Thank you for trying Sticky AMP!!

শেষ পর্যন্ত লরেন্স রো হয়ে থাকেন এক আক্ষেপেরই নাম

>

প্রভাত কি সব সময় দিনের সঠিক পূর্বাভাস দেয়? কখনো দেয়, কখনো দেয় না। ক্রিকেটও এমনই। দুঃস্বপ্নের মতো শুরুর পরও যেমন আলো ছড়ানোর গল্প আছে, তেমনি হইচই ফেলে দেওয়া আবির্ভাবের পর পথ হারিয়ে ফেলারও। এসব গল্প নিয়েই নতুন এই ধারাবাহিক শুরু করলেন উৎপল শুভ্র

আর. ই. ফস্টার, লরেন্স রো, ব্রেন্ডন কুরুপ্পু, ম্যাথু সিনক্লেয়ার, জ্যাক রুডলফ: অভিষেক টেস্টে ডাবল সেঞ্চুরি।

টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম সেঞ্চুরিটি চার্লস ব্যানারম্যানের। সেটি ইতিহাসের প্রথম টেস্টেই। টেস্ট অভিষেকেই সেঞ্চুরি করার প্রথম কীর্তিটাও যে ব্যানারম্যানের, এটি তাই না বললেও চলছে। এরপর কতজনই তো তা করেছেন। নির্দিষ্ট করে বললে আরও ১০৫ জন। তবে প্রথম সেঞ্চুরিতে গড়া ব্যানারম্যানের একটি রেকর্ড অম্লান এখনো। অস্ট্রেলিয়ার ২৪৫ রানের স্কোরে ব্যানার‍ম্যানের একারই অবদান ছিল ১৬৫। শতাংশের হিসাবে যা ৬৭.৩৪। টেস্ট ক্রিকেটে দলের রানে এর চেয়ে বেশি অবদান রাখতে পারেননি আর কেউ। এমন একটা শুরুর পরও ব্যানারম্যান আর টেস্ট খেলেছেন মাত্র দুটি। আর কোনো সেঞ্চুরি দূরে থাক, হাফ সেঞ্চুরিও নেই।

তবে রেকর্ডটি আছে। যেটির বয়স টেস্ট ক্রিকেটের সমান। টেস্ট ক্রিকেটের সবচেয়ে পুরনো রেকর্ডের তালিকা করলে এরপরই আসবে আর. ই. ফস্টারের নাম। ১৯০৩ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিডনিতে তাঁর ২৮৭ রানের ইনিংসটি এখনো টেস্ট অভিষেকে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড। এমন একটা শুরুর পরও ফস্টার টেস্ট খেলেছেন আর মাত্র ৭টি। ব্যানারম্যানের মতোই প্রথম ইনিংসেই যা করার করে ফেলেছেন। সেঞ্চুরি ওই একটাই। ব্যানারম্যানের মতো তাঁরও অমরত্ব নিশ্চিত হয়ে গেছে ওই এক সেঞ্চুরিতেই।

ফস্টারের আরেকটি কীর্তিও একেবাদ্বিতীয়ম হয়ে আছে এত বছর। চিরদিনই যে তা থাকবে, এ নিয়েও কোনো সংশয় নেই। ক্রিকেট এবং ফুটবল দুটিতেই জাতীয় দলকে নেতৃত্ব আর কেউ দিতে পারবেন নাকি কোনেদিন! রান সংখ্যায় ছুঁতে না পারলেও টেস্ট অভিষেকে ডাবল সেঞ্চুরিতে তাঁকে ছুঁয়েছেন আরও চারজন। ফস্টারের মতো তাঁদের কারোর ক্যারিয়ারও এমন স্মরণীয় একটা শুরুর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়নি। এই চারজনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি, ৭টি সেঞ্চুরি লরেন্স রোর। সবচেয়ে বেশি, ৪৮টি টেস্ট খেলেছেন জ্যাক রুডলফ। তবে ওই ৪৮ টেস্টে ব্যাটিং গড় মাত্র ৩৫.৪৩। বাকি দুজনের মধ্যে ম্যাথু সিনক্লেয়ার ৩৩ টেস্টের সঙ্গে মিল রেখে করেছেন ৩টি সেঞ্চুরি। বাকি দুটি সেঞ্চুরির একটিও ডাবল, আরেকটি ১৫০। তবে এরপরও ৩২.০৫ ব্যাটিং গড় সাধারণ এক ব্যাটসম্যান হিসাবেই চিনিয়ে দেয় তাঁকে। অভিষেকে ডাবল পাঁচ ডাবল সেঞ্চুরিয়ানের মধ্যে সবচেয়ে কম টেস্ট খেলেছেন কুরুপ্পু । ডাবল সেঞ্চুরি দিয়ে শুরু ক্যারিয়ার কিনা মাত্র ৪ টেস্টেই শেষ! আর কোনো সেঞ্চুরিও নেই, হাফ সেঞ্চুরিও না।

কুরুপ্পুর ক্যারিয়ারই যেহেতু সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত, তাঁর গল্পটাই আগে বলে নেওয়া যাক। ১৯৮৭ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে কলম্বো ক্রিকেট ক্লাব মাঠে প্রথম টেস্ট খেলতে নামার আগেই ২২টি ওয়ানডে খেলা হয়ে গেছে এই উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যানের। ধুমধাড়াক্কা ব্যাটিংটাও হয়ে গেছে ট্রেডমার্ক। ১৯৮৩ বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে ক্যারিয়ারের মাত্র দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ৭২ রান করার পথে মুদাসসর নজরকে উড়িয়ে মাঠের বাইরে ফেলেছেন। সেই ম্যাচটা আবার হচ্ছিল স্যার গ্যারি সোবার্সের ছয় বলে ছয় ছক্কার স্মৃতিবিজরিত সোয়ানসিতে। এ হেন ব্রেন্ডন কুরুপ্পুই টেস্ট অভিষেকে ওপেন করতে নেমে দেখা দিলেন পুরো বিপরীত চেহারায়। অপরাজিত ২০১ রানের ইনিংসটি খেলতে লাগিয়ে ফেললেন ৭৭৭ মিনিট। বীরের বেশে যখন বেরিয়ে আসছেন, শুধু টেস্টেই নয়, ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটেও মন্থরতম ডাবল সেঞ্চুরির রেকর্ডটি হয়ে গেছে তাঁর।

লরেন্স রো: অভিষেক টেস্টে ডাবল সেঞ্চুরি ও সেঞ্চুরিতে সবচেয়ে বেশি রানের রেকর্ড, আছে ট্রিপল সেঞ্চুরিও, তারপরও আক্ষেপের গল্পই! ছবি: আইসিসি টুইটার

টেস্ট অভিষেকে ডাবল সেঞ্চুরির সর্বশেষ কীর্তিটি জ্যাক রুডলফের। সবচেয়ে বেশি নাটকও তাঁর অভিষেক নিয়েই। ২০০৩ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে চট্টগ্রামে অভিষেক টেস্টের আগের রাতেও হয়তো রুডলফের মনে খেলা করছিল সংশয়---শেষ পর্যন্ত আমার টেস্ট অভিষেক হবে তো! এর আগে যে দুবার তা হতে হতেও হয়নি। প্রথমবার তো খেলেছেনও, তারপরও না। ২০০১ সালে ভারতের দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে মাইক ডেনেস বিতর্কের কারণে সেঞ্চুরিয়নের সেই ম্যাচটি শেষ মুহূর্তে হয়ে গেছে 'আনঅফিসিয়াল টেস্ট'। যেটি আসলে হওয়ার কথা ছিল সিরিজের তৃতীয় টেস্ট। দ্বিতীয় টেস্টে ম্যাচ রেফারি মাইক ডেনেস বল টেম্পারিংয়ের অভিযোগে শচীন টেন্ডুলকারসহ ভারতের আর কয়েকজন খেলোয়াড়কে শাস্তি দেওয়ার পর রীতিমতো আগুন জ্বলে ওঠে ভারতে। বাতিল হতে বসা সফর বাঁচাতে আইসিসির মধ্যস্থতায় ডেনেসকে সরিয়ে দেওয়া হয় দায়িত্ব থেকে। সেঞ্চুরিয়ন 'টেস্ট' পরিণত হয় নিছকই পাঁচদিনের একটি ট্যুর ম্যাচে। সেই ম্যাচে খেলেও তাই টেস্ট ক্রিকেটার হওয়া হয়নি রুডলফের।

পরের বারের ঘটনা আরও মর্মান্তিক। ২০০২ সালের জানুয়ারিতে পরদিন টেস্ট অভিষেক হচ্ছে জেনে ঘুমাতে গেছেন রাতে। সকালে জানলেন, তাঁর বদলে খেলছেন জাস্টিন অনটং। দক্ষিণ আফ্রিকা দলে 'কোটা' ঠিক রাখতে আগের রাতে বোর্ড প্রেসিডেন্টের নির্দেশে বদলে গেছে একাদশ।

মনে মনে নিশ্চয়ই ফুঁসছিলেন রুডলফ। শেষ পর্যন্ত যখন সত্যি সত্যি টেস্ট অভিষেক হলো, এতদিনের জমে থাকা সব হতাশা, সব অপমানের ঝাল মেটালেন বাংলাদেশের বোলারদের ওপর। 'ডাবল' সেঞ্চুরি কথাটার আক্ষরিক অনুবাদ করে অপরাজিত ২২২ রান। এম এ আজিজ স্টেডিয়ামের প্রেসবক্সে বসে বাংলাদেশের বোলারদের দেখে সেদিন মায়াই হচ্ছিল। এক রামে রক্ষা নাই তায় সুগ্রীব দোসর! তাঁদের নাকের জল চোখের জল এক করে দিতে তো শুধু রুডলফই ছিলেন না, ছিলেন বোটা ডিপেনারও। গ্রায়েম স্মিথ ইনিংস ঘোষণা করে দেওয়ার আগে তৃতীয় উইকেটে এই দুজন তুলে ফেলেছেন ৪২৯, যেটি এখনো যেকোনো উইকেটে দক্ষিণ আফ্রিকান রেকর্ড হয়ে আছে। এমন একটা শুরুর পরও রুডলফের ক্যারিয়ার কখনোই সেভাবে পাখা মেলতে পারেনি। দলে আসা-যাওয়া করতে করতে তিতিবিরক্ত হয়ে এক সময় তো দক্ষিণ আফ্রিকাকে ত্যাগ করে 'কলপ্যাক' ক্রিকেটার হয়ে পাড়ি জমান ইংলিশ কাউন্টিতে।

টেস্ট অভিষেকে ডাবল সেঞ্চুরি করার প্রথম কীর্তিটি যাঁর, সেই লরেন্স রোর কথাটা সবার শেষে বলার কারণ আছে। এই পাঁচজনের মধ্যে সন্দেহাতীত সেরা ব্যাটসম্যানই শুধু নন, অভিষেক-কীর্তিতে বাকিদের চেয়ে একটু আলাদাও এই জ্যামাইকান। প্রথম ইনিংসে ডাবল সেঞ্চুরি করেই তো থামেননি, সেঞ্চুরি করেছেন দ্বিতীয় ইনিংসেও। ১৯৭২ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে কিংস্টনে লরেন্স রোর ২১৪ ও অপরাজিত ১০০। দুই ইনিংস মিলিয়ে ৩১৪ এখনো অভিষেক টেস্টে সবচেয়ে বেশি রান করার রেকর্ড। অভিষেকে দুই ইনিংসে ডাবল সেঞ্চুরি ও সেঞ্চুরিও আর কারও নেই। তবে দুই ইনিংসেই সেঞ্চুরি আছে আরেকজনের। সেটির সঙ্গেও আবার জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের নাম। ২০০৩ সালে করাচিতে অভিষেকেই ইয়াসির হামিদের জোড়া সেঞ্চুরি বাংলাদেশের বিপক্ষেই। লরেন্স রোর মতো তিনিও ডাবল সেঞ্চুরি ও সেঞ্চুরি প্রায় করেই ফেলেছিলেন। প্রথম ইনিংসে মাত্র ৩০ রানের জন্য সেঞ্চুরিটাকে ডাবল বানাতে পারেননি। করাচির যে ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে দুই ইনিংসে ১৭০ ও ১০৫ রানে ইয়াসির হামিদের স্বপ্নের মতো টেস্ট অভিষেক, ছয় বছর আগে ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে তাঁর অভিষেকও ওই একই মাঠে। শুরুর ওই দুই গল্পে কী বৈপরীত্য! ফার্স্ট ক্লাস অভিষেকে জোড়া শূন্য পেয়ে ড্রেসিংরুমে কান্নায় ভেঙে পড়া তরুণই টেস্ট অভিষেকের পর জোড়া সেঞ্চুরির আলোয় উদ্ভাসিত!

ইয়াসির হামিদ: জোড়া সেঞ্চুরি দিয়ে শুরু টেস্ট ক্যারিয়ারে সেঞ্চুরির দেখা পাননি আর। ছবি: টুইটার

লিকলিকে শরীর আর শিশুসুলভ মুখের ইয়াসির হামিদের স্মরণীয় ওই টেস্ট অভিষেকও প্রেসবক্সে বসেই দেখেছি। টেম্পারামেন্টটা খুব নজর কেড়েছিল, উইকেটের সব দিকে স্ট্রোক খেলার ক্ষমতাও। সব মিলিয়ে তিন নম্বরে পাকিস্তানের সমস্যার দীর্ঘস্থায়ী সমাধান বলে মনে হয়েছিল তাঁকে। অথচ প্রভাত যে অনেক সময়ই দিনের সঠিক পূর্বাভাস দিতে ব্যর্থ, সেটি প্রমাণ করে মাত্র ২৫ টেস্টেই থেমে গেছে ইয়াসির হামিদের ক্যারিয়ার। সেটিও খেলেছেন বেশ কয় পর্বে। অভিষেকে ওই দুই সেঞ্চুরির পর যে টেস্টে আর সেঞ্চুরিই করতে পারেননি।

লরেন্স রোর ঘটনা তা নয়। প্রথম ১২ টেস্টেই তাঁর আরও ৩টি সেঞ্চুরি, যার একটি আবার ট্রিপল! ওই ১২ টেস্ট শেষে ৭০.৬৯ ব্যাটিং গড় ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের পরবর্তী গ্রেট ব্যাটসম্যান হিসাবে ঘোষণা করেছিল তাঁর নাম। অমন দুর্দান্ত শুরুই এর একমাত্র কারণ ছিল না। লরেন্স রোর ব্যাটিংয়ে এমন সহজাত একটা অনায়াস ভঙি ছিল, এমন স্টাইলিশ ছিল তাঁর স্ট্রোক প্লে, তাঁকে এক ঝলক দেখলেই মুগ্ধ হয়ে যেতেন সবাই। বলতে গেলে লরেন্স রো তখন জ্যামাইকার সব তরুণ ক্রিকেটারেরই আইডল। এমনকি বোলারদেরও। ১৯৯৫ সালে শারজায় মাইকেল হোল্ডিংকে প্রথম যখন ইন্টারভিউ করি, এটা জেনে একটু অবাকই হয়েছিলাম। আইডল কেউ ছিলেন কিনা জিজ্ঞেস করে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কোনো ফাস্ট বোলারের নাম শোনার জন্য উৎকর্ণ হয়ে আছি। লরেন্স রোর নাম বলার পর প্রথমে তাই মনে হয়েছিল, ভুল শুনলাম না তো নাকি আমার প্রশ্নটাই বুঝতে পারেননি! আবার জিজ্ঞাসা করে নিশ্চিত হয়ে নিয়েছিলাম। পরে জ্যামাইকা গিয়ে আরও ভালোভাবে বুঝতে পেরেছি লরেন্স রো নামের মহিমা। সেই মহিমায় অবশ্য কিছুটা কালির ছিটে পড়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান 'রেবেল' দলের অধিনায়ক হয়ে রো বর্ণবাদের জন্য নিষিদ্ধ দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যাওয়ায়। সেটিই লরেন্স রোর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের সমাপ্তি টেনে দেয়।

কিন্তু সেটি তো এর আগে থেকেই ধুঁকছিল। প্রায় দুই বছর তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের বাইরে। অথচ ইনিংস বাই ইনিংস তাঁর স্কোরে চোখ বুলালে দেখবেন, শেষ টেস্টেও হাফ সেঞ্চুরি আছে, এর আগের টেস্টে সেঞ্চুরি। সমস্যাটা শুরু হয় এর পরই। সে সমস্যাও বড় বিচিত্র। ঘাসের প্রতি চোখের এলার্জি! পানিতে মাছের এলার্জির সঙ্গে তুলনা করলে উপমাটা হয়তো একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যায়, কিন্তু মাছের যেমন পানিতে, একজন ক্রিকেটারেরও তো তেমনি ঘাসেই বিচরণ। সেটির প্রতি এলার্জি হলে আর খেলবেন কিভাবে!

এমন একটা শুরুর পরও লরেন্স রো শেষ পর্যন্ত তাই আক্ষেপের এক গল্পই। যা হয়েছে, সেটি ভুলে গিয়ে 'কী হতে পারত' আফসোস!