ফারুকের নামে ‘কপি–পেস্ট’ অভিযোগে অনাস্থা আনা যায় তাঁদের বিরুদ্ধেও

ক্রীড়া উপদেষ্টার কাছে দেওয়া অনাস্থা প্রস্তাবে ফারুক আহমেদের বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ এনেছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) আট পরিচালক। যার মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ফারুক আহমেদকে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ না দিয়েই জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি) বিসিবি পরিচালক হিসেবে তাঁর মনোনয়ন বাতিল করেছে।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়েছে, পুরো স্ক্রিপটটা যেন লেখাই ছিল! পরশু রাতে ক্রীড়া উপদেষ্টা ফারুককে জানালেন, সরকারের ‘ঊর্ধ্বতন মহল’ তাঁকে আর বিসিবি প্রধান পদে ‘কন্টিনিউ’ করতে চাচ্ছে না। ফারুক জানতে চাইলেন, ‘কেন?’ কোনো উত্তর পাননি। এরপর কাল দুপুরে ফারুক সংবাদমাধ্যমে জানিয়ে দিলেন, তিনি পদত্যাগ করবেন না। কারণ, কেন তাঁকে পদত্যাগ করতে হবে, তার কোনো ব্যাখ্যা তাঁকে দেওয়া হয়নি।

এর কিছুক্ষণের মধ্যেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হয়ে সংবাদমাধ্যমে এল ফারুকের বিরুদ্ধে উপদেষ্টার কাছে দেওয়া আট বিসিবি পরিচালকের অনাস্থা প্রস্তাব। পরপরই এল বিপিএল নিয়ে গঠন করা সত্যানুসন্ধান কমিটির প্রতিবেদন। বিপিএলের সঙ্গে অনেকের সংশ্লিষ্টতা থাকলেও প্রতিবেদনে ঢালাওভাবে সবকিছুর দায় ফারুককে দেওয়া হয়েছে। এরপর কাল রাতেই এনএসসি বিসিবি পরিচালক হিসেবে ফারুকের মনোনয়ন বাতিল করে।

অস্ত্র সব তাক করাই ছিল। ফারুক নিজ থেকে হার মেনে নিলে এত কিছু হয়তো হতো না। সেটা করেননি বলেই একটার পর একটা অস্ত্র ছুড়ে একপেশে খেলায় মেতে উঠে তাঁকে ‘ক্ষমতাচ্যুত’ করা হলো এবং সেটা কোনো আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে।
ফারুক বোর্ডে এনএসসির মনোনীত পরিচালক ছিলেন। কোনো সমস্যা থেকে থাকলে আগে এনএসসি সেসব নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলবে, এটাই স্বাভাবিক হতো। কিন্তু অদৃশ্য কোনো জাদুবলে এনএসসি সে পথে যায়নি।

অনাস্থা প্রস্তাবে আনা অভিযোগগুলোকে ফারুক বলেছেন ‘কপি–পেস্ট’ অভিযোগ। অর্থাৎ গত ১২ বছরে পরিচালকেরা নিজেরা যা যা করেছেন, সব এখন ফারুকের নামের পাশে জুড়ে দিচ্ছেন। যদি তা–ই হয়, অনাস্থা তো এই পরিচালকদের বিরুদ্ধেও আনা যায়!

তার আগে বরং একটু বিশ্লেষণী দৃষ্টিতে দেখা যাক কী আছে আট পরিচালকের অনাস্থা প্রস্তাবে, যেটির এত শক্তি?

ফারুক স্বেচ্ছাচারী, কর্তৃত্ববাদী

বাংলাদেশের ক্রিকেটে ফারুককে যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে চেনেন, তাঁরা জানেন ফারুক কঠোর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এবং স্পষ্টভাষী একজন মানুষ। কাজের ক্ষেত্রে অনেক সময় তাঁর আচরণে রূঢ়তা প্রকাশ পায়। আট পরিচালক ফারুকের এই চরিত্রকেই হয়তোবা স্বেচ্ছাচারী ও আধিপত্যবাদী বোঝানোর চেষ্টা করেছেন অনাস্থা প্রস্তাবে।

কিন্তু এই আট–নয় মাসে ফারুকের ‘স্বেচ্ছাচারী ও কর্তৃত্ববাদী’ আচরণ কি আওয়ামী লীগের সময়ের সাবেক বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসানের চেয়ে বেশি ছিল? স্বেচ্ছাচারী, কর্তৃত্ববাদী, আধিপত্যবাদী—এসব শব্দ তো নাজমুল হাসানের সঙ্গেই বেশি যেত, যাঁর বোর্ড সভায় ভিন্নমত প্রদানের সুযোগ ছিল না বলে ফারুকের প্রতি অনাস্থা আনা পরিচালকেরাই বিভিন্ন সময় বলেছেন। কই তখন তো তাঁরা কেউ নাজমুল হাসানের প্রতি অনাস্থা আনেননি? উল্টো হীরক রাজার পারিষদের ব্যক্তিত্বহীন সদস্যদের মতো সবকিছুতে ওপর–নিচ মাথা নেড়ে গেছেন।

বিসিবির সাবেক সভাপতি ফারুক আহমেদ

ঘরোয়া ক্রিকেটে দুর্নীতি–অনিয়ম বিগত বোর্ডের সময়ই সবচেয়ে বেশি হয়েছে। পাতানো ম্যাচ আর পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিংয়ের বিষে বিষাক্ত হয়েছে তৃণমূলের ক্রিকেট। এসব নিয়ে বিসিবির পরিচালকদের কেউ কোনো দিন একটা প্রতিবাদ করেছেন বলে শোনা যায়নি।

আট পরিচালকের মধ্যে দুজন আছেন, যাঁরা নাজমুল হাসানের সময় সিসিডিএম প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন, ক্লাব ক্রিকেটের নষ্ট রাজনীতির চর্চা হয় যেখানে। কেউ বলতে পারবেন, তাঁদের সময়ে সিসিডিএম পাতানো ম্যাচ আর পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিংয়ের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে? উল্টো তাঁদের ক্লাব এবং চিঠিতে স্বাক্ষর করা আরও কয়েকজন প্রভাবশালী পরিচালকের ক্লাবও সেই প্রক্রিয়ার সুবিধা নিয়েছেন।

২০১৮ সালে এ নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে বিসিবির সাবেক প্রভাবশালী পরিচালক ইসমাইল হায়দার মল্লিক বলেছিলেন, ঘরোয়া ক্রিকেটের ৫৬টি ক্লাবই ‘একই ছায়াতলে’ ছিল, যারা পাতানো ম্যাচ আর পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিংয়ের অবৈধ সুবিধা নিয়ে থাকত।
ওই ৫৬ ক্লাবের মধ্যে ফারুকের বিরুদ্ধে অনাস্থা আনা পরিচালকদের কারও কারও ক্লাবও ছিল, ঘরোয়া ক্রিকেটে ক্যানসারের মতো ছড়িয়ে পড়া দুর্নীতির সুবিধা তাঁরাও বিভিন্ন সময় নিয়েছিলেন। এখানে উল্লেখ করা দরকার, মল্লিকের ওই বক্তব্যের প্রতিবাদ এই পরিচালকদের কেউই করেননি। উল্টো নিজ ক্লাবের স্বার্থে অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়ে গেছেন উটপাখি হয়ে।

ভালো কথা, নাজমুল হাসানের বোর্ডে যে পরিচালক বিসিবির আম্পায়ার্স কমিটির প্রধান থাকার সময় পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিং নির্লজ্জভাবে বেড়ে গিয়েছিল, তিনিও কিন্তু ফারুকের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবে স্বাক্ষর করেছেন বাকি সাতজনের সহযোগী হয়ে।

কমিটি গঠনে বিলম্ব ও কাজ করতে না দেওয়ার অভিযোগ

আট পরিচালকের অভিযোগ, ফারুক আহমেদ দায়িত্ব নেওয়ার পাঁচ মাস পর বিসিবির বিভিন্ন কমিটি পুনর্গঠন করেছেন, তা–ও সবাইকে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে দিচ্ছেন না। এককভাবে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।

তো এই আট পরিচালক কি জানেন, ‘ফ্যাসিস্ট’ সরকারের বোর্ডে ‘ফ্যাসিস্ট’দের ‘দোসর’ ছিলেন বলে বিসিবিতে তাঁদের অনেকের কার্যক্রমই সীমিত রাখার নির্দেশনা ফারুকের প্রতি ওপর থেকেই ছিল? শুরুর দিকে সে জন্যই ফারুক বোর্ড চালিয়েছেন এক–দুজন পরিচালককে নিয়ে।

আট পরিচালকের বেশ কয়েকজন আগের সরকারের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন এবং সুবিধাভোগীও ছিলেন। একজন আবার পূর্বাচলে প্রস্তাবিত শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম (ফারুক আহমেদ দায়িত্ব নিয়ে শুরুতেই অপচয়ের সে প্রকল্প বাতিল করে দেন) প্রজেক্ট কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। ৯০০ কোটি টাকা বাজেটের স্টেডিয়ামটির নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার আগেই এর সম্ভাব্য খরচ বেড়ে হয়ে গিয়েছিল প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। অস্ট্রেলিয়ার একটি প্রতিষ্ঠানকে বিতর্কিতভাবে ৭৬ কোটি টাকায় পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল স্টেডিয়ামটির জন্য। দুদক বিসিবির যেসব অনিয়মের তদন্ত করছে, তার মধ্যে আছে এটাও।

ফারুকের ‘স্বেচ্ছাচারী কর্মকাণ্ড এবং ক্রিকেট অপারেশন্স বিভাগে অযাচিত হস্তক্ষেপের’ কারণেই নাকি বাংলাদেশ র‍্যাঙ্কিংয়ে ১০–এ গিয়ে ঠেকেছে। ভাবতে কষ্ট হয় এ রকম অদ্ভুত, হাস্যকর এবং অক্রিকেটীয় যুক্তি তুলে ধরাদের মধ্যে দেশের একজন প্রাজ্ঞ ক্রিকেট ব্যক্তিত্বও আছেন, যিনি নিজে বর্তমানে বিসিবির ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের প্রধান।

বাতিল হওয়া শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামের প্রজেক্ট কমিটির আহ্বায়ক আবার জাতীয় স্টেডিয়ামে (বর্তমান নাম) ফ্লাডলাইট লাগানোর কাজ করেছেন সাবেক ক্রীড়ামন্ত্রী ও বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসানের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে।

তিনিসহ আট পরিচালকের বেশ কয়েকজনের ব্যাপারেই শুরুতে ফারুকের প্রতি নির্দেশনা ছিল, ফারুক যেন তাঁদের বোর্ডের কার্যক্রম থেকে দূরে রাখেন। একই কারণে আগের বোর্ডের নিয়োগকৃত অনেক বেতনভুক্ত কর্মকর্তা–কর্মচারীকেও নিষ্ক্রিয় রাখতে হয়েছে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় স্বাভাবিকভাবেই তখন বোর্ডের কার্যক্রমে ধীরতা এসেছে, অনেক সিদ্ধান্ত ফারুককে নিতে হয়েছে একা। আর এখন বিতর্কিত সেসব পরিচালকের অনাস্থাতেই ফারুকের পরিচালক মনোনয়ন বাতিল করল এনএসসি!

আরেকটি অভিযোগ

সাবেক কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহেকে ফারুক একক সিদ্ধান্তে বিদায় করেছেন। এটা ঠিক যে শ্রীলঙ্কান কোচের ওপর আগে থেকেই একটা রাগ ছিল ফারুকের। প্রধান নির্বাচকের পদ ফারুক ছেড়ে দিয়েছিলেন হাথুরুসিংহেকে তখনকার সভাপতি নাজমুল হাসানের অন্যায় কর্তৃত্ব দেওয়ার প্রতিবাদে।

কিন্তু হাথুরুসিংহেকে বিদায় করার সময় ফারুকের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ কি করেছিলেন আট পরিচালকের কেউ? কেউ কি বলেছিলেন, ‘রেখে দিন হাথুরুসিংহেকে।’ না, সে রকম কিছু তখন অন্তত শোনা যায়নি। বরং এই আট পরিচালকের কেউ কেউ টক শো আর কলামে নিয়মিত হাথুরুসিংহের কঠোর সমালোচনাই করে গেছেন। বোর্ড সভাতে করেছেন অন্য পরিচালকেরাও। বর্তমানে প্রভাবশালী হয়ে ওঠা একজন সাবেক ক্রিকেটারও পিছু লেগেছিলেন হাথুরুসিংহের।

সাবেক কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে

চিঠিতে হাথুরুসিংহের প্রসঙ্গে টেনে আট পরিচালক তাঁদের অজান্তেই একটা বিষয় মনে করিয়ে দিলেন। ২০১৬ সালে তখনকার বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসানের অন্যায় সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে কিন্তু প্রধান নির্বাচকের চাকরিতে ইস্তফা দেওয়ার সাহস দেখিয়েছিলেন ফারুক। অনাস্থা জ্ঞাপন করা আট পরিচালকের সাতজনই তো নাজমুল হাসানের বোর্ডে ছিলেন। ফারুকের মতো পদত্যাগের সাহস দেখানো দূরের কথা, কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদও কোনো দিন তাঁরা করেননি। হয়তো নাজমুল হাসানের বোর্ডে কোনো অন্যায় তাঁরা দেখেনইনি।

র‍্যাঙ্কিংয়ে অবনমনের দোষও ফারুকের! কোথায় গেল ক্রিকেট–জ্ঞান

অনাস্থা প্রস্তাবে প্রকারান্তরে মেনে নেওয়া হয়েছে, সাবেক সভাপতি নাজমুল হাসানের সময়ই দেশের ক্রিকেটের অবস্থা ভালো ছিল। কারণ, তাঁরা চিঠিতে লিখেছেন, বিগত বছরগুলোতে (আওয়ামী লীগের সময়) বাংলাদেশ দল খুব ভালো খেলে র‍্যাঙ্কিংয়ে ৬–৭ নম্বরে উঠে এসেছিল। কিন্তু এখন জাতীয় দলের পারফরম্যান্স নিম্নমুখী। ফারুকের ‘স্বেচ্ছাচারী কর্মকাণ্ড এবং ক্রিকেট অপারেশন্স বিভাগে অযাচিত হস্তক্ষেপের’ কারণেই নাকি এখন তা ১০–এ গিয়ে ঠেকেছে।

পাকিস্তানের বিপক্ষেও হারছে বাংলাদেশ

ভাবতে কষ্ট হয় এ রকম অদ্ভুত, হাস্যকর এবং অক্রিকেটীয় যুক্তি তুলে ধরাদের মধ্যে দেশের একজন প্রাজ্ঞ ক্রিকেট ব্যক্তিত্বও আছেন, যিনি নিজে বর্তমানে বিসিবির ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের প্রধান। জাতীয় দল খারাপ খেললে কোচ–ক্রিকেটারদের পর সবার আগে দায়টা যাওয়ার কথা তাঁর ওপর। আর তাঁর বিভাগ যদি সত্যি সত্যি সভাপতির ‘অযাচিত হস্তক্ষেপের’ শিকার হয়ে থাকে, তিনি কি সেটা নিয়ে কখনো কোনো প্রতিবাদ করেছেন? তিনি নিজেকে এককভাবে বলবেন, বোর্ড সভাপতির কারণেই দল খারাপ করছে?

শুধু বাংলাদেশ নয়, ক্রিকেট–বিশ্বের অনেক দেশের সংবাদমাধ্যমেরই এটা জানা যে বাংলাদেশ দলের কার্যক্রমে কত বেশি হস্তক্ষেপ ছিল সাবেক বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসানের। একজন সাবেক ক্রিকেটার হয়েও সে তুলনায় ফারুক আহমেদ জাতীয় দলের কার্যক্রম নিয়ে বলতে গেলে কোনো নাকই গলাননি। জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের সঙ্গে কথা বললেই সেটা জানা যায়। অথচ নাজমুল হাসানের দল–সম্পৃক্ততায় সমর্থন দিয়ে তাঁর পেছনে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি চাটুকারের হাসি হাসারাই এখন ফারুকের বিরুদ্ধে হাস্যকর অভিযোগ আনছেন। বলিহারি তাঁদের ক্রিকেট–জ্ঞান!

গঠনতন্ত্র সংশোধন ও অনিয়ম–দুর্নীতি বন্ধ না করার অভিযোগ

অনাস্থা প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ফারুক আহমেদকে বিসিবি সভাপতির দায়িত্ব দেওয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল গঠণতন্ত্রের পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করা এবং বিগত সরকারের আমলে বিসিবির অনিয়ম ও দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রণয়ন করা। তা ফারুক তো সে পথেই ছিলেন! তাঁকে এগোতে দিচ্ছিলেন না তো অন্য পরিচালকেরাই!

ফারুক আহমেদের সভাপতিত্বে বিসিবির এক সভায় গঠণতন্ত্র সংশোধনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল পাকিস্তান থেকে অনাস্থা প্রস্তাবে সই করা আট পরিচালকের একজন নাজমূল আবেদীনকে। তিনি যুগযোপযোগী একটা গঠণতন্ত্রের খসড়া তৈরিও করেছিলেন। কিন্তু সেটা কেন আলোর মুখ দেখছে না তা সবাই জানেন, ক্লাব রাজনীতির শিকার হয়ে।

সংশোধন প্রস্তাবে বিসিবিতে ক্লাবের ক্ষমতা কমানোর প্রস্তাব করায় ঢাকার ক্লাবগুলো নাজমূল আবেদীনের পদত্যাগ পর্যন্ত চেয়েছে, যে ক্লাবগুলোর কয়েকটির শীর্ষ কর্মকর্তারাই আবার অনাস্থা প্রস্তাবে সই করে প্রশ্ন তুলছেন—ফারুক কেন গঠণতন্ত্র যুগোপযোগী করতে পারলেন না!

আর দুর্নীতির তদন্ত তো হচ্ছেই

বিগত বোর্ডের দুর্নীতির তদন্ত এরই মধ্যে দুদক শুরু করেছে। সভাপতি হিসেবে ফারুক আহমেদ বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন, দুদক কর্মকর্তাদের যেন যাবতীয় সহযোগিতা করা হয় এবং সেটি করাও হচ্ছে। দুদক কর্মকর্তারা এ পর্যন্ত তিনবার বিসিবিতে অভিযান চালিয়ে নানা তথ্য সংগ্রহ করেছেন। ফারুক আহমেদ তাদের কার্যক্রমে কোনো বাধা দিয়েছেন, এমন অভিযোগ দুদক করেনি।

তবে সূত্র জানিয়েছে, দুদক কর্মকর্তারা যখন বোর্ডে এসে কাগজপত্র যাচাই করেন, তখন আগের বোর্ডেও ছিলেন, এই বোর্ডেও আছেন এবং অনাস্থা প্রস্তাবে সই করেছেন—এমন এক শীর্ষ বোর্ড পরিচালক তাঁদের আশপাশে ঘুরঘুর করেন, কখনো কখনো পাশে গিয়ে বসেন। এটা শুনে ফারুকই তাঁকে পরামর্শ দিয়েছেন সেখানে না থাকার জন্য, যেন দুদক স্বাধীন ও নিরবচ্ছিন্নভাবে তাদের কাজ করতে পারে।

বিগত বোর্ডের দুর্নীতির তদন্ত এরই মধ্যে দুদক শুরু করেছে

বিপিএল–বিতর্ক ও তালিকাভুক্ত কোম্পানিকে কাজ না দেওয়ার অভিযোগ

বিপিএলের বিভিন্ন অনিয়মের দায়ও এককভাবে ফারুককে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। যদিও সে দায় বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের সদস্যসচিবসহ অন্যদের ওপরও বর্তায়। অনাস্থা প্রস্তাবে দাবি করা হয়েছে, ফারুক আহমেদ বিসিবির তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানকে সুযোগ না দিয়ে তাঁর পছন্দের নিম্নমানের ও অনিবন্ধিত ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিকে কাজ দিচ্ছেন।

এ অভিযোগটি তাঁরা কার স্বার্থে তুললেন, সেটি একটু খতিয়ে দেখা দরকার। কারণ, বিসিবির তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর বেশির ভাগই বিগত বোর্ডের মাধ্যমে তালিকাবদ্ধ হয়েছে। নাজমুল হাসানের বোর্ড নিয়মনীতি মেনে তাঁদের তালিকাভুক্ত করেছে কি না, নিয়মনীতি মেনে তাদের কাজ দিত কি না, এসব ব্যাপারে কতটা নিশ্চিত আট পরিচালক? আর নতুন যেসব প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হচ্ছে, ঢালাওভাবে অভিযোগ না করে তাদের পরিচয়টা সাহস করে সুনির্দিষ্টভাবে বললেই তো দুদকের কাজ কিছুটা কমে যায়!

বিসিবি সভাপতি হিসেবে ফারুক আহমেদের সমস্যা থাকতে পারে। হতে পারে তিনি কোনো অনিয়ম করেছেন, স্বজনপ্রীতি করেছেন। কিন্তু সেসব অভিযোগ তোলামাত্র তাঁকে পত্রপাঠ বিদায় করতে হবে কেন? এসব অভিযোগের ব্যাপারে তো আগে তদন্ত হতে হবে! ফারুককে আত্মপক্ষ সমর্থন দিতে হবে! সেগুলো না করেই যখন বিসিবির পরিচালক হিসেবে তাঁর মনোনয়ন বাতিল করা হয়, বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না, আসলেই ‘কপি–পেস্ট’ অভিযোগ দিয়ে তৈরি স্ক্রিপটটা আগে থেকেই লিখে রাখা। স্ক্রিপ্টের লেখকটি কে, সেটাই হলো কথা!