Thank you for trying Sticky AMP!!

১২ বছরে জার্মানির ১ কোচ, আর্জেন্টিনার ৮!

আর্জেন্টিনার কোচ হিসেবে সবচেয়ে দীর্ঘ মেয়াদে ১৯ বছর দায়িত্বে ছিলেন গুইলের্মো স্তাবিল। ছবি: আলকেট্রন
>২০০৬ বিশ্বকাপের পর থেকে ২০১৬ বিশ্বকাপ বাছাই পর্ব, এই ১০ বছরের মধ্যে আটজন কোচ বদল করেছে আর্জেন্টিনা। দলকে সাফল্য এনে দেওয়াই ছিল এই বদলের লক্ষ্য। যা বুমেরাং হয়ে ফিরে এসেছে। সাফল্যের দেখা পায়নি আর্জেন্টিনা, উল্টো বারবার কোচ বদলের প্রভাব পড়েছে দলের খেলায়। যার মূল্য চুকাতে হয়েছে রাশিয়া বিশ্বকাপের শেষ ষোলো থেকে বিদায় নিয়ে।

স্মৃতিশক্তি পরীক্ষামূলক একটা প্রশ্ন করা যাক, সর্বশেষ আর্জেন্টিনার কোন কোচ একটানা ৫ বছর দলের দায়িত্বে ছিলেন? প্রশ্নটা একটু ঘুরিয়ে করি, ২০০৪ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে আর্জেন্টিনার কোচের দায়িত্ব পালন করেছেন কজন?

প্রথম প্রশ্নের উত্তর মার্সেলো বিয়েলসা, ১৯৯৮ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন ভদ্রলোক। বিয়েলসা চলে যাওয়ার পর গত ১৪ বছরে ‘ভদ্রলোক’ থেকে শব্দটা পরিণত হয়েছে ‘ভদ্রলোকেরা’তে। ২০০৪ থেকে ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপ পর্যন্ত আর্জেন্টিনা কোচের দায়িত্ব হাতবদল হয়েছে ৮ জন ‘ভদ্রলোকের’ মাঝে। গত ৭ বছরে যা পাঁচবার! এর মধ্যে আবার আলেসান্দ্রো সাবেলাই সবচেয়ে বেশি দিন ছিলেন, সেটিও আড়াই বছরের মতো।

এই ঘন ঘন কোচ বদলের কারণ ছিল প্রত্যাশিত সাফল্য অর্জন। আর্জেন্টিনা সাফল্য-বুভুক্ষু দেশ। তাদের দেশের জনগণের কাছে বিশ্বকাপের ফাইনাল হারাও ব্যর্থতা বলেই বিবেচিত। সেই সাফল্য পাওয়ার জন্যই যে পদ্ধতি আর্জেন্টিনা ফুটবল ফেডারেশন গ্রহণ করেছে, সেটি যে কাজে লাগেনি, তা বলাই বাহুল্য।

গত এক যুগের মধ্যে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নিয়েছে দুবার, শেষ ষোলো থেকে বাদ পড়েছে একবার, ফাইনালে হেরেছে একবার, কোপা আমেরিকার ফাইনালে হেরেছে তিনবার, কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নিয়েছে একবার। অর্থাৎ সাতটি বড় টুর্নামেন্ট খেলে শিরোপা জিততে পারেনি একবারও। দায়টা কার? কোচের নাকি খেলোয়াড়দের? আসলে দায়টা বর্তায় আর্জেন্টিনা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের (এএফএ) ওপর। বারবার কোচ বদলের সিদ্ধান্তটা যে তাদের কাছ থেকেই আসে।

একটি দলের কোচ যখন বারবার বদল হয়, তখন সেই দলের বিশেষত্ব বলে কিছু থাকে না। একেকজন কোচ তার নিজস্ব দর্শন, খেলার পদ্ধতি নিয়ে আসেন, খেলোয়াড়দের বারবার সেই পদ্ধতির সঙ্গে মানিয়ে ‍নিয়ে খেলতে হয়, যা ভীষণ রকমের কঠিন কাজ। উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক বর্তমান কোচ হোর্হে সাম্পাওলি এবং গত বিশ্বকাপে দলের দায়িত্বে থাকা সাবেলার দর্শনকে।

সাম্পাওলি আক্রমণাত্মক ঘরানার কোচ, হাইপ্রেসিং ও আক্রমণই সাম্পাওলির কোচিং দর্শনের শেষ কথা। সেই অনুযায়ীই দলকে খেলানোর চেষ্টা করেছেন তিনি। সাবেলা ছিলেন পুরোপুরি উল্টো, নিজের ঘর সামলে তবেই পরের এলাকায় আক্রমণ করা ছিল সাবেলার পদ্ধতি। তাই সাবেলার সময় আর্জেন্টিনার রক্ষণভাগ ভূয়সী প্রশংসা পেলেও আক্রমণভাগে তেমন ধার ছিল না। বিশ্বকাপ ফাইনালে আর্জেন্টিনা উঠেছিল কেবল ৮ গোল করেই।

সাম্পাওলি ও সাবেলার দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে খুব বেশি অদলবদল হয়নি। লিওনেল মেসি, অ্যাঙ্গেল ডি মারিয়া, গঞ্জালো হিগুয়েইন, সার্জিও আগুয়েরো, হাভিয়ের মাচেরানো, মার্কোস রোহো, এনজো পেরেজরা ছিলেন দুই দলেই। এই খেলোয়াড়েরাই সাম্পাওলির দর্শন অনুযায়ী প্রতিপক্ষ দলকে হাইপ্রেস করবেন, আবার একই খেলোয়াড়েরা সাবেলার পদ্ধতি অনুযায়ী রক্ষণ সামলে আক্রমণে উঠবেন, এ রকম প্রত্যাশা করাটা বাড়াবাড়িই বটে।

গত ১২ বছরের কোচ বদলের চক্রে সর্বশেষ দায়িত্ব পেয়েছেন হোর্হে সাম্পাওলি, বরখাস্ত হওয়ার শঙ্কায় আছেন তিনিও। ছবি: রয়টার্স

আর্জেন্টিনা ফেডারেশনের অদ্ভুত নীতির এখানেই শেষ নয়। জোড়াতালি দিয়ে নাম না জানা ব্যক্তিদেরও কোচ বানিয়েছে তারা। গত ৭ বছরে আর্জেন্টিনার হয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন সার্জিও বাতিস্তা, এদগার্জো বাউজার মতো ব্যক্তিরা। কোচিং ক্যারিয়ারে যাঁদের কোনো নামডাক নেই। ফলও খুব দ্রুতই পেয়েছে এএফএ। দুজনই ৭ মাসের বেশি দায়িত্বে থাকতে পারেননি।

যেকোনো দলের সাফল্য পাওয়ার লক্ষ্য থাকলে সেই লক্ষ্য অনুযায়ী একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন। উদাহরণ হিসেবে জার্মানিকে আনা যায়। ২০০২ বিশ্বকাপের ফাইনাল হারের পর জার্মান ফেডারেশন ১২ বছরের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করে। পরিকল্পনাটি ছিল শক্তিশালী একটি ঘরোয়া লিগ কাঠামো তৈরি করা, যেখান থেকে জার্মান জাতীয় দলের জন্য এমন খেলোয়াড়েরা উঠে আসবেন, যাঁদের মধ্যে তারুণ্য ও অভিজ্ঞতার মিশেল থাকবে।

জার্মান ঘরোয়া লিগের শক্তিমত্তার প্রমাণ পাওয়া যায় ২০১০ থেকে ২০১৩-এর মধ্যে। জার্মানির সেরা ক্লাব বায়ার্নকে পেছনে ফেলে টানা দুবার ঘরোয়া লিগ জেতে বরুসিয়া ডর্টমুন্ড। বায়ার্ন ২০১০ থেকে ২০১৩-এর ভেতর চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল খেলে তিনবার। ২০১৩ সালে অল জার্মান চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে বরুসিয়া ডর্টমুন্ডকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় বায়ার্ন।

জার্মানির মূল লক্ষ্য ছিল ২০১৪ সালের বিশ্বকাপ জেতা। ২০০৬ বিশ্বকাপে নিজেদের দেশে তৃতীয় হয়েও তাই খুব একটা চিন্তিত হয়নি তারা। ২০১০ বিশ্বকাপেও তৃতীয় হয় জার্মানি। তবু তারা ধৈর্যশীল ছিল। ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ম্যানুয়েল নয়্যার, টনি ক্রুস, মেসুত ওজিল, টমাস মুলার, মারিও গোটশেদের মতো তরুণ তুর্কি ও বাস্তিয়ান শোয়েইনস্টেইগার, ফিলিপ লাম, মিরোস্লাভ ক্লোসাদের অভিজ্ঞতার সম্মিলিত রূপে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয় জার্মানি।

জোয়াকিম লো ১২ বছর ধরে জার্মানির কোচের দায়িত্ব পালন করছেন। সূত্র রয়টার্স

এই ১২ বছরের মধ্যে জার্মান দলের কোচ ছিলেন কজন জানেন? একজন। ২০০৬ বিশ্বকাপের পর ইয়ুর্গেন ক্লিন্সম্যান আর চুক্তির মেয়াদ বাড়াননি। এরপর সেই বছরই ক্লিন্সম্যানের জায়গায় আসেন কোচ হিসেবে আসেন জোয়াকিম লো। ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায়ের পরও ২০২২ কাতার বিশ্বকাপ পর্যন্ত লোর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে জার্মান ফুটবল ফেডারেশন।

চাইলে এমন ভূরি ভূরি উদাহরণই দেওয়া যাবে। ২০১০ বিশ্বকাপ ও ২০১২ ইউরো জয়ী স্পেন, ২০১১ কোপা আমেরিকা জয়ী উরুগুয়ে, ২০১৫, ২০১৬ কোপা আমেরিকা জয়ী চিলির সাফল্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনারই ফসল। ২০১৫ কোপা আমেরিকায় চিলিকে চ্যাম্পিয়ন করিয়েছিলেন বর্তমান আর্জেন্টিনা কোচ হোর্হে সাম্পাওলিই।

যত উদাহরণ দেওয়া হবে ততই আর্জেন্টিনার ফুটবল পদ্ধতির রুগ্‌ণ দশা বের হয়ে আসবে। গুঞ্জন রয়েছে, রাশিয়া বিশ্বকাপে ব্যর্থতার জেরে সাম্পাওলিকেও বরখাস্ত করা হতে পারে। কিন্তু তাতে যে ১৪ বছরের সেই পুরোনো নতুন কোচ-নতুন দর্শন-ব্যর্থতা-কোচ বরখাস্ত-নতুন কোচ ধারাটাই আবার চলে আসবে, সেটি বোঝার মতো ঘিলু কি আর্জেন্টিনা ফুটবল ফেডারেশনের কর্তাব্যক্তিদের আছে?