
আর্জেন্টিনা টানা ৩১ ম্যাচ অপরাজিত। ব্রাজিল দক্ষিণ আমেরিকান অঞ্চলের বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে কোনো ম্যাচ তো হারেইনি, সবার ওপরে থেকে, সবার আগে বিশ্বকাপে জায়গা নিশ্চিত করেছে। আর্জেন্টিনা দলে মেসি, দি মারিয়া, মার্তিনেজ, দি পলদের উপস্থিতি আর্জেন্টাইনদের বিশ্বকাপের স্বপ্ন দেখায়। আর ব্রাজিলে নেইমার, ভিনিসিয়ুস, আন্তোনি, জেসুস, কুতিনিও, কাসেমিরো, আলিসনদের দলটা তো ব্রাজিলের ইতিহাসেই অন্যতম প্রতিভাবান।
কিন্তু আর্জেন্টিনার মিডফিল্ডার লিয়ান্দ্রো পারেদেস কাতার বিশ্বকাপে ফেবারিটের তালিকার সেরা তিনে নিজের দল আর্জেন্টিনাকে তো রাখেনইনি, চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলকেও রাখেননি! তাঁর চোখে বিশ্বকাপের দাবিদার হিসেবে সবার চেয়ে এগিয়ে থাকা তিন দল ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ও স্পেন।
আর্জেন্টাইন দৈনিক টিওয়াইসি স্পোর্তে সাক্ষাৎকারে আর্জেন্টিনা দল, পিএসজিতে মেসির আগমন, মেসি-দি মারিয়া-দি পলের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব, ২০১৮ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার কোচ হোর্হে সাম্পাওলির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক...অনেক কিছু নিয়েই কথা বলেছেন পারেদেস। বিশ্বকাপের বছরে সেখানে কাতার বিশ্বকাপের প্রসঙ্গ তো স্বাভাবিকভাবেই চলে আসে।
আর্জেন্টিনার এবারের দলটাকে গত কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে গোছানো বলে রায় দেন অনেকেই, মেসির শেষ বিশ্বকাপ বলে এবার আর্জেন্টাইনরা দারুণ সমাপ্তির আশায় বুক বাঁধছেন। কাতার বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনাকে ফেবারিট দলগুলোর একটিও ধরা হয়। যদিও ব্রাজিল, স্পেন, জার্মানি, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড দলের চেয়ে ধারে-ভারে আর্জেন্টিনা কিছুটা পিছিয়ে বলেও সাদা চোখের বিশ্লেষণে উঠে আসে। পারেদেসও আর্জেন্টিনাকে বেশি এগিয়ে রাখছেন না।
কাতার বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার সম্ভাবনা নিয়ে টিওয়াইসি স্পোর্তে পিএসজির আর্জেন্টাইন মিডফিল্ডারের বিশ্লেষণ, ‘আমাদের যে দলটা আছে, আমরা নিশ্চিতভাবেই চেষ্টা করব যতটা সম্ভব বিশ্বকাপের শেষ পর্যন্ত যেতে। একেবারে শেষ পর্যন্ত যাওয়ার মতো ক্ষমতা আমাদের দলটার আছে।’
তবে প্রশ্ন যখন হলো তাঁর চোখে কাতার বিশ্বকাপে সম্ভাবনার দৌড়ে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা তিন দলের নাম নিয়ে, সেখানে আর্জেন্টিনাকে রাখেননি পারেদেস। রাখেননি চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলকেও। ইউরোপেই চোখ আটকে গেছে তাঁর। ‘ফ্রান্স—গত বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন, এবারও ওদের দলটা দারুণ। ইংল্যান্ডের দলটাও দারুণ। আর স্পেন’—পারেদেসের বিশ্লেষণ।
তবে আর্জেন্টিনা জাতীয় দল নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আবেগ ঝরে পারেদেসের। লিওনেল স্কালোনির অধীনে মাঠে আর্জেন্টিনার ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের পেছনে জাতীয় দলে খেলোয়াড়দের ভাতৃত্ববোধের চিত্রই সবার আগে উঠে আসে। মেসি, দি পল, দি মারিয়া, পারেদেস, মার্তিনেজদের সম্পর্কটা যে সহজ, সেটি দূর থেকে দেখেও টের পাওয়া যায়।
টের পাওয়া গেল পারেদেসের কথায়ও, ‘অসাধারণ খেলোয়াড়দের একটা দল গড়ে উঠেছে, যে দলটার কথা সব সময়ই মনে পড়ে। ক্লাবে যখন খেলি, মাঝে মধ্যে নিজেরাই বলি, ‘‘জাতীয় দলের খেলা কবে আসবে?’ ’ এখানে থাকা, জাতীয় দলের জার্সিতে মাঠে নামা, অনুশীলন, একসঙ্গে মাতে (আর্জেন্টিনা-উরুগুয়েতে জনপ্রিয় দক্ষিণ আফ্রিকান গরম পানীয়) পান করা...।’
এর পেছনে আর্জেন্টিনা কোচ লিওনেল স্কালোনিরই যত অবদান দেখেন পারেদেস, ‘এমন একটা দল গড়ে ওঠার পেছনে কৃতিত্ব কোচেরই প্রাপ্য, পাশাপাশি আরও যাঁরা ছিলেন সবারও। এত লম্বা সময় ধরে এত ভালো কাটবে, এমনটা নিশ্চিত করা অনেক কঠিন। প্রতিদিন একে অন্যকে দেখার, অনুশীলনে একসঙ্গে থাকার সময়টুকুতে কখনো একঘেয়েমি আসে না। (খেলোয়াড়দের একসঙ্গে তোলা) ছবিগুলো ক্যারিয়ারের বাকি সময়, জীবনের বাকি সময়টুকুতে আমাদের মনের কোণে গেঁথে থাকবে।’
সতীর্থদের সবার মধ্যে তিনজনের কথা আলাদা করে বলেছেন পারেদেস। রদ্রিগো দি পল তাঁর চোখে ‘ছোট ভাই’। আনহেল দি মারিয়া কেমন বন্ধু সেটা বোঝাতে বললেন, ‘প্রার্থনা করি প্রত্যেক মানুষের দি মারিয়ার মতো একজন বন্ধু থাকুক। ও একজন জিনিয়াস, সব দিকে মনোযোগ থাকে ওর, সব বোঝে। আবার পার্টিতে অনেক হাসাতেও পারে।’
বাকি থাকা অন্য একজন কে? লিওনেল মেসি! পারেদেসের চোখে, মেসি ‘যতটা ভালো খেলোয়াড়, তার চেয়েও অনেক অনেক ভালো একজন মানুষ।’ আর মেসি কতটা ভালো খেলোয়াড়, সেটি সম্ভবত কাউকে বলতে হয় না।
মেসির পিএসজিতে আসার গল্পও হয়েছে সাক্ষাৎকারে। পিএসজিতে যোগ দেওয়ার আগে স্পেনের ইবিজায় মেসির দেখা হয়েছিল পারেদেস, দি মারিয়া, ভেরাত্তিদের সঙ্গে। পারেদেসরা তখন মেসিকে পিএসজিতে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানালেও জবাবে মেসির বার্সেলোনার প্রতি আনুগত্যের কথা তো সংবাদমাধ্যমে এই মৌসুমে কয়েকবারই এসেছে। ইবিজা থেকে ফিরে বার্সায় নতুন চুক্তিতে সই করার কথাও পারেদেসদের জানিয়েছিলেন মেসি।
কিন্তু যেদিন বার্সায় তাঁর চুক্তি হওয়ার কথা ছিল, সেদিনও উল্টো বার্সা জানিয়ে দিল, স্প্যানিশ লিগের নিয়মের বেড়াজালের কারণে ক্লাবের সঙ্গীন আর্থিক অবস্থায় মেসির চুক্তি নবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। এরপরই মেসির পিএসজিতে যোগ দেওয়া। ব্যাপারটা এতটাই অবিশ্বাস্য ছিল যে, মেসি পিএসজিতে যাচ্ছেন শুনেও তাঁকে পারেদেস বলেছিলেন, ‘তুমি পিএসজির জার্সি গায়ে দেওয়ার আগ পর্যন্ত আমি বিশ্বাস করছি না!’
পিএসজিতে মেসির সময়টা অবশ্য ভালো কাটেনি। মৌসুমে লিগ ছাড়া আর কিছু জেতেনি পিএসজি, কিন্তু পিএসজির তো আর ফরাসি লিগ জেতার জন্য মেসিকে লাগে না! পিএসজি চেয়েছিল মেসিকে নিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিততে, কিন্তু রিয়াল মাদ্রিদের কাছে হেরে শেষ ষোলোতেই বাদ পড়েছেন মেসি-নেইমার-এমবাপ্পেরা। এরপর পিএসজির সমর্থকেরাই দুয়ো দিয়েছেন মেসি-নেইমারদের।
সেটি ভালো লাগেনি পারেদেসের, ‘বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে ওকে দুয়ো দিচ্ছে মানুষ! অনেক কিছুই থাকে যেগুলো সহ্য করা যায় না, এটা সেসবের চেয়েও বেশি অবিশ্বাস্য। কষ্টটা বেশি লাগছিল কারণ আমি জানি লিও (মেসি) কেমন, ও কী চেয়েছে, কী না করার চেষ্টা করেছে দলের জন্য আর সত্যটা কীভাবে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে সেসব দেখে।’
অপ্রিয় আরেকটা সত্যি নিয়েও কথা বলেছেন পারেদেস—আর্জেন্টিনার দুঃস্বপ্ন হয়ে থাকা ২০১৮ বিশ্বকাপে কোচ সাম্পাওলির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে। বিশ্বকাপের আগে প্রস্তুতি ম্যাচগুলোতে সুযোগ দিলেও শেষ পর্যন্ত রাশিয়ায় বিশ্বকাপে পারেদেসকে নেননি সাম্পাওলি। আর্জেন্টিনা দলে তখন সাম্পাওলির সঙ্গে আরও অনেক খেলোয়াড়ের বিভেদের গুঞ্জন ছড়িয়েছিল।
সাম্পাওলিকে নিয়ে ভালো স্মৃতি নেই পারেদেসেরও, ‘কোনো কোনো কোচ মনে ভালো স্মৃতি রেখে যান, কেউ খারাপ স্মৃতি। ভালো স্মৃতিগুলো সবাই জানতে পারে, খারাপগুলো আমি নিজের কাছেই রাখতে পছন্দ করি। তাঁকে নিয়ে বলার কিছু নেই।’