ক্রিকেট ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে প্রতিটি দিনেই দেখা মিলবে কোনো না কোনো স্মরণীয় ঘটনার। তবে ১৮ এপ্রিলের মতো এমন ঘটনার ঘনঘটা খুঁজে পাওয়া যাবে খুব কম দিনেই। কত কিছুই না হয়েছে এই দিনে—এক বাঁহাতি জিনিয়াসের রেকর্ড-ভাঙা ইনিংস, ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত ছক্কা, সর্বকালের অন্যতম সেরা এক ফাস্ট বোলারের জন্ম, দক্ষিণ আফ্রিকার টেস্টে প্রত্যাবর্তন, ক্রিকেটকে বদলে দেওয়া আইপিএলের জন্মও!
১৯৫৮
মার্শালের জন্ম
তাঁর ডাকনাম ছিল ম্যাকো। আত্মজীবনীর নাম ‘মার্শাল আর্ট’! ‘ছিল’ শব্দটাতেই বুঝে ফেলা উচিত, যাঁর কথা বলা হচ্ছে, তিনি আর এই পৃথিবীতে নেই। বেঁচে থাকলে আজ ৬৭তম জন্মদিন পালন করতেন। অথচ তাঁর স্ত্রী-পুত্রের কাছে এই ‘জন্মদিন’ এখন শুধুই বেদনাপ্লুত হওয়ার উপলক্ষ।
১৯৯৯ সালে মাত্র ৪১ বছর বয়সে ক্যানসার নিয়ে গেছে তাঁকে। তবে ক্রিকেট ইতিহাসে অমরই হয়ে আছেন ম্যালকম ডেনজিল মার্শাল। ৮১ টেস্টে ৩৭৬ উইকেট। এতেও মার্শাল আর্টের পুরো মহিমা প্রকাশিত নয়। গতি, সুইং, বুদ্ধিমত্তা—সব মিলিয়ে ‘কমপ্লিট ফাস্ট বোলার’ বলতে যা বোঝায়, ম্যালকম মার্শাল ছিলেন তা-ই। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সর্বজয়ী দলে ফাস্ট বোলারদের মিছিলের মধ্যেও আলাদা করে রাখতে হয় মার্শালকে। গ্রেটদের ভিড়ে তিনি যে ছিলেন গ্রেটেস্ট!
১৯৮৬
মহামূল্য সেই ছক্কা
ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত ছক্কা বোধ হয় এটিই। শারজায় অস্ট্রেলেশিয়া কাপের ফাইনালে জয়ের জন্য শেষ বলে পাকিস্তানের প্রয়োজন ৪ রান। চেতন শর্মার ফুল টসে ছক্কাই মেরে বসলেন জাভেদ মিয়াঁদাদ। ‘বড়ে মিয়াঁ’র ১১৪ বলে অপরাজিত ১১৬ রানের ইনিংসটিতেই পাকিস্তানের প্রথম কোনো বড় ট্রফি জয়। সবচেয়ে বিখ্যাত ছক্কা, সবচেয়ে দামি ছক্কাও। সেটি কিভাবে? শুধু শারজাপ্রবাসী পাকিস্তানিরাই নয়, আরবের ধনাঢ্য শেখরাও যে নেমে পড়েছিলেন মিয়াঁদাদকে উপহার দেওয়ার প্রতিযোগিতায়।
তা উপহার পাওয়ার মতোই খেলেছিলেন মিয়াঁদাদ। বলতে গেলে একাই শোকস্তব্ধ করে দিয়েছিলেন ভারতের কোটি কোটি মানুষকে। প্রথম তিন ব্যাটসম্যান কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্ত (৭৫), সুনীল গাভাস্কার (৯২) ও দিলীপ ভেংসরকারের (৫০) হাফ সেঞ্চুরিতে ভারত করেছিল ২৪৫। ২১৫ রানে পাকিস্তানের সপ্তম উইকেট পড়ে যাওয়ার পর ‘ম্যাচ শেষ’ বলেই ধরে নিয়েছিলেন সবাই। শুধু মিয়াঁদাদই যা মানতে চাননি। শেষ ওভারে যখন নবম উইকেট পড়ল, জয় থেকে পাকিস্তান তখন ৫ রান দূরে।
শেষ ব্যাটসম্যান তৌসিফ আহমেদ একটি বলই খেললেন, সেটিতে সিঙ্গেল নিয়ে স্ট্রাইক দিলেন মিয়াঁদাদকে। চেতন শর্মা ইয়র্কার করতে চেয়েছিলেন, হাত ফসকেই হোক অথবা মিয়াঁদাদ এগিয়ে দাঁড়ানোয় লেংথের গণ্ডগোলে, সেটি হয়ে গেল কোমর উচ্চতার ফুল টস। লেগ সাইডের দিকে ব্যাট চালিয়েই দু হাত তুলে উদযাপন করতে শুরু করলেন মিয়াঁদাদ।
মিয়াঁদাদের ওই ছক্কার তাৎপর্য শুধু একটা ট্রফি জয়েই শেষ হয়ে যায়নি। অনেক দিনের জন্য ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট লড়াইয়ের ভবিষ্যত গতিপথও নির্দিষ্ট করে দেয় তা। এর আগ পর্যন্ত এই দ্বৈরথে অনেক এগিয়ে ছিল ভারত, এরপর থেকেই শুরু হয় পাকিস্তানের আধিপত্য। ওই ছক্কা যে ভারতকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে অনেক দিন!
১৯৯২
দক্ষিণ আফ্রিকার প্রত্যাবর্তন
বারবাডোজে একটি টেস্ট ম্যাচ শুরু হলো ১৯৯২ সালের ১৮ এপ্রিল। শুধুই আরেকটি টেস্ট ম্যাচ? তা-ই যদি হতো, তাহলে কি আর সেটি এই লেখায় জায়গা পায়!
২২ বছর পর দক্ষিণ আফ্রিকার টেস্ট ক্রিকেটে প্রত্যাবর্তন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওই টেস্ট দিয়ে। গায়ের রং দিয়ে মানুষকে আলাদা করে রাখার আদিমতম নীতির কারণে ওই ২২ বছর বিশ্ব ক্রিকেটে নিষিদ্ধ হয়ে ছিল ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার পরই টেস্ট খেলার অধিকার পাওয়া দেশটি।
নিষিদ্ধ হওয়ার আগে সর্বশেষ সিরিজে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৪-০ টেস্টে জয়। যে সিরিজ ছিল অলিখিত টেস্ট ক্রিকেটের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ। দক্ষিণ আফ্রিকার সেই দলের ব্যারি রিচার্ডস, গ্রায়েম পোলক, এডি বারলোদের দীর্ঘশ্বাস তাই কান পাতলেই শোনা যেত। বর্ণবাদের কারণেই যে তাঁদের প্রতিভা রং ছড়াতে পারেনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে।
১৯৯৪
লারা-মহাকাব্য: প্রথম পর্ব
টেস্টের তৃতীয় দিনের খেলা শুরুর সময় ব্রায়ান লারার নামের পাশে ৩২০। নির্ঘুম আগের রাতের বর্ণনা আছে ব্রায়ান লারার আত্মজীবনী ‘বিটিং দ্য ফিল্ড’-এ—“রাত চারটায় সময়ও আমি জেগে, কিছুতেই ঘুম আসছে না। চোখের সামনে ভেসে উঠছিল তাদের মুখ—যারা বলে এসেছে ‘আমি এটা করতে পারব’—অনেকে তো অনেক বছর আগে। শুধু মনে হচ্ছিল, ওদের কাছেও আমার একটা দায় আছে। গলফ খেলতে যাওয়ার ইচ্ছাটা আবার প্রাণপণে দমন করলাম। ভাবতে লাগলাম সামনের লক্ষ্যগুলো নিয়ে—গ্রাহাম গুচের ৩৩৩, ডন ব্র্যাডম্যানের ৩৩৪, ওয়ালি হ্যামন্ডের ৩৩৬, হানিফ মোহাম্মদের ৩৩৭, লেন হাটনের ৩৬৪ এবং সবচেয়ে বড়টা, স্যার গ্যারি সোবার্সের ৩৬৫। মনে মনে কিছু শটও খেললাম। ঘামে ভিজে গেছে আমার হাতের তালু। জীবনে কখনো এত নার্ভাস বোধ করিনি।”
ইংল্যান্ডের বোলারদের চেয়েও বড় প্রতিপক্ষ ছিল ওই নার্ভাসনেস। দুটিকেই জয় করলেন লারা। অ্যান্ডি ক্যাডিককে চার মেরে সোবার্সকে ছুঁলেন, ক্রিস লুইসকে চার মেরে ছাড়িয়ে গেলেন তাঁকে। লারার বইয়ে দেওয়া আছে সময়টাও—সকাল ১১.৪৬ মিনিট। ৪৬ বছর ধরে ছায়াসঙ্গী রেকর্ডটার মরণ দেখতে মাঠেই ছিলেন স্যার গ্যারি সোবার্স। হইহই করতে করতে মাঠে নেমে যাওয়া দর্শকদের মধ্যে পথ করে নিয়ে উইকেটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন লারাকে।
মাঠ থেকে দর্শক বের করে আবার যখন শুরু হলো খেলা, তখনকার অনুভূতিটাও জেনে নিন লারার কাছ থেকেই—‘আমি ব্যাট করে যেতে চেয়েছিলাম। চেয়েছিলাম টেস্ট ম্যাচে চার শ রান করা প্রথম খেলোয়াড় হতে।’ কিন্তু এমন একটা অর্জনের অবশ্যম্ভাবী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আবেগের ঢেউ যে তখন ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে লারাকে! আর দুটি সিঙ্গেল নেওয়ার পর একটি চার—এরপরই কট বিহাইন্ড। স্কোরবোর্ডে লেখা—বোলারের নাম ক্যাডিক। আসলে হয়তো উইকেটটা নিল ওই দুকূলপ্লাবী আবেগই। ৭৬৬ মিনিটে ৫৩৮ বলে ৪৫টি চারখচিত ৩৭৫ রানে শেষ হলো লারার মহাকাব্যিক ইনিংস।
প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে টেস্টে ৪০০ করতে চেয়েছিলেন। দশ বছর পর অ্যান্টিগার সেই রিক্রিয়েশন গ্রাউন্ডে সেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষেই তা করেছেন লারা। ওই ৪০০ মুকুট পুনরুদ্ধারের ইনিংসও। ছয় মাস আগে রেকর্ডটা যে তাঁর কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার ম্যাথু হেইডেন।
লারার ৩৭৫-এর টেস্টে ইংল্যান্ডের অধিনায়ক মাইক আথারটন। আত্মজীবনী ‘ওপেনিং আপ’-এ সেই ইনিংসটির সময়কার অনুভূতি বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন, কখনো কখনো তাঁর মনে হচ্ছিল সব কিছু ভুলে গিয়ে লারার ব্যাটিং উপভোগ করাটাই ভালো। লারাকে প্রশংসার একটা জায়গা তো অসাধারণ। লারার ২৯১ হয়ে যাওয়ার পর প্রথমবারের মতো প্রথম স্লিপটা সরিয়ে নিয়েছিলেন। অ্যান্ড্রু ক্যাডিকের পরের বলটাই লারার ব্যাটের কানা নিয়ে ওই শূন্য স্থান দিয়ে বেরিয়ে যায়। আথারটনকে উত্ত্যক্ত করতে ইচ্ছে করেই ওভাবে খেলেছিলেন? আথারটন নিশ্চিত নন। কারণ হিসেবে বলেছেন, ‘লারার প্রতিভার মাত্রা সম্পর্কে ধারণা করতে পারাটাও আমার বোধশক্তির বাইরে।’
২০০৮
আইপিএল যুগের শুরু
এক সময় ক্রিকেটে দ্বিতীয় বিশ্বযুুদ্ধের আগে-পরের পার্থক্য বোঝাতে ‘যুদ্ধপূর্ব’ ও ‘যুদ্ধোত্তর’ কথা দুটির খুব ব্যবহার হতো। এরপর এল ‘প্যাকার-পূর্ব’ আর ‘প্যাকার-পরবর্তী’ যুগ। ডে-নাইট ক্রিকেট, রঙিন পোশাক, সাদা বল—এর সবই তো কেরি প্যাকারের ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেটের উপহার। ‘আইপিএল-পূর্ব’ আর ‘আইপিএল-পরবর্তী’ বিভাজনটাও তো একই রকম তাৎপর্যপূর্ণ। ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের আইপিএল বদলে দিয়েছে ক্রিকেটের মানচিত্রই। ক্রিকেট আর গ্ল্যামারের অপ্রতিরোধ্য মিশেলের সঙ্গে অঢেল অর্থ বদলে দিয়েছে ক্রিকেটারদের মনোজগতও।
আইপিএলের দেখানো পথে টেস্ট খেলুড়ে প্রতিটি দেশেই শুরু হয়েছে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ। শুধু টেস্ট খেলুড়ে দেশেই বা আটকে রাখা কেন; এর বাইরের অনেক দেশেও তো বসছে টি–টোয়েন্টির মেলা। ১৪ বছর আগে আজকের এই দিনেই যাত্রা শুরু হয়েছিল আইপিএলের, যেটির সুর বেঁধে দিয়েছিল ব্রেন্ডন ম্যাককালামের অবিশ্বাস্য এক ইনিংস। এরপর ক্রমশই বড় থেকে আর আরও বড় হয়ে ওঠা আইপিএল এখন এমন এক বাস্তবতা, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সূচিও ঠিক করতে হয় এটা মাথায় রেখে। আইপিএলই কি তাহলে ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে যুগ বদলের নাম!