ইডেনের সেই বিকেলটি ছিল শুধুই রোহিত শর্মার
ইডেনের সেই বিকেলটি ছিল শুধুই রোহিত শর্মার

ফিরে দেখা

একটি ক্যাচ মিস, একটি ইনিংস, এবং ইতিহাস—ইডেনের ১৩ নভেম্বর

ক্রিকেটের ভাষায় ম্যাচটা ছিল ‘ডেড রাবার’, মরা ম্যাচ। ভারত-শ্রীলঙ্কার পাঁচ ওয়ানডের সিরিজ। প্রথম তিনটিতেই জিতে ভারত সিরিজ নিশ্চিত করে ফেলে আগেভাগেই। চতুর্থ আর পঞ্চম ম্যাচ হয়ে পড়ে আনুষ্ঠানিকতার। এ ধরনের ম্যাচকে অনেক সময় দলগুলো নেয় এক ধরনের সুযোগ হিসেবে। যে খেলোয়াড়দের আগের ম্যাচগুলোয় সুযোগ দেওয়া যায়নি, বা যে খেলোয়াড়কে ভবিষ্যতের জন্য বাজিয়ে দেখা দরকার, তাঁদের নামিয়ে দেওয়া হয় এমনসব ম্যাচে।

কলকাতার ইডেন গার্ডেনে সিরিজের চতুর্থ ওয়ানডেতে ভারতও সেটিই করে। একাদশে আনা হয় পাঁচটি পরিবর্তন। ম্যাচটি অবশ্য ইডেন গার্ডেনের জন্য বিশেষই ছিল। ক্রিকেট ইতিহাসের বিখ্যাত মাঠটির ১৫০ বছর পূর্তি বলে কথা। সেদিন বিকেলে ইডেন গার্ডেনের গ্যালারিতে যাঁরা জড়ো হয়েছিলেন, তাঁদের অবশ্য জানার কথা নয় ক্রিকেট ইতিহাসের আরেক জ্বলজ্বলে অধ্যায়ের সাক্ষী হতে যাচ্ছেন।

গ্যালারিতে ছিল প্রায় পঞ্চাশ হাজার দর্শক, ইডেনের আকাশে হালকা শরতের রোদ, বাতাসে উৎসবের গন্ধ। আর এমন এক বিকেলেই একটা মানুষ নিজের ব্যাট দিয়ে ম্যাচের গতিপথ, ওয়ানডে ইতিহাসের পরিসংখ্যান খাতা এমনকি দর্শকদের স্মৃতিও বদলে দিলেন। নাম তাঁর রোহিত শর্মা। বয়স ২৬ বছর।

রোহিত সেদিন মাঠে ফিরেছিলেন চোট কাটিয়ে। আঙুলে চোটের কারণে প্রায় দুই মাস ক্রিকেট থেকে বাইরে ছিলেন। সিরিজের চতুর্থ ওয়ানডে ছিল তাঁর জন্য একপ্রকার নতুন শুরু। কিন্তু শুরুটা কিছুতেই শুভ বলা যায় না। ইনিংসের প্রথম দিকেই, মাত্র ৪ রানে, থার্ডম্যানে থিসারা পেরেরার হাতে ক্যাচ দিলেন। ক্রিকেটের সহজতম এক ক্যাচ। সোজা বাংলায়, একেবারে ‘লোপ্পা’ ক্যাচ। কিন্তু শ্রীলঙ্কানদের চোখমুখকে বিস্ময়ে ভাসিয়ে থিসারা সেটি ফেলে দিলেন। কে জানত, এই ফসকানো ক্যাচটাই হয়ে উঠবে ওয়ানডে ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল ভুলগুলোর একটি!

রোহিতের ক্যাচ ফেলেছেন থিসারা, মাথায় হাত বোলার ইরাঙ্গার

রোহিতের ব্যাট প্রথমদিকে ছিল শান্ত, সংযত। প্রথম ২১ বলে মাত্র ৬ রান। ওপেনার, কিন্তু প্রথম চার পেলেন অষ্টম ওভারে নিজের ২২তম বলে। পঞ্চাশে পৌঁছাতেও সময় লাগল অনেক—৭২তম বলে। এরপর খোলস ছাড়তে শুরু করলেন ধীরে ধীরে। ম্যাচের ৩০তম ওভারে মিডউইকেট দিয়ে নুয়ান কুলাসেকারাকে মারলেন ছক্কা, ম্যাচে তাঁর প্রথম।

৩২তম ওভারে পেলেন বড় মাইলফলকের দেখা। শামিন্দা ইরাঙ্গার বল স্কয়ারে লেগে পাঠিয়েই সিঙ্গেল—১০০ বলে ১০০। দৌড়ে অপর প্রান্তে পৌঁছে দুই হাত উঁচিয়ে ধরলেন আকাশের দিকে, তারপর বারবার আঙুল তুলে দেখালেন ওপরের দিকে। হাঁটু গেড়ে বসলেন, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে দর্শকদের করতালির প্রশংসা উপভোগ করলেন। অভিনন্দন পেলেন সঙ্গে থাকা অধিনায়ক বিরাট কোহলির কাছ থেকে। চোটের কারণে মাঠের বাইরে থাকতে দেখছিলেন, অজিঙ্কা রাহানে ওপেনিংয়ে নিয়মিত রান করছেন। তাঁর জায়গা নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে। এমন সময়ে সুযোগ পেয়েই তিন অঙ্ক ছোঁয়াটা চাট্টিখানি কিছু নয় নিশ্চয়ই।

সেঞ্চুরি পেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে যেন বুকের ওপরের ভারটা নেমে গেল। এরপরই বদলে গেল তাঁর শরীরের ভাষা, ব্যাটের ছন্দ, সেই সঙ্গে যেন মাঠের পরিবেশও। ১০০ থেকে ১৫০-এ পৌঁছাতে লাগল মাত্র ২৫ বল। অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুজ, সুরঙ্গা লাকমল, সেকুগে প্রসন্ন—যাঁর হাতেই বল, রোহিতের সামনেই সবাই নিস্তেজ। তাঁর একেকটি শটে শুধু রান আসছিল না, গ্যালারির প্রতিটি আসন থেকে উঠে আসছিল গর্জন, চিৎকার আর তালি।

রোহিত শর্মা

৪৬তম ওভারের চতুর্থ বলে কুলাসেকারাকে কাভার দিয়ে চার মারলেন, পেয়ে গেলেন ডাবল সেঞ্চুরি। ইডেন তখন উল্লাসে ফেটে পড়েছে। ভারতের দর্শক প্রথম দুই শ দেখেছে শচীন টেন্ডুলকারের কাছ থেকে। বীরেন্দর শেবাগের কাছ থেকেও দেখেছে। এমনকি এক বছর আগে (২০১৩ সালের নভেম্বরে) বেঙ্গালুরুতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এই রোহিতও করেছেন। কিন্তু কেউ দুই শ করলেন দুবার—এ যে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটই তখন পর্যন্ত দেখেনি।

তবে রোহিতের গল্প তখনো শেষ হয়নি। ডাবল সেঞ্চুরির পর খেলেছেন ২২ বল। তাতে ৮টি চার ৪টি ছক্কা। সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংসের রেকর্ড থেকে শেবাগকে (২১৯) সরিয়ে এক ঝটকাতেই রোহিত পেরিয়ে গেলেন ২৫০। শেষ বলে কুলাসেকারার হাতে ক্যাচ দিলেন বটে, কিন্তু ততক্ষণে স্কোরবোর্ডে জ্বলজ্বল করছে এক অবিশ্বাস্য সংখ্যা—২৬৪, মাত্র ১৭৩ বলে।

ডাবল সেঞ্চুরির পর রোহিত শর্মা

৩৩টি চার আর ৯টি ছক্কায় গড়া ইনিংস ভারতকে নিয়ে যায় ৪০৪ রানে। এই রানপাহাড়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অবদান কোহলির ৬৬। বাকিরা শুধু দর্শক।
৫০ রান—৭২ বলে,
১০০—১০০ বলে,
১৫০—১২৫ বলে,
২০০—১৫১ বলে,
২৫০—১৬৬ বলে।

এ যেন ধাপে ধাপে ওঠার গল্প, যেখানে ধৈর্য, হিসাব, নিখুঁত শট সিলেকশন আর নির্বিচার আক্রমণ মিলেমিশে তৈরি করেছে ক্রিকেটের অনন্য এক রেকর্ড, যা টি-টোয়েন্টির দাপুটে যুগেও টিকে আছে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে। দিনটি ছিল ২০১৪ সালের ১৩ নভেম্বর।

(ভারতের ৪০৪ রান তাড়ায় শ্রীলঙ্কা অলআউট হয়েছিল ২৫১ রানে। শ্রীলঙ্কার পুরো দলের চেয়ে বেশি রান করা রোহিত ম্যাচের শেষে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার হিসেবে পেয়েছিলেন ২৬৪০০০ রুপি লেখা চেক)।