যেদিন সৃষ্টিকর্তার খুব কাছাকাছি ছিলেন ডি ভিলিয়ার্স

আব্রাহাম বেঞ্জামিন ডি ভিলিয়ার্স। ক্রিকেট বিশ্ব তাঁকে চেনে এবি ডি ভিলিয়ার্স নামে। নিজের প্রজন্মের তো বটেই, সংক্ষিপ্ত সংস্করণে সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন তিনি। আধুনিক ক্রিকেটে সময় উদ্ভাবনী শট খেলায় এগিয়ে ছিলেন অনেকের চেয়ে। অপ্রথাগত সব শট খেলার রেঞ্জ এত বেশি যে তাঁকে ‘মিস্টার ৩৬০ ডিগ্রি’ নামেও ডাকা হয়। ওয়ানডেতে দ্রুততম ফিফটি, দ্রুততম সেঞ্চুরি ও দ্রুততম ১৫০ রানের রেকর্ড তাঁর দখলে। ২০১৫ সালে জোহানেসবার্গে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তাঁর সেই ৪৪ বলে ১৪৯ রানের ইনিংসটি এখন ক্রিকেট–রূপকথার অংশ। আত্মজীবনী ‘এবি—দ্য অটোবায়োগ্রাফি’তে সেই ইনিংসটি নিয়ে একটি অধ্যায় লিখেছেন ডি ভিলিয়ার্স।

কী লিখেছেন এবি ডি ভিলিয়ার্স

অন্য কারও ব্যাটিংয়ে নামা উচিত।

রোববার। ১৮ জানুয়ারি, ২০১৫। জোহানেসবার্গের ওয়ান্ডারার্স স্টেডিয়ামে ওয়ানডে খেলছে দক্ষিণ আফ্রিকা। তিল ধারণের ঠাঁই নেই গ্যালারিতে উষ্ণ রোদের সরব দর্শক। কারণ, মাঠে ব্যাটিংয়ে রাইলি রুশো ও হাশিম আমলা, অসাধারণ খেলছে। ভিত গড়ছে জয়ের।

স্কোর দুই শ পেরিয়ে গেল। ওরা ফেরেনি। ড্রেসিংরুমে রাসেল ডমিঙ্গোকে গিয়ে ধরলাম, উনি আমাদের কোচ, ‘মিলার এরপর যাক, কোচ। ওর জন্য একদম আদর্শ (ম্যাচের পরিস্থিতি)।’

‘না, এরপর তুমি’—ডমিঙ্গোর শক্ত কণ্ঠ।

কিন্তু আমার মাথায় ঢুকল না। সুলেমান বেনের এখনো দুই ওভার বাকি। কেউ আউট হলে মিলার নেমে এই বাঁহাতি স্পিনারকে একদম চালিয়ে খেলবে। কারণ, তার বল বাঁহাতির ভেতরে আসবে। পরিস্থিতিটা মিলারের জন্য একদম আদর্শ।
পাঁচ ম্যাচের সিরিজে আমরা ১-০ তে এগিয়ে। আমরাই সিরিজ জিতব, সবার ধারণা। কিন্তু সে জন্য কোনো সুযোগই হাতছাড়া করা যাবে না।

আমলা ও রুশো দাপটের সঙ্গে খেলছে। স্কোর ২২০ পেরিয়ে গেল।
এখন একটু অন্য রকম ভাবাই যায়।
‘কোচ, সিরিয়াসলি বলছি এরপর ডেভের যাওয়া উচিত।’
‘না, এই পরিস্থিতিতে তুমিই সেরা।’
এক্সট্রা কাভার দিয়ে হাশিম আমলার আরেকটি চার। স্কোর এগোচ্ছে ভালোই।

ড্রেসিংরুমে ফিজিওথেরাপি দেওয়ার বিছানায় গা-টা এলিয়ে দিই। ডেল স্টেইন, ফাফ ডু প্লেসিরা আশপাশেই। ওয়ান্ডারার্সে আরেকটি ‘গোলাপি’ রোববারে কোলাহল ভালোই লাগছিল সবার। বার্ষিক এ ম্যাচে গোলাপি জার্সি পরে নামে দক্ষিণ আফ্রিকা, বেশির ভাগ দর্শকের গায়েও তাই; স্তন ক্যানসার নিয়ে সচেতন করতে তহবিল সংগ্রহ করা হয়।
এটা আমার ১৭৭তম ওয়ানডে। কিন্তু নার্ভাস লাগছিল। প্রথম ম্যাচে যেমন লেগেছিল।
‘আর ঠিক হলো না’, অস্ফুটে একটু জোরেই মুখ ফুটে বেরিয়ে গেল কথাটা। অন্য কাউকে উদ্দেশ করে বলিনি, কিন্তু ফাফ শুনল, ‘কী?’

‘স্নায়ুচাপ। ব্যাটিংয়ে নামার আগে খুব বাড়ে।’

কথা বলার ফাঁকেই ১২৮ করে রাইলি ডিপে ধরা পড়ল। আমাদের স্কোর ১ উইকেটে ২৪৭। নামতে হবে। ব্যাটটা নিয়ে সিঁড়ি ভাঙতে গিয়েই হোঁচট খেলাম। ডেল আর ফাফের সে কী হাসি।

অনন্তকালের পথ পেরিয়ে অবশেষে মাঠে। শরীরটা একটু আলগা করে নিলাম। হাত দুটোও। হঠাৎ করেই চারপাশটা খেয়াল হলো। হাইভেল্ডে সুন্দর রৌদ্রোজ্জ্বল একটা দিন। চারপাশে গোলাপির জয়জয়কার। প্রোটিয়ারা ভালো করছে। লোকে খুশি। উত্তেজিত। আবারও জীবিকার জন্য এই খেলাটি খেলতে পারায় নিজেকে ভাগ্যবান মনে হলো। দেশের প্রতিনিধিত্ব করছি, এখন ওয়ানডে দলের অধিনায়কও, এসব ভাবতে ভাবতে খেয়াল হলো, আবেগ নিয়ন্ত্রণে নিতে হবে। এখন কাজের সময়। একটা ছন্দ মেনে জোনে ফিরতে হবে। নিজের খেলাটা খেলতে হবে।

হ্যাশ (হাশিম আমলা) ১১৬ বলে ১১৪ করে আমার অপেক্ষায়। খুবই শান্ত ও নিয়ন্ত্রিত। আমরা সেই কিশোরকাল থেকে একসঙ্গে কিংবা বিপক্ষে ক্রিকেট খেলছি। স্কুল, প্রদেশ হয়ে এখন দেশের জার্সিতে। সে খুবই উঁচুমানের মানুষ, উঁচুমানের খেলোয়াড়।
‘আমি এক বা দুই ওভার একটু দেখব। তারপর একসঙ্গে চালাব’ বললাম হাশিমকে। খুবই সরল পরিকল্পনা। হাশিম শেষ পর্যন্ত খেলবে। আমি যত দ্রুত সম্ভব সেট হয়ে মোমেন্টাম এনে দেওয়ার চেষ্টা করব। সব চালাব। ৩৫০ পেরিয়ে যেতে পারলে ম্যাচটা ওদের থেকে বের করে নেওয়া যাবে।

আর ৬৯ বল বাকি।

সেদিন অন্য মাত্রার ব্যাটিং করেছিলেন ডি ভিলিয়ার্স

জেরোম টেলর দৌড়ে এসে বল করল। স্লোয়ার…সোজা ও ফুল…একদম মারার জায়গায়। ড্রাইভের টাইমিংটা ঠিকমতো হলো না। কিন্তু মিড অন দিয়ে চার। ভালো বোধ হচ্ছিল। কখনো কখনো এমন সব ম্যাচে শট ঠিকমতো খেলতে না পারলেও মনে হয় সব ঠিক আছে।

৪০তম ওভারে স্ট্রাইক ধরে রাখলাম। আন্দ্রে রাসেল করবে। প্রথম বলে সিঙ্গেল নিলাম, পরেরটায় হ্যাশ সিঙ্গেল নিল। বেশ কিছু বল খেলা হলো। মনে হলো এখনই সময়!
মিড অফের ওপর দিয়ে চার…ছক্কা…অফ স্টাম্পে সরে এসে স্কয়ার লেগের ওপর দিয়ে ছক্কা। একদম দর্শকদের কাছে। চার এক্সট্রা কাভারের ওপর দিয়ে, ফ্লিক করে স্কয়ার লেগের ওপর দিয়ে ছক্কা। ডান হাঁটুতে ভর করে বসতে ভারসাম্য হারিয়েছি, কিন্তু বলটা খেলেছি ভালোভাবে।

৮ বলে আমার ২৮। ইনিংসের শুরুতে সাধারণত আমি এভাবে খেলি না।
সবকিছু ঠিকঠাক মনে হচ্ছে। ঠিক জায়গায় আছি আজ। একটি শটও আগে থেকে ভেবে রাখা নয়। ডেলিভারির আগে চারপাশটা দেখে নিই। ফিল্ডাররা কে কোথায়, গ্যাপ কোথায়, মারব কোথায়, সেটা ঠিক করে রাখি। তাতে তিন থেকে চারটি শট খেলার সুযোগ থাকে, লেংথ দেখে সেখান থেকে একটা খেলি।

উদাহরণ দিতে পারি। লেগে মারার কথা ভাবলে অফ স্টাম্পের বাইরে সরে আসি। তখন ফুল লেংথে ড্রাইভ করতে পারব, খাটো লেংথে পুল কিংবা এর মধ্যে যেখানেই পড়ুক। এক হাঁটুর ওপর বসে ল্যাপ শটও খেলা যাবে, স্কয়ার লেগের ওপর দিয়ে ফ্লিক, বলকে বের হয়ে যেতে সাহায্য করা। এটাই পরিকল্পনা। কিন্তু সব সময় কাজে লাগে না।
টেলর ভালো বোলিং করছে। তার ওভারের শেষ বলটি রিভার্স সুইপ করতে গিয়ে ব্যাটে পাইনি। খুব অদ্ভুত লাগল। মনকে বোঝালাম—এটা রিভার্স সুইপের দিন নয়। জোর করে কিছু করার প্রয়োজন নেই। এমনিতেও বল ভালো মারছি। তাই আমার অবশ্যই নিজের স্ট্রোকগুলোর ওপর নির্ভর থাকা উচিত এবং ‘ভি’তে খেলা উচিত। আর মাঝেমধ্যে ল্যাপ শট। নিজের ভেতরকার অনুভূতিতে আস্থা রাখতে হবে।
৪১ ওভার শেষে স্কোর ১ উইকেটে ২৮৮। আমরা সাড়ে তিন শর আশপাশে থামার পথেই আছি।

এখন পুরোপুরি হাত খুলে ব্যাটিংয়ের সময়।

শুধু ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলিং নয় রেকর্ড বইও ওলট-পালট করেছিলেন ডি ভিলিয়ার্স

ছক্কা...ল্যাপ শটে স্কয়ার লেগের ওপর দিয়ে। আবারও ছক্কা, মিড অফ দিয়ে। ১৬ বলে ৫০ হলো আমার—ওয়ানডেতে নতুন বিশ্ব রেকর্ড। কিন্তু এসবের মূল্য আমার কাছে সামান্যই। এখন উপভোগের সময়। সব বল মেরে মাঠের বাইরে পাঠাতে হবে।
আরেকটি ছক্কা। মারলন স্যামুয়েলসের মাথার ওপর দিয়ে বাইরে পড়ল। হাঁটু গেড়ে কাভারের ওপর দিয়ে চার। দর্শকেরা উঠে দাঁড়িয়ে করতালি দিচ্ছেন। আমি এখন জোনের মধ্যে।

গ্যালারিতে মা–বাবা আছেন। সঙ্গে আমরা বড় ভাই ইয়ানের তিন বছর বয়সী ছেলে বেঞ্জামিন। কিন্তু তারা (গ্যালারির) কোথায় আমার অজানা। আমার স্ত্রী দানিয়েল্লের শরীর ভালো নেই। আমরা প্রথম সন্তানের অপেক্ষায় আছি। সে প্রিটোরিয়ায় বাসায় টিভিতে ম্যাচটি দেখছে। এমন পাগলাটে সময়ে পরিবারের সবাই যেন আমাকে দেখে গর্বিত হয়, সেটাই আমি চাই।

ক্রিস গেইল এগিয়ে এসে বলল, ‘তুমি কিংবদন্তি।’ আমার কেমন লজ্জা লাগল। একটু হেসে বললাম, ‘না, তুমি কিংবদন্তি।’

স্কোর ১ উইকেটে ৩১২। আর ৮ ওভার বাকি। আমার স্কোর ১৮ বলে ৬১। হ্যাশ বলল, আমরা ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদের কাছ থেকে ম্যাচ বের করে নিয়ে যেতে পারি। সে জন্য যেভাবে খেলছি, সেভাবেই খেলতে হবে। আমি একমত এবং সেটাই করছিলাম।
২০০৪ সালে প্রোটিয়াদের হয়ে অভিষেকের পর অনেক কিছুই পাল্টেছে। তখন বলের লাইনে গিয়ে আমার ‘গো টু শট’ ছিল কাভার কিংবা স্কয়ারে ড্রাইভ খেলা। এখন আমি আরও অভিজ্ঞ। (বল) বানিয়ে নিয়ে খেলি। গ্যাপে উড়িয়ে বা নিচে যতটা জোরে মারার চেষ্টা করি।

ল্যাপ শট ব্যাটে ভালো লাগছে। ৪৫তম ওভারে স্কয়ার লেগ দিয়ে আরেকটি ছক্কা মারলাম। এখন আমার স্কোর ৮৮। সবকিছু্ই ব্যাটে আসছে ভালোমতো।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ অধিনায়ক হোল্ডার ইয়র্কার মারার চেষ্টা করল, আমি একটু সরে গিয়ে ফুল টস বানিয়ে ফাইন লেগ দিয়ে ছক্কা মারলাম। পরেরটি স্কয়ার লেগ দিয়ে ছক্কা। ইলেকট্রনিক স্কোরবোর্ড ঘোষণা করল আমার রান ৩১ বলে ১০০। ওয়ানডেতে নতুন বিশ্ব রেকর্ড।

গ্যালারিতে দর্শকদের গর্জন। দুই হাত উঁচিয়ে ধরলাম। আমার জন্য বিশেষ মুহূর্ত। হ্যাশকে জড়িয়ে ধরলাম। এ পর্যন্তই। নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখেছি। অবশ্যই আমি খুশি। তবে সবকিছুর আগে বাকি থাকা কাজটা শেষ করতে হবে। পাশাপাশি এই খেলা এবং প্রতিপক্ষকেও অসম্মান করা যাবে না। দ্রুত ক্রিজে ফিরলাম। হোল্ডার বোলিং করতে প্রস্তুত এবং তারপর মিড অন দিয়ে আবারও ছক্কা!
৪ ওভার বাকি। আমাদের স্কোর ১ উইকেটে ৩৮৮।

ক্রিস গেইল এগিয়ে এসে বলল, ‘তুমি কিংবদন্তি।’ আমার কেমন লজ্জা লাগল। একটু হেসে বললাম, ‘না, তুমি কিংবদন্তি।’

গ্যালারির একাংশে গর্জন উঠেছে, ‘এ–বি! এ–বি! এ–বি!’
ওয়ান্ডারার্সে এমন আগেও ঘটেছে। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে ঘটবে, সেটা দূরতম কল্পনায়ও ছিল না।

যাহোক, ওসব চিন্তা বাদ। কাজে ফেরা যাক।

দিনটা ছিল ডি ভিলিয়ার্সের। যেভাবে চেয়েছেন সেভাবেই খেলতে পেরেছেন

৪৭তম ওভারে ১২তম ছক্কাটা পেলাম। হাশিমও বাউন্ডারি মেরে ১৫২ রানে পৌঁছে গেল। আর ৪৯তম ওভারে এসে যেন জাদুর গালিচায় চড়লাম! মিড উইকেটের ওপর দিয়ে ছক্কা, মিড অনের ওপর দিয়ে ছক্কা, ইয়র্কার থার্ড ম্যান দিয়ে চার, শর্ট বল স্কয়ার লেগের ওপর দিয়ে পুল করে ছক্কা, মিড অফের ওপর দিয়ে ছক্কা এবং স্লগ সুইপে মিড উইকেট দিয়ে ২ রান।

আমাদের স্কোর ১ উইকেটে ৪৩৬। আর এক ওভার বাকি।
বোলিংয়ে রাসেল। চতুর্থ বলটি অফ স্টাম্পে হাফ ভলি ছিল। কাভার পয়েন্টে খেললেও টাইমিং ভালো ছিল না। সীমানায় জোনাথন কার্টারের হাতে ক্যাচ। আউট!
গ্যালারি কেমন চুপচাপ, ফিসফাস। ড্রেসিংরুমের পথে হাঁটা ধরার সময় আওয়াজ ধীরে ধীরে বাড়ছিল। পাদপ্রদীপ কিংবা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকাটা কখনো উপভোগ করিনি। যত দ্রুত সম্ভব ড্রেসিংরুমে পৌঁছাই।
নিজের জায়গায় বসে লম্বা একটা শ্বাস নিলাম।
সত্যি সত্যিই কি এটা ঘটল?
অ্যাড্রেনালিনের গতি কমে এলে খুব ক্লান্ত লাগল। ভাগ্যবান মনে হলো নিজেকে।
৫০ ওভারে আমাদের স্কোর ২ উইকেটে ৪৩৯। তাড়া করতে নেমে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৭ উইকেটে ২৯১ রানের সম্মানজনক স্কোর করল। পাঁচ ম্যাচের সিরিজে আমরা ২–০ ব্যবধানে এগিয়ে যাই।
দিনটা অসাধারণ ছিল। কিন্তু আসল ব্যাপারটি কী বলুন তো?

আসল ব্যাপার হলো, দল হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকা ভালো খেলেছে। গ্যালারিতে ও টিভিতে ম্যাচটি দেখা সবাইকে আমরা আনন্দ দিতে পেরেছি।

রেকর্ড কিংবা পরিসংখ্যান আমাকে টানে না। টিভিতে দেখানো হলো, পরদিন সংবাদপত্রেও ওসব ছাপা হলো। রেকর্ড আসবে–যাবে। কিন্তু সত্যিকারের গৌরব হলো স্মৃতিতে, মানুষের আবেগে, যা মানুষ মনে রাখে, বাড়িয়ে তোলে জীবনের ব্যাপ্তি।
আমি বাড়ি ফিরলাম।

ওয়ান্ডারার্সে খেলার একটা সুবিধা হলো নিজে গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরতে পারি। দানিয়েল্লেকে দেখার জন্য মনটা ছটফট করছিল। দলীয় কথাবার্তা শেষে প্রিটোরিয়ার পথ ধরলাম। মুঠোফোনে চার্জ নেই। মিডর‌্যান্ড দিয়ে যাওয়ার সময় গান শুনতে শুনতে হঠাৎ করেই নিজেকে সৃষ্টিকর্তার খুব কাছাকাছি মনে হলো। চিৎকার করে বলে উঠলাম, ‘ধন্যবাদ।’

আমি একজন খ্রিষ্টান।

ডি ভিলিয়ার্সের সেদিনের ব্যাটিংয়ে সমৃদ্ধ হয়েছিল ওয়ানডের ইতিহাস

মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি এই বইটা আমার গল্প নয়। সৃষ্টিকর্তা আমার জন্য যে পরিকল্পনা করেছেন এবং আমার মাধ্যমে যা বুঝেছেন, সেটাই এই বইয়ের গল্প। আশা করি সবাই পড়ে বুঝবে যে এটা তাঁর (সৃষ্টিকর্তা) অর্জন, আমার ব্যক্তিগত অর্জন নয়। এই লাইনগুলোয় কারও কারও অস্বস্তি জাগতে পারে। আমি দুঃখিত। ধর্ম কখনো কখনো এমন প্রভাব ফেলে। সৃষ্টিকর্তার প্রতি আমার আস্থা এবং তাঁর সঙ্গে সম্পর্কটা আমার কাছে অবিশ্বাস্যরকম গুরুত্বপূর্ণ।

এটার অর্থ এই নয় যে আমি নিজেকে অন্য কারও চেয়ে শ্রেয়তর মনে করি। আমি তেমন নই।

নিজের মনে সঙ্গোপনে দুটি মুহূর্ত স্মরণ করি, যখন সৃষ্টিকর্তা সরাসরি আমার সঙ্গে কথা বলেছিলেন। এর আগে কাউকে এটা বলিনি, এমনকি আমার মা–বাবাকেও না।

১৯৯৫ সালে জানুয়ারির এক সন্ধ্যা। এরাসমাস পরিবার এবং বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দময় সময় কাটিয়ে ওয়ার্মবাথস থেকে আমরা ফিরছিলাম। বাবা ইসুজু ফ্রন্টিয়ার চালাচ্ছিলেন। মা পেছনের সিটে। ১০ বছর বয়সী আমি পেছনে ম্যাট্রেসের ওপর শুয়ে ছিলাম। খুব অদ্ভুত লাগছিল। হঠাৎ করেই কেঁদে ফেলি। সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব অনুভব করছিলাম। তিনি কী বলেছিলেন? সব সময় যেন বিনয়ী থাকি এবং যা পেয়েছি, তা নিয়েই যেন সন্তুষ্ট থাকি।

১৪ বছর পর যখন আমার বয়স ২৪ বছর, দক্ষিণ আফ্রিকা জাতীয় দলে খেলি, তখন সিডনি হারবারে দ্বিতীয়বার এটা ঘটে। বড় একটা বোটে আমরা পার্টিতে মত্ত ছিলাম। শরীরটা ভালো লাগছিল না। ডেকে শুয়ে পড়ি। কয়েক ঘণ্টা পর হঠাৎ করেই সেই অনুভূতিটা ফিরে আসে। ভেতর থেকে কেউ একজন বললেন, ‘নিজেকে তুমি কী ভাবো? তারকা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার? খুব মদ্যপান করছ? তোমার বিনয়ী থাকা প্রয়োজন। কাছের মানুষদের সঙ্গে থাকা প্রয়োজন। যা পেয়েছ, তা নিয়েই সুখী থাকা প্রয়োজন।’

ফুঁপিয়ে কান্না এল আমার। কেউ ছিল না ওখানে। শুধু কান্না এবং আমি।

পাঠকদের জন্য তথ্য

১৫ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে তিনবার ওয়ানডের বর্ষসেরা খেলোয়াড় হয়েছেন এবি ডি ভিলিয়ার্স। ২০১৯ সালে উইজডেনের বিচারে দশকের সেরা পাঁচ ক্রিকেটারের একজন। বিধ্বংসী, অপ্রথাগত শট খেলার মাস্টার, ক্ল্যাসি এবং অবিশ্বাস্য ফিল্ডার। সহজ ভাষায়, একই অঙ্গে অনেক গুণে গুণান্বিত এই ক্রিকেটারের আন্তর্জাতিক অভিষেক ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে টেস্ট ক্রিকেটে।

সংক্ষিপ্ত সংস্করণে বেশি পরিচিত পেলেও টেস্টেও সময়ের প্রয়োজনে ২২০ বলে ৩৩ রানের অবিশ্বাস্য ইনিংস আছে ডি ভিলিয়ার্সের। ১১৪ টেস্টে ৫০.৬৬ গড়ে ২২ সেঞ্চুরি ও ৪৬ ফিফটিসহ করেছেন মোট ৮৭৬৫ রান। টেস্টে দক্ষিণ আফ্রিকার চতুর্থ সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। ২২৮ ওয়ানডেতে ৫৩.৫০ গড়ে ২৫ সেঞ্চুরি ও ৫৩ ফিফটিসহ করেছেন ৯৫৭৭ রান। ওয়ানডেতে দক্ষিণ আফ্রিকার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক।

৭৮টি আন্তর্জাতিক টি–টোয়েন্টিতে ১০ ফিফটিসহ ২৬.১২ গড়ে ১৩৫.১৬ স্ট্রাইক রেটে করেছেন ১৬৭২ রান। আর ফ্র্যাঞ্চাইজি টি–টোয়েন্টিতে বিশ্বের সেরাদের একজন। আইসিসি হল অব ফেমে জায়গা পাওয়া এই কিংবদন্তি ২০২১ সালে ক্রিকেট থেকে অবসর নেন।