বসন্ত এসে গেছে। গাছে গাছে নতুন কুশি। রঙিন পাতা হবে একসময়। পাশেই তাদের জায়গা করে দেওয়ার প্রস্তুতি। রং ফুরিয়ে বেশ ধূসর হয়ে পড়া দুটি পাতা দিন গুনছে ঝরে পড়ার। একটির নাম রোহিত শর্মা, অন্যটির বিরাট কোহলি!
পাতা দুটিকে আঁকড়ে ধরে রাখা গাছটি প্রকাণ্ড। এর বীজ কে বা কারা কবে রোপণ করেছিল, অজানা থাকায় লোকের মুখে বয়সের গাছপাথর নেই। একটু ডাগর হয়ে ওঠা থেকে ধরলে ১৪৮ বছর চলছে।
বিবিধ বিবর্তন ও অভিযোজনে টিকে থাকা এই গাছের পাতাদের রং বাহারি, ফারাক উজ্জ্বলতায় ও টিকে থাকায়। সবাই ইচ্ছেমতো থাকতে পারে না। সামর্থ্য, প্রকৃতির খেয়াল ও মানুষের সিদ্ধান্তের প্রভাব তো থাকেই। কিন্তু যেসব পাতা এসব বাধা ডিঙিয়ে, সৌন্দর্যে ও নান্দনিকতা ছড়িয়ে টিকেছে নতুন কুশির উঁকি দেওয়া পর্যন্ত, তারপর একদিন ঝরে পড়েছে আপন ইচ্ছায়; তারা আসলে ওই গাছেরই স্পন্দন।
লোকে সেসব স্পন্দনের নাম রেখেছে ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যান, গ্যারি সোবার্স, শেন ওয়ার্ন, ওয়াসিম আকরাম, শচীন টেন্ডুলকার, ব্রায়ান লারা…রোহিত ও কোহলি।
পথিকের ফিসফাস, ঝরে পড়ার আগে শেষ দুটির স্পন্দন থেমে যাবে গাছের একটি বিশেষ অলিন্দে—নাম তার ওয়ানডে!
তারপর একদিন থামবে মূল স্পন্দনও। গাছ ও শাখার সঙ্গে বন্ধন ছিঁড়ে নেমে আসবে মাটিতে।
লোকে বর্তমানে বসত করে বলেই সবার প্রাধান্য ফিসফিসে। এর বাস্তবতাও আছে। রোহিত আটত্রিশ ছোঁবেন এপ্রিলে, নভেম্বরে কোহলি সাঁইত্রিশে। ২০২৩ সালের নভেম্বরে বিশ্বকাপ ফাইনালের পর থেকে গত মাস পর্যন্ত তাঁরা ভারতের ৭ ওয়ানডের ৩টিতে খেলেছেন। ওয়ানডেতে তাঁদের অনাগ্রহটা পরিষ্কার। আন্তর্জাতিক আঙিনার স্রোতও তা–ই। ওয়ানডে খেলাই হয় কম। আর চ্যাম্পিয়নস ট্রফির পর ওয়ানডেতে আইসিসির পরবর্তী ইভেন্ট ২০২৭ বিশ্বকাপ। গাছের ‘শাখা’ (বিসিসিআই) থেকে রোহিতের কাছে সমন গেছে, চ্যাম্পিয়নস ট্রফির পর কী করবেন জানাতে। কোহলির জন্য তারা আরেকটু অপেক্ষা করতে চায়, তবে ২০২৭ বিশ্বকাপের পরিকল্পনায় নেই। অর্থাৎ বসন্তে পাতাদের পালাবদলের মতো কোহলি-রোহিতও আছেন পালাবদলের মধ্যে।
তাহলে ওয়ানডেতে তাঁদের শেষ স্পন্দন কি চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতেই?
আবেগতাড়িত সমর্থকও হয়তো এ কথায় আপত্তি তুলবেন না, তাঁদের আর চালিয়ে না গেলেও চলে। ওয়ানডেতে অর্জনে ও ইতিহাসে তাঁরা এরই মধ্যে সেই বিশেষ তালিকার অংশ। রোহিতের শুধু আসল বিশ্বকাপটাই নেই। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ থেকে বেশির ভাগ আইসিসি ট্রফি আছে তাঁদের। টি-টোয়েন্টি ছেড়েছেন সর্বশেষ বিশ্বকাপ জিতেই। বাকি দুই সংস্করণের মধ্যে টেস্ট আসলে ওই গাছের সঙ্গে পাতার সম্পর্কচ্ছেদের মতোই, ওটা আরেকটু পরে হবে হয়তো। মাঝে খামাখা ওয়ানডে ঝুলিয়ে রেখে লাভ কী! দল থেকে সমর্থক—সবখানেই ওয়ানডের দামও পড়ে গেছে। বোর্ডও চাইছে নতুন করে সব সাজাতে। আসলে শাখাই যখন চাইছে না আর সব রং ছড়ানোও মোটামুটি শেষ, তাহলে স্পন্দনের অপচয়ে কী লাভ?
রোহিত–কোহলির ব্যাট তলোয়ার হয়ে উঠলেও দেখে কখনো কসাইয়ের ছুরি মনে হয়নি। বরং কোহলির কাভার ড্রাইভ কিংবা রোহিতের পুল দেখে কল্পনাবিলাসী ভক্তের মনে হতে পারে, ভিঞ্চি বুঝি এভাবেই ছবি আঁকতেন!
শিল্প তো সেটাই, যেটায় অপচয় নেই, আছে পরিমিতিবোধ। কোথায়, কখন থামতে হবে, তা জানতে হয়। রোহিত–কোহলি তো ব্যাটিংয়ের শিল্পীই।
আবার গাছটিকে সোৎসাহে দেখা পথিকও জানেন, এ দুটি পাতার স্পন্দন থামলেই শেষ হবে ওয়ানডে দেখে বেড়ে ওঠা শেষ প্রজন্মের আখ্যান।
২০০৫ সালে আন্তর্জাতিক টি–টোয়েন্টি শুরুর দুই বছর পর রোহিতের ওয়ানডে অভিষেক। কোহলির তিন বছর পর। অর্থাৎ জাতীয় দলে আসার আগে দুজনের শৈশব থেকে বেড়ে ওঠার সঙ্গী ছিল টেস্ট–ওয়ানডে। পরবর্তী প্রায় সব প্রজন্মের ক্রিকেটাররা উঠে আসার পথে তিন সংস্করণই পেয়েছেন। কিন্তু রোহিত–কোহলির শৈশব নব্বইয়ের দশকের রমরমা ওয়ানডের, তখন শুধু চার–ছক্কা নয়, কতটা শিল্পীত সুষমায় কীভাবে তা মারা হলো, সেসব গুণ বিচার করে সেরাদের তালিকা হতো। মননে সেসব নিয়ে বেড়ে ওঠা রোহিত–কোহলির ব্যাট তাই তলোয়ার হয়ে উঠলেও দেখে কখনো কসাইয়ের ছুরি মনে হয়নি। বরং কোহলির কাভার ড্রাইভ কিংবা রোহিতের পুল দেখে কল্পনাবিলাসী ভক্তের মনে হতে পারে, ভিঞ্চি বুঝি এভাবেই ছবি আঁকতেন!
বড় দৈর্ঘ্যের রঙিন ক্যানভাসে আঁকা সেসব ছবির আসলে তুলনা নেই। বিজ্ঞান বলে, পাতারা নাকি গাছেদের রান্নাঘর। তা, এ দুটি পাতায় তৈরি হওয়া খাবারদাবার ক্রিকেট নামের মহিরুহকে যতটা ঋদ্ধ করেছে, তার তুলনা খুব কমই হয়।
একসময় ভাবা হতো, ওয়ানডেতে টেন্ডুলকারের ৪৯ সেঞ্চুরির রেকর্ড কেউ ভাঙতে পারবেন না। কোহলির নামের পাশে ৫০ সেঞ্চুরি। ওয়ানডেতে রান তাড়া করে জেতানোয় সর্বোচ্চ সেঞ্চুরিও (২৭) তাঁর। ব্যাটসম্যান হিসেবে এ দুটি কীর্তি থাকলেই তাঁকে ওয়ানডে সিংহাসনে বসিয়ে দেওয়া যায়! ‘রাজা’র অলংকার ও আভরণ হিসেবে যোগ করতে পারেন বিশ্বকাপের এক আসরে সর্বোচ্চ রান, দ্রুততম ৮, ৯, ১০, ১১, ১২ ও ১৩ হাজার রান। রানের কথা যেহেতু উঠলই, কোহলি ওয়ানডের সেই তালিকায়ও কিন্তু সর্বকালের সেরায় তৃতীয়।
রোহিতের সৌন্দর্য অন্য জায়গায়। ওয়ানডেতে ডাবল সেঞ্চুরি তিনটি, যেখানে একটির বেশি নেই আর কারও। এই সংস্করণে ওপেনারদের মধ্যে সেঞ্চুরিসংখ্যায় শুধু টেন্ডুলকারই (৪৫) তাঁর ওপরে (৩০)। তিন সংস্করণ মিলিয়ে অবশ্য ভারতের ওপেনারদের মধ্যে রানে টেন্ডুলকারও তাঁর পেছনে, সামনে শুধু বীরেন্দর শেবাগ। বর্তমান ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ রানেও দ্বিতীয়, সামনে শুধু তাঁর সতীর্থ কোহলি। অর্থাৎ চ্যাম্পিয়নস ট্রফির পর তাঁরা এই সংস্করণ থেকে সরে দাঁড়ালে ওয়ানডে প্রজন্মের ওই ধারাটাও শেষ হবে। টি–টোয়েন্টির রমরমা সময়ে কোহলির (২৯৭) তিন শ ছুঁই ছুঁই কিংবা রোহিতের মতো আড়াই শ (২৬৮) ম্যাচ পেরিয়ে যাওয়া ক্যারিয়ার আর কারও হবে কি না, সেটা যে অনেক বড় প্রশ্ন।
স্বয়ং গাছটাও তা জানে। কিন্তু গাছেদের দুঃখকষ্ট তো বোঝা যায় না ক্রিকেটের মতোই। পাতা দুটির স্পন্দন যেদিন থামবে, সেদিন বড়জোর গাছের শাখা–প্রশাখায় আলোড়ন হবে, এ–ই যা! পথিকও যথাস্থানে তাঁদের না দেখে আফসোসের দীর্ঘশ্বাস ফেলবেন, তারপর একদিন ভুলে যাবেন?
নাহ্, কিছু পাতা ঝরার ক্ষত গাছকে চিরকাল বইতে হয়, পথিককেও ফিরে তাকিয়ে বলতে হয়—আহা, পাতা দুটি কী সুন্দরই না ছিল!