Thank you for trying Sticky AMP!!

২০১৩-২০২০ পর্যন্ত ৮ বছরে একসঙ্গে ৮৫ জনকে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার দেওয়া হলো

যে পুরস্কারের জন্য তাঁদের অপেক্ষা ছিল এত দিন

ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আজ সকালে যেন বসেছিল চাঁদের হাট। অনুষ্ঠান শেষ হতেই গমগম করছিল পুরো হল। সবাই আসন ছেড়ে গল্প-আড্ডায় মেতে উঠলেন। জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার অনুষ্ঠানটা এমনই হয় বরাবর। এবার একসঙ্গে ২০১৩-২০২০ পর্যন্ত ৮ বছরে ৮৫ জনকে পুরস্কার দেওয়া হলো। ফলে হলে ছিল না তিল ধারণের জায়গা। আড্ডাটা অনেক বেশি জমে উঠল স্বাভাবিকভাবেই।

সেই আড্ডায় চারদিকে সব চেনামুখ। এদিকে পুরস্কারপ্রাপ্ত ক্রিকেটের জালাল ইউনুস, আহমেদ সাজ্জাদুল আলমরা তো কয়েক হাত দূরে ফুটবলের শওকত আলী খান জাহাঙ্গীর বা ফজলুর রহমান বাবুলরা। সবার মুখেই উচ্ছ্বাস। তার মাঝেই আহমেদ সাজ্জাদুল আলম তাঁর বাবা প্রয়াত জাতীয় নেতা মহিউদ্দিন আহমেদ ও তাঁর মাকে স্মরণ করলেন। জালাল ইউনুস বলছিলেন, ‘৪৫ বছরের ক্রিকেট জীবনে আজ এই পুরস্কার পেয়ে অন্য রকম আনন্দ হচ্ছে।’

জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারপ্রাপ্ত ৮৫ জন

এক পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন ৯০ বছর বয়সী রোইং ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক খোরশেদ আলম তো তাঁর পাশেই সবচেয়ে কনিষ্ঠ পুরস্কারপ্রাপ্ত ভারোত্তোলন কোচ শাহরিয়া সুলতানার কণ্ঠে শোনা যায়, ‘পুরস্কার পাওয়ার উত্তেজনায় কাল রাতে ঘুমাতেই পারিনি।’

একই রকম অনুভূতি ছিল অনেকেরই। জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পাওয়ার প্রতিক্রিয়ায় সবাই অভিন্ন কণ্ঠেই বলে গেলেন, ‘ভালো লাগছে। এই আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।’ হ্যান্ডবল ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান কোহিনুর সে সঙ্গে যোগ করেন, ‘পুরস্কার পাওয়ার জন্য এত বছর কাজ করিনি।’ আবার কেউ কেউ ৮ বছরের পুরস্কার একবারে দেওয়ার কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘আরও আগেও পাওয়া উচিত ছিল পুরস্কারটা।’

ক্রীড়ায় সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারের আশায় থাকেন সব ক্রীড়াবিদ, সংগঠকই। সুতরাং এই পুরস্কারপ্রাপ্তদের কাছে দিনটা হয়ে ওঠে আনন্দময়। পুরস্কার নিয়ে ফেরার সময় সত্তর-আশির দশকের সাবেক ফুটবলার খন্দকার রকিবুল ইসলাম বলেন, ‘১৯৭৩ সালে প্রথম আসি ঢাকায়। তখন আমি বাচ্চা ছেলে। ৪৯ বছর ধরে আছি ফুটবলের সঙ্গে। আজ বড় একটা স্বীকৃতি পেলাম। কতটা ভালো লাগছে বলে বোঝাতে পারব না।’

ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যোগ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

সাবেক ফিফা রেফারি তৈয়ব হাসান এই প্রতিবেদকে জানালেন, পুরস্কার হিসেবে পাওয়া ১ লাখ টাকা তিনি সাতক্ষীরার সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য ব্যয় করবেন। তৈয়ব বলছিলেন, ‘রেফারিং জীবনে অনেক প্রাপ্তির মধ্যে আজ বড় একটা প্রাপ্তি হলো আমার। তবে এই ১ লাখ টাকা আমি নেব না, টাকাটা আর্তমানবতার সেবায় দান করব। আমার মতে অন্যদের এটা করা উচিত।’

স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ম্যানেজার তানভীর মাজহার তান্না এসেছিলেন লাঠি ভর দিয়ে। পুরস্কার নিয়ে নিজের অনুভূতি জানাতে গিয়ে বলছিলেন, ‘আমি স্বাধীন বাংলাদশ দলে ছিলাম। ক্রিকেট বোর্ডের সাধারণ সম্পাদক ও আবাহনীর প্রতিষ্ঠাতা সহসভাপতি ছিলাম। এত দিন পর কাজের স্বীকৃতি পেলাম, মন্ত্রণালয় পুরস্কার দিয়েছে। এতেই অনেক ভালো লাগছে।’

কারাতে সংগঠক হিসেবে পুরস্কারপ্রাপ্ত আওলাদ হোসেন সত্তর দশকে দেশে জুডো-কারাতের প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন। এত বছর পর জাতীয় পুরস্কার পেয়ে তিনি আপ্লুত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘এই পুরস্কার পেয়ে আমি ভীষণ খুশি। এটা আমার জীবনে বড় এক প্রাপ্তি।’

এক ফাঁকে পাওয়া গেল আবাহনীর ভারপ্রাপ্ত ডাইরেক্টর ইনচার্জ কাজী নাবিল আহমেদকে। এই পুরস্কার দায়িত্ব আরও বাড়িয়ে দিল জানিয়ে সামনে তাকান তিনি, ‘আগামীতে আরও ভালো কাজ করার চেষ্টা করব।’ পুরস্কারটা কাকে উৎসর্গ করতে চান জানতে চাইলে উত্তরটা দিলেন এভাবে, ‘কাউকে না।’

ভিড়ের মধ্যে ক্রীড়া সাংবাদিকেরা খুঁজছিলেন জুয়েল রানাকে। ১৯৯৯ কাঠমান্ডু সাফ গেমসে তাঁর নেতৃত্বেই প্রথমবার দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে সোনা জেতে বাংলাদেশ। সেই জুয়েল যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী হয়েছেন কয়েক বছর আগে। পুরস্কার নিতে এসেছেন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ফিরবেন ১৫ মে। অনুষ্ঠান শেষে নিজের উচ্ছ্বাসই প্রকাশ করলেন, ‘অনেক দিন মাঠে খেলেছি। আজ একটা স্বীকৃতি পেলাম। এর চেয়ে বড় আনন্দের কিছু নেই।’

নব্বই দশকে দেশের ৭ বারের দ্রুততম মানবী সুলতানা পারভীন লাভলীর সঙ্গে নব্বই দশকে লংজাম্পের রেকর্ডধারী নিলুফার ইয়াসমিন, সত্তর দশকে বর্শা নিক্ষেপে রেকর্ডধারী জোৎস্না আফরোজরা একসঙ্গে ছবি তুললেন পুরস্কার নিতে এসে। কিছু সময় আনন্দ করে কাটালেন।

তৃণমূলের অ্যাথলেটিকস সংগঠক নোয়খালীর রফিক উল্ল্যাহ আখতার মিলন ছিলেন খুব খুশি। প্রকাশও করলেন সেটা, ‘আমি তৃণমূল থেকে অনেক খেলোয়াড় তুলে এনেছি। তারা জাতীয় পর্যায়ে পদক জিতেছে। চাকরি পেয়েছে। নিজেদের পরিবারের হাল ধরেছে। আজ ভাবতে ভালো লাগছে যে পরিশ্রম মূল্য পেলাম।’

ক্রীড়া পুরস্কার পেয়েছেন সাবেক অধিনায়ক জুয়েল রানা

দিনটি একটু আলাদাই ছিল মোজাফফর হোসেন পল্টু ও এনায়েত হোসেন সিরাজের জন্য। দুই ভাই একই দিনে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পেলেন সংগঠক হিসেবে। পল্টু ২০১৩ সালে ও সিরাজ ২০১৪ সালের জন্য। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের প্রতিষ্ঠাতাকালীন সাধারণ সম্পাদক মোজাফফর হোসেন পল্টু বলছিলেন, ‘এই বয়সে এসে পুরস্কার পেয়ে ভালোই লাগছে। হয়তো আগেও পেতে পারতাম। দুই ভাই একই দিন পুরস্কার পেলাম এটার অনুভূতি অন্য সবার চেয়ে আলাদা।’

তাঁর ছোট ভাই এনায়েত হোসেন সিরাজ দেশের বাইরে যাবেন তাই একটু তাড়া ছিল তাঁর। অনুষ্ঠানস্থল ছেড়ে যাওয়ার সময় বলে গেলেন, ‘পল্টু ভাই পঞ্চাশের দশকে শান্তিনগর ক্লাব করেছেন। সেই শান্তিনগর ক্লাব না করলে আমার মতো আরও অনেক তরুণেরই হয়তো ক্রিকেট ও ক্রীড়াঙ্গনে আসা হতো না। আজ দুই ভাই একই দিনে ক্রীড়াঙ্গনে সর্বোচ্চ স্বীকৃতি পেলাম। এই অনুভূতি অন্য সবকিছুর চেয়ে আলাদা।’

৮ বছরের পুরস্কারের জন্য ৩৪০ জন আবেদন করেছিলেন এবার। তাঁদের মধ্য থেকে বাছাই করে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে ৮৫ জনকে। তবে অপেক্ষাকৃত কম যোগ্যতার অনেকই পেয়ে গেছেন পুরস্কারটা। অতীতের ধারাবাহিকতায় অনেকে তদবির করেছেন, পেয়েছেন। ফলে বিতর্ক পিছু ছাড়েনি এ বছরও।

জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন হাবিবুল বাশার

পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান ভার্চ্যুয়ালি উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি তাঁর বক্তব্যে আগামী বছর থেকে এই পুরস্কার নিয়মিতভাবে আয়োজনের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। পরে ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসানও বলেন, আর বিরতি না দিয়ে আগামী বছর থেকে নিয়মিত জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার দেওয়া হবে।

প্রধানমন্ত্রী তাঁর স্মৃতিচারণায় আবাহনীর প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত শেখ কামালকে স্মরণ করেন। ছোট ভাইয়ের গল্প বলতে গিয়ে ফিরে যান ১৯৭৫ সালে। বলেন, ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্টের কয়েক দিন আগে তিনি জার্মানি যাওয়ার সময় শেখ কামালকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তাঁর জন্য কী আনবেন। শেখ কামাল বলেছিলেন, আবাহনীর ফুটবলারদের জন্য বুট আনতে। কিন্তু ১৫ আগষ্টের হত্যাকাণ্ডে সব এলোমেলো হয়ে যায়। বুট আর আনা হয়নি।

জেলা পর্যায়ের স্টেডিয়ামগুলো সব খেলা যেন ব্যবহার করতে পারে তার ওপরও জোর দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এখন দেখা যায় অনেক স্টেডিয়ামই ক্রিকেটের অধীনে। কিন্তু ক্রিকেট কখন হবে তার জন্য অপেক্ষায় সারা বছর কেটে যায়, স্টেডিয়ামগুলো শূন্য পড়ে থাকে। এই দিকটা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী সব খেলার জন্য স্টেডিয়ামগুলো উন্মুক্ত করে দিতে যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীকে নির্দেশ দেন।

মন্ত্রী আগামীতে খেলাধুলার প্রসারে আরও কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আগামীর খেলোয়াড় গড়ে তুলতে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার ভূমিকা রাখবে, এমন প্রত্যাশাই রেখে গেলেন পুরস্কারপ্রাপ্ত ক্রীড়াবিদেরা।