এমন নয় যে শিরোনামের প্রশ্নটির উত্তর জানা নেই। ক্যান্ডির ইতিহাস–ঐতিহ্য, পাহাড়, গাঢ় সবুজ প্রকৃতি, নানা রকম পাখি, মনোরম আবহাওয়া—এখানে বেড়াতে আসার আকর্ষণের তালিকা করতে গেলে অনেক লম্বাই হয়ে যাবে তা। বরং উল্টো করে বলা উচিত, কেন ক্যান্ডিতে ঘুরতে আসবে না মানুষ!
এক ‘টেম্পল অব দ্য টুথ’কে ঘিরেই যে কত আগ্রহ, সে তো ২০২৩ সালে এশিয়া কাপ কাভার করতে এসেই দেখে গেছি। বৌদ্ধধর্মালম্বীরাই শুধু নন, বিশ্বের নানা দেশ থেকে আসা সব ধর্মের সব পর্যটক একবার হলেও দেখে যান ক্যান্ডি লেকের পাড়ের এই প্রাচীন মন্দির, যেখানে গৌতম বুদ্ধের দাঁতের নিদর্শন রাখা আছে বলে বিশ্বাস বৌদ্ধদের। অবশ্য সেই দুর্লভ বস্তু দেখার সুযোগ মেলে প্রতি পাঁচ বছরে একবারই।
১৯৮৮ সালে ইউনেসকো শ্রীলঙ্কার একসময়ের রাজধানী ক্যান্ডিকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে মূলত ওল্ড রয়্যাল প্যালেস কমপ্লেক্সের মধ্যে থাকা ‘টেম্পল অব দ্য টুথ’-এর ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় গুরুত্বের সুবাদেই।
তারপরও মনে হলো, ক্যান্ডি ঘুরতে আসা দু–চারজনেক জিজ্ঞাসা করেই দেখা যাক, কেন তাঁরা বেড়ানোর জন্য এই শহরকে বেছে নিলেন? তাঁদের মুখ থেকেই শোনা যাক, কার আগ্রহের জায়গা কোথায়।
ক্যান্ডিতে পাখি দেখতে এসে মন খারাপ করে ফিরে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। পুরো শ্রীলঙ্কাই নানা রকম পাখির অভয়ারণ্য, ক্যান্ডি সম্ভবত আরও বেশি। সন্ধ্যা যত ঘনিয়ে আসে, শহরে ততই বেড়ে যায় পাখির কিচিরমিচির।
কী সৌভাগ্য! রাতে প্রশ্ন ঠিক করে আজ সকাল সকাল উত্তর খুঁজতে রাস্তায় নেমে একেবারে ঘরের দরজায় পেয়ে গেলাম এক কপোত–কপোতীকে! সুবেশী দম্পতি উল্টো দিকের লেকঘেঁষা ফুটপাতে দাঁড়িয়ে কুইন্স হোটেল পেছনে রেখে নানা ভঙ্গিতে ছবি তুলছেন। আগের রাতেও তরুণ এক টিকটক গ্রুপকে শুটিং করতে দেখেছি ক্যান্ডিতে আমার ঠিকানা এই হোটেলের সামনে।
ক্যান্ডির ঐতিহাসিক কুইন্স হোটেল ‘টেম্পল অব দ্য টুথ’–এর ঠিক উল্টো দিকে। একসময়ের মালাবার স্ট্রিট, বর্তমানে ডি এস সেনানায়েকে ভিধিয়ায় (সড়ক) এর অবস্থান। ১৬০ বছরের পুরোনো ইতিহাসকে ধরে রেখেছে শ্রীলঙ্কার অন্যতম প্রাচীন তিন তারকা হোটেলটি। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ধাঁচের কুইন্স হোটেল ভবনের স্থাপত্য আর অন্দরসজ্জায় এখনো আছে পুরোনো ঘ্রাণ। সেই সময়ের ব্যবহার্য সামগ্রী সাজিয়ে রাখা এখানে–ওখানে, পুরোনো পলেস্তারার দেয়ালে ঝোলানো ইতিহাসের খণ্ড খণ্ড ছবি।
হোটেলে দুই স্তরবিশিষ্ট কলাপসিবল গেটের লিফটটি কত বছর আগের, কে জানে! সেই লিফট দিয়ে আবার চারতলার মাত্র দোতলা পর্যন্তই ওঠানামা করা যায়। পরের দুই তলায় যেতে দোতলার এদিকে–ওদিকে আছে কয়েকটি প্রকাণ্ড কাঠের সিঁড়ি। কাঠের মেঝের সরু করিডরে মচমচিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যদি একবার সিঁড়ি গুলিয়ে ফেলেন, করিডরে করিডরেই দিতে হবে কয়েক চক্কর।
শহরের বুকে শুয়ে থাকা নয়নাভিরাম ক্যান্ডি লেক মাছে ভরপুর, কিন্তু মাছ ধরে না কেউ। পর্যটকদের ছিটিয়ে দেওয়া খাবার খেতে মাছেরা ঝাঁক বেঁধে চলে আসে একেবারে লেকের পাড়ে।
রাজ–সুনীতা দম্পতি ভারতীয়, তবে ইতালিপ্রবাসী। বছরে একবার ঘুরতে বের হন, এবার এসেছেন শ্রীলঙ্কায়। আমার মতোই গল–কলম্বো হয়ে তাঁরা এখন দুই দিনের জন্য ক্যান্ডিতে। পাহাড়ঘেরা ক্যান্ডিতে রাজ–সুনীতার মূল আকর্ষণ সবুজ প্রকৃতি। শহরের একটু বাইরের কী একটা রিসোর্টে উঠেছেন সে জন্য। তবে ‘টেম্পল অব টুথ’ আর ক্যান্ডির ইতিহাস–ঐতিহ্যেও তাঁদের আগ্রহ ব্যাপক। মন্দির থেকে বেরোনোর পর কুইন্স হোটেলের পুরোনো স্থাপত্য সে কারণেই ছবি তোলার জন্য টানল এই দম্পতিকে।
ক্যান্ডি লেকের পাড়ে ডেনমার্কের দুই তরুণকে পাওয়া গেল ক্যামেরা হাতে। তবে নিজেদের ছবি তুলছিলেন না তাঁরা, তুলছিলেন লেকে ভেসে বেড়ানো সারস পাখির ছবি। মূলত পাখির ছবিই তোলেন এই দুই তরুণ। আলাপচারিতায় জানান, তাঁদের ক্যান্ডি আসার মূল উদ্দেশ্য পাহাড়ি এলাকায় গিয়ে নানা রকম পাখির ছবি তোলা।
ক্যান্ডিতে এসে প্রথম দিনেই তাঁরা ঘুরে এসেছেন রয়্যাল বোটানিক্যাল গার্ডেনে, প্রকৃতিপ্রেমী পর্যটকদের জন্য যেটি আরেক আকর্ষণের জায়গা। তরুণদের একজন ক্যামেরার স্ক্রিনে দেখালেন পেখম মেলা ময়ূরের চমৎকার এক ছবি। পাহাড়ের কোন রাস্তায় নাকি নির্ভয়ে হেঁটে বেড়াতে দেখেছেন ময়ূরটিকে।
ক্যান্ডিতে পাখি দেখতে এসে মন খারাপ করে ফিরে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। পুরো শ্রীলঙ্কাই নানা রকম পাখির অভয়ারণ্য, ক্যান্ডি সম্ভবত আরও বেশি। সন্ধ্যা যত ঘনিয়ে আসে, শহরে ততই বেড়ে যায় পাখির কিচিরমিচির। স্থানীয় এক দোকানি জানান, পাখিরা ভোর হতেই উড়ে যায় আশপাশের পাহাড় আর বনের গাছগাছালিতে। সারা দিন সেখানে কাটিয়ে শহরের গাছগাছালিতে ফিরে আসে সন্ধ্যায়। আর শহরে যেহেতু গাছের অভাব নেই, সন্ধ্যার পর কিচিরমিচির শব্দে মুখর হয়ে উঠতে থাকে সব জায়গাই।
পাল্লেকেলের আসল সৌন্দর্য প্রকৃতি, যেটা গোটা ক্যান্ডি; আরও বড় করে দেখলে গোটা শ্রীলঙ্কারই সৌন্দর্য। হুনাসগিরিয়া আর রিকিল্লাগাসকাডা–হানতানে পর্বতশ্রেণি ঘিরে রেখেছে স্টেডিয়ামটিকে। পাহাড়ঘেরা এই মাঠ যেন সবুজের বুক চিরে বানানো একটুকরা সবুজ ভূস্বর্গ!
লেকপাড়ের হোটেল রুম থেকে তো অনেক রাতেও সেই শব্দ শোনা গেল বার কয়েক। তবে পাখিরা কেন পাহাড়ে যায়, কেনই–বা সেখানে থেকে না গিয়ে নিয়ম করে প্রতি সন্ধ্যায় শহরে ফিরে আসে, সেটা আজন্ম রহস্য ক্যান্ডির বাসিন্দা ওই দোকানির কাছেও।
কাল সন্ধ্যায় ওয়ার্ড স্ট্রিটে দাঁড়িয়ে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হলো পাখি দর্শন আর কান ঝালাপালা করা কিচিরমিচির শ্রবণের। ‘টেম্পল অব টুথ’–এর সামনে গেলে দেখা মিলবে ঝাঁকে ঝাঁকে কবুতরের। মানুষ খাবার দিয়ে যাচ্ছে, কবুতরের দল মন্দিরের সামনের চত্বরে নির্ভয়ে খাবার খাচ্ছে। কেউ তাদের তাড়িয়ে দিচ্ছে না, পাশ দিয়ে মানুষ হেঁটে গেলেও তারা ভয়ে উড়ে যাচ্ছে না।
শহরের বুকে শুয়ে থাকা নয়নাভিরাম ক্যান্ডি লেক মাছে ভরপুর, কিন্তু মাছ ধরে না কেউ। পর্যটকদের ছিটিয়ে দেওয়া খাবার খেতে মাছেরা ঝাঁক বেঁধে চলে আসে একেবারে লেকের পাড়ে। পাখিদের মতো ক্যান্ডির মাছেরাও হয়তো জানে, এই শহরে তাদের কোনো ভয় নেই।
তবে বানর থেকে সাবধান থাকা ভালো এবং কেন, সেটা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না। কুইন্স হোটেলের জানালার কাচেও অতিথিদের জন্য সেঁটে দেওয়া আছে সাবধান বাণী। তবে সেটা এতটাই প্রশ্রয়ী ভাষায় যে বানরকে আপনার পরিবারের কোনো দুষ্টু ছেলে বলেই মনে হবে। জানালায় লেখা, ‘চঞ্চল বানরগুলো হয়তো আপনাকে আনন্দ দেবে। তবে তারা দুষ্টু এবং আপনার ঘর বা বারান্দা থেকে জিনিসপত্র তুলে নিয়ে যেতে পারে।’
ক্যান্ডিতে আসার উদ্দেশ্য ক্রিকেট হলে আপনি অবশ্যই আসবেন পাল্লেকেলে আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে। স্টেডিয়াম তো নয়, যেন শিল্পীর আঁকা ছবি! মাঠ, গ্যালারি, প্রেসবক্স, ড্রেসিংরুম সব স্টেডিয়ামেই থাকে, এখানেও আছে বেশ পরিপাটিভাবে। তবে পাল্লেকেলের আসল সৌন্দর্য প্রকৃতি, যেটা গোটা ক্যান্ডি; আরও বড় করে দেখলে গোটা শ্রীলঙ্কারই সৌন্দর্য। হুনাসগিরিয়া আর রিকিল্লাগাসকাডা–হানতানে পর্বতশ্রেণি ঘিরে রেখেছে স্টেডিয়ামটিকে। পাহাড়ঘেরা এই মাঠ যেন সবুজের বুক চিরে বানানো একটুকরা সবুজ ভূস্বর্গ!
ক্যান্ডিকে প্রকৃতি যেমন উদারভাবে বিলিয়েছে তার ঐশ্বর্য, ক্যান্ডির মানুষেরও প্রকৃতির প্রতি উদারতা দেখাতে এতটুকু কার্পণ্য নেই। অলিখিত এই দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্কের কারণেই হয়তো এখানে পাখিরা গান গায়, মাছেরা হাসে, ময়ূর নির্ভয়ে নাচে আর ক্রিকেটের আবহে ভর করে মুগ্ধতা।
ক্যান্ডিতে কেন আসবে না মানুষ!