এশিয়া কাপে সুপার ফোরে দুবাইয়ে আজ ভারতের মুখোমুখি বাংলাদেশ। টুর্নামেন্টে এখনো হারেনি ভারত। ফাইনালে ওঠার পথে সূর্যকুমারের দলই সবচেয়ে বড় ফেবারিট। তবে খেলাটা যেহেতু ক্রিকেট, তাই ভালো খেললে যেকোনো কিছুই ঘটতে পারে। সুপার ফোরে নিজেদের প্রথম ম্যাচে শ্রীলঙ্কাকে হারানোয় ভালো খেলার সে আত্মবিশ্বাস পেয়েছে লিটন দাসের দল।
এখন ভারতের ‘মেন ইন ব্লু’দেরও হারাতে চাই দলটির দুর্বলতা বের করে ভালো খেলার ‘ব্লু প্রিন্ট’ তৈরি করা। বাংলাদেশের টিম ম্যানেজমেন্ট নিশ্চয়ই তেমন পরিকল্পনা তৈরি করে সে অনুযায়ীই প্রস্তুতি সেরেছে। যদিও ভারতের স্কোয়াডে দুর্বলতা নেই বললেই চলে। কিন্তু টি-টোয়েন্টি এমন খেলা, যেখানে নির্দিষ্ট দিনে যে কেউ জিততে পারে।
এশিয়া কাপে দুবাই আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে এ পর্যন্ত এক ম্যাচ খেলেছে বাংলাদেশ। সুপার ফোরে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টস জিতে পরে ব্যাটিং করে জিতেছে। গ্রুপ পর্ব ও সুপার ফোরে পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ মিলিয়ে দুবাই স্টেডিয়ামে এ পর্যন্ত তিন ম্যাচ খেলেছে ভারত। আরব আমিরাতের বিপক্ষে টস জিতে পরে ব্যাটিংয়ে নেমে জিতেছে। পাকিস্তানের বিপক্ষে টস হেরে জেতে পরে ব্যাটিং করে। সুপার ফোরে সেই পাকিস্তানের বিপক্ষেই টস জিতে পরে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয় ভারত। ১৭১ রান তাড়া করে জেতে ৬ উইকেটে। অর্থাৎ, এশিয়া কাপে দুবাইয়ে রান তাড়া করে সব ম্যাচ জিতেছে ভারত। নিজেদের ব্যাটিং শক্তির ওপর আস্থা রাখার প্রমাণ এটি। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ টসে জিতলে ভারতকে রান তাড়া করানোর সিদ্ধান্ত নেবে কি না, সেটি ভাবার বিষয়।
টস জিতে পরে বোলিং করার সমস্যা আছে আরও একটি। ম্যাচটি শুরু হবে দুবাইয়ে স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬.৩০ মিনিটে। রাতে শিশির পড়ে সেখানে। অর্থাৎ পরে বোলিং করলে শিশিরের কারণে বল গ্রিপ করতে না পারায় সমস্যায় ভুগতে হতে পারে বাংলাদেশের স্পিনারদের। পাশাপাশি শিশিরের কারণে বল স্কিডও করে, এতে স্পিনাররা প্রত্যাশিত বাঁক না পাওয়ায় ব্যাটিংটা সহজ হয়ে যায়।
টসে জিতলে পরে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে আরও একটি যুক্তি দাঁড় করানো যায়। ভারতের বিপক্ষে এ পর্যন্ত ১৭টি-টোয়েন্টি খেলে একটিতে জিতেছে বাংলাদেশ। সেটা দিল্লির অরুণ জেটলি স্টেডিয়ামে, যেখানকার উইকেট দুবাইয়ের মতোই একটু মন্থর ও স্পিনবান্ধব। বাংলাদেশ সে ম্যাচে পরে ব্যাট করে ভারতের ১৪৮ রান তাড়া করে ৬ উইকেটে জিতেছিল।
ভারতের দুই ওপেনার অভিষেক শর্মা ও শুবমান গিল পাওয়ার প্লেতে দ্রুত রান তোলায় অভ্যস্ত। বিশেষ করে অভিষেক শর্মার টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ার স্ট্রাইক রেট ১৯৭.২১! তাঁকে দ্রুত আউট করতে ডানহাতি অফ স্পিনার খেলাতে পারে বাংলাদেশ টিম ম্যানেজমেন্ট। সে ক্ষেত্রে স্পিন বোলিং অলরাউন্ডার মেহেদী ভালো ভূমিকা রাখতে পারেন। গিলের ক্ষেত্রে ডানহাতি কিংবা বাঁহাতি স্পিনে পার্থক্য নেই। যেকোনো বোলারের বিপক্ষে উইকেটের চারপাশেই শট খেলতে পারেন। পাওয়ার প্লেতে তাই ভালো লাইন-লেংথে বোলিংয়ের বিকল্প নেই। তবে গিলকে দ্রুত আউট করার ক্ষেত্রে কিছু কৌশল কার্যকর হতে পারে। তাঁর ইনিংসে শুরুর দিকে স্টাম্পের বল লেগ সাইডে খেলার প্রবণতা আছে। আর স্টাম্পের একটু বাইরের বল কাট করার প্রতি দুর্বলতা আছে গিলের। অর্থাৎ স্টাম্পে ভালো লেংথের বল তাঁর বিপক্ষে এলবিডব্লিউর সুযোগ তৈরি করতে পারে। পাশাপাশি ‘ফোর্থ’ স্টাম্পে ভালো লেংথে বোলিং উইকেটের পেছনে ক্যাচের সুযোগ বাড়াতে পারে।
ক্রিকমেট্রিকের পরিসংখ্যান বলছে, টি-টোয়েন্টিতে ডানহাতি অফ স্পিনারের বিপক্ষে এ পর্যন্ত ১৩ ইনিংসে ব্যাটিং করে ৫২ বলে ৮১ রান তুললেও ২৩.১ শতাংশ বল ‘ডট’ দিয়েছেন গিল। বাঁহাতি স্পিনে ১২ ইনিংসে ৭১ বল খেলে ৬৯ রান তোলার পাশাপাশি ৪৬.৫ শতাংশ বল ‘ডট’ দিয়েছেন। সে ক্ষেত্রে নতুন বলে বাংলাদেশের বাঁহাতি স্পিনার নাসুম আহমেদ বড় ভূমিকা রাখতে পারেন।
ভারতের মিডল অর্ডার বরাবরই খুব শক্তিশালী। মাঝের ওভারগুলোয় দ্রুত রান তুলতে পারে, যেটা অন্য দলগুলোর সঙ্গে তাদের পার্থক্য গড়ে দেয়। এশিয়া কাপেই বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ভারতের বিশ্লেষক হার্শা ভোগলে এর আগে বলেছিলেন, ‘মিডল অর্ডারে তাদের একজন বলপ্রয়োগকারী লাগবে। খেয়াল করে দেখবেন, সূর্যকুমার ভারতের হয়ে এ কাজটা করে। মাঝের ওভারগুলোয় সে দারুণ স্ট্রাইক রেট এনে দেয়।’
এবার এশিয়া কাপে সূর্য এখনো সেভাবে জ্বলে উঠতে পারেননি। আজকের ম্যাচে যেন তা নয়, সেটা নিশ্চিতে রান আটকানোর চেষ্টায় না গিয়ে সূর্যর বিপক্ষে উইকেট নেওয়ার বোলিং করাই বুদ্ধিমানের কাজ। কারণ সামর্থ্য বিচারে রান আটকানোর বোলিংয়ে তাঁকে চাপে ফেলাটা খুব কঠিন হবে। উইকেট নেওয়ার বোলিং করলে অন্তত সুযোগটা তৈরি হতে পারে। সেটা করতে গিয়ে দ্রুত রান দিয়ে ফেললে রক্ষণাত্মক বোলিংয়ে ফেরার সুযোগও আছে। কিন্তু রান আটকাতে গিয়ে সেটা না পারলে আউটের সুযোগ কমে আসবে। কারণ, সূর্য ততক্ষণে বড় ইনিংস খেলার পথে ‘সেট’ হয়ে যাবেন।
ডেথ ওভারে হার্দিক পান্ডিয়া-শিবম দুবেদের ঠেকাতে আসলে নির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনার ওপর ভরসার সুযোগ নেই। ডেথ ওভারে বাংলাদেশের চিরনির্ভরতার জায়গা মোস্তাফিজুর রহমান এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারেন। আইপিএলে খেলার সুবাদে ভারতের ব্যাটসম্যানদের দলে অন্য যে কারও থেকে ভালো জানেন মোস্তাফিজ। তাঁর কাটারগুলো আজ দুবাইয়ের বাইশ গজে ধরলে দেখা যেতে পারে আরেকটি ‘ফিজ স্পেশাল’।
ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশের প্রথম কাজ হবে পাওয়ার প্লেতে দ্রুত রান তোলা। এ জায়গায় কোনোভাবেই পিছু হটার সুযোগ নেই। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আগের ম্যাচে প্রথম ৬ ওভারে ১ উইকেটে ৫৯ রান তোলে বাংলাদেশ। অর্থাৎ ওভারে প্রায় ১০ করে রানরেট ছিল। ভারতের বোলিং যেহেতু শ্রীলঙ্কার চেয়েও ভালো, তাই চাপ থাকবে দুই ওপেনার সাইফ হাসান ও তানজিদ হাসানের ওপর। চাপ কি কিছুটা ভারতের বোলারদের ওপরও থাকবে না?
প্রতিপক্ষের কাছে প্রায় ‘অচেনা’ সাইফ যে আগের ম্যাচে এতটা ভালো করবেন, তা তো কারও জানা ছিল না! সে কারণে তাঁর আজও সুযোগ আছে ভারতের বোলারদের চমকে দেওয়ার। বিশেষ করে ভারতের প্রিমিয়াম পেসার যশপ্রীত বুমরা পাকিস্তানের বিপক্ষে আগের ম্যাচে অতটা ভালো করতে পারেননি। ৪ ওভারে ১১.২৫ করে রান দিয়েছেন। বুমরাকে ভারত যদি আজও খেলায় তবে তাঁর ওপর চাপ তৈরি করতে পারলে দ্রুত রান তোলাটা সহজ হয়ে যাবে বাংলাদেশের জন্য। তানজিদ এই কাজে বড় ভূমিকা রাখতে পারেন। পেসারদের দারুণ টাইমিংয়ে উড়িয়ে ছক্কা মারায় তাঁর সামর্থ্য বেশ ভালো। তবে তানজিদকে খেয়াল রাখতে হবে ভেতরে ঢুকে বলে যেন ‘বিট’ না হন—এবার এশিয়া কাপে দুবার এমন ডেলিভারিতে আউট হয়েছেন।
অনুশীলনে চোট পাওয়া লিটন আজ খেললে ব্যাটিংয়ে তার ওপর বড় দায়িত্ব থাকবে। বড় দলের বিপক্ষে এবারের আসরে লিটনকে এখনো তাঁর চিরচেনা রূপে দেখা যায়নি। গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে বড় রান লিটনের কাছে তাই পাওনা হয়ে আছে। বেশি কিছু করতে হবে না, শুধু নিজের ব্যাটিংটা করতে হবে তাঁকে। পাশাপাশি খেয়াল রাখতে হবে কুলদীপ যাদব ও বরুণ চক্রবর্তীর রহস্যময় স্পিন পড়তে না পেরে বারবার সুইপ করতে গিয়ে যেন এলবিডব্লিউ না হন। এমন না যে তারা বাজে ডেলিভারি একদমই করবেন না। সেগুলো মেরে ভালো বলগুলোয় পায়ের ব্যবহারে এক-দুই রান করে নিয়ে ওভারপ্রতি ছয়ের বেশিও রান তোলার সুযোগ থাকে। সে ক্ষেত্রে রানিং বিটুইন দ্য উইকেট ভালো হতে হবে, যেটা এবারের এশিয়া কাপে বাংলাদেশের বেশ ইতিবাচক দিক।
মিডল অর্ডারে তাওহিদ হৃদয়ের রানে ফেরাটা বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ। চার নম্বরে হৃদয় যদি বেশিক্ষণ ব্যাট করতে পারেন, সেটি বাংলাদেশের ইনিংসের সুর ঠিক করে দিতে পারে। তবে দুশ্চিন্তার জায়গাও আছে। হৃদয় সাধারণ ব্যাকফুটের ব্যাটসম্যান। হিটিং বেজ খুব ভালো হওয়ায় অনেকটা দাঁড়িয়ে মারতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। ভারতের বিপক্ষে শুধু এই কৌশলে ভরসা রাখার সুযোগ নেই। কারণ, চারে হৃদয়কে এমন সময় ব্যাটিংয়ে নামতে হবে যখন ভারতের স্পিনাররা আসবেন। কুলদীপ ও বরুণ হাফ ভলি প্রায় দেন না বললেই চলে। সে ক্ষেত্রে সাবধানে খেলার পাশাপাশি তাঁদের ডেলিভারিগুলো বানিয়ে মারতে হবে।
ফিনিশারের ভূমিকায় আজ জাকের আলী না নুরুল হাসান—সেটা একটা প্রশ্ন। সামর্থ্য বিবেচনায় জাকেরের প্রতিই ঝুঁকতে পারেন নির্বাচকেরা। যদিও এবারের এশিয়া কাপে এখন পর্যন্ত হতাশ করেছেন জাকের। একটি ছক্কাও মারতে পারেননি। স্ট্রাইক রেটও সন্তোষজনক নয়। কিন্তু ধ্বংসস্তূপ থেকে দলের ইনিংসকে লড়াকু জায়গায় টেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে নুরুলের তুলনায় জাকেরের সামর্থ্য পরীক্ষিত। ক্রিকবাজের বিশ্লেষণে ভারতের সাবেক ক্রিকেটার রোহান গাভাস্কারও জাকেরকে নিয়ে সূর্যকুমারের দলকে সতর্ক করে দিয়েছেন। এই ভূমিকায় যে-ই খেলুন, শেষ পাঁচ ওভারে তাঁকে দ্রুত রান তুলতেই হবে।
শেষ দিকে জাকের কিংবা নুরুলকে সহায়তা করতে নাসুম, মেহেদীরাও ব্যাট করতে পারবেন। মোট কথা, আগে ব্যাট করলে ভারতের বিপক্ষে অন্তত দুই শ ছুঁইছুঁই সংগ্রহের বিকল্প নেই। কিন্তু পরে ব্যাট করলে সবার আগে লক্ষ্য থাকতে হবে ভারতকে যত কম রানে বেঁধে ফেলা। কথাগুলো বলা যত সহজ, ভারতের বিপক্ষে তা মাঠে ফলানো ততটাই কঠিন।
কিন্তু সামর্থ্য না থাকলে কি সুপার ফোরে উঠত বাংলাদেশ? সামর্থ্য না থাকলে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে রান তাড়ায় শেষ ওভারের আগপর্যন্ত বাংলাদেশ দলকে তো আর এমনিতেই অস্ট্রেলিয়া মনে হয়নি। কী পেশাদারসুলভ রান তাড়া!
ভারতের বিপক্ষে আজ এমন একটা পারফরম্যান্সই চাই বাংলাদেশ দলের।