
ঠিকঠাক ক্রিকেট-ক্যারিয়ার শুরু হওয়ার আগেই নিয়তি তাঁকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল ভয়ংকর রণক্ষেত্রে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হলেন। নো ম্যানস ল্যান্ডে পড়ে থাকলেন কয়েক দিন। ঘোষণা করা হলো মৃত। হয়ে গেল স্মরণসভাও। কিন্তু অলৌকিকভাবে তিনি বেঁচে গেলেন। সেখানেই শেষ নয়। কয়েক বছর পর বেঁচে গেলেন সমুদ্রযাত্রায় ডুবে মরার হাত থেকেও।
আর দুবার মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাওয়া এই মানুষই ৪০ বছর বয়সে হয়ে গেলেন টেস্ট ক্রিকেটার। তা–ও নানা নাটকীয়তার পর। পরবর্তী সময়ে ব্যাট–বলে অনেক বড় কেউ হয়ে উঠতে পারেননি, তবে জীবনের বাঁকে বাঁকে নানা উত্থান–পতনের মধ্যে টিকে থেকে হয়ে উঠেছেন কিংবদন্তিসম। নাম তাঁর হ্যারি লি।
হ্যারি লির জন্ম ইংল্যান্ডের মেরিলিবোনের এক সাধারণ পরিবারে, ১৮৯০ সালে। বাবা ছিলেন সবজিওয়ালা, কয়লাও বিক্রি করতেন। তখনো পর্যন্ত আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে থাকা ক্রিকেটে এমন পরিবারের কারও প্রবেশ সহজ ছিল না। কিন্তু ক্রিকেটের প্রতি তীব্র আকর্ষণ লিকে ক্রিকেটেই আটকেছে। ল্যাম্পপোস্টকে স্টাম্প বানিয়ে রাস্তায় ক্রিকেট খেলতেন। খেলতেন স্কুলেও। সেন্ট টমাস স্কুলের প্রধান শিক্ষক ডেসিপ্ট তাঁর ছাত্রদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতেন, যে তাঁকে আউট করতে পারবে, তাঁকে এক পয়সা দেওয়া হবে। বেশির ভাগ সময়ই সেটা লির পকেটে ঢুকত। তখন মূলত বোলিংই করতেন লি।
১৯০৬ সালে ১৬ বছর বয়সে হ্যারি লি লর্ডসের গ্রাউন্ড স্টাফ হিসেবে কাজ শুরু করেন। আত্মজীবনীতে লিখেছেন, গ্রাউন্ড স্টাফ হিসেবে শুধু বল কুড়ানো বা উইকেটের পরিচর্যা নয়, তাঁকে নেট ঝাড়তে হতো, চেয়ার মুছতে হতো, স্কোরবোর্ড চালানো থেকে শুরু করে স্কোরকার্ড বিক্রি পর্যন্ত সবই করতে হতো। এ কাজ করতে গিয়ে লাভ যেটা হয়েছে, লর্ডসে খেলা সে সময়ের তারকা ক্রিকেটার টেডি উইনিয়ার্ড, আলবার্ট ট্রটের মতো অভিজ্ঞ খেলোয়াড়দের কাছাকাছি যেতে পেরেছিলেন। নিতে পেরেছিলেন ক্রিকেটের পাঠ।
১৯১১ সালে আচমকাই কাউন্টি ক্লাব মিডলসেক্সের হয়ে প্রথম শ্রেণির ম্যাচে অভিষেক হয় তাঁর। ক্লাবটির কয়েকজন খেলোয়াড় ইংল্যান্ড জাতীয় দলের ট্রায়ালে গেলে খেলোয়াড়–শূন্যতায় লির ডাক পড়ে, জায়গা পেয়ে যান একাদশেও। এই ক্রিকেটীয় জীবন অবশ্য তাঁর জন্য বড় কোনো পরিবর্তন নিয়ে আসেনি। যা আসে ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর।
১৯১৪ সালের সেপ্টেম্বরে অন্য অনেক ব্রিটিশ তরুণের সঙ্গে হ্যারি লি–ও যোগ দেন বিশ্বযুদ্ধে। ব্রিটিশ আর্মির ১৩তম কাউন্টি অব লন্ডন ব্যাটালিয়ন ‘দ্য কেনসিংটনস’–এ নাম লেখানোর পর তাঁকে পাঠানো হয় ফ্রান্সের নিউভ-শাপেল যুদ্ধক্ষেত্রে।
১৯১৫ সালের মার্চে সেই যুদ্ধক্ষেত্রেই লির বাঁ পায়ে গুলি লাগে। ওই অবস্থায় টানা তিন দিন ধরে নো ম্যানস ল্যান্ডে (দুই যুদ্ধরেখার মাঝের এলাকা) পড়েছিলেন লি। ক্রিকেটের বাইবেলখ্যাত উইজডেন ক্রিকেটার্স অ্যালামনাকের তথ্য অনুসারে, তিন দিন পর তাঁকে মৃত বলে ধরে নেওয়া হয়। তাঁর জন্য ব্রিটেনে আয়োজন করা হয় স্মরণসভারও।
মৃত্যুসংবাদ ছাপা হয় সংবাদপত্রে। ক্রিকেট–বিশ্ব ধরে নিয়েছিল, এক প্রতিভাবান তরুণ ক্রিকেটারকে তারা চিরতরে হারিয়ে ফেলেছে। সে সময়ের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন অঙ্গনের উদীয়মানদের যুদ্ধে হারিয়ে যাওয়াটা অবশ্য প্রায় স্বাভাবিকতায় পরিণত হয়।
কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পর এক আশ্চর্যজনক খবর আসে—হ্যারি লি বেঁচে আছেন! গুরুতর আহত অবস্থায় জার্মান সৈন্যরা তাঁকে উদ্ধার করে প্রথমে ফ্রান্সের ভ্যালেন্সিয়েনে, পরে জার্মানির হ্যানোভারের একটি হাসপাতালে নিয়ে যায়। লি তখন যুদ্ধবন্দী। ধীরে ধীরে সুস্থও হতে শুরু করেন।
এ সময় তাঁর সঙ্গে থাকা এক সহযোদ্ধা বন্দী লিকে পরামর্শ দেন, সুস্থতার লক্ষণ দেখানো যাবে না। আহতাবস্থা গুরুতর হলে দুই পক্ষের মধ্যে বন্দিবিনিময়ের সময় তাঁর সুবিধা মিলতে পারে। শেষ পর্যন্ত হয়েছেও তা–ই।
৬ সপ্তাহ জার্মানদের কাছে বন্দী থাকার পর ১৯১৫ সালের অক্টোবরের দিকে বন্দিবিনিময়ের অংশ হিসেবে ইংল্যান্ডে ফেরার সুযোগ আসে লির। তবে পায়ের পেশি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় অস্ত্রোপচার করাতে হয় তাঁর। এতে তাঁর পা স্থায়ীভাবে আধা ইঞ্চি ছোট হয়ে যায়। আর এমন শারিরীক খুঁত থাকার অর্থ, সামরিক বাহিনীতে অযোগ্য। সে বছরই ব্রিটিশ আর্মি থেকে তাঁকে সম্মানজনক অব্যাহতি দেওয়া হয়।
বিশ্বযুদ্ধে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসার পর লির জীবনে আসে অন্য বাস্তবতা। পায়ে স্থায়ী আঘাত, পা ছোট হয়ে যাওয়া এবং পেশির ক্ষতি তাঁকে পেশাদার ক্রিকেট খেলায় অক্ষম করে তোলে। চিকিৎসকেরা তাঁকে বলেন, তাঁর পক্ষে আর প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলা সম্ভব নয়।
১৯১৭ সালে তাঁর জীবনে আসে এক নতুন মোড়। মিডলসেক্সের সাবেক খেলোয়াড় ও অলরাউন্ডার ফ্র্যাঙ্ক ট্যারান্টের সুপারিশে তিনি তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতে কুচবিহার মহারাজার ক্রিকেট ও ফুটবল কোচ হিসেবে চাকরি পান। এই চাকরিজীবন শুরু করতে ভারতযাত্রার পথে তাঁকে আবারও মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়।
ভারতে যাওয়ার জন্য লি প্রথমে যে জাহাজের টিকিট কেটেছিলেন, তার নাম ছিল নিয়ানজা। যাত্রা শুরুর ঠিক আগে তাঁর টিকিট বদলে যায়, ওঠেন নাগোয়া নামের অন্য একটি জাহাজে। পরে জানা যায়, নিয়ানজা জাহাজটি প্লাইমাউথ উপকূল থেকে রওনা হওয়ার পরপরই একটি জার্মান সাবমেরিনের টর্পেডোর আঘাতে ডুবে যায়। এতে ৪৯ জন যাত্রী প্রাণ হারান।
ভাগ্যের খেলা এখানেই শেষ হয়নি। ভূমধ্যসাগর পেরোনোর সময় নাগোয়ার বহরও জার্মান আক্রমণের মুখে পড়ে। সেই বহরেরই ‘সিটি অব লক্ষ্ণৌ’ নামের জাহাজটি টর্পেডোর আঘাতে ডুবে যায়। আবারও অলৌকিকভাবে রক্ষা পান হ্যারি লি।
১৯১৯ সালে ইংল্যান্ডে ফিরে হ্যারি লি আবারও ব্যাট হাতে মাঠে নামেন। উইজডেন অ্যালামনাকে লির এই প্রত্যাবর্তনকে অভিহিত করা হয়েছে ‘ছোট্ট অলৌকিক ঘটনা’ হিসেবে। যুদ্ধের পঙ্গুত্ব বা শারীরিক সীমাবদ্ধতা একপাশে তিনি হয়ে ওঠেন কাউন্টির নিয়মিত খেলোয়াড়। শুধু খেলেনইনি, প্রথম মৌসুমেই লি এক হাজার রানের মাইলফলক অতিক্রম করেন। প্রত্যাবর্তনের বছরটিতেই সারের বিরুদ্ধে একটি চ্যারিটি ম্যাচে লি দুই ইনিংসে সেঞ্চুরিও করেন।
পরের মৌসুমগুলোতেও এই ধারাবাহিকতা কমবেশি বজায় ছিল। ১৯২০ ও ১৯২১ সালে মিডলসেক্সের কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ে তিনি ছিলেন অন্যতম নায়ক। এর মধ্যে ১৯২১ সালে ৭২ উইকেট নিয়ে নিজেকে অলরাউন্ডার হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত করেন।
মোটের ওপর আগে–পরে সবমিলিয়ে ৪৩৭টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলেছেন লি। ডানহাতি মিডিয়াম ফাস্ট বোলিংয়ে নিয়েছেন ৪০১ উইকেট। ব্যাট হাতে ৩৮টি সেঞ্চুরিসমেত রান করেছেন ২০১৫৮।
তবে কাউন্টিতে এমন ভালো ক্রিকেট খেললেও ইংল্যান্ড বা এমিসিসি দলের হয়ে সুযোগ পাননি। খুব সম্ভবত শারিরীক খুঁতই ছিল কারণ।
১৯৩০–৩১ মৌসুমের ঘটনা। ইংল্যান্ড দল খেলতে গেছে দক্ষিণ আফ্রিকায়। ৪০ বছর বয়সী লি তখন দক্ষিণ আফ্রিকার দুটি স্কুলে কোচিং করান। সফরের মাঝপথে ইংল্যান্ড দলে দেখা দেয় খেলোয়াড়–সংকট। কেউ অসুস্থ, কেউ চোটে। তখন দল গড়ার কাজটি করে মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব (এমসিসি)। ইংল্যান্ড অধিনায়ক পারসি চ্যাপম্যান এমসিসিকে বলেন, দলের ৭ খেলোয়াড় খেলার মতো অবস্থায় নেই। লি যেহেতু দক্ষিণ আফ্রিকাতেই আছেন, তাঁকে দলে নিয়ে নেওয়া হোক।
১৯৩১ সালের ফেব্রুয়ারিতে জোহানেসবার্গে সিরিজের চতুর্থ টেস্টে ইংল্যান্ডের হয়ে অভিষেক হয় লির। ম্যাচটিতে খুব বেশি কিছু তিনি করতে পারেননি। প্রথম ইনিংসে ১৮ আর দ্বিতীয় ইনিংসে ১ রান। কিন্তু লির সেই মাঠে নামাটা ছিল ঐতিহাসিক মুহূর্ত—মৃত ঘোষণার ১৫ বছর পর এক পায়ের স্থায়ী খুঁত নিয়ে তিনি ক্রিকেটের সর্বোচ্চ মঞ্চে।
জীবনে ওই একটা টেস্টই খেলতে পেরেছেন লি। পরে আর সুযোগ মেলেনি। তবে সেই এক টেস্ট ঘিরে নাটকীয়তা কম হয়নি। টেস্ট খেলোয়াড় হিসেবে ক্যাপ ও ব্লেজার পেয়ে থাকেন খেলোয়াড়েরা। কিন্তু এমসিসি কর্তৃপক্ষ লিকে তা দিতে অস্বীকার করে। একটি স্কুল নাকি এমসিসির কাছে অভিযোগ করে, লি অনুমতি ছাড়াই চাকরিস্থল ছেড়ে ইংল্যান্ড দলে যোগ দিয়েছিলেন।
অভিযোগ অস্বীকার করেন হ্যারি লি। এমসিসি জানায়, ক্ষমা চাইতে হবে। তবে বিপদের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে বেঁচে থাকা লি যেন অন্য ধাতুতে গড়া। তাঁর মতে, কোনো ভুল হয়নি। ক্ষমা চাওয়ার যৌক্তিকতা নেই।
দুই পক্ষের অনড় অবস্থানের ফল, লি টেস্ট খেলেও ব্লেজার আর ক্যাপ পাননি। পরে কিংবদন্তি ক্রিকেটার স্যার জ্যাক হবস তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে লিকে একটি টাই উপহার দেন। ইংল্যান্ডের টেস্ট ক্রিকেটার হিসেবে এটাই লির একমাত্র স্মারক।
মাত্র ২৫ বছর বয়সে ১৯১৫ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধেই মৃত ঘোষিত হওয়া মানুষটি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন ৯১ বছর বয়সে, ১৯৮১ সালে। বারবার বিপদ থেকে ফিরে আসার আর জিতে যাওয়ার অসাধারণ সব গল্প লেখা মানুষটি জন্ম নিয়েছিলেন ১৯৯০ সালের ২৬ অক্টোবর, আজকের দিনে।
তথ্যসূত্র: উইজডেন ক্রিকেটার্স অ্যালামনাক, টাইমস অব ইন্ডিয়া ও মিডলসেক্স ক্রিকেট।