
এশিয়ান গেমসে মোট ১৩ হাজার স্বেচ্ছাসেবী কাজ করছেন। প্রতি ভেন্যুতে তাঁদের ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। স্বেচ্ছাসেবীদের আতিথেয়তায় মুগ্ধ সবাই।
ধরুন, এশিয়ান গেমস কাভার করতে জাকার্তায় এসে আপনি পথ হারিয়ে ফেলেছেন। গন্তব্যে যেতে সহায়তা চাইলেন কোনো গেমস স্বেচ্ছাসেবীর। তিনি আপনাকে গন্তব্যে পৌঁছে না দেওয়া পর্যন্ত নিজের কাজে আর ফিরে যাবেন না। তা দুই মাইল হাঁটতে হোক আর দুই ঘণ্টাই লাগুক। জাকার্তায় এসে মানুষের প্রতি মানুষের এমন ভালোবাসা দেখে অবাক না হয়ে পারছি না। বিপদগ্রস্ত মানুষকে সহায়তা করতে পারলেই তাঁদের খুশি দেখে কে! স্বেচ্ছাসেবীর ধর্ম তো এমনই হওয়া উচিত।
একজন-দুজন নয়, এই মনোভাব নিয়ে ১৮তম এশিয়ান গেমসে কাজ করছেন প্রায় ১৩ হাজার স্বেচ্ছাসেবী। জাকার্তা তো আছেই, সহ-আয়োজক শহর দক্ষিণ সুমাত্রা প্রদেশের রাজধানী পালেমবাংয়ে কাজ করছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। স্বাভাবিকভাবে সব গেমসেই থাকে, যা দেখা যায়। অলিম্পিক, বিশ্বকাপসহ সব বড় আয়োজনের অলংকার হয়ে ওঠেন কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ের এই তরুণ-তরুণীরা। আয়োজনটাকে সফল করতে তাঁদের পরিশ্রমের শেষ নেই। এবার রাশিয়া বিশ্বকাপের স্বেচ্ছাসেবীদের প্রশংসায় ভিজিয়ে দিয়েছিলেন খোদ ফিফা সভাপতি ইনফান্তিনো। বলছিলেন, স্বেচ্ছাসেবীরা এত আন্তরিকভাবে কাজ না করলে বিশ্বকাপ এত সফল হতো না।
জাকার্তা এশিয়ান গেমসের স্বেচ্ছাসেবীরা সম্ভবত আরেক কাঠি এগিয়ে। এই ছেলেমেয়েদের একটাই কথা, ‘দেশের জন্য আমরা কাজ করি। দেশকে সবার কাছে তুলে ধরতেই আমাদের এই পরিশ্রম।’
মধ্য জাভা থেকে জাকার্তায় এশিয়াডের মূল ভেন্যুতে কাজে আসা ২২ বছর বয়সী আকমালিয়া নিয়ামা তাঁদেরই একজন। গেমসের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও প্রটোকল বিভাগে কাজ করে দেশকে সেবা দিতে পেরেই আকলামিয়া খুশি, ‘আমি স্বেচ্ছাসেবী হয়েছি মূলত বিশ্বের কাছে আমার দেশকে তুলে ধরতে। সেটা পেরেছি বলেই আমার মনে হয়। ভিন্ন ভিন্ন দেশের মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। দেশ-দুনিয়া নিয়ে অনেক কিছু জানলাম। এই অভিজ্ঞতা জীবনে চলার পথে ভীষণভাবে কাজে লাগবে।’
আকমালিয়া যদি দেশের সেবা করতে পেরেই খুশি থাকেন, তো রাতি বাউনো দেখালেন আরও বড় প্রতিশ্রুতি। সদ্য বিবাহিত মেয়েটি তাঁর জাপানে মধুচন্দ্রিমায় যাওয়া পর্যন্ত পিছিয়ে দিয়েছেন এই গেমসে কাজ করবেন বলে। নিজের সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণ হওয়ায় রাতি এত খুশি যে এই দিনগুলোকে কখনোই ভুলতে পারবেন না, ‘এই দায়িত্বটা পাওয়ার পর প্রথমে তো ভেবেছিলাম আমি আমার বিয়েই স্থগিত করে দেব। কিন্তু আমার মা বললেন, সব তো জোগাড়যন্ত্র হয়ে গেছে। এখন আর বিয়ে পেছানো যাবে না। কী আর করা, বিয়েটা হলো এবং আমার স্বামী আমার স্বেচ্ছাসেবক হতে অনেক সহায়তা করেছে।’
আর স্বেচ্ছাসেবীরা সহায়তা করছেন এখানে আসা খেলোয়াড়, কর্মকর্তা, সাংবাদিকদের। আতিথেয়তা দিতে সদা প্রস্তুত তাঁরা। বাংলাদেশের বিভিন্ন দলের সঙ্গে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবীদের অনেকে টুকটাক বাংলাও শিখে ফেলেছেন। ‘তুমি কেমন আছে’, ‘আমি ভালো’—এ-জাতীয়। বাংলার প্রতি তাঁদের আগ্রহও বেশ। বাংলাদেশ কী, কবে স্বাধীন হয়েছে, খেলাধুলায় কেমন—নানা আগ্রহ। গেমসে আসা বাংলাদেশের কুস্তিগির খেলোয়াড় শিরিন সুলতানা বলছিলেন, ‘এই ছেলেমেয়েরা এত ভালো যে সামান্যতম অসুবিধা হতে দেবে না কারোর। আমি তো কয়েকজনকে নিয়মিত বাংলা শেখাতাম। আমি তোমাকে ভালোবাসি...এগুলো বলতাম, শেখাতাম...হা হা...।’
বাংলাদেশ ফুটবল দলের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যে কজন স্বেচ্ছাসেবী কাজ করছেন, তাঁদের একজন কলেজছাত্র হামিদা আতসু বলেন, ‘ইন্দোনেশিয়ায় অনেক সংস্কৃতি। এগুলো তুলে ধরাই আমাদের বড় একটা কাজ। আমরা আসলে যতটুকু করছি, সবটুকু পুরোপুরি দেশের সম্মানের কথা ভেবে।’ ফুটবল দলের এক খেলোয়াড় একটু হাঁটতে বেরিয়েছেন হোটেলের সামনে। সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবী আসবেনই।
পশ্চিম জাকার্তার ইউনিভার্সিটি অব ড্রামা পারকারদার ২২ বছরের ছাত্র আরাঙ্গনের কাছে এশিয়ান গেমসটা ইন্দোনেশিয়ার জন্য অনেক বড় উপলক্ষ, ‘এখানে আমি স্বেচ্ছাসেবী হয়েছি অন্য স্বেচ্ছাসেবীদের কাছ থেকে অভিজ্ঞতা নেব বলে। আমি জীবনে একজন ভালো মানুষ হতে চাই এবং আমি মনে করি, এই অভিজ্ঞতা একজন ভালো মানুষ হতে আমাকে এগিয়ে নেবে।’
৩৫ হাজার আবেদন থেকে পুলিশ, সেনা, গোয়েন্দাসহ সাতটি সংস্থার যাচাই-বাছাইয়ের পর চূড়ান্ত নিয়োগ পেয়েছেন এসব স্বেচ্ছাসেবী। প্রার্থীদের বসতে হয়েছে বাছাই পরীক্ষায়। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরাই মূলত এসেছেন। এশিয়ান গেমসসহ আয়োজক শহর পালেমবাংয়ের জন্য ওখানকার ছেলেমেয়েরা পেয়েছেন অগ্রাধিকার। আয়োজক কমিটি এত ছেলেমেয়েকে বাসস্থান দিতে পারছে না স্বাভাবিকভাবেই। তবে গ্রামীণ অঞ্চলে সাইক্লিং হয়েছে, তাই ওখানে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের জন্য আবাসন ছিল সেনাবাহিনীর কিছু কোয়ার্টার।
স্বেচ্ছাসেবী মানে স্বেচ্ছাশ্রম। তাই এখানকার স্বেচ্ছাসেবীদের জন্যও কোনো আর্থিক প্রণোদনা নেই। দৈনিক শুধু খাবার ও যাতায়াতের জন্য তিন লাখ রুপি পান তাঁরা (বাংলাদেশি টাকায় সতেরো-আঠারো শ)। বাড়তি যেটা করা হয়েছে, ভবিষ্যতে এই স্বেচ্ছাসেবীরা সরকারের কাছে চাকরির সময় অগ্রাধিকার পাবেন। তাঁদের জীবনবৃত্তান্ত এশিয়ান গেমসের আয়োজক কমিটি পাঠিয়ে দিয়েছে ইন্দোনেশীয় সরকারের কাছে। তবে চাকরির আশায় তো আর এই ছেলেমেয়েরা কাজটা বেছে নেননি। নিয়েছেন আসলে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম দেশটির সংস্কৃতি আর ভালোবাসার বার্তা পৌঁছে দিতে। গত ১৫ দিন জাকার্তায় গেমস কাভার করে মনে হলো, এই ছেলেমেয়েদের কাছে শেখার আছে অনেক কিছুই!