
৩৫৫/৫।
২৩৯/০।
দুটিতে কোনো মিল খুঁজে পাচ্ছেন?
একটু ভাবুন তো! দ্বিতীয়টা সহজেই বুঝে ফেলার কথা। ফতুল্লা টেস্টের প্রথম দিন শেষে স্কোরবোর্ডের চেহারা। প্রথমটা?
প্রথমটাও তা-ই। পার্থক্য হলো, সেটি প্রায় নয় বছর আগের। এই মাঠে এর আগে একটিই টেস্ট ম্যাচ। ২০০৬ সালের ৯ এপ্রিল সেই টেস্টের প্রথম দিন শেষে স্কোরবোর্ড দেখাচ্ছিল ৩৫৫/৫।
দেখাচ্ছিল না বলে জ্বলজ্বল করছিল লেখাই ভালো। কারণ ওই স্কোরটা ছিল বাংলাদেশের। সেটিও তখনকার প্রবল পরাক্রান্ত সর্বজয়ী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। দিন শেষের সংবাদ সম্মেলনে সেঞ্চুরিয়ান শাহরিয়ার নাফীস তো আসবেনই, এসেছিলেন কোচ ডেভ হোয়াটমোরও। উচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়ার দুর্নাম যাঁর কোনোকালেই ছিল না, সেই হোয়াটমোরের চোখমুখ থেকে উপচে পড়ছিল খুশি। প্রশ্নগুলোও ছিল যথারীতি মধু মাখানো।
কাল সংবাদ সম্মেলনে কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে একা। বাংলাদেশের কোচ হিসেবে তাঁর বর্ষপূর্তির দিন। সেটির ‘উদ্যাপন’ কি না এমন অস্বস্তিকর এক সংবাদ সম্মেলনে! যেভাবে একের পর এক তির ছুটে গেল তাঁর দিকে, তাতে সংবাদ সম্মেলনের সমাপ্তি ঘোষণাটা নিশ্চয়ই মধুর সংগীত হয়ে বেজেছে হাথুরুসিংহের কানে।
নয় বছর আগে-পরে ফতুল্লার দুই টেস্টের প্রথম দিন শেষে সংবাদ সম্মেলনে দুই কোচের পুরো বিপরীত অভিজ্ঞতাই বলে দিচ্ছে দিন দুটির পার্থক্য। বৃষ্টিতে খণ্ডিত দিনে ভারতের দুই ওপেনারেরই ৫৬ ওভারে ২৩৯ রান তুলে ফেলাটা হাথুরুসিংহের প্রশ্নবাণে জর্জরিত হওয়ার কারণ নয়। হ্যাঁ, রানটা অনেক। টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের বিপক্ষে এর চেয়ে বড় উদ্বোধনী জুটি একটিই। ২০০৮ সালে চট্টগ্রামে নিল ম্যাকেঞ্জি ও গ্রায়েম স্মিথের ৪১৫ আবার বিশ্ব রেকর্ডও।
তবে হাথুরুসিংহেকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর কারণ ওই বিনা উইকেটে ২৩৯ নয়। কারণ এই টেস্টে বাংলাদেশের অব্যাখ্যানীয় এক একাদশ নিয়ে খেলতে নামা। যা দেখলে যে কারও মনে হতে বাধ্য, প্রতিপক্ষ নিশ্চয়ই স্পিনকে জুজুর মতো ভয় পায়। নইলে কি আর কোনো দল চার স্পিনার নিয়ে খেলতে নামে! স্পেশালিস্ট পেসার থাকে মাত্র একজন! সেই একজনও আবার এমন, আদর্শ টেস্ট আক্রমণে যাঁর থার্ড সিমারের বেশি মর্যাদা পাওয়ার কথা নয়। গতি এবং মানসিকতায় অনেক বেশি আক্রমণাত্মক রুবেল হোসেন ও আবুল হাসান বাইরে বসে, খেলছেন কি না মোহাম্মদ শহীদ!
তা এই স্পিনারে ঠাসা একাদশ কাদের বিপক্ষে? ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও যে দেশের ব্যাটসম্যানরা স্পিন খেলতে পারে বলে প্রবাদ। অবশ্যই একটু বাড়িয়ে বলা। আমি-আপনি হাত ঘোরালেও ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ব্যাটিং করা সম্ভব নয়। তবে শেন ওয়ার্ন কথাটা বলেছিলেন বড় দুঃখে। তর্কাতীতভাবে সর্বকালের সেরা লেগ স্পিনার, প্রকারভেদ বিবেচনায় না নিয়ে তর্কযোগ্যভাবে সর্বকালের সেরা স্পিনারের ভারতের বিপক্ষে বোলিং গড় ৪৭.১৮। অন্য কোনো দেশের বিপক্ষে যা ৩০-ও ছোঁয়নি।
স্পিন দিয়ে ভারতকে কাবু করার এই রণপরিকল্পনা এমনই ব্যাখ্যাতীত যে, এ নিয়ে রসিকতাও হলো। একটা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ‘শ্রেষ্ঠত্ব’ তো ম্যাচ শুরুর আগেই প্রতিষ্ঠিত। ভারতের ঘূর্ণি বিভাগে দুজনই অফ স্পিনার আর বাংলাদেশ দলে কী নেই—অফ স্পিনার, লেগ স্পিনার, বাঁহাতি স্পিনার!
নামমাত্র একজন পেসার নিয়ে স্পিনারভর্তি একাদশ ভারতীয় ক্রিকেটের ঐতিহ্য। তবে সেটি তো ডিজাইনার পিচে। যেটিতে প্রথম দিন থেকেই ধুলো উড়তে শুরু করবে, দ্বিতীয় দিন থেকে ভাঙবে। ফতুল্লার উইকেট তো বলতে গেলে স্টেডিয়ামের পাশের মহাসড়কের মতো। আগের দিন উইকেটে আলগা ঘাস দেখে হাথুরুসিংহে বলেছিলেন, এমন উইকেট তিনি জীবনে দেখেননি। কাল যেটিকে বললেন তাঁর দেখা সবচেয়ে ফ্ল্যাট উইকেট।
এর আগেও একবার এক পেসার নিয়ে খেলেছে বাংলাদেশ। গত বছরের শুরুতে চট্টগ্রামে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সেই টেস্টের সঙ্গে আরও দুটি মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। সেবারও তুলনায় অভিজ্ঞ রুবেলকে বাইরে রেখে খেলানো হয়েছিল মাত্র দুই টেস্ট খেলা আল আমিনকে। এখানেও রুবেল বাইরে, মোহাম্মদ শহীদও টেস্ট ক্রিকেটে মাত্র দুই ম্যাচ পুরোনো। এর চেয়েও তাৎপর্যপূর্ণ মিল—দুটি টেস্টেই অধিনায়কের নাম মুশফিকুর রহিম।
চট্টগ্রামের ওই টেস্টেই বাংলাদেশের বিপক্ষে একমাত্র ট্রিপল সেঞ্চুরিটি করেছিলেন কুমার সাঙ্গাকারা। ট্রিপল সেঞ্চুরি অনেক দূরের পথ, তবে এখানেও এর অর্ধেকটা কিন্তু পেরিয়ে গেছেন আরেক বাঁহাতি। সকালে ঘণ্টা দেড়েক খেলা হওয়ার পরই ঝেঁপে বৃষ্টি না এলে যিনি হয়তো লাঞ্চের আগেই সেঞ্চুরির বিরল কীর্তি গড়ে ফেলতেন। ৪৭ বলে যখন হাফ সেঞ্চুরি ছুঁয়েছেন, ওপেনিং সঙ্গী মুরালি বিজয় মাত্র ১১ রানে। সেঞ্চুরি ১০১ বলে। অথচ লোকেশ রাহুল ইনজুরিতে না পড়লে শিখর ধাওয়ানের হয়তো এই টেস্ট খেলাই হতো না। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিডনিতে ভারতের আগের টেস্টে বাদ পড়েছিলেন, সেই টেস্টেই রাহুলের সেঞ্চুরি। ক্রিকেট কখনো কখনো এভাবে কারও ভাগ্য বদলে দেয়। যেমন দিল শিখর ধাওয়ানের। তা ভাগ্য এদিন সত্যিই ধাওয়ানের ছায়াসঙ্গী। তাইজুলের বলে শর্ট মিড উইকেটে শুভাগত ক্যাচটি নিতে পারলে তো ৭৩ রানেই শেষ হয়ে যায় তাঁর ইনিংস। জোরালো দুটি এলবিডব্লুর আবেদনে আম্পায়াররা নিশ্চল থাকাতেও নিজেদের ভাগ্য বিড়ম্বিত ভাবতে পারে বাংলাদেশ।
তা এই টেস্টের ভাগ্যে কী লেখা আছে? হাথুরুসিংহে এই নির্বিষ বোলিং আক্রমণ নিয়েও জয়ের স্বপ্ন দেখছেন, যেটিকে দিবাস্বপ্ন বলাই ভালো। পাঁচ স্পেশালিস্ট বোলারের ভারতের বিপক্ষে ড্র-ই হবে জয়ের মতো। প্রথম দিনেই বৃষ্টি যদি পরের চার দিনেরও পূর্বাভাস হয়ে থাকে, সেটি অসম্ভব কিছু নয়। এক পেসারের দল ছাড়াও চট্টগ্রাম আর ফতুল্লায় তাহলে আরেকটি মিল পাওয়া যাবে। প্রথম ইনিংসে ট্রিপল সেঞ্চুরির পর দ্বিতীয় ইনিংসেও সেঞ্চুরি—সাঙ্গাকারার বীরত্বের পরও চট্টগ্রাম টেস্ট কিন্তু ড্র-ই হয়েছিল।
প্রথম দিনের শেষে
ভারত ১ম ইনিংস: ২৩৯/০