
‘তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব রে’—মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দীপ্ত করা গানটি একাত্তরেও গেয়েছেন। এখনো প্রতিদিন সংসার নামের উত্তাল সাগর পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করে চলেছেন নারায়ণগঞ্জের একটি কাগজকলের নিরাপত্তা তত্ত্বাবধায়ক আইনুল হক। কিন্তু তাঁর আসল পরিচয়—স্বাধীন বাংলা দলের ফুটবলার।
স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরও এই ফুটবল দলের অনেকেই জীবন-যুদ্ধে বিপর্যস্ত। তাঁদেরই একজন নাটোরের তসলিম উদ্দিন শেখ। স্বাধীনতা পূর্ব সময়ে খেলতেন ঢাকা ওয়ান্ডারার্সে। খেলা ছেড়েছেন ১৯৭৭ সালে। এরপর সংসার চালাতেন নাটোরে চিনি আর লালি গুড় বিক্রি করে। টাকার অভাবে সে ব্যবসাও এখন বন্ধ। এক ছেলে তারিকুদ্দিন চিনিকলের ট্রাক্টর ড্রাইভার, আরেক ছেলে আরিফুদ্দিন সমবায় অধিদপ্তরের কেরানি।
উন্নত চিকিৎসার অভাবে গত বছর অনাদর-অবহেলায় মারা গেছেন ফুটবলার সিরাজ উদ্দিন (সিরু)। অভাবে দিন কাটছে ফুটবলার সনজিত দে, শেখ আশরাফ আলী, আবদুল খালেকদের। অথচ মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত তৈরি করতে এবং তহবিল গড়তে বিশেষ ভূমিকা রাখে ওই সময়ের স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল।
দেশ স্বাধীন হয়েছে। বদলে গেছে অনেক কিছু। কিন্তু ভাগ্য বদল হয়নি এই ফুটবলারদের। আক্ষেপ করে আইনুল বলছিলেন, ‘সবই ভাগ্যের পরিহাস। সরকারের কাছ থেকে তিন হাজার টাকা ভাতা পাই। এর বাইরে চাকরি থেকে সামান্য যা টাকা পাই, তা দিয়ে সংসার চালানো বড়ই কষ্টের।’
৩৫ সদস্যের ফুটবল দলের অনেকেই এখন প্রবাসী। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের প্রধান উদ্যোক্তা সাইদুর রহমান প্যাটেল যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন দীর্ঘদিন। বছর দুয়েক হলো দেশে ফিরে এসে ব্যবসা করছেন। জীবিকার সন্ধানে অনেক বছর আগেই যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছেন আরেক ফুটবলার এনায়েতুর রহমান খান। নিউইয়র্কে স্থায়ী আবাস গড়েছেন শাহজাহান আলমও। টঙ্গীতে একটি ইস্পাত কারখানায় লজিস্টিক কর্মকর্তা হিসেবে আছেন আবাহনীর সাবেক ফুটবলার আশরাফ আলী।
চট্টগ্রামে অবসর জীবন যাপন করছেন প্রাণগোবিন্দ কুন্ডু ও বিমল কর। ফুটবলার হিসেবে রেলওয়েতে চাকরি পেয়েছিলেন বিমল, ১৯৭৭ সালে রেলওয়ের নিরাপত্তা কর্মকর্তা হিসেবে অবসরে যান। বর্তমানে যশোরে ঠিকাদারি করছেন লুৎফর রহমান। অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু ও প্রতাপশঙ্কর হাজরা মোহামেডান ক্লাবের সদস্য, অমলেশ সেন আবাহনীর কোচ। কাজী সালাউদ্দিন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের বর্তমান সভাপতি। বেঁচে নেই আলী ইমাম, মনিরুজ্জামান পেয়ারা, মাহমুদুর রশীদ ও দলের কোচ ননী বসাক। সবার আগে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন শেখ মনসুর আলী (লালু)। মুক্তিযুদ্ধ শেষে ঢাকায় ফিরে একাত্তরের ১৮ ডিসেম্বরই চলে গেছেন তিনি।
বাফুফে ভবনে ঢোকার মুখে শ্বেত ফলকে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা চোখে পড়ে। সেখানে বাদ পড়েছে ফুটবলার সাইদ হোসেনের নাম। মারা যাওয়ার আগে এটা নিয়ে তাঁর দুঃখ ছিল। সাইদুর রহমান প্যাটেল বলছিলেন সে কথাই, ‘এই দল নিয়ে অনেকে অনেক রাজনীতি করার চেষ্টা করছেন। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ফুটবলাররা এখন প্রাপ্য সম্মানটুকু পাচ্ছেন না। সাইদ ভাই ফলকে নিজের নাম না দেখে ভীষণ দুঃখ পেয়েছিলেন।’
তখনকার ছাত্রনেতা এবং পিডব্লুডির ফুটবলার হিসেবে প্যাটেল বাড়তি স্নেহ পেতেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীনের কাছে। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল গড়ার উদ্যোগটাও তাঁরই নেওয়া। প্রস্তাবটা শুনেই লুফে নেন তাজউদ্দীন, ১৩ জুন গড়া হয় স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। বাকিটুকু ইতিহাস।