
১৯৫০ বিশ্বকাপে মারাকানাকে স্তব্ধ করে দেওয়া তাঁর সেই গোল আজও অম্লান। ‘মারাকানাজো’ নামে বিখ্যাত হয়ে যাওয়া সেই মহাকাব্যিক ম্যাচে জয়ী উরুগুয়ে দলের একমাত্র জীবিত সাক্ষী এখন অ্যালসিডেস ঘিগিয়া। গত মাসে বিশ্বকাপ ড্র অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ব্রাজিল গিয়েছিলেন ৮৭ বছরের ঘিগিয়া, তখনই ফিফা ডট কমকে দেওয়া সাক্ষাত্কারে খুলে দিয়েছেন স্মৃতির ঝাঁপি
ফিফা ডট কম: ব্যক্তিগতভাবে ব্রাজিলে ফিরতে পেরে আপনার কেমন লাগছে?
অ্যালসিডেস ঘিগিয়া: আমার কাছে এটা দ্বিতীয় বাড়ির মতো। মাঝে মাঝে মানুষ এখানে আমাকে দেখে চিনে ফেলে। আমার সঙ্গে তারা ছবি তুলতে বা অটোগ্রাফ নিতে চায়, মানুষ হিসেবে আমাকে কতটা মূল্যায়ন করে, এটাই তার প্রমাণ। যখনই এখানে আসি আমার খুব ভালো লাগে।
ফিফা: ১৯৫০ সালের সেই শিরোপানির্ধারণী ম্যাচটাকে কি আপনি বিশ্বকাপ ইতিহাসের সেরা ঘটনা মনে করেন?
ঘিগিয়া: হ্যাঁ, এটা দারুণ এক অর্জন ছিল। কেননা, এর আগে কোনো স্বাগতিক দেশই বিশ্বকাপ ফাইনালে হারেনি (ব্রাজিল-উরুগুয়ের ম্যাচটা ছিল চার দেশের মিনি সিরিজের শেষ ও শিরোপানির্ধারণী ম্যাচ)। আমি সব সময় একটা কথা বলি, তিনজন মারাকানাকে পুরোপুরি স্তব্ধ করে দিতে পেরেছিল—পোপ, ফ্রাঙ্ক সিনাত্রা ও আমি। সেদিন স্টেডিয়ামে ছিল পিনপতন নীরবতা।
ফিফা: সেই ম্যাচের পর ৬৪ বছর চলে গেল। এখনো কি ১৬ জুলাই, ১৯৫০ সালের সেই গোলের কথা আপনার মনে আছে?
ঘিগিয়া: অবশ্যই। ওদের গোলরক্ষক বারবোসা ভেবেছিল প্রথম গোলে যেমন করেছিলাম, আমি আবার হয়তো কাটিয়ে ভেতরে ঢুকব। সে একটু এগিয়ে এসেছিল। ফলে একটু ফাঁকা জমিন পেয়ে যাই। আমাকে মুহূর্তের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। গোলরক্ষক ও পোস্টের মাঝবরাবর আমি শট নিলাম, গোল। এরপর কীভাবে আমার পরিবার, বন্ধু ও সতীর্থরা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল, সেটিও আমার মনে আছে। আমি দেশকে উদ্যাপনের উপলক্ষ এনে দিয়েছিলাম। সেদিন ব্রাজিলকে শোকে ভাসিয়েছিলাম।
ফিফা: শেষ বাঁশির পর পরিবেশটা কেমন ছিল?
ঘিগিয়া: অনেককেই কাঁদতে দেখেছিলাম। ম্যাচটা জিতে যদিও আমরা খুব খুশি ছিলাম কিন্তু যখন আপনি দর্শকদের দিকে তাকাবেন, আপনার মন খারাপ হবেই। কিন্তু ফুটবল এমনই, কখনো আপনি জিতবেন, কখনো হারবেন। ব্রাজিলে সবাই ম্যাচের আগেই ভেবেছিল ওরাই জিতে গেছে। পত্রিকার শিরোনাম ছিল, ‘ব্রাজিল বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন।’ শুধু স্কোরটাই লেখা বাকি ছিল, এই যা! কিন্তু সবকিছুই পরে বদলে গেল।
ফিফা: সেই ম্যাচ নিয়ে উরুগুয়ে অধিনায়ক অবদুলিও ভ্যালেরা নাকি বলেছিলেন, ‘সবকিছু ভুলে যাও, মাঠের খেলাটা হবে এগারো বনাম এগারো।’ ঘটনা কি এটাই ছিল?
ঘিগিয়া: শনিবার বিকেলে তিনজন উরুগুয়ে পরিচালক আমাদের সবচেয়ে অভিজ্ঞ তিনজন অবদুলিও, মাসপোলি, গামবেত্তার সঙ্গে কথা বলতে এসেছিল। তারা আমাদের বলেছিল, আমরা যথেষ্ট করে ফেলেছি। শুধু মাঠে যেন আমরা নিজেদের সংযত রাখি, কোনো ঝামেলা না করি, তিন বা চার গোল যেন না খাই। মাঠে ঢোকার সময় টানেলে এটা শুনেছিলাম। অবদুলিও আমাদের থামিয়েছিল, এর পরই এই বিখ্যাত উক্তিটার জন্ম।
ফিফা: আরেকটা গল্প এ রকম—সেই ম্যাচের পর উরুগুয়ের কিছু খেলোয়াড় পানশালায় গিয়েছিল, সেখানে ব্রাজিলিয়ান সমর্থকদের নাকি সান্ত্বনা দিয়েছিল তারা। এটা সত্যি?
ঘিগিয়া: অবদুলিওই গিয়েছিল। সেটি হোটেলের কাছেই একটা পানশালায়। ব্রাজিলিয়ানরা ওকে দেখে চিনে ফেলে। চোখে অশ্রু নিয়েই ওকে ওরা জড়িয়ে ধরে। সে নিজেই এটা বলেছে আমাদের। এও বলেছে, ‘এমনকি আমাকে সেখানে কোনো পয়সাও দিতে হয়নি (হাসি)।’
ফিফা: জর্ডানের সঙ্গে বিশ্বকাপ বাছাইয়ের প্লে-অফের দ্বিতীয় লেগটা হয়েছিল গত ২০ নভেম্বর উরুগুয়েতে। সেখানে আপনাকে সম্মাননা জানানো হয়। আপনি কি মনে করেন এতে আপনার ও আপনার সতীর্থদের সঙ্গে ন্যায়বিচার করা হয়েছে?
ঘিগিয়া: ১৯৫০ বিশ্বকাপে আমাদের অর্জনটা মানুষ বড়জোর এক কি দুই বছর মনে রেখেছিল। এরপর সবাই সেটি ভুলে যায়। মাঝেমধ্যে কিছু জিনিস শুধু স্মৃতিতেই বেঁচে থাকে। আমার সেই গোলের রিপ্লে বড় পর্দায় দেখানোর মুহূর্তটা (সম্মাননা অনুষ্ঠানে) অসাধারণ ও আবেগঘন ছিল। প্রথমবার উরুগুয়েতে এমন কিছু করা হলো। আমি পৃথিবীর অনেক দেশেই গিয়েছি। কিন্তু উরুগুয়ের চেয়ে সবখানেই আমাকে নিয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে। সে জন্যই আমি এত খুশি হয়েছিলাম।
ফিফা: ফুটবল মানে আপনার কাছে কী?
ঘিগিয়া: ফুটবল আমার কাছে বধূর মতো। আপনি এটা দেখেই প্রেমে পড়ে যাবেন। সারা জীবনের জন্য সে হয়ে যাবে আপনার। আমার কাছে ফুটবল এমনই। আপনাকে বলটা বুঝতে হবে, জানতে হবে। তখনই এটাকে সবচেয়ে ভালোবাসতে পারবেন।
ফিফা: বিশ্বকাপের আর কয়েক মাস বাকি। তখনো কি আপনার ইচ্ছে করবে আবার ব্রাজিলে আসতে?
ঘিগিয়া: হ্যাঁ, আমি তখন ব্রাজিলে ফের আসতে চাই। ব্রাজিল-উরুগুয়ে ফাইনাল হোক, ফাইনালে উরুগুয়ে শিরোপা জিতে নিক, আমি চাইব এসব যেন দর্শকসারিতে বসে দেখতে পারি।