কোটি টাকার ফুটবলারের দাম কেন ৪০ লাখ

দুই বছর আগেও ফুটবলের দলবদলে আগুন লেগে থাকত। শীর্ষ ফুটবলাররা পেতেন মোটা অঙ্কের পারিশ্রমিক। তাঁদের জন্য ক্লাবগুলোর মধ্যে চলত টানাটানিও। এখন বাজার নিস্তব্ধ। টাকার অঙ্ক বলতে লজ্জা পান ফুটবলাররাই।

পারিশ্রমিকের পতন: কোটি থেকে মাত্র ৪০ লাখ

সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে চ্যালেঞ্জ কাপ দিয়ে ঘরোয়া ফুটবলের নতুন মৌসুম শুরু হয়েছে। তার আগে হয়ে গেল ফুটবলারদের দলবদল। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোটি টাকার আশপাশ থেকে শীর্ষ ফুটবলারদের চুক্তি নেমে এসেছে ৪০–৫০ লাখ টাকায়।

যাঁরা এক বছরে ৫০–৬০ লাখে চুক্তি করতেন, তাঁরা এখন নামছেন ১৫–২০ লাখে। বেশির ভাগ ফুটবলারই বলার মতো কোনো চুক্তি পাননি। আগে যাঁদের বছরে ২০–২৫ লাখ টাকা মিলত, তাঁদের দাম নেমে এসেছে ৫–৭ লাখে। অর্থাৎ দলবদলের বাজারে নেমেছে বড় ধস।

মোহামেডানের কোচ আলফাজ আহমেদ

যা দেখে বিস্মিত জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ও মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের কোচ আলফাজ আহমেদ বলেন, ‘এ মৌসুমে ফুটবলারদের চুক্তির অবস্থা করুণ। গতবারও একই ছিল, তবে এবার আরও খারাপ হয়েছে। একজন ফুটবলার আগে এক বছরের জন্য ক্লাবের সঙ্গে ৫০ লাখ টাকায় চুক্তি করলে এখন তাঁর ভাগ্যে ১০ লাখও জুটছে না। আমার এত দীর্ঘ ফুটবল ক্যারিয়ারে এমন ধস কখনো দেখিনি।’

অথচ জাতীয় দলের খেলা দেখতে এখন মানুষের আগ্রহ বেড়েছে! হামজা, শমিত সোমরা আসার পর খেলার মানও বেড়েছে, স্টেডিয়াম দর্শক উপচে পড়ছে। কিন্তু প্রদীপের নিচের অন্ধকারের মতো ফুটবলারদের বাজারমূল্য অবিশ্বাস্যভাবে কমে গেছে।

বিকল্প পথ ‘খ্যাপ’

কেউ কেউ বলছেন, দেশের শীর্ষ লিগে খেলা ৮০ ভাগ ফুটবলারই খেলছেন ‘পেটেভাতে’। চুক্তির আওতায় থাকা অনেকে আবার ঠিকমতো টাকা পাচ্ছেন না। এই তালিকায় আছেন জাতীয় দলের ফুটবলাররাও। তাই তাঁরা সুযোগ পেলেই ঢাকার বাইরে ‘খ্যাপ’ খেলতে যান। কদিন আগেও জাতীয় দলের ৩-৪ জন ফুটবলার ঢাকার বাইরে খ্যাপ খেলে এসেছেন বলে শোনা গেছে।

বিভিন্ন জেলায় জেলা প্রশাসক গোল্ডকাপের মতো টুর্নামেন্টে অনেক শীর্ষস্তরের ফুটবলার খেলেন। সূত্র বলছে, খ্যাপ খেলে একজন ফুটবলার গড়ে ৩০-৩৫ হাজার টাকা পান। জাতীয় দলের ফুটবলাররা কেউ কেউ ৬০-৭০ হাজার টাকাও পান! ফলে খ্যাপ খেলায় ফুটবলারদের আগ্রহ বেড়েছে।

এলাকার রাজনৈতিক নেতাদের অনুরোধে খ্যাপ খেলতে হয় বলে জানিয়েছেন রহমত মিয়া

১৮ নভেম্বর ভারতের বিপক্ষে এশিয়ান কাপ বাছাইয়ের ম্যাচ, যার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে গত ৩১ অক্টোবর থেকে। বেশ আগেই জাতীয় দলের প্রস্তুতি শুরু করার কারণ হিসেবে টিম ম্যানেজমেন্টের এক সদস্য বলেছিলেন, ফুটবলারদের খ্যাপ খেলা ঠেকাতেই মাত্র ১৫ জন ফুটবলার নিয়ে প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। তাঁর এই কথাতেই বাস্তবতা লুকিয়ে আছে। ফুটবলাররা বলছেন, বেতন ঠিকমতো না হওয়ার কারণেই তাঁরা বিভিন্ন এলাকায় খ্যাপ খেলেন।

জাতীয় দলের ডিফেন্ডার রহমত মিয়াও ব্যাপারটা স্বীকার করেছেন। ৩১ অক্টোবর অনুশীলনের প্রথম দিনে তিনি বলেছিলেন, এলাকার রাজনৈতিক ব্যক্তিরা অনুরোধ করলে তাঁরা তা অগ্রাহ্য করতে পারেন না; খেলতে বাধ্য হন। যদিও পেশাদার ফুটবলার হিসেবে তাঁদের খ্যাপ খেলা নিষিদ্ধ।

তারিক কাজীর বসুন্ধরা কিংস ছাড়া কী বার্তা দিচ্ছে

যে বসুন্ধরা কিংস ফুটবলারদের পারিশ্রমিক প্রায় এক কোটি টাকার আশপাশে নিয়ে গিয়েছিল, তারাও নাকি এখন টাকার অঙ্ক কমিয়ে দিয়েছে! সূত্রমতে, অঙ্কটা এখন ৫০-৬০ লাখের মধ্যে।

এর মধ্যেই গত মাসে ক্লাব ছাড়েন নির্ভরযোগ্য সেন্টার ব্যাক তারিক কাজী। ছয় বছরের সম্পর্ক শেষ। তারিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, এক বছরের বেশি সময় ধরে ক্লাব থেকে নিয়মিত বেতন-ভাতা না পাওয়ায় এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ঘটনাটি দেশের ক্লাব ফুটবলের বাস্তবতা স্পষ্ট করে দেয়।

বসুন্ধরা কিংসের সঙ্গে ৬ বছরের সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন তারিক কাজী

কিংস এবার আবাহনীর গতবারের অধিনায়ক মোহাম্মদ হৃদয়, ফরোয়ার্ড শাহরিয়ার ইমন, রহমতগঞ্জের সেন্টার ব্যাক তাজ উদ্দিন ও ফরোয়ার্ড নাবিব নেওয়াজকে দলে নিয়েছে। কোচ আলফাজ আহমেদের মতে, হৃদয়, ইমন আর তাজ উদ্দিনই এবার কিছু অর্থ দাবি করে দলবদল করতে পেরেছেন। বাকিদের বেশির ভাগই যে যেখানে ছিলেন, সেখানেই থেকে যেতে বাধ্য হয়েছেন।

সূত্র জানাচ্ছে, হৃদয়ের চুক্তিটা ৬০-৬৫ লাখ টাকার। এ মৌসুমে তিনিই দেশের সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পাওয়া ফুটবলার বলে কিংসের এক সূত্রের দাবি।

কিংসের এক খেলোয়াড়কে চুক্তি নিয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘কত টাকা জানি না। ক্লাব বলেছে খেলতে, আমিও খেলছি। টাকার ব্যাপারটি তাঁরা দেখবেন বলেছেন।’

সম্প্রতি কিংস ছাড়া আরেক ফুটবলার নিজের অবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে, ‘আমি যতটুকু জানি, গত বছর ৫ আগস্টের পর থেকে কোনো ফুটবলার টাকা পায়নি। ক্লাবের নাকি সমস্যা। কারও ৭০ লাখ, কারও ৮০ লাখ, কারও ৬০ লাখ বাকি।’

তিনি আরও বলেন, ৫ আগস্টের আগে তাঁর সঙ্গে ৯০ লাখের ওপরের চুক্তি ছিল, তখন পর্যন্ত টাকার সমস্যা হয়নি। সমস্যা হয়েছে সরকার বদলের পর। এ ব্যাপারে কিংসের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে কিংসের একটি সূত্র জানিয়েছে, ক্লাব আর্থিক সংকটে আছে, সংকট কাটলে সব ফুটবলারের পাওনাই শোধ করা হবে।

তরুণ মোরছালিন কত পেলেন

দেশের তরুণ ও আলোচিত ফরোয়ার্ড শেখ মোরছালিন বসুন্ধরা কিংস ছেড়ে এবার ঢাকা আবাহনীতে যোগ দিয়েছেন। কিংসে তিনি বাইন্ডিংস (তরুণ বয়সে ক্লাবে আসা এবং আর্থিক চুক্তি ছাড়া থাকা) ফুটবলার ছিলেন। ফলে কিংস তাঁকে বিনা পারিশ্রমিকেই দলে রাখতে পেরেছিল। তবে গত মৌসুমে ক্লাব তাঁকে কিছু টাকা দিয়েছিল।

শেখ মোরছালিন বসুন্ধরা কিংস ছেড়ে আবাহনীতে যোগ দিয়েছেন

সেই অঙ্কটা কত? মোরছালিনকে জিজ্ঞেস করলে তিনি কিছুক্ষণ নীরব থাকেন। অঙ্কটা খোলাসা করেননি। তাঁর কথায় মনে হলো, টাকার অঙ্কটা তাঁর মানের ফুটবলারের জন্য বেশ বিব্রতকরই। শেষে এইটুকু বললেন, ‘গত মৌসুমে আমি কিংস থেকে যা পেয়েছি, তা দুই মাসেই শেষ।’ এক সূত্রের দাবি, তিনি মাসে এক লাখ টাকা করে পেয়েছিলেন।

এ বছর কত পেলেন? মোরছালিন বলেন, ‘এ মৌসুমে আবাহনীতে এসে যা পাচ্ছি, তা দিয়ে আমার সারা বছরের খরচ চলে যাবে। বুট-টুট সবই কিনতে পারব। কিন্তু হাতে এলে আর কিছু থাকবে না। তবে কিংস থেকে এখানে বেশি টাকা পাচ্ছি।’ জানা গেছে, আবাহনীর সঙ্গে তাঁর চুক্তিটা ২০ লাখ টাকার আশপাশে।

অন্যদিকে জাতীয় দলের স্ট্রাইকার আল-আমিন পুলিশ এফসি ছেড়ে আবাহনীতে এসেছেন ২০ লাখের কাছাকাছি একটা অঙ্কে। আর ব্রাদার্স থেকে মোহামেডানে আসা জাতীয় দলের ডিফেন্ডার রহমত মিয়া মোহামেডান থেকে ২০ লাখের মতো বা এর চেয়ে সামান্য বেশি পেয়েছেন। গত মৌসুমে এই রহমত ব্রাদার্স থেকে পেয়েছিলেন মাত্র ৮ লাখ টাকার মতো।

দেশে সরকার বদলের পর আবাহনী ‘না’ করায় রহমত কম পারিশ্রমিকে ব্রাদার্সে যেতে বাধ্য হন, যিনি একসময় আবাহনীর অধিনায়কও ছিলেন।

ফর্টিস এফসির ম্যানেজার রাশেদুল ইসলাম

প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব ফর্টিস এফসির ম্যানেজার ও সাবেক ফুটবলার রাশেদুল ইসলাম বলেন, ‘যেহেতু বাংলাদেশ ফুটবল লিগ দেশের ফুটবলের সর্বোচ্চ পর্যায়, তাই আমি মনে করি খেলোয়াড়দের আরেকটু ভালো অর্থ পাওয়া উচিত।’

পারিশ্রমিক কমার প্রধান কারণ

মূলত গত বছর ৫ আগস্ট দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুই ভাইয়ের নামে থাকা শেখ রাসেল ক্রীড়াচক্র ও শেখ জামাল ধানমণ্ডি ক্লাব ফুটবল থেকে সরে যায়।

এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে দলবদলের বাজারে। এই দুটি বড় ক্লাবের পৃষ্ঠপোষকেরা সরকার বদলের পর পিছিয়ে যান। ফলে অন্তত ৪০-৪৫ জন ফুটবলার খেলার সুযোগ হারান।

আলফাজ আহমেদ বলেন, ‘গত বছর শেখ জামাল ও শেখ রাসেলের মতো দুটি দলের ফুটবল থেকে সরে যাওয়া ছিল একটা ধাক্কা। এতে খেলোয়াড়েরা পড়ে যায় গ্যাঁড়াকলে। সেটারই ধারাবাহিকতা চলছে। এ কারণেই ফুটবলারদের বাজারদর পড়ে গেছে।’

দীর্ঘদিনের সংগঠক ও ব্রাদার্স ইউনিয়নের ম্যানেজার আমের খানের মতে, দেশে রাজনৈতিক পরিবর্তন, ক্লাবগুলোর নিজস্ব আয় না থাকা, স্পনসরদের সরে যাওয়া—এসবই ফুটবলারদের পারিশ্রমিকে ধস নামার অন্যতম কারণ। তাঁর মতে, এ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য ফুটবলে পৃষ্ঠপোষকদের এগিয়ে আসতে হবে।

ক্লাবের সংকটের ভার ফুটবলারদের কাঁধে

শেখ রাসেল ও শেখ জামাল ক্লাব দুটির সঙ্গে আগেভাগে চুক্তিবদ্ধ ফুটবলাররা গত বছর ৫ আগস্টের পর অথৈ সাগরে পড়ে যান। কেউ কেউ ফুটবল ছেড়ে দেন। কেউবা বাধ্য হয়ে মাত্র ৫-৬ লাখ টাকায় বা নামমাত্র পারিশ্রমিকে অন্য ক্লাবে খেলতে বাধ্য হন। বছরে ৫-৬ লাখ টাকা মানে মাসে ৫০ হাজার টাকা আয়। এই টাকায় একজন পেশাদার ফুটবলারের সংসার চলে না।

গত বছর ৫ আগস্ট দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আবাহনী প্রতিষ্ঠাতা শেখ কামালের প্রতিকৃতিতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়

প্রয়াত শেখ কামাল প্রতিষ্ঠিত আবাহনী ক্লাবও গত বছর সরকার বদলের পর বিভীষিকার মধ্যে পড়ে। ক্লাবে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট হয়। ক্লাবটির লিগে খেলাই অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।

আবাহনী ৫ আগস্টের আগে যেসব খেলোয়াড়ের সঙ্গে ৩০-৪০-৫০ লাখ টাকায় চুক্তি করেছিল, ৫ আগস্টের পর আর্থিক সংকটের কারণে তাদের বলা হয় অন্যত্র চলে যেতে। আর আবাহনীতে থেকে গেলে ৫-৭ লাখ টাকার বেশি দিতে পারবে না বলেও জানিয়ে দেয়। সেই ধাক্কা কাটিয়ে চলতি মৌসুমে আকাশি-নীলেরা গতবারের চেয়ে তুলনামূলক কিছুটা গুছিয়ে দল গড়েছে।

শুধু আবাহনী নয়, চট্টগ্রাম আবাহনীর মতো দলও সরকার বদলের পর সংকটে পড়ে। হাল ধরার লোক ছিল না। শেষে জাহিদ হাসান এমিলি, মামুনুল ইসলামসহ কয়েকজন সাবেক ফুটবলার মিলে কোনোমতে একটি দল গড়েন। কিন্তু খেলোয়াড়দের অনেককে এক-দুই লাখ টাকাও দিতে পারেনি ক্লাব। সেই চট্টগ্রাম আবাহনী এ মৌসুমে শীর্ষ ফুটবল থেকে অবনমিত হয়ে গেছে।

তার ওপর, ২০২২ সালে দেশের শীর্ষ ফুটবল থেকে বিদায় নেয় বাংলাদেশের প্রথম করপোরেট ক্লাব সাইফ স্পোর্টিং। ২০২২ থেকে ২০২৪—এই তিন বছরের মধ্যে চারটি বড় ক্লাবের ফুটবল থেকে হারিয়ে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে ফুটবলারদের দলবদলে।

পৃষ্ঠপোষকতার অভাব: ক্লাবগুলোর নিজস্ব আয় কই

অর্থনৈতিক মন্দায় ক্লাবগুলোর পৃষ্ঠপোষক কমে গেছে। আগে বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠী কয়েকটি ক্লাবকে পৃষ্ঠপোষকতা করত, টাকা ঢালত ক্লাব ফুটবলে। গত বছর সরকার বদলের পর তা অনেক কমে গেছে।

ক্লাবগুলোর নিজস্ব আয় না থাকার কুফলও আজকের অবস্থার জন্য অনেকটা দায়ী। এত বছরেও ক্লাবগুলো ফুটবল বিপণন করে নিজস্ব আয়ের পথ তৈরি করতে পারেনি। ফুটবল বিশ্লেষকেরা বলছেন, বছর বছর কিছু লোকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে কত আর দল গড়া যায়?

কে আয় করেন সবচেয়ে বেশি?

বাংলাদেশের ফুটবলারদের মধ্যে কার আয় সবচেয়ে বেশি, তা নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। কারণ, ক্লাব-খেলোয়াড় কেউই চুক্তির অঙ্ক প্রকাশ করে না। তবে বসুন্ধরা কিংসে খেলা কেউই যে দেশের সবচেয়ে বেশি আয় করা ফুটবলার, তা নিয়ে সংশয় নেই।

সম্প্রতি সার্ফ এক্সেলের শুভেচ্ছাদূত হয়েছেন জামাল ভূঁইয়া

কিংসের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘গত ৫ বছরে সবচেয়ে বেশি আয় করা বাংলাদেশি ফুটবলার জিকো, তপু, রাকিব। সব মিলিয়ে হিসাব করলে ওরাই সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক পেয়েছে। টাকার অঙ্কটা বছরে ৮০-৯০ লাখ টাকার ঘরে। কিংসে খেলা অন্য শীর্ষ খেলোয়াড়েরাও কাছাকাছি অঙ্কের টাকা পেয়েছেন।’

বাংলাদেশের ফুটবলারদের ক্লাবের সঙ্গে চুক্তির বাইরে আর আয় নেই বললেই চলে। বাড়তি আয় আসত পারত বিজ্ঞাপন বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকলে। কিন্তু ফুটবলারদের বাণিজ্যিক চাহিদা নেই। জাতীয় দলের অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়া কয়েকটি বিজ্ঞাপনে মডেল হয়েছেন, এই যা।

দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের অবস্থান

দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারতের কথা আলাদা। দেশটির ক্লাব–সংস্কৃতি অনেক শক্তিশালী, ফুটবলারদের পারিশ্রমিকও ভালো। কেউ কেউ ক্লাব থেকে বছরে ২-৩ কোটি টাকাও পান। এক কোটি টাকা পারিশ্রমিক পাওয়া ফুটবলার ভারতে ভূরি ভূরি আছে।

দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আয় ভারতীয়দের

ভারতের পর দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের ফুটবলারদের পারিশ্রমিক তুলনামূলকভাবে বেশি ছিল, এমনকি অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী মালদ্বীপের চেয়েও।

মালদ্বীপের ফুটবলাররা দুই-তিন বছর আগেও যখন শুনতেন, বাংলাদেশের ফুটবলাররা এক মৌসুমে ৭০-৮০ লাখ টাকা বা তারও বেশি পান, তখন তাঁদের চোখ কপালে উঠে যেত! মালদ্বীপের শীর্ষস্থানীয় ফুটবলাররা মাসে ১ হাজার থেকে দেড় হাজার ডলারে ক্লাবে খেলেন।

নেপাল-শ্রীলঙ্কার ফুটবলাররা পান নামমাত্র টাকা। ফর্টিস এফসি নেপাল জাতীয় দলের ফরোয়ার্ড অঞ্জন বিস্তাকে মাসে মাত্র ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ ডলার পারিশ্রমিকে আনতে চেয়েছিল, টাকার অঙ্কে যা প্রায় দেড় লাখের মতো।

চুক্তির সব টাকা কি হাতে আসে?

অনেক ক্লাব সময়মতো টাকা দেয় না। ছোট ক্লাবগুলোর ফুটবলাররা টাকা নিয়ে বেশি ভোগেন। তবে বড় ক্লাবের মধ্যে মোহামেডানও নিয়মিত ফুটবলারদের বেতন দিতে পারে না বলে অভিযোগ শোনা যায়।

কয়েক বছর আগেও ফুটবলারদের কাছ থেকে এমন অভিযোগ বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনে (বাফুফে) জমা পড়ত, কোনো একটি ক্লাব থেকে তারা চুক্তির ১৫ শতাংশ, ২০ শতাংশ বা তারও বেশি টাকা পাননি।

খোদ জাতীয় দলের অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়াও বাফুফের কাছে পুরো পারিশ্রমিক না পাওয়ার অভিযোগ করেন। সাইফ স্পোর্টিং ক্লাব তাঁর সঙ্গে চুক্তির পুরো টাকা দেয়নি বলে জানিয়েছিলেন তিনি। সাইফের সঙ্গে তাঁর চুক্তি ছিল এক মৌসুমে ৬০ লাখ টাকা, পরে তা কিছু বেড়েছিল।

অথচ পারিশ্রমিক বেড়েছিল ৫ গুণও

খেলোয়াড়দের জীবন কত দ্রুত পাল্টে যায়! এমন স্বপ্নের পরিস্থিতির সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল ২৭ বছর বয়সী ফুটবলার ইকবাল হোসেনের। ২০২৩ সালে তাঁর পারিশ্রমিক ৬ লাখ থেকে এক লাফে ৩০ লাখ টাকা হয়েছিল! সে বছর জুলাইয়ে শেষ হওয়া বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে চট্টগ্রাম আবাহনীর মিডফিল্ডার ছিলেন তিনি। সেখান থেকে শেখ রাসেলে যান ২৪ লাখ টাকা বাড়িয়ে! যদিও তাঁর লক্ষ্য ছিল ৪০ লাখ টাকা।

আরেকটি উদাহরণ: ২০১৮ সালে আরামবাগ ক্রীড়া সংঘের অধিনায়ক মাহবুবুর রহমান সুফিল পেতেন ৬ লাখ টাকা। সে সময়ে প্রিমিয়ারে নবাগত বসুন্ধরা কিংসে গিয়ে সেটা হয়ে যায় প্রায় ৬ গুণ! অর্থাৎ প্রায় ৩৫ লাখ টাকা পান বলে গুঞ্জন আছে। সেই সময়ের তুলনায় এখনকার অবস্থা তাই আরও বেশি হতাশাজনক।

ফুটবলাররা হতাশ

মতিন মিয়া, মাসুক মিয়া জনিরা এই সেদিনও জাতীয় দলে খেলেছেন। কিন্তু গত মৌসুমে তাঁরা দল পাননি, বা পেলেও এমন অঙ্কের প্রস্তাব পান, যা তাঁদের নিরাশ করেছে। ফলে তাঁদের গত মৌসুমে মাঠে দেখা যায়নি, এ বছরও খেলছেন না। শোনা যায়, তাঁরা এখন খ্যাপ খেলে বেড়ান।

রহমতগঞ্জের ডিফেন্ডার মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘বেশির ভাগ ফুটবলারই হতাশার মধ্যে আছে। অনেক ফুটবলার নিয়মিত টাকা পায় না। এই যুগে এক মৌসুম চুক্তিতে ৫-৭ লাখ টাকায় খেলা কঠিন একজন ফুটবলারের জন্য। সব মিলিয়ে দলবদলের বাজারে ধস নেমেছে। ক্ষোভ-দুঃখে অনেকে ফুটবল থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।’