প্রথম দল হিসেবে টানা ইউরো জিতেছে স্পেন।
প্রথম দল হিসেবে টানা ইউরো জিতেছে স্পেন।

ফিরে দেখা ইউরো

আরও একবার স্প্যানিশ টিকিটাকার জাদু

যে সময় হওয়ার কথা, করোনা সে সময় ইউরো হতে দেয়নি। এক বছর পিছিয়ে যখন শেষ পর্যন্ত হতে যাচ্ছে, করোনা তখনো বিদায় নেয়নি পৃথিবী থেকে। তাতে কী! করোনার ভয়ে তো সব বন্ধ করে বসে থাকলে চলবে না। ১১ জুন থেকে তাই মাঠে গড়াচ্ছে ইউরোপিয়ান ফুটবলে জাতীয় দলগুলোর সবচেয়ে মর্যাদার আসর। তবে আনুষ্ঠানিক নামটা থাকছে আগের মতোই—ইউরো ২০২০। আরও একবার ইউরোপিয়ান ফুটবলের উন্মাদনায় মেতে ওঠার আগে স্মৃতির ভেলা ভাসিয়ে ফিরে দেখা যাক আগের আসরগুলো—

স্পেনের টানা তিন

দুই বছর আগে বিশ্বচ্যাপিয়ন, তারও দুই বছর আগে ইউরোপের। ২০১২ ইউরো শুরুর আগে তাই যথারীতি স্পেনই ফেবারিট। কিন্তু সবার পছন্দের ছিল না দলটা।
টিকিটাকা ফুটবলের বিরক্তিকর দিকটা তখন অনেককেই সমালোচক বানিয়ে ফেলেছে। জার্মান কিংবদন্তি ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারই তো টুর্নামেন্ট শুরুর আগে বলেছিলেন, ‘ওরা (স্পেন) মাঝেমধ্যে শট কেন নেয় না? শুধু পাস আর পাস!’

বেকেনবাওয়ারের অপছন্দ হতে পারে। কিন্তু আরও একবার সেই টিকিটাকাই খুব কার্যকর প্রমাণিত হতো। ২০০৮ ইউরোতে লুইস আরাগোনেস যেভাবে খেলিয়েছিলেন, তার চেয়ে একটু পরিবর্তন অবশ্য দেখা গেল চার বছর পরে দেল বস্কের দলে। বিশেষজ্ঞ কোনো স্ট্রাইকার ছাড়াই প্রায় পুরো টুর্নামেন্ট খেলেছে স্পেন। সেস্ক ফ্যাব্রেগাস মাঝেমধ্যে খেলেছেন ‘ফলস নাইন’ হিসেবে। কিন্তু নিজেদের কাজটা এত ভালো করেছেন স্প্যানিশ ফুটবলাররা, ওই অস্বাভাবিক কৌশলও খুবই কার্যকর লেগেছে সেই ইউরোতে।

স্পেনের সেরা প্রজন্ম সম্ভাব্য সবকিছুই জিতেছে।

কিয়েভের অলিম্পিক স্টেডিয়ামের ফাইনালে প্রায় সবকিছু স্পেন যেভাবে চেয়েছিল, সেভাবেই হলো। ইতালি যা চেয়েছিল, হলো না তার কিছুই।

জার্মানিকে সেমিফাইনালে হারাতে গিয়েই যেন সব শক্তি শেষ করে ফেলেছিল ইতালি। ফাইনালে খুব ক্লান্ত মনে হলো আজ্জুরিদের। তার ওপর ম্যাচের শেষ ২৮ মিনিট ইতালিকে খেলতে হলো ১০ জন নিয়ে। থিয়াগো মোত্তা চোট পেয়ে যখন মাঠ ছাড়েন, তার আগেই তিনটি বদল করে ফেলেছিলেন ইতালির কোচ সিজার প্রানদেল্লি।

ম্যাচের ভাগ্য অবশ্য নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল তার আগেই। গুনে গুনে টানা ১৪ পাসের পর ডেভিড ভিয়ার প্রথম গোল। জর্দি আলবার দ্বিতীয় গোলটাও প্রায় প্রথম গোলের ‘কপি-পেস্ট’। ৪১ মিনিটের মধ্যে দুই গোল খেলে আর ফেরা যায় নাকি ম্যাচে! উল্টো ১০ জনের ইতালিকে পেয়ে শেষ দিকে আরও দুটি গোল করে দিলেন ফার্নান্দো তোরেস ও হুয়ান মাতা।

টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় ইনিয়েস্তা।

প্রথমবারের মতো ইউরোর ফাইনালে কোনো দল ৪ গোলের ব্যবধানে জিতল, ইউরোর ফাইনালে সবচেয়ে বড় হারের লজ্জা নিয়ে মাঠ ছাড়ে ইতালি। ইউরোপের প্রথম দল হিসেবে টানা তিনটি বড় ট্রফি জিতল স্পেন। প্রথম কোচ হিসেবে চ্যাম্পিয়নস লিগ, ইউরো ও বিশ্বকাপ জেতার বিরল কীর্তি গড়লেন স্পেনের ভিসেন্তে দেল বস্ক।

একনজরে ইউরো ২০১২

স্বাগতিক: পোল্যান্ড-ইউক্রেন
ফাইনালের ভেন্যু: অলিম্পিক স্টেডিয়াম, কিয়েভ
চ্যাম্পিয়ন: স্পেন
রানার্সআপ: ইতালি

গোল্ডেন বুট: ৩ গোল, ফার্নান্দো তোরেস (স্পেন)

সেরা খেলোয়াড়: আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা (স্পেন)

২০০৮ ইউরোর পর আরও একবার দুই স্বাগতিক দলকেই বিদায় নিতে হয় গ্রুপ থেকে। ‘এ’ গ্রুপে চতুর্থ হয়েছিল পোল্যান্ড, ‘ডি’ গ্রুপে তৃতীয় ইউক্রেন। সবচেয়ে বেশি হতাশ করেছিল নেদারল্যান্ডস। জার্মানি, পর্তুগাল, ডেনমার্ককে নিয়ে গড়া গ্রুপ থেকে ডাচরা বিদায় নিয়েছিল কোনো ম্যাচ না জিতে, কোনো পয়েন্ট না পেয়ে। সেমিফাইনালে ওঠার জন্য শেষ আটে ইংল্যান্ডকে হারাতে টাইব্রেকার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে ইতালির। স্পেনও শেষ চারে পর্তুগালের বিপক্ষে সেমিফাইনালে জিতেছে টাইব্রেকার–ভাগ্যেই। পুরো টুর্নামেন্টে একটা গোল খেয়েছিল স্পেন, সেটা গ্রুপ পর্বে ইতালির সঙ্গে ১-১ ড্রয়ে।

আরও যত গল্প

জিওভান্নি ত্রাপাত্তোনি।

বুড়ো কোচ

৭৩ বছর ৯৩ দিন বয়সে ডাগআউটে দাঁড়িয়ে ইউরোর সবচেয়ে বেশি বয়সী কোচ হিসেবে রেকর্ড গড়েন জিওভান্নি ত্রাপাত্তোনি। সেদিন তাঁর দল আয়ারল্যান্ড অবশ্য ২-০ গোলে হেরেছিল ত্রাপাত্তোনির নিজের দেশ ইতালির কাছে।

হেডেই বাজিমাত

৩১ ম্যাচে ৭৬টি গোল হয়েছল ২০১২ ইউরোতে, যার মধ্যে ২২টিই ছিল হেড থেকে। শুরুটা হয়েছিল উদ্বোধনী ম্যাচে গ্রিসের বিপক্ষে পোলিশ স্ট্রাইকার রবার্ট লেভানডফস্কির হেডে। ইউরোর এক আসরে হেডে এত বেশি গোল আর কখনো হয়নি।

টিকিটাকা

স্পেন-আয়ারল্যান্ড ম্যাচে আইরিশরা পাস খেলেছিল ১৯৮টি, স্পেন ৮১০টি। স্প্যানিশ মিডফিল্ডার জাভি একাই দিয়েছিলেন ১২৭টি পাস। ইউরোর এক ম্যাচে একা কোনো খেলোয়াড় আর কখনো এর চেয়ে বেশি পাস দেননি।

টানা দুটি ইউরোর ফাইনালে গোল করেছেন ফার্নান্দো তোরেস।

দুই ফাইনালে গোল

প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে টানা দুটি ইউরোর ফাইনালে গোল করলেন ফার্নান্দো তোরেস। মোট তিন গোল করে ২০১২ ইউরোর গোল্ডেন বুটও জিতেছিলেন স্প্যানিশ স্ট্রাইকার। ৩টি করে গোল করেছিলেন আরও ৫ জন। এর মধ্যে জার্মানির মারিও গোমেজ ও তোরেসের একটি করে অ্যাসিস্টও ছিল। তবে গোমেজের চেয়ে কম সময় খেলায় তোরেসকেই দেওয়া হয় সোনার জুতো।

অবিশ্বাস্য রোনালদো

নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে জোড়া গোল করার পর টানা পাঁচটি বড় টুর্নামেন্টে (২০০৪, ২০০৮, ২০১২ ইউরো, ২০০৬ ও ২০১০ বিশ্বকাপ) গোল করা প্রথম পর্তুগিজ খেলোয়াড় হন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। পর্তুগিজ ফরোয়ার্ড অবশ্য সেখানেই থামেননি। পরে গোল করেছেন ২০১৪ বিশ্বকাপ, ২০১৬ ইউরো ও ২০১৮ বিশ্বকাপেও। টানা আটটি বড় টুর্নামেন্টে গোল করার কীর্তি নেই ফুটবল ইতিহাসের আর কোনো খেলোয়াড়ের।