ভারতের ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি যেন এই ছবিটি
ভারতের ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি যেন এই ছবিটি

৪ কারণে ঘরের মাঠে ভারতের এমন দুর্দশা

ঘরের মাঠে ভারত সিরিজ হারতেই পারে। ঘরের মাঠে টানা ১৮টি সিরিজ জেতার বিশ্ব রেকর্ড গড়া দলটি যে কখনোই হারবে না, এমন তো নয়। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে ভারতের হারের ধরনে। গত বছর অক্টোবরে নিউজিল্যান্ড সিরিজে ৩-০তে হারার পর দলটি এবার দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে হেরেছে ২-০তে।

নিউজিল্যান্ড সিরিজে বেঙ্গালুরু টেস্টের প্রথম ইনিংসে তো মাত্র ৪৬ রানেও গুটিয়ে গিয়েছিল ভারত। গতকাল গুয়াহাটি টেস্টে দক্ষিণ আফ্রিকার ৫৪৯ রান তাড়া করতে নেমে গুটিয়ে গেছে ১৪০ রানে। এই সিরিজে কলকাতায় প্রথম টেস্টে ১২৪ রানের লক্ষ্যে ভারত অলআউট হয় ৯৩ রানে। সাদা পোশাকের ক্রিকেটে হঠাৎ ভারতের এমন ছন্দপতনের কারণ কী?

কোনো কৌশলেই হচ্ছে না কাজ

ভারতের পিচগুলো সাধারণত স্পিন সহায়ক হয়। তবে শুধু ‘স্পিন সহায়ক’ বললেই সব বোঝা যায় না। স্পিনও আবার নানা মাত্রার হয়। ঘরের মাঠে অজেয় থাকার সময় (২০১৩–২০২৪) ভারত বানাত ‘স্বাভাবিক’ টার্নার পিচ।

যেখানে শুরুর দুই–তিন দিন ব্যাটসম্যানরা মোটামুটি স্বচ্ছন্দেই খেলতে পারতেন, বোলারদের একচ্ছত্র দাপট শুরু হতো চতুর্থ, পঞ্চম দিনে। এসব উইকেটে রবিচন্দ্রন অশ্বিন আর রবীন্দ্র জাদেজা উইকেট তুলতেন, সঙ্গে তৃতীয় স্পিনার ও পেসাররাও ভূমিকা রাখতেন। সেই সময়ে বিরাট কোহলি, চেতশ্বর পূজারারা সেরা সময় পার করছিলেন। এর মধ্যেও কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হয়েছে। ২০১৪–১৫ দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজের কথা উদাহরণ হিসেবে নেওয়া যেতে পারে। সেই সিরিজে একেবারে স্পিন সহায়ক (র‍্যাঙ্ক টার্নার) উইকেট তৈরি করে দক্ষিণ আফ্রিকাকে সিরিজ হারিয়েছিল ভারত।

তবে বেশির ভাগ সিরিজেই থাকত ‘স্বাভাবিক’ টার্নার পিচ, যার সুবিধা নিয়ে ২০২১ সালে ইংল্যান্ডের ভারত সফরের প্রথম টেস্টে ডাবল সেঞ্চুরি করেন জো রুট। চেন্নাইয়ে হওয়া সেই টেস্টে ভারত হেরেছিল। এরপর সিরিজের পরের দুই ম্যাচেই অতি মাত্রায় টার্নিং উইকেট তৈরি করে ভারত, জেতে ম্যাচের সঙ্গে সিরিজও।

২৫ বছর পর ভারতে টেস্ট সিরিজ জিতেছে দক্ষিণ আফ্রিকা

এক দশক ধরে ভারত নিজেদের কৌশল বদলেছে প্রতিপক্ষ এবং আগের ম্যাচের পিচের ফল দেখে। ফল খারাপ হলেই পরের ম্যাচেই উইকেটে বড় পরিবর্তন এনেছে দলটি। তবে গত বছরের শেষ দিকে নিউজিল্যান্ড আর এবার দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে এই কৌশল কাজে লাগেনি। এই যেমন নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সবুজ উইকেট তৈরি করে প্রথম টেস্টে বড় ব্যবধানে হেরে বসে ভারত। পরের দুই টেস্টে স্পিন সহায়ক উইকেট তৈরি করেও কোনো লাভ হয়নি। হেরে যায় দুই ম্যাচেই। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে কলকাতা টেস্টে ভারত অতিরিক্ত টার্নিং উইকেট বানায়। ফল ৩০ রানে হার। পরের টেস্টে স্বাভাবিক টার্নার বানিয়ে তো ৪০৮ রানের রেকর্ড রানে হার জুটেছে কপালে।

ভাগ্যও সহায় হয়নি। এই পাঁচটি টেস্টে ভারত টসে হেরেছে চারটিতেই। যেটিতে জিতেছিল সেটিতেই সবুজ উইকেটে আগে ব্যাটিং নিয়ে ৪৬ রানে গুটিয়ে যায় ভারত।

গৌতম গম্ভীরের আইপিএল–নীতি

সমালোচকদের অভিযোগ, গৌতম গম্ভীরের অধীনে ভারতের টেস্ট দল অস্থির হয়ে পড়েছে। ঘরোয়া প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটকে গুরুত্ব না দিয়ে তিনি আইপিএলকে প্রাধান্য দিয়ে দল সাজাচ্ছেন। তাঁদের অভিযোগ, গম্ভীর সাই সুদর্শনকে দলে সুযোগ দিলেও রঞ্জি ট্রফিতে রানের পর রান করা সরফরাজ খান, করুণ নায়ারদের সুযোগ দেন না।

শুধু তা–ই নয়, আইপিএলের মতো টেস্টেও ব্যাটসম্যানদের ব্যাটিং অর্ডার বারবার পরিবর্তন করছেন। যেমন কলকাতা টেস্টে ৩ নম্বরে ব্যাট করেছেন অলরাউন্ডার ওয়াশিংটন সুন্দর, কিন্তু গুয়াহাটি টেস্টে তিনে ব্যাট করেছেন সাই সুদর্শন। আর সুন্দর এই টেস্টে নেমেছেন ৮ নম্বরে। সর্বশেষ ৮ ইনিংসে সুন্দর ৫, ৯, ৭ বিভিন্ন পজিশনে ব্যাটিং করেছেন।

টেস্টেও ব্যাটসম্যানদের ব্যাটিং অর্ডার বারবার পরিবর্তন করছেন গম্ভীর

এ ছাড়া অনেকেই বলছেন, গম্ভীর টি-টোয়েন্টি দলের মতো টেস্ট দলেও অলরাউন্ডারদের বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন। কিন্তু এর ফল মোটেই সন্তোষজনক নয়। এই সিরিজে অফ স্পিনার হিসেবে খেলেছেন সুন্দর, উইকেট পেয়েছেন মাত্র ১টি। তুলনায় দক্ষিণ আফ্রিকার অফ স্পিনার সাইমন হারমার পেয়েছেন ১৭টি উইকেট। সহজ কথায়, সুন্দর যেন শুধু ব্যাটসম্যান হিসেবেই খেলেছেন। দলের আরও একজন পেস বোলিং অলরাউন্ডার নীতীশ রেড্ডি থাকলেও বিশেষজ্ঞ ব্যাটসম্যান বা বোলার খেলানো হয়নি।

ভারতীয় ক্রিকেটে পালাবদল

রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলি ও রবিচন্দ্রন টেস্ট ছেড়েছেন। এর আগে দল থেকে বাদ পড়েছেন চেতশ্বর পূজারা ও অজিঙ্কা রাহানে। টেস্ট দল থেকে তাঁদের বিদায়ে ভারতীয় দল একটা পালাবদলরে মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

শুবমান গিলকে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ২-২ ড্র হওয়া সিরিজের আগে টেস্ট দলের অধিনায়ক করা হয়। তাঁর নেতৃত্বে ঘরের মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ২-০ ব্যবধানে হারায় ভারত। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজের প্রথম ম্যাচেই চোট পান গিল। দ্বিতীয় টেস্টে তিনি খেলতে পারেননি।

গম্ভীর নিজেও এ প্রসঙ্গে কথা বলেছেন, ‘আমি কখনো অজুহাত দিই না, অতীতেও দিইনি। কিন্তু যদি দেখেন, এই দলে শীর্ষ আট ব্যাটসম্যানের মধ্যে চার-পাঁচজনের টেস্ট ম্যাচের সংখ্যা ১৫টিরও কম। খেলতে খেলতে তারা শিখছে। আমি মনে করি না, আগে কখনো টেস্ট ক্রিকেটে এমনটা হয়েছে, যে একই সময়ে ব্যাটিং আর স্পিন বোলিং, দুই বিভাগেই বদল ঘটছে। আমাদের সবাইকে সময় দিতে হবে। আমি নিশ্চিত, ওদের দক্ষতা আছে, প্রতিভা আছে, সামর্থ্যও আছে।’

দুই প্রতিপক্ষের কৌশল ও সামর্থ্য

ভারতের বিপক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকা ও নিউজিল্যান্ডের ব্যাটসম্যানরা সুইপ শটের পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন। স্পিনারদের বিপক্ষে রাচিন রবীন্দ্র, উইল ইয়াং, টনি ডি জর্জি, টেম্বা বাভুমারা প্রতিনিয়ত সুইপ খেলে গেছেন। আর এই কৌশলেই তাঁরা স্পিনারদের অনেকটাই অকার্যকর রেখেছেন।

পর্যাপ্ত সুইপ খেলতে পারছে না ভারত

দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে স্পিনারদের সামর্থ্যেও পার্থক্য ছিল। সাইমন হারমার প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে এক হাজারের বেশি উইকেট নেওয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে ভারতে এসেছেন। ২ টেস্টে তিনি উইকেট নিয়েছেন ১৭টি। তাঁর বিপক্ষে মুখ থুবড়ে পড়েছেন ভারতের ব্যাটসম্যানরা। তাঁকে যোগ্য সঙ্গ দিয়েছেন কেশব মহারাজ। সেই তুলনায় জাদেজা, কুলদীপরা এই উইকেট থেকে খুব ভালো কিছু করতে পারেননি।

নিউজিল্যান্ড সিরিজে ভারত এজাজ প্যাটেল ও মিচেল স্যান্টনারদের বিপক্ষে ভুগেছে। স্যান্টনার তো নিয়মিত আইপিএল খেলেন। প্যাটেল এর আগে ২০২১ সালে ভারত সফর করেছিলেন।