চিরবিদায়।
বিদায়? না, মোহাম্মদ আলীর বিদায় হতে পারে না। যিনি মার্কিন সেনাবাহিনীর হয়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধে যোগ দেননি ফেডারেল সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে, যে জন্য দণ্ডিত হয়েছেন, বক্সিং থেকে নির্বাসিত থেকেছেন তিন বছর, শিরোপা খুইয়েছেন, আর আইনি লড়াই করে জীবনযুদ্ধে জিতেছেন, তাঁর শারীরিক মৃত্যু হতে পারে—অনন্ত স্মৃতির মৃত্যু হতে পারে না।
ভিয়েতনাম নিশ্চয়ই চোখের জল ফেলছে। গোটা পৃথিবীরই আজ মন খারাপ। বাংলাদেশও শোকাতুর। ১৯৭৮ সালে যে তিনি এসেছিলেন এই দেশে, পেয়েছিলেন সবুজ পাসপোর্ট আর নাগরিকত্ব! ঢাকার পল্টন ময়দানে তাঁরই হাতে উদ্বোধন হওয়া মোহাম্মদ আলী বক্সিং স্টেডিয়াম আলীর স্মৃতি বয়ে বেড়াবে যুগ-যুগান্তর। ইস্কাটনে সরকারি অতিথিনিবাস পদ্মার পাশ দিয়ে যেতে যেতে অনেকের মনে পড়ে যাবে আলীকে। বাংলাদেশ সফরে এটিই ছিল তাঁর মূল ঠিকানা। মোহাম্মদ আলী স্টেডিয়াম ও পদ্মা বাংলাদেশের কানে গুঞ্জরিত হবে সেই ছড়া, যা তিনি আওড়াতেন বক্সিং রিংয়ে, ‘ফ্লোট লাইক আ বাটারফ্লাই, স্টিং লাইক আ বি। দ্য হ্যান্ডস কান্ট হিট হোয়াট দ্য আইজ কান্ট সি।’
‘শতাব্দীর সেরা’ ক্রীড়াবিদ, যুদ্ধ ও আগ্রাসনবিরোধী মহান বীর, কবি, গায়ক, অভিনেতা—আপনাকে এই পৃথিবী কখনো ভুলবে না। আপনি অমর। অবিনশ্বর আপনার স্মৃতি!
আরও পড়ুন: