মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন।
সম্ভবত ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত নাম। দেশটির অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান ও সফল অধিনায়ক। আবার ম্যাচ ফিক্সিং কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে আজীবন নিষিদ্ধ। সত্যিই কি টাকা পেয়ে ম্যাচ ছেড়ে দিয়েছিলেন আজহার? নাকি তাঁকে বলির পাঁঠা বানানো হয়েছিল? এই শতাব্দীর শুরুর দিকে ভারতীয় ক্রিকেটে যে ম্যাচ ফিক্সিং কেলেঙ্কারি ঝড় তুলেছিল, সেই কালো অধ্যায়ে জড়ানো আজহারউদ্দিন সত্যিই বিচার পেয়েছিলেন কি না, সেটাই খোঁজার চেষ্টা করেছেন পরিচালক টনি ডি’সুজা তাঁর ‘আজহার’ সিনেমায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছবিটা কি আদৌ দর্শকদের সন্তুষ্ট করতে পেরেছে?
সিনেমার শুরুতেই ডিসক্লেইমার দেওয়া হয়, ‘এটি কারও বায়োপিক নয়, বরং একটি বা একাধিক ঘটনার কাল্পনিক নাট্যরূপ…শুধু বিনোদনের উদ্দেশ্যে বানানো।’ এই দাবি বেশ মজার। কারণ, সিনেমাটা হায়দরাবাদে জন্ম নেওয়া ভারতীয় ক্রিকেটারকে নিয়ে, যাঁর নাম আজহার। যিনি সাধারণ পরিবার থেকে উঠে এসেছেন, আশির দশকে যাঁর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক, প্রথম তিনটি টেস্টেই সেঞ্চুরি, যিনি অল্প বয়সেই নওরিন নামের এক নারীকে বিয়েও করেন। শুধু তা–ই নয়, পরে তিনি ভারতের অধিনায়কত্ব করেছেন, সঙ্গীতা নামের এক অভিনেত্রীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছেন, পরে তাঁকে বিয়েও করেছেন এবং একপর্যায়ে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অভিযোগে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধও হন। যদিও এক দশকের বেশি সময় পর আদালত সেই নিষেধাজ্ঞা বাতিল করে দেন।
বায়োপিক নয়? দাবিটা বেশ মজার বৈকি!
সিনেমা দেখে মনে হয়েছে পরিচালক টনি ডি’সুজা মূলত তিনটি দিকে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন—আজহারের ব্যক্তিগত জীবন, প্রেম-পরকীয়া সম্পর্ক এবং ম্যাচ ফিক্সিং কেলেঙ্কারি। কিন্তু দুঃখজনকভাবে তিনটিতেই ব্যর্থ হয়েছেন।
আজহারের প্রথম স্ত্রী নওরিনের সঙ্গে সম্পর্কটা যতটা ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা দেখানো হয়েছে, সঙ্গীতা বিজলানির সঙ্গে সম্পর্কটা ঠিক ততটাই উপেক্ষিত। আর সবচেয়ে অবাক করার বিষয়—এটা এক ক্রিকেটারের গল্প হলেও সিনেমায় ক্রিকেট প্রায় নেই–ই! কোনো স্মরণীয় ম্যাচ নেই, মাঠের উত্তেজনা নেই—সবটাই কাগজে–কলমে লেখা কথার ওপর ভরসা।
পুরো সিনেমায় বারবার বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে—আজহার নির্দোষ। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, যদি বোর্ড (সরাসরি নাম উল্লেখ না করলেও বোঝা যায় এটা বিসিসিআই) তাকে ফাঁসিয়েই থাকে, তবে তারা কেন এটা করল? সে প্রশ্নের কোনো উত্তর সিনেমাটি দেয় না।
আজহার চরিত্রে ইমরান হাশমি চেষ্টা করেছেন। হয়তো ভাষার টানটা ঠিকমতো আনতে পারেননি, কিন্তু আজহারের মতো একজন ভাঙা হৃদয়ের মানুষকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার চেষ্টা ছিল তাঁর। প্রাচী দেশাইও ভালো অভিনয় করেছেন নওরিন চরিত্রে। কিন্তু সঙ্গীতা বিজলানির চরিত্রে নার্গিস ফাখরির অভিনয় দুর্বলই লেগেছে। সংলাপে দুর্বলতা আর মুখের অভিব্যক্তিতে অনভিজ্ঞতা একেবারে স্পষ্ট।
ম্যাচ ফিক্সিংয়ের মামলা নিয়ে কিছু মামুলি আদালতকক্ষের দৃশ্য থাকলেও তা এতটাই নিরস আর সাজানো লাগে যে দর্শক হিসেবে বিরক্তিই আসার কথা। একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, অথচ তার পেছনের বাস্তবতা, আবেগ, সিদ্ধান্তের গভীরতা—সবই উধাও।
সিনেমার একটি দৃশ্যে আজহারকে একটা জিম উদ্বোধন করতে বাধ্য করা হয়, যাতে মানুষ ভাবে তিনি এখনো স্বাভাবিক জীবন যাপন করছেন। কিন্তু জিমমালিক যেন তাঁকে কিনে ফেলেছেন, এমন আচরণ করে। এই দৃশ্য বেশ দাগ কাটে। তারকাদের এই জীবনটা বাইরে থেকে আমরা সাধারণত দেখতে পাই না। ওই মুহূর্তেই বোঝা যায়, আজহারের জীবনে অনেক অদেখা যুদ্ধ ছিল।
দুঃখের বিষয়, পুরো সিনেমায় এমন দৃশ্য হাতে গোনা কয়েকটি। বাকি গল্প যেন রংচং মাখানো।
‘আজহার’ আসলে হতে পারত একটি সাহসী, গভীর ও আবেগঘন গল্প। হতে পারত একজন পতিত তারকার হারানো সম্মান খুঁজে ফেরার লড়াই। কিন্তু সিনেমাটি শেষ পর্যন্ত রয়ে গেছে একটা সুযোগ হারানোর আক্ষেপ হয়ে।
পরিচালক: টনি ডি’সুজাচিত্রনাট্য: রজত অরোরামুক্তি: ১৩ মে ২০১৬রান টাইম: ১৩২ মিনিটঅভিনয়: ইমরান হাশমি, প্রাচী দেশাই, নার্গিস ফাখরি, কুনাল রয় কাপুর, লারা দত্ত, কুলভূষণ খরবান্দা, রাজেশ শর্মা।আইএমডিবি রেটিং: ৫.৭ /১০